সুগন্ধি ফুল২ (পর্ব ৯)

0
4

#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_৯
#জান্নাত_সুলতানা

-“কে এসছে তখন?”

ফিজা জিজ্ঞেস করলো। আবরাজ টাওয়াল দিয়ে তখন বউয়ের চুল শুকিয়ে দিচ্ছে। সে কাজ করতে করতে জবাব দিলো,

-“আব্রাহাম।”

-“আল্লাহ! দেখি ছাড়ুন। ব্রেকফাস্ট বানাতে হবে তো ওনার জন্য।”

ফিজা তড়িঘড়ি করে বলে। আবরাজ ওকে এক হাতে টেনে ধরলো। কোলে বসিয়ে দিয়ে জানালো,

-“মেইড আছে। আর কখনো যেনো কিচেনে যেতে না দেখি।”

ফিজা ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো সেখানেই। আবরাজ ওর চুল মুছে দিয়ে নিজে ক্লোজেট থেকে নিজের ড্রেস নিয়ে এলো। রেডি হয়ে গায়ে পারফিউম দিচ্ছে তখনই ফোন বেজে উঠলো। ফিজা উঁকি দিলো। তেমন কিছু বুঝতে পারলো না। কে কল দিয়েছে। শুধুই নাম্বার টা শো করছে। আবরাজ তৎক্ষনাৎ এসে ফোন টা ছু মেরে হাতে তুলে নিলো। কল রিসিভ করে কানে তুলে নিলো। কাঁধে ফোন টা চেপে ধরে বাঁ হাতে ঘড়ি পরতে পরতে ফিজা কে ইশারায় বাই বলে একটা ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

——-

আব্রাহাম ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। গায়ে কম্ফর্টার জড়িয়ে নিজের ফোন টা বেড সাইড টেবিল থেকে হাতে তুলে নেয়। গতকাল জুনায়েদ কবির তার টেলিগ্রামে একটা ছবি পাঠিয়েছে। তখন সে ব্ল্যাক ফরেস্ট পাহাড়ের উঁচুতে নেটওয়ার্কের খুঁজে। যখন নেটওয়ার্ক পেলো তখন নোটিফিকেশন চেক করে ছবি টা পেয়ে দেহের মধ্যে বুকের বাঁ পাশে থাকা হৃদপিণ্ডটা টা লাফিয়ে উঠে ছিলো। মেয়ে টা বাঙালি হবে। ব্যাক সাইড থেকে তোলা ছবি টা। চেহারা টা যদি স্পষ্ট। টানটান ভ্রু আর মায়াবী তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া চমৎকার। চিকন পাতলা ঠোঁট জোড়া যখন কথা বলার সময় তাদের বিচ্ছেদ ঘটায় তখন নিশ্চয়ই এই রমণী কোনো এক পুরুষ কে ঘায়েল করার ক্ষমতা রাখে। আব্রাহামের ছটফট মনে এই রমণী খুঁজে পাওয়ার তীব্র এক বাসনা জন্ম নিয়েছে। সে ছবি টা জুম করে করে দেখছে। লম্বা চুল গুলো যেনো তাকে লোভ দেখাচ্ছে। একটু ছুঁয়ে দেখার লোভ।
জুনায়েদ কবির ছবি টা দিয়ে বলেছে মেয়ে টা তার ফ্রেন্ড। আব্রাহাম বিপরীতে কিছুই ফিডব্যাক দেয় নি তাকে। কেননা জুনায়েদ কবির তাদের ফ্রেন্ড কম শত্রু বেশি। কখন কী প্যাচ লাগাবে কে জানে। আব্রাহাম নিজে থেকে ইনভেস্টিগেশন এর জন্য ছবি টা বাংলাদেশ আবরাজের এসিস্ট্যান্ট সাব্বির কে ফরোয়ার্ড করে দিয়ে মেয়ে টার ডিটেইল দেওয়ার জন্য বার্তা পাঠিয়ে ফোন টা অফ করে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। ঘুম থেকে ওঠে নিশ্চয়ই একটা ভালো খবর পাবে সে সেই আশায়। আদৌও কতটুকু ভালো খবর হতে চলেছে সেই বার্তার জবাবে? কে জানে, কে বলতে পারে!

—–

একটা ক্লাবে ঢুকেছে আবরাজ সাথে আছে জন। এবং বাইরে আছে তার গার্ড। লন্ডনের এক অভিজাত ক্লাব এটি। ভিতরে ঢুকলেই নরম আলো। হালকা জ্যাজ মিউজিক। আর চকচকে কাঠের বার কাউন্টার চোখে পড়ে। দেয়ালে দামী আর্টওয়ার্ক। এক কোণে হচ্ছে পোল ডান্স। এসব দেখে আবরাজের চোখে-মুখে যে বিরক্ত প্রকাশ পাচ্ছে তা আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। সে সোজা সিঁড়ি বেয়ে লোহার রেলিঙ ধরে ওপরে দোতলায় ওঠে আসে। সেখানে চামড়ার সোফায় বসে অতিথিরা হুইস্কি বা ওয়াইন উপভোগ করছে। লাল-সোনালি ইন্টেরিয়র। নিঃশব্দে চলা বাটলারদের সার্ভিস সব মিলিয়ে এক নিঃসঙ্গ, বিলাসী, আর গোপন গ্ল্যামারের অনুভব তৈরি করে। তবে আবরাজের নজর শুধু একজন মধ্যবয়স্ক আধপাকা চুল দাড়িওয়ালা লোকটার দিকেই যায়। যার কোলে বসে আছে অর্ধনগ্ন একটি মেয়ে। ধপধপে ফরসা এই মেয়ে টার চেহারা চেহারা-ছুরত দেখে বলা যায় রমণী রাশিয়ান। আবরাজ কে দেখে মিস্টার জি মেয়ে টাকে নিজের কোল থেকে নামিয়ে দিলো। এবং আবরাজ সিঙ্গেল একটা সোফায় বসার জন্য ইশারা করলো। আবরাজ বসার পরপরই মিস্টার জি নিজেই একটা ড্রিংক নিলো। সেটা আবরাজের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আবরাজ নিলো। তবে তা মুখে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না বোধহয় পুরুষ। সে সেটা কাঁচের টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে বললো,

-“আপনার সব চামচা আমি এবং আমার সকল কিছু থেকে দূরে রাখুন।”

অন্য একটি সোফায় বসে ছিলো জুনায়েদ। সে প্রচুর ড্রিংকস করে ফেলেছে। মাতাল হলে-ও তালে ঠিক আছে সে। আবরাজ যে তাকে ইঙ্গিত করেই কথা টা বলেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় নি তার। তাই তো গর্জন করে উঠলো,

-“আবরাজ!”

-“হেই, জাস্ট শাট আপ। তোমার সাথে কথা বলার মতো রুচি আমার নেই অন্তত।”

জুনায়েদ সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলো। মিস্টার জি পরিস্থিতি বেগতিক দেখে একটা মেয়ে কে ইশারা করে। পরপরই একজন বডিকন পরা হোস্টেস এসে জুনায়েদ কবির কে সেখান থেকে নিয়ে গেলো। আবরাজ চোখ সরিয়ে নেয়। তখন সিঁড়ি দিয়ে কেউ ঠকঠক করে ওঠে আসে। গানের তালে তালে তা হারিয়ে গিয়েও খুব নিকটে লাগে। আবরাজ ঘাড় বাঁকিয়ে সেদিকে দৃষ্টিপাত করলো। তবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই গায়ে এসে ঝাপিয়ে পড়লো কেউ। আবরাজ চরম বিরক্ত হয়ে খুব জোরে ধাক্কা দিলো সেই মানুষটাকে। মিস্টার জি তৎক্ষনাৎ রেগে যান। চিৎকার করে উঠেন,

-“আবরাজ!”

-“আওয়াজ নিচে। আর একবার যদি আমাকে এখান থেকে কল করা হয় তাহলে জানে মেরে ফেলবো সব-কয়টা কে। আমার যা কাজ আমি তাই করবো। এর বাইরে কিচ্ছু নয়। নাথিং।”

আবরাজ ওঠে দাঁড়ালো। নিজের ব্লেজার ঠিক করে চলে যেতে নিয়েও পেছন ফেরে তাকায়। একজন বাবা এবং একজন মেয়ের ক্রোধিত চোখের সাক্ষাৎ পায় সে। আবরাজ আবারও কঠিন স্বরে হুঁশিয়ারী দেয়,

-“আই সয়্যার এর বাইরে কিছু বাড়াবাড়ি করলে খুব ভয়ংকর হবে এর পরিণাম।”

-“বউয়ের জন্য করছো সব? ওই মেয়ে টার জন্য। যদি সব জেনে যায়? ভালো হবে তোমার?”

সে কী করে? খারাপ লোকের সঙ্গ দেয়? অবশ্যই এরজন্য সে সমান দোষী হবে। কিন্তু সে তার দোষ স্বীকার করতে রাজি। তবুও ফিজা নামের রমণী কে সঙ্গে নিয়ে। এবং সেটা মৃত্যু হলে তাই সই। সে সাহস পায়। দম নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দেয়,

-“আমার খারাপ হওয়ার আগে আপনার হবে। জীবন ভর আফসোস করবেন। তবুও আপনি চাইলে তাকে জানাতে পারেন।”

আবরাজ জন কে নিয়ে বেরিয়ে আসে। মিস্টার জি সেখানে দাঁড়িয়ে কটমট করতে থাকে। তৃণা টলমল রাগী চোখে নিজের বাবা-র দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো,

-“তোমার এ-সব কাজ আমার লাইফ টা বরবাদ করে দিয়েছে পাপ্পা।”

-“মনে রেখো এ-সব করেছি বলেই তোমাকে এমন সুন্দর একটা জীবন দিতে পেরেছি। তুমি আমার সব, ভুলে যেয়ো না সেটা।”

একমাত্র মেয়ে তৃণা। স্ত্রী বহু আগে তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। মেয়ের ভালো এবং ভালো থাকার লোভে তিনি কখন যে নিজে খারাপের পথে হেঁটে সেটার শেষপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে বুঝতেই পারে নি। এখন যে ফিরে আসার পথ সব বন্ধ। তৃণা নিজের বাবার পরিস্থিতি বুঝে কিন্তু মেনে নিতে যত আপত্তি মেয়ে টার।

-“কিন্তু পাপ্পা আবরাজ খান কে আমার চাই।”

-“আমি ট্রাই করছি তো, মাই চাইল্ড।”

মিস্টার জি মেয়ে কে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দেন। তৃণা আশ্বস্ত হতে পারে না। কেননা তাদের ধর্ম ভিন্ন একথা সত্যি। এটা কখনো সম্ভব হবে? কে জানে। জেদ হয়তো পরিস্থিতি বদলাতে পারে তবে কপালের লিখা নয়।

——-

আব্রাহাম সারাদিন রুম থেকে বের হয় নি। মেইড রুমেই খাবার দিয়েছে। ফিজা দেখা করতে যায় নি। বাড়িতে আবরাজ থাকলে কথা ছিলো। যেহেতু আবরাজ নেই আর আব্রাহাম ও রুম থেকে বের হয় নি তাই ফিজা আর আগবাড়িয়ে কথা বলতে যায় নি। আসুক আবরাজ। দেখা করবে তখন।
রাতের জন্য সে আবরাজের জন্য কিছু একটা রান্না করছে। আব্রাহাম মাত্রই রুম থেকে বেরিয়েছে। সে হাঁক ছেড়ে ডাকছে মেড কে। মেড দৌড়ে যায়। ফিজা ও রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ফিজা লিভিং রুমে উপস্থিত সাথে সাথে চমকে উঠলো আব্রাহাম। এই মেয়ে টা এখানে? সে কী স্বপ্ন দেখছে? এটা কিভাবে পসিবল? আব্রাহাম নিজের মনে অংক মিলাতে ব্যাস্ত আবরাজ তখন সেখানে উপস্থিত হলো। ফিজা কে এক সাইড থেকে জড়িয়ে ধরে আব্রাহাম কে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“শী ইজ মাই ওয়াইফ। ফিজা সিদ্দিকী পুষ্প।”

ফিজা মৃদু হাসে। আব্রাহাম অবাক হয়েছে। বুকে ব্যাথা করছে। উপরে আসমান ঘুরছে আর নিচে জমিন টা যেনো কাঁপছে। জীবনে প্রথম সে কোনো মেয়ের জন্য কিছু ফিল করে ছিলো। আর সেটাও কি-না নিজের অজান্তেই নিজের বড়ো ভাই এর বউয়ের জন্য! ছিঃ, এরকম ঘৃণিত একটা কাজ তার দ্বারা হয়ে গিয়েছে। ভেবেই সে নিজের ওপর রাগ হলো। তবে রাগের ফলাফল খুব ভয়াবহ হবে সেটা জুনায়েদ কবির নিশ্চয়ই খুব শীগগির টের পাবে। আব্রাহাম নিজে কে যথা সম্ভব ঠিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো। এরমধ্যে আবরাজ ফিজার শরীর অতিমাত্রায় উত্তপ্ত। তাই তো বউ নিয়ে সে দ্রুত রুমের দিকে চলে গেলো। আব্রাহাম নিজেও রুমে ফিরে আসে। হাতের কাছে থাকা সব কিছু তচনচ করে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কী হবে এতে! রাগে শরীর টা কাঁপছে। সে ফিসফিস করে আওড়াল,

-“খুব খারাপ করেছো জুনায়েদ কবির। এরজন্য তোমার শাস্তি পাওনা রইলো।”

——-

আবরাজ ফিজা কে রুমে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

-“জ্বর কখন থেকে? জানাও নি কেনো?”

-“কোথায় জ্বর? জ্বর নেই তো। শরীর টা ব্যাথা করছে শুধু।”

ফিজা বসা থেকে জোর করে উঠতে চায়। আবরাজ বুঝতে পারে জ্বরের জন্য ওর শরীর ওর কন্ট্রোলে নেই। সে জোর করে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। ফিজা জোরাজুরি করে আবার উঠতে চায়। আবরাজ সেই সুযোগ দেয় না। নিজেও বউয়ের পাশে শুয়ে পড়ে। এতোটাই জ্বর ওর গায়ে যে চোখ দুটো দিয়ে জল আপনা-আপনি গড়িয়ে পড়ছে। আবরাজ ওর চোখের জলে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে শুষে নেয়। জড়িয়ে ধরে ধীরে কণ্ঠে আওড়ায়,

-“আইএম সো সরি সুইটহার্ট।

ফিজা জ্বরের ঘোরে আবরাজের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বললো,

-“আপনি কেনো সরি?”

আবরাজ অবাক হয়। ও কী সত্যি বুঝতে পারছে না সে সরি কেনো বলছে আর জ্বর কেনো হয়েছে? না-কি জ্বরের ঘোরে সব ভুলে গেলো। আবরাজ বাঁকা হাসলো। ফিজার কানের কাছে মুখ টা এগিয়ে নিয়ে হাস্কি আওয়াজে বললো,

-“সরি কেনো বলছি, এর কারণ কী আমি তোমাকে আবারও মনে করিয়ে দেবো, সুইটহার্ট!”

#চলবে……

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here