#সুতোয় বাঁধা সংসার
writer::প্রিয়া
৩৭
অরু শব্দ করে হাসতে শুরু করলো।হাসির শব্দটা খুবই বাজে উপহাসের হাসি যাকে বলে।
অরুনার হাসি শুনে সকলের মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো।রুবি আবারও অরুর হাত ধরে বললো।
-আমি কোনো ছলনা করছি না।সত্যি বলছি আমাকে মাফ করে দাও।তোমার সংসার আমি ছেড়ে চলে যাবো।
-এই শেষ বয়সে এসে সংসার, কি হবে এমন সংসার দিয়ে বলতে পারো আপা।
১৭বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিলো, একটা কিশোরী মেয়ের মন কতোটা চঞ্চল থাকে জানো।আমার মন ও চঞ্চল ছিলো। বিয়ে স্বামী নিয়ে মেয়েদের কত স্বপ্ন আমার ও ছিলো।সব স্বপ্ন তো সেদিন ভেঙ্গে যায়, যেদিন সারারাত একা বাসর ঘরে বউ সেজে বসেছিলাম।
একদিন সাহস নিয়ে হাসানকে বললাম আমি কলেজে পড়বো।আমার কথা পাত্তা না দিয়ে উড়িয়ে দিলো।আরে আমার ও তো ইচ্ছে করতো অসুখের সময় হাসান আমার মাথার পাশে একটু বসুক।চুলে হাত বুলিয়ে দিক।
অসুখের সময় একা রাত কাটিয়েছি,চোখের জল কেউ দেখেনি।মাত্র ১৮বছর বয়সে যখন জানলাম মা হবো কত খুশি হয়েছিলাম।মূহুর্তে সেই খুশি হারিয়ে গেলো যখন হাসান, তোমাকে জড়িয়ে ধরে বললো।রুবি আমরা মা-বাবা হবো।
প্রেগন্যান্সির প্রতিটা মূহুর্ত একটা মায়ের জন্য কত যন্ত্রণার।রুমেল যখন পেটে লাথি মারতো দুনিয়া আঁধার লাগতো।তবুও খুশি হতাম আমার বাচ্চা পেটে খেলা করছে ভেবে।সেই সময় তো হাসান আমার হাত ধরে একবার বলেনি অরু কিচ্ছু হবে না তোমার।আমাদের ঘর আলো করে সন্তান আসবে আমরা মা-বাবা হবো।
তবুও ছেড়ে যাইনি কার কাছে যাবো।এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আমার চেনা একটা মেয়েকে স্বার্থ ছাড়া কেউ কাছে টানবে না।
রুমেল আমাকে মা বলে ডাকেনি মম বলতে শিখালেন আপা।উনাকে বড় মা। এক এক করে চারটা সন্তান জন্ম দিলাম।তবুও মা হলাম না আর না হাসানের স্ত্রী হলাম।তোরা স্কুলে গেলে আমি বাইরে তাকিয়ে থাকতাম।তোরা কখন ফিরবে খুব ইচ্ছে করতো আমি তোদের গোসল করিয়ে,খাইয়ে স্কুলে নিয়ে যাই।
একবার ভাই বলেছিলে ওই পরিবারে কেউ তোর না চলে আয়।আমি বললাম আমার ছেলেমেয়ে দিনশেষে ওরা আমার নাড়ি ছেড়া ধন।
এখানে থাকলে ওদের তো দেখতে পাবো।কোলে নিতে পারবো।চলে গেলে ওরা জানবে ওদের মা ওদের রেখে পালিয়ে গেছে।এমন অপবাদের বোঝা আমি সইতে পারবো না।
এই ৫২বছর বয়সে আমার আর সংসার লাগবে না।এখন সংসার দিয়ে কি হবে?
কারো প্রতি অভিমান নেই,সব আমার কপাল।
অরু কথাগুলো বলে রুমে চলে গেলো,মন কিছু হালকা লাগছে জমানো কষ্ট বলতে পেরে।
হাসান মাথা নিচু করে কপালে হাত রেখে বসে আছে।রুবি রুমে গিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।ছেলেরা যার যার রুমে।
প্রিয়ন্তি এসে বসলো শিমুলের পাশে।
-শিমুল আমি মমের জায়গায় থাকলে কি করতাম।আমি তো এতোকিছু সহ্য করতে পারতাম না।
-মমের মর্যাদা আমরা কোনদিন ভাবিনি প্রিয়ন্তি।আজ মম যদি মনের কষ্ট খুলে না বলতেন কখনো জানতেই পারতাম না।
রুমেল কান্না করছে জন্মদাত্রী মাকে কোনোদিন জড়িয়ে ধরা হয়নি।কণিকা ওর কাঁধে হাত রাখলো
-মমের জন্য খারাপ লাগছে যাও একবার কথা বলো।আমাদের বুঝা উচিত ছিলো অনেক আগে।বড্ড দেরিতে বুঝলাম আমরা।রুমেল এসে দেখলো অরুর রুমের দরজা বন্ধ।তাই ডাকলো না
হিমেল সেই কখন থেকে শুইয়ে আছে চোখ বন্ধ করে।আজ যদি স্বপ্না আন্টি চোখে আঙ্গুল দিয়ে সত্যটা না দেখাতেন। কখনোই বুঝতে পারতাম না মা কত ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।
রাত প্রায় দুটো বাজে অরু ডায়েরি লিখছে মূলত এটি চিঠি।
আজকের পর থেকে কেউ আমাকে খোঁজো না।আমি যেখানে যাচ্ছি আর ফিরবো না।জানি আমার কথাগুলো শুনে আমার সন্তানেরা অনুতপ্ত হবে।আসবে আমার কাছে ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে।
মায়ের অভিযোগ থাকে না সন্তানের প্রতি আমার ও নেই।আত্মসম্মান অনেক আগেই বিসর্জন দিয়েছিলাম।তবুও যেটুকে আছে সেটুকু নিয়ে চলে যাচ্ছি।
হিমেল একটা অনুরোধ তুই তরীকে বিয়ে করিস না।মেয়েটা বড্ড ভালো ওকে আর বিরক্ত করিস না।
আর আমার সন্তানদের কাছে অনুরোধ তোদের বাবা কিংবা বড় মাকে অসম্মান করিস না কখনো।হাসান তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারো নি আমি কিন্তু ভালোবেসেছিলাম।যাক এসব কথা। সবাই খুব ভালো থেকো।
জঞ্জাল মুক্ত তোমাদের পরিবার এবার।
চুপিচুপি গেইট দিয়ে বেড়িয়ে গেলো অরু।একটা পরিচিত গাড়ি এসে ওকে নিয়ে গেলো।
**সকাল হতেই রুমেল আসলো মায়ের রুমে।রুমে কেউ নেই দেখে ওয়াসরুমের দিকে তাকালো দরজা খোলা।
কাজের মেয়ে বকবক করছে।এতো সকাল বাসার মেইন দরজা খুলে কেডা বাইরে গেলো।
রুমেল ভাবলো মা হয়তো হাঁটতে গেছে।তখনি খেয়াল হলো ডায়েরির দিকে।
চিঠি পড়ে সবাইকে ডাকলো রুমেল।ঘুম ঘুম চোখে সবাই উঠে আসলো।এক এক করে সবাই পড়ে একজন অন্যজনের দিকে তাকালো।
হাসান অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়ালো।রুবি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি চলে গেলো।ওর মনে সত্যিই অনুশোচনার জন্ম হয়েছিলো।আজ নিজেকে অপরাধী ভাবছে।
হিমেল কান্না করছে তিনভাই একত্রে কান্না করছে।একবার মা ডাকার সুযোগ দিলে না আমাদের।এতো অভিমান।
**স্বপ্না এসে মায়ের পাশে বসলো আজ তিনি ঠিকমতো তাকাচ্ছেন না।অল্প চোখ খুলে আবার বন্ধ করছেন।কিছু বলা কিংবা বুঝার অবস্থায় নেই।
স্বপ্না কুরআন তেলাওয়াত করছে পাশে বসে।তরী নামাজ পড়ছে রিদ্ধ দোকান বন্ধ করে এসে দাদুর কাছে বসে আছে।কিছুক্ষণ পর পর উনি জোরে শ্বাস নিচ্ছেন।স্বপ্না ওর ননদদের ফোন করলো।
একবার মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে এসেছিলো ওরা।আজ অবস্থা প্রচুর খারাপ ওদের না জানালে হবে না।ফোন পেয়ে ওরা তড়িঘড়ি ছুটে আসলো দুপুরের মধ্যেই।
দুই মেয়ে মায়ের মাথার কাছে বসে আছে।তাদের পাশে সালমান বসে।চেয়ারে বসে আছে ওদের স্বামীরা।
স্বপ্না সবার জন্য রান্না করলো সালমান মায়ের রুমে তাই ও যেতে পারছেনা।টেবিলে খাবার দিয়ে সবাইকে ডাকলো।
সবাই খেতে বসলে স্বপ্না গিয়ে মায়ের হাত জড়িয়ে বসে আছে।কপাল ঘেমে জল ঝরছে উনার বেশ কষ্ট হচ্ছে চিৎকার করে স্বপ্না সবাইকে ডাকলো।খাবার রেখে সবাই উঠে গেলো।
স্বপ্নার শাশুড়ী সেই সময়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করলেন।মায়ের বুকের উপর পরে কান্না করছে স্বপ্না।ওকে থামানো যাচ্ছেনা সবাই কাঁদছে।
রিদ্ধের অবস্থা আরো খারাপ এতো শক্ত মনের ছেলে পাগলামি করে যাচ্ছে।
সাদা কাফনে জড়ানো মাকে দেখে স্বপ্না পাথর হয়ে আছে।অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়। স্বপ্নার সেই অবস্থা।
লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় তরী পিছনে দৌঁড় দেয়।ওর ফুফুরা ওকে ধরে ফেলেন।স্বপ্নার বাবার বাড়ির সবাই এসেছেন।স্বপ্নার অবস্থা খুব খারাপ তমাল ডাক্তার নিয়ে আসে।স্বপ্না, তরী দুজনকে সামলানো দ্বায়।
সন্ধ্যার পর পুরো বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা। স্যালাইন চলছে স্বপ্নার,তরীকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়ছে।
সালমান বোনদের সাথে বসে আছে।রিদ্ধ মায়ের পাশে বসে আছে।
পরেরদিনের অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক তবে স্বপ্না এখনো ঘোরের মধ্যেই আছে।মায়ের রুমে গিয়ে কাপড় জড়িয়ে বসে আছে।স্বপ্নার মা অনেক চেষ্টায় মেয়েকে আর তরীকে কিছু খাওয়ালেন।ওর ফুফুরা সেই সময় একবার ও ওদের কাছে যায়নি।
চারদিন শোকের পর যে যার মতো চলে যাবে। কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে।
সালমানের বড় বোন সুমিতা এসে বললো
-স্বপ্না চাবিটা দাও মায়ের আলমারির।
রিদ্ধ -কেনো ফুফি দাদুর আলমারিতে কি আছে?
-দেখ বাবা, মা -বাবা তোদের সবই দিয়ে গেছেন।মায়ের কিছু গহনা ছিলো ওগুলো আমরা নিবো।
-বড় আপা মায়ের গহনা তো নেই।তিনি খুব বেশি অসুস্থ হলে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে আমার আর মায়ের গহনা সব বিক্রি করে দেই।
-দেখলি বোন এই স্বপ্নার চালাকি সব ও ভালো করেই জানে মায়ের গহনার প্রতি হক আমাদের।তাই আগেভাগে সব বিক্রি করে টাকা একাউন্টে জমা করছে।
-বড় ফুফু না জেনে কথা বলো না।আমার মা এতো লোভী না।আমাদের আছে কি? এই বাসা ভাড়া কত পাই আমরা।দোকান থেকে কি এমন রোজগার হয়।আমাদের লেখাপড়া আর খরচাপাতি করেই সব শেষ হয়ে যায়।দাদুর হাসপাতালে অনেক বিল আসে তাই মা শুধু দাদুর গহনা না মায়ের গহনা গুলো ও বিক্রি করেছেন
বিশ্বাস না হলে যাও গিয়ে তোমাদের ভাইকে জিজ্ঞাসা করো।
দু বোন বকবক করতে করতে বেড়িয়ে গেলো।রিদ্ধ মাকে জড়িয়ে ধরে বলে।
-আচ্ছা মা আমাদের দাদা-দাদুর মতো ভালো মানুষদের ঘরে এমন স্বার্থপর অমানুষগুলোর জন্ম হলো কি করে?
**মাস কেটে গেলো তমাল আর ওর স্ত্রী এসেছে।
-আপা একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।
-বল?
-আমাদের কানাডা যাওয়ার কাজ চলছে।বলছি তরীকে আমাদের সাথে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করি।ওইখান থেকে গ্রাজুয়েট কমপ্লিট করবে।
-কিন্তু তরী আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না।তাছাড়া মেয়েটা অসুস্থ।
-তমাল আমাকে বলেছে তরীর অসুখের কথা।আমরা ওকে ভালো ডাক্তার দেখাবো।
-কিন্তু তোরা যাচ্ছিস ওকে নিবি কেনো।
-আমার মেয়ে ও যাচ্ছে।দু বোন একসাথে থাকবে।
স্বপ্না, তরী আর রিদ্ধের সাথে বুঝাপড়া করে ওদের জানাবে বলে দিলো।
চলবে