সুগন্ধি ফুল২ (পর্ব ৪ -৫)

0
2

#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_৪
#জান্নাত_সুলতানা

ঘুমের মধ্যে ফিজা অনুভব করতে পারছে তার উদর জুড়ে একটা শীতল স্পর্শ। যা খুব সুক্ষ্ম কিন্তু গভীর ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার শরীর। মধ্যরাতে ঘুম চোখে ধরা দিয়ে ছিলো। তাই একটু সময় লাগলো সম্পূর্ণ বিষয় টা বুঝে উঠতে। পিটপিট করে লাল লাল চোখে যখন সামনে চাইলো তখন কোনো কিছুই নজরে এলো না। পাশ ফিরে বিছানা থেকে দূরে আবরাজ কে সোফায় বসে ল্যাপটপ কোলে কিছু করতে দেখা গেলো। ফিজা চিন্তায় পরলো। সে যে কিছু সময় পূর্বে অনুভব করলে তবে কী তা ভ্রম মাত্র নিজের?

-“হোয়াট হ্যাপেন জান? এমন লাগছে কেনো তোমায়? ঘুম ভালো হয় নি, সুগন্ধি ফুল?”

ফিজা সাথে সাথে জবাব দিতে পারলো না। আবরাজ উত্তরের অপেক্ষা করলো ও না। সে নিজের কাজ ফেলে দ্রুত পায়ে বউয়ের কাছে এলো। ফিজা নিজের শাড়ী ঠিক করে বিছানায় পা ভাজ করে বসলো। বললো,

-“আপনি একটু আগে এখানে ছিলেন?”

-“আমি তো এখানেই।”

-“মজা করবেন না। আমার মনে হলো কেউ আমার গ,,,”

বলতে বলতে থেমে গেলো ফিজা। আবরাজ সাথে সাথে ওর গলা টা চেপে ধরে নিজেও ঝুঁকে গেলো ফিজার দিকে। পরপরই আবরাজ বললো,

-“বলো বলো। স্পিক আপ।”

ফিজার গলা দিয়ে আর শব্দ বের হয় না। কিভাবে হবে? একটা মানুষ এভাবে গলা মুখ গুঁজে রাখলে এটা আদৌও পসিবল? ফিজা তবুও বললো,

-“আবরাজ ছাড়ুন প্লিজ। আমার অস্থির লাগছে।”

-“তোমার অস্থির লাগছে না। আমি জানি তোমার ভালো লাগে।”

হাস্কি আওয়াজ পুরুষ টার। ফিজা সত্যি বুঝতে পারে না তার কী অস্থির লাগে না-কি ভালো লাগে। তবে কিছু তো একটা হয় যা তার কথা বলার শক্তি হারিয়ে যায়। ফিজার ভাগ্য সহায় ছিলো বিধায় হয়তো শাশুড়ির ডাক এলো তখন। আবরাজ মেড কে জিজ্ঞেস করলো বিশেষ কোনো কারণ। তখন মেড জানালো ব্রেকফাস্ট এর জন্য ডাকছে। আবরাজ একথা শোনামাত্র বউ কে ছাড়লো। সরে এসে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

-“যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।”

ফিজা ধীরে উঠে দাঁড়ালো। ওয়াশ রুমে যেতে যেতে পুরো রুম পর্যবেক্ষণ করে নিলো। একপাশে বিশাল জানালা, সিল্কের হালকা ক্রিম কালারের পর্দায় ঢাকা। মাঝখানে আছে একটা কিং সাইজের মাস্টার বেড। বিছানায় হালকা গ্রে শেডের থ্রি-পিস বেডকভার, সাথে ম্যাচিং কুশন আর ছোট্ট একটা ছড়িয়ে রাখা সাদা কম্বল। বিছানার একপাশে আছে কাঠের তৈরি একজোড়া বেডসাইড টেবিল, একটাতে রাখা বইয়ের গাদা। আরেকটাতে একটা ছিমছাম টেবিল ল্যাম্প। বেশ পরিপাটি আর সৌখিনতার পরিচয় বহন করছে যেনো কক্ষ টা।

রুমের এক কোনায় বসানো ড্রেসিং টেবিল। মাঝারি মাপের আয়না, চারপাশে লুকানো লাইট। নিচে কয়েকটা ড্রয়ার, যার একটাতে সাজসজ্জার জিনিস। আরেকটাতে পারফিউমের বোতল। দেখা যেনো অনুমান করা যাচ্ছে পারফিউম এর বোতল গুলো এক-এক টা বেশ দামী হবে।
টেবিলের উপর ছোট্ট গ্লাস ভেস, তাতে কিছু আধমরা ফুল।
ফিজা দাঁড়িয়ে এসব ভাবছে আর রুমের অন্য পাশে রাখা সোফায় বসে যে আবরাজ খান ওকেই দেখছে সেদিকে খেয়াল নেই মেয়ে টার। ওয়াশ রুম থেকে নরমালি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো ফিজা। কাপড় রাতের টাই পরনে। রুমে ফিরে দেখলো আবরাজ কাঠের প্যানেল দিয়ে করা বিল্ট-ইন ক্লোজেট এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। স্লাইডিং দরজা, একটায় আয়না লাগানো। ভেতরে আলাদা শেলফ, হ্যাংগার রোড, এবং জুতা রাখার জায়গা। সবকিছু গোছানো। রঙ অনুযায়ী শার্ট সাজানো, সিল্কি শাড়িগুলো কাভারে ঝুলছে। শাড়ী দেখে ফিজার মাথায় আকাশ ভেঙে পরার জোগাড়। একজন অবিবাহিত পুরুষের ক্লোজেটে শাড়ী? তৎক্ষনাৎ মাথায় বাসা বাঁধল আবরাজ খান কী তবে পূর্ব কোনো রমণীর সঙ্গে সংসার করেছে? তবে পরক্ষণেই সেই চিন্তায় ফিজার নিজের ওপর রাগ হয়। ছিঃ ছিঃ এ হতে পারে না। কোনো কিছু আগে পরিকল্পনা করে নেওয়া ঠিক নয়। ফিজা একটু এগিয়ে গিয়ে হাত দু’টো কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞেস করলো,

-“এখানে এতো শাড়ী?”

-“ইয়াহ। অল ইউর’স।”

ফিজা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আবরাজের মুখের দিকে খানিকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলো। আবরাজ হয়তো বউয়ের মনোভাব বুঝতে পারলো। একটা শাড়ী মেয়ে টার হাতে দিয়ে বললো,

-“গো ফাস্ট রেডি হয়ে এসো।”

ফিজা শাড়ী হাতে নিলো। চিকন জর্জেট টাইপ শাড়ী টার ডাস্টি পিংক বা পুরনো গোলাপি রঙের ও বলা যায়। পুরো শাড়ি জুড়ে অফ হোয়াইট রেশমি থ্রেডের কাজ রয়েছে। ছোট ছোট জ্যামিতিক প্যাটার্নে সূক্ষ্ম কড়ি-কাটার কাজ যেনো নজরকাড়া সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। পাড়ে মোটা ডিজাইন, যেখানে ফুলের মতো মোটিফ ও ঘন এমব্রয়ডারির কাজ রয়েছে সিলভার রঙে। প্রান্তে আছে হালকা ঢেউখেলানো কারচুপি। যেটার ফিজার খুবই পছন্দ হলো। শাড়ী নিয়ে ও মাথা দুলিয়ে ফের ওয়াশ রুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আবরাজ পেছন থেকে বলে উঠলো,

-“কোথায় যাচ্ছো?”

-“ওয়াশ রুম।”

-“আমি বাইরে যাচ্ছি তুমি এখানেই চেঞ্জ করে নাও।”

বলতে বলতে আবরাজ বেরিয়ে গেলো। ফিজা আয়নার দরজা টা আলগোছে চাপিয়ে দিলো। রেডি হয়ে যখন বেরিয়ে এলো আবরাজ তখন বসে আছে। ওর অপেক্ষায় না-কি অন্য কারণ বোঝা গেলো না।
তবে হাতের ইশারায় ফিজা কে কাছে ডাকলো। ফিজা এগিয়ে এলো। শাড়ির আঁচল টা মাথায় তোলা তখন। আবরাজ আচমকাই ওর হাত টেনে ধরে হেঁচকা টানে নিজের উরুর ওপর বসিয়ে দিলো। মাথা থেকে আঁচল খসে পরলো। সাথে সাথে উন্মুক্ত হলো ঘাড়গর্দান। ফিজা এক হাতে শাড়ির আঁচল শক্ত করে কাঁধে চেপে ধরে। অন্য হাত টা আবরাজের ঘাড় আঁকড়ে ধরলো। আবরাজ কিছু সময় চুপ থেকে নিষ্প্রভ দৃষ্টে চেয়ে রইলো বউয়ের মুখের দিকে। পরপরই হিমবাহের ন্যায় শীতল কণ্ঠে বললো,

-“আই নিড সাম থিং, ডু ইউ নিড এনি থিং জান?”

ফিজা চোখ কটমট করে তাকায়। আবার সকাল সকাল মানুষ টার নির্লজ্জ কথাবার্তা শুরু হয়েছে। সারাদিন কিভাবে পাড় হবে? এই বেহায়া নির্লজ্জ পুরুষ তাকে সুস্থ রাখবে তো? মনে তো হচ্ছে না। নির্লজ্জ কথাবার্তা দিয়ে তাকে মেরে ফেলবে বোধহয়। ফিজা আবরাজের বুকে ধাক্কা দিলো। শাড়ির আঁচল টা মাথায় তুলে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে আওড়াল,

-“অসভ্য নির্লজ্জ পুরুষ।”

আবরাজ ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়াল। ফিজা দরজার সামনে থেকে শুনতে পেলো আবরাজ বলছে,

-“আমি অসভ্য, নির্লজ্জ পুরুষ তা তো শুধু তুমিই জানবে সুগন্ধি ফুল। কারণ আমি তোমার কাছেই অসভ্যতামি করবো।”

ফিজা পেছনে তাকালো না আর। মূলত তাকানোর মতো সাহস টা করে উঠতে পারলো না। বুক টা দুরুদুরু করছে। কাঁপছে বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা। তাই তো নিজে কে লুকিয়ে পালিয়ে গেলো।

——-

পুরো সকাল টা ফিজা শাশুড়ির আঁচল ধরে ঘুরঘুর করলো। মিসেস ইলা রান্না ঘরে রান্না করছে ফিজা সেখানেই ওনার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। শাশুড়ির বেশ মনোযোগ দিয়ে রান্না করছে। রান্না করতে বেশ পছন্দ করে ভদ্রমহিলা। বাড়িতে রান্নার জন্য আলাদা রান্না দু’জন লোক থাকলে-ও তিনি রান্না নিজের হাতেই করে থাকেন। স্বামী উনার হাতের রান্না বেশ পছন্দ করে। তবে বাড়িতে যেহেতু দুইজনেই থাকে শুধু তাই রান্না করতে উনার তেমন অসুবিধা হয় না। বরং রান্না তিনি যতোদিন সুস্থসবল থাকবেন ততদিনই করার মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
শাশুড়ির সাথে গল্পে গল্পে ফিজা আশে-পাশের কথা এবং সে শ্বশুর বাড়িতে আছে একথা ও একপ্রকার ভুলেই গেলো। তবে আচমকাই খুব জোরে রান্না ঘরের বাইরে থেকে আবরাজ তার মাকে ডাকছে।

-“আম্মু! আম্মু!”

ইলা বেগম অবাক হলেন। ফিজাও হতভম্ব হয়ে গেলো। দুজনেই দ্রুত পায়ে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। টেবিলের ওপর থেকে সবেমাত্র একটা আঙুরফল তুলে মুখে দিয়েছে আবরাজ। স্বাভাবিক সে। ইলা বেগম চিন্তিত হয়ে ছেলে কে জিজ্ঞেস করলো,

-“কী হয়েছে বাবা? কিছু লাগবে তোমার?”

-“হাঁ আম্মু। বউ লাগবে। তুমি আমার বউ সকাল থেকে নিয়ে রেখেছো। এখন আমার বউ আমাকে ফেরত দাও।”

দুই জোড়া চোখ বিস্ময়ে আকৃতি ধারণ করলো গোলগোল। কী সব বলছে মাথা ঠিক আছে তো? ফিজার লজ্জায় মনে হলো মাটির তলায় লুকিয়ে যেতে। অথচ সামনের পুরুষের কোনো হেলদোল নেই। সে টপাটপ আরও কয়েকটি আঙুর মুখে পুরে নিচ্ছে। মিসেস ইলা বেগম তাড়া দেখিয়ে রান্না ঘরে যেতে যেতে অস্থির কণ্ঠে বললো,

-“তোমার বউ তুমি নিয়ে যাও। আমার রান্না ঘরে মেলা কাজ। আমি যাই।”

ফিজা চোখ কটমট করে তাকালো আবরাজের দিকে। আবরাজ সে-সব তোয়াক্কা করে না। বরং চোখ টিপে দিয়ে বললো,

-“উম দেখো না দেখো না। এভাবে দেখো না জান। নিজের সর্বনাশ কখনো হবে টেরও পাবে না।”

#চলবে…..

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_৫
#জান্নাত_সুলতানা

-“রুমে কেনো ডেকে নিয়ে এসছেন?”

ফিজা যেনো কিছু টা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো। আবরাজ একটা লাগেজ নামিয়েছে। ফিজা অবাক হয় সেটা দেখে। হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো,

-“আপনি আজ চলে যাচ্ছেন?”

-“হাঁ। আমরা চলে যাচ্ছি।”

-“কোথায়?”

-“কোথায় যেতে চাও বলো। কোথায় গিয়ে বাসর করলে তুমি খুশি হবে?”

ফিজার চোখ গুলো অটোমেটিক ভাবে বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। লজ্জায় অস্বস্তি মূহুর্তের মধ্যে ঘিরে ধরলো মেয়ে টাকে। আবরাজ বউয়ের লজ্জা মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

-“ব্যাস আর একটা দিন। দেখবে লজ্জা তোমার কোথায় লুকয়।”

ফিজা বিরক্ত হলো। খুব বিরক্ত করছে তাকে এই পুরুষ। না জানি একা তাকে কত কী সহ্য করতে হবে৷ ওয়াশ রুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আবরাজ পেছন থেকে ওর বাহু টেনে ধরলো। বললো,

-“আজ একটাও কিস হয় নি জান।”

তো? ফিজার ইচ্ছে করলো আবরাজ খানের নাক ফাটিয়ে দিতে। গত পরশুদিন থেকে শুরু হয়েছে জ্বালানো। ফিজা বিরক্তিকর স্বরে আওড়াল,

-“তো?”

-“বিয়ের পর প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর বউ কে চুমু খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, সুগন্ধি ফুল।”

ফিজার কান গুলো গরম হয়ে এলো। ও মুখ টা কঠিন করে ওয়াশরুম যাওয়ার জন্য ফের পা ফেলতে আবরাজ আবারও আঁটকে নিলো ওকে। হেঁচকা টানে নিজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করে নিলো।
পুরুষালী ওষ্ঠদ্বয়ের সংঘর্ষে ফিজা ফুঁপিয়ে উঠলো। আবরাজ বউয়ের অধর জোড়া কয়েক সেকেন্ড এর জন্য ছাড়লো। স্লো ভয়সে বললো,

-“একটু কষ্ট করে মানিয়ে নাও জান।”

ভেজা চোখে ফিজা একপলক তাকালো আবরাজের মুখের দিকে পরপরই সেই সুযোগ ও হারালো। আবরাজ নিজের ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে আবারও চেপে ধরলো বউয়ের ওষ্ঠদ্বয়। কত সময় ধরে সেই ভালোবাসা নামক যন্ত্রণা আবরাজ বহমান রাখলো সেই হিসাব কষতে পারে না ফিজা।

——–

সন্ধ্যার আগে আগে আবরাজ বউয়ের লাগেজ নিজে গুছিয়ে নিলো। ফিজার মা বোন কে ডেকে নিয়েছেন খান বাড়িতে। ওরা সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। গন্তব্যে পৌঁছাতে ওদের সময় লাগলো দশ ঘন্টার বেশি সময়। ফ্লাইট থেকে নেমে ফিজা আশ্চর্য হলো। দেশের আবরাজ খান আর এখনকার আবরাজ খানের মধ্যে পেলো আকাশপাতাল পার্থক্য। তবুও সে নিজের বিস্ময় চেপে রাখলো।
গাড়িতে চড়ে বসার পর এক এক করে সামনে পেছনে পাঁচ টা গাড়ি চলতে শুরু করলো। মার্সিডিজটার কালো শরীর ঝকঝকে রোদে চকচক করছিল। গাড়ির ভিতরে একটা নীরব শান্তি। শুধু হালকা বাজছিল রেডিওতে পেছনের দশকের কোনো জার্মান জ্যাজ।
আবরাজ ড্রাইভিং সিটে বসে নিঃশব্দে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। ডানে বাঁকে গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে সবুজে মোড়া পাহাড়ের পথ। ফিজা জানালার পাশে মাথা হেলিয়ে বাইরে তাকিয়ে। গাড়ির জানালায় হাত রেখে সে আঙুল দিয়ে আবছা মেঘের ছবি আঁকছিল।
তবে মনে হাজার টা প্রশ্ন।
গাড়ি গুলো ধীরে ধীরে একটা পুরনো গেটের সামনে থামে। লোহার গেট খুলে যায় অটো সেন্সরে। ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা বড়ো বাড়ি টার সৌন্দর্য চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো।
একটা প্রশান্ত এলাকা। চারপাশে সবুজ গাছগাছালি, টানা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন ডুপ্লেক্স বাড়ি টা। আধুনিক জার্মান স্থাপত্য আর ঐতিহ্যের মিশেলে তৈরি। বাইরের দেয়ালগুলো ধবধবে অফ-হোয়াইট। তার মাঝে ছড়িয়ে আছে ধূসর পাথরের নকশা। ছাদটা টাইলসের তৈরি, গাঢ় লালচে-বাদামি রঙের, ক্লাসিক ইউরোপিয়ান লুকে।

বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট কিন্তু পরিপাটি গার্ডেন, ছাঁটা ঘাস, গোলাপি-সাদা রঙের হাইড্রেঞ্জিয়া ফুল ফুটে আছে। মাঝখানে পাথরের পথ বেয়ে হাঁটলে ডাবল উঁচু কাঠের দরজার কাছে পৌঁছানো যায়। দরজার দুই পাশে বড় বড় কাচের জানালা। ভেতর থেকে ঝুলছে শীতল টোনের পর্দা।

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা কালো রঙের, মার্সিডিজ-বেঞ্জ জি-ক্লাস SUV আর তার পাশে একটা হালকা ধূসর আউডি এ৭ স্পোর্টব্যাক। যেনো গ্যারেজের বদলে গাড়িগুলোই বাড়ির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। এর সাথে রাখা হয় বাকি গাড়ি গুলো। ফিজার হাত ধরে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো আবরাজ। জন নামের একজন কে নিয়ে ফের সাইডে চলে গেলো।
ফিজা বাড়ি টা দৃষ্টি বুলিয়ে দেখতে লাগলো।
বাড়িটা দুটো তলায় ভাগ করা। নিচতলায় বিশাল একটি ড্রইংরুম। উঁচু ছাদ। কাঠের ছাঁট বসানো ফ্লোরিং। মার্বেল টপ কফি টেবিল আর একটা ম্যাট কালার্ড লেদার সোফা। দেয়ালে আধুনিক আর্ট আর একটা বিশাল ফ্রেমে বাঁধানো পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপ।

দক্ষিণ দিকে দেখা যাচ্ছে একটা ফায়ারপ্লেসে আর সেখান থেকে বসে দেয়াল ভেদ করে দেখা যাচ্ছে বিশাল এক সুইমিং পুল। একটা ওপেন কিচেনও আছে নিচতলায়। স্লেট-গ্রে মডুলার কেবিনেট, ইন্ডাকশন চুলা, আর কাচের ডাইনিং টেবিলের চারপাশে সাদা চেয়ার।

-“সুগন্ধি ফুল!”

-“বাড়ি টা আপনার?”

-“না বিয়ের পর বউ নিয়ে থাকার জন্য আমার আব্বাজানের থেকে গিফট পেয়েছি।”

ফিজার ভ্রু কুঁচকে আসে। নিজের বাবা-র থেকে বউ নিয়ে থাকার জন্য গিফট! আশ্চর্যের ঘটনা।
লাগেজ গুলো জন ওপর তুলছে তখন। ছেলে টা হ্যাংলা সুন্দর। চেহারায় কিছু টা বিদেশি ছাপ রয়েছে। সে হাসছে। ফিজা সেই হাসির উৎস খুঁজে পেলো না। তাই আবরাজের পেছন পেছন কিচেনে গেলো। আবরাজ কফি বানাচ্ছে। ফিজা সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। কফি বানিয়ে নিয়ে আবরাজ একটা বউ কে দিলো তো একটা নিজে নিয়ে ওপরের দিকে হাঁটা শুরু করে ফিজা কে বললো,

-“কাম উইথ মি।”

উপরতলায় রয়েছে তিনটা বেডরুম। মাস্টার বেডরুমটা খুবই রুচিশীল। মিনিমাল ডিজাইন, কিন্তু রুচির ঘনত্বে পূর্ণ। বড় জানালায় সাদা পর্দা। জানালার ওপাশে দূরের সবুজ টিলা দেখা যায়। অ্যাটাচড ওয়াক-ইন ক্লোজেট আর মার্বেল বাথরুমে জ্যাকুজি বসানো।

বাড়ির পেছনে একটা কাঠের ডেক, যেখানে সানসেটের সময় চেয়ার পেতে বসে কফি খাওয়া যাবে। পেছনের দিকটা আধা-প্রাইভেট। বড় একটা গেটেড বাউন্ডারিতে মোড়ানো। যেনো শহরের ভেতর নিজের একটা শান্ত দ্বীপ। জানালার পাশ থেকে সরে এসে ফিজা আবরাজ কে জিজ্ঞেস করলো,

-“কেউ থাকে না এখানে?”

-“না। আজ থেকে আমরা থাকবো।”

-“আমি যে শুনলাম আপনার ভাই আপনার সাথে থাকে।”

-“আব্রাহাম এখন বার্লিন শহর থাকে। আর আমরা এখন ফ্রেইবুর্গ রয়েছি। আব্রাহাম এবং আমি ফ্রাইবুর্গ ইউনিভার্সিটি থেকে স্টাডি কমপ্লিট করেছি।”

-“ওহ আচ্ছা।”

-“ও কাল দেখা করতে আসবে আমাদের সাথে।”

কথা বলতে বলতে আবরাজ নিজের পোশাক পরিবর্তন করে নিলো। সকাল দশ টা এখন। ওরা সকালের ব্রেকফাস্ট প্ল্যানে করে ছিলো। তাই ফিজার শরীর বিছানা পেয়ে আরাম করতে চাইলো।
আবরাজ ওর গায়ে কম্ফর্টার জড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
ফিজার যখন ঘুম ভাঙে তখন পেট জ্বলছে ক্ষুধায়। শোয়া থেকে ওঠে আশেপাশে দেখে বুঝতে পারলো সময় টা সন্ধ্যায় কিংবা তার আগে পরে হতে পারে। রুমে লাইট অন করে ফ্রেশ হতে গেলো সে। ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে ও আবরাজ খানের অস্তিত্বের দেখা পেলো না। রান্না ঘরে গিয়ে পুরো রান্না ঘর খুঁজে একটা স্যুপের প্যাকেট পেলো। ক্ষুধার তোপে সেটাই রান্না ঘরে খেতে লাগলো। সময় অনেকক্ষণ অতিবাহিত হলো কিন্তু তবুও আবরাজের পাত্তা নেই।
ফোন বের করে সোফায় বসে যখন মাসেজে করবে তখনই হুট করে আবরাজ সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো। গায়ে একটা লম্বা ওভার কোট। কালো জুতো, ড্রেসআপ কেমন অদ্ভুত লাগলো। ফিজা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। আবরাজ এসে ওর পাশ ঘেঁষে বসলো। ফিজা সাথে সাথে শরীর থেকে সিগারেটের গন্ধ পেয়ে নাকমুখ কুঁচকে বলে উঠলো,

-“বিড়ির গন্ধ।”

-“এটা সিগারেটের গন্ধ সুগন্ধি ফুল। নট অ বিড়ির গন্ধ।”

আবরাজ গম্ভীর স্বরে বললো। ফিজা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো আবরাজের মুখের দিকে। আবরাজ আচমকাই ওর দিকে ঝুঁকে এলো। ওর গলা টা চেপে ধরে মুখ টা এগিয়ে আনলো নিজের দিকে। থুতনিতে আলগোছে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো,

-“চলো রেডি হবে। আমরা একটা পার্টিতে যাচ্ছি।”

অদ্ভুত মানুষ সারাদিন কোথায় ছিলো? আর এসেছে পর একবার ও তো জানতে চাইলো না ও কিছু খেয়েছে কি-না। ফিজার অল্প অভিমান হলো। যা আবরাজ খান নামক পুরুষ টের ও পেলো না। সুতরাং এই অভিমানের কোনো ভিত্তি নেই।

#চলবে…..

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#জান্নাত_সুলতানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here