#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_১৫
#জান্নাত_সুলতানা
ফিজা খুব ক্লান্ত। শপিং শেষ ডিনার করে বেরিয়ে বেচারি আরও হাঁটতে পারছে না। আবরাজ কিছু শপিং ব্যাগ হাত হাঁটছে। ফিজা চোখ-মুখ কুঁচকে বলে উঠলো,
-“আপনার এতো গার্ড। শুধু শুধু কেনো রেখেছেন?”
-“তো তুমি কী চাইছিলে আমি আমাদের ডেটে ওদের নিয়ে আসি?”
ফিজা চোখ পিটপিট করে তাকায়। আসলেই তো। সে ভেবে দেখে নি সেটা। সারাদিন যা করেছে আবরাজ গার্ড সাথে থাকলে নিশ্চয়ই ফিজা আরও বেশি অপ্রস্তুত হতো। এসব ভাবতেই ওর লাঞ্চ করার সময়কার ঘটনা মনে পরলো। খাওয়াদাওয়া শেষ গাড়িতে আবরাজ ওর শার্টের বাটন তিনটা খুলে নিয়ে ছিলো। সেখানে মুখ গুঁজে কত সময় ছিলো ফিজার সময় মনে নেই। তবে এমন ভাবে তাকে আঁকড়ে ধরে ছিলো মনে হচ্ছিল তার শরীর থেকে আত্মা শুষে নিচ্ছে। ফিজার মনে হতেই শরীর জুড়ে কম্পন ছড়িয়ে পরে। সে ভাবনায় বিভোর আবরাজ ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে টের ও পায় নি। শক্ত খাম্বার মতো কোনো কিছুতে ধাক্কা খেয়ে চোখ মুখ বিকৃতি করে নিলো। সে ভেবে নিয়েছে তার কপাল ফেটে রক্তক্ষরণ হবে। আবরাজ ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকায়। আর গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
-“সামনে এসো।”
ফিজা কপালে ঘষে একবার। এরপর সামনে চলে আসে। আবরাজ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে ব্যাগ না থাকলে হয়তো তার মনের না বলা অব্যক্ত বোঝা যেতো। ফিজা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার প্রয়াস করে। আবরাজ চওড়া কাঁধ টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে। আর মুখের ভাবভঙ্গি খুব সিরিয়াস। সে গুরুগম্ভীর স্বর আদেশ করে,
-“গলা জড়িয়ে ধরো।”
ফিজা অবাক হয়। চারপাশে তাকায়। মানুষ নিজেদের মতো চলাফেরা করছে। এখন আবার এই পুরুষ কী করবে? ফিজার ভাবতে গিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে নিলো। আবরাজ খুব ভালো মানুষ নয়। তার ভাষায় নির্লজ্জ। যা কিছু হতে পারে।
-“কেনো?”
-“প্লিজ।”
আবরাজ যেনো অনুরোধ করছে। ফিজা চোখ গোল গোল করে হাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। আবরাজ সাথে সাথে নিজের দুই হাত ওর হাঁটুর নিচে দিয়ে জড়িয়ে ধরে। ফিজা চমকায়। এতো কিছু হাতে নিয়ে তাকে-ও কোলে নিয়ে হাঁটতে অসুবিধা হবে না? ফিজার খারাপ লাগলো। সে তাই অস্থির কণ্ঠ বলে উঠলো,
-“প্লিজ নামিয়ে দিন।”
-“কেনো?”
-“আমি আপনার মতো এতো নির্দয় নয়।”
আবরাজ বাঁকা হাসে। বউ তার কেনো এই কথা বলছে সে খুব ভালো করে জানে।
-“সরি বাট নট সরি, সুগন্ধি ফুল। তোমার এই কথায় তুমি রাতে কাঁদা থেকে ছাড় পাবে না। আমি এতো টাও ভালো নই। ”
-“অসভ্য পুরুষ।”
ফিজা বিড়বিড় করে। আবরাজ হাঁটে। তবে তার দৃষ্টি শকুনের মতোই তীক্ষ্ণ। সুইমিংপুলের ওপারে থাকা কোনো এক ব্যাক্তি কে সে ঠিকই দৃষ্টি দিয়ে শাঁসালো।
——
আগে মেহরিনের কাজ ছিলো অফিসের যাবতীয় ফাইল কালেক্ট করা। আর সাব্বির কিংবা মিলন খানের পিএ কে দেওয়া। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আজ সে এই কাজ পাচ্ছে না। এটার জন্য অন্য আরেকটা ছেলে রাখা হয়েছে। আর তাকে সাব্বিরের সাথে দেখা করতে বলা হয়েছে। সাব্বিরের সাথে দেখা করতে হলে বসের কেভিনের পাশের কেভিনে যেতে হবে। আর সেখানেই বসে সাব্বির। তবে মিলন খান এখন অফিস আসে না। খুব প্রয়োজন ছাড়া। আর ভয় এখানেই আব্রাহাম খান এখন বর্তমানে অফিসে বাবা-র দায়িত্ব পালন করছে। আর মেহরিন সেইজন্যই আরও আতংকিত। সেদিনের পর তারা সকালেই খান বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলো।
আব্রাহাম অফিসে চেয়ারে বসে আছে। খুব অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। আর বারবার সাব্বিরের দিকে তাকাচ্ছে। সাব্বির তাকাচ্ছে দরজার দিকে। আব্রাহাম যেনো অধৈর্য। সে দাঁতে দাঁত চেপে বিরক্তি প্রকাশ করলো। আর বললো,
-“তুমি বলেছিলে ওকে কেভিনে পাঠাতে?”
-“জি স্যার। কিন্তু এখানে আসছে না কেনো বুঝতে পারছি না।”
-“উফ।”
সাব্বির ঠোঁট কামড়ে ধরে বারবার দোয়া পরছে। আব্রাহাম মাথায় হাত ঠেকিয়ে বসে ছিলো তখনই সাব্বির চেঁচিয়ে উঠলো। আর বললো,
-“স্যার স্যার ওই দিকে দেখুন।”
আব্রাহাম ঘাড় কাত করে রেখেই বাইরে দৃষ্টিপাত করলো। একটা মেরুন রঙের থ্রি-পিস পড়া মেয়ে কাচের দেয়ালের ওপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাব্বির কে আব্রাহাম ইশারা করে। সাব্বির বেরিয়ে যায়। আব্রাহাম তপ্ত শ্বাস ফেলে বসে থাকে। গুলুমুলু মেয়ে টা সাব্বিরের সাথে খুব ভদ্রভাবে কথা বলছে। আব্রাহাম কত সময় এভাবে তাকিয়ে ছিলো কে জানে। তবে দরজায় নক পড়তেই তার ধ্যান ভাঙে। আর নিজে কে সামলে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
-“কাম ইন।”
মেহরিনের একটা পা প্রথমে কেভিনের ভেতর পরে। নরমাল একজোড়া নকওয়ালা ফ্ল্যাট জুতো। জুতোটা সুন্দর না-কি পা? আব্রাহাম নিজের ভাবনায় নিজেই আশ্চর্য হয়। মেহরিন যখন সশরীরে উপস্থিত হলো আব্রাহাম একটু নড়েচড়ে বসলো।
-“এখানে আপনার সাইন লাগবে স্যার।”
-“এদিকে নিয়ে এসো।”
মেহরিন ফাইলটা সামনে থেকে ধরলেও আব্রাহাম চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আদেশ টা দিলো। মেহরিন এমনিতেই একটু অস্বস্তিতে আছে। কেননা তার কাজ টা হঠাৎ করে চেঞ্জ করে আব্রাহামের নিকট হতে সকল ফাইল সাইন করিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব টা তার। আর তারউপর মানুষ টাকে নিয়ে ওর মনে ভয়ের শেষ নেই। এখন তার শরীর যে কাঁপছে কিভাবে গিয়ে দাঁড়াবে সে? মেহরিন লম্বা শ্বাস টানে আর নিজে কে শান্ত রাখতে চেষ্টা করে। আব্রামের বাঁ দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে সামন্য ঝুঁকে মেহরিন কলম টা এগিয়ে দিলো আব্রাহাম কে। আব্রাহাম প্রথমেই চোখে বন্ধ করে শ্বাস টানলো। অদ্ভুত মেয়ে টার শরীর থেকে বেলী ফুলের সুগন্ধি ভেসে আসছে।
-“তোমার থেকে বেলী ফুলের স্মেল আসছে।”
আব্রাহাম কাঁধ উঁচিয়ে জানায়। মেহরিন মাথা নিচু করে রাখে। মানুষ টা বিদেশ পড়তে গিয়ে হয়তো দেশি তেলের গন্ধ ভুলে গিয়েছে। মেহরিনের হাসি পায় কেনো জানি। সে হাসি চেপে বলে,
-“এটা ফুলের নয়, তেলের ঘ্রাণ।”
আব্রাহাম ভ্যাবাচ্যাকা খায় যেনো। ঠোঁট দু’টো অটোমেটিক নিজেদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায়। তবে সে নিজে কে সামলে নেয়। আর ফাইলে সাইন করে। মেহরিন চলেই যাচ্ছিলো। আব্রাহাম ডাকতেই দাঁড়িয়ে গেলো সে। ভয় হচ্ছে কিছু ভুল করে ফেললো না তো সে? আব্রাহাম পেছন থেকে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি কী প্রেম করছো?”
-“ন না তো।”
মেহরিন অপ্রস্তুত হয় এমন প্রশ্নে। আব্রাহাম কাঁধ উঁচিয়ে বলে,
-“আচ্ছা যাও। এসব করা ভালো নয়। পছন্দ হলে বিয়ে করে নেওয়া উচিৎ।”
-“আর যদি সে পছন্দ না করে?”
এটা কী বোকা মানুষের প্রশ্ন? না মোটেও নয়। কিন্তু মেহরিনের প্রশ্ন শুনে আব্রাহামের ওকে বোকাই মনে হচ্ছে। আব্রাহাম ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর তার চোখ দু’টো যেনো শান্ত কোনো এক সাগর। যাতে লুকিয়ে আছে হাজার রকমের প্রশ্ন। গম্ভীর স্বরে আব্রাহাম উত্তর করে,
-“তাহলে জোর করে করা উচিৎ।”
মেহরিন মাথা নাড়ে আর বেরিয়ে যায়। আব্রাহাম সঙ্গে সঙ্গে ফোন হাতে নিয়ে কাউ কে কল দেয়।
——
আবরাজ খুব তাড়ায় আছে। বউ কে ঘুমে রেখে সে এখানে এসছে। বউয়ের ঘুম কোনোভাবে ভেঙে যাওয়ার আগে বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। সে কালো রঙের স্যুটের সঙ্গে সাদা শার্টে গলায় ঝুলানো টাই ঠিক করে। এরপর দুই হাত মেলে পা ক্রস করে বসে। মিস্টার জি এবং জুনায়েদ তার বিপরীতে বসে আছে। মিস্টার জি কয়েকটি ছবি সামনের চকচকে কাচের টেবিলের ওপর রাখতেই আবরাজ ভ্রু কুঁচকে নিলো। মিস্টার জি বললো,
-“এটা নিলামে তুলতে চাই।”
আবরাজ ভ্রু কুঁচকে নিলো। সে এ-সব নিয়ে মোটেও আগ্রহ নয়। তবুও ছবিগুলো দেখা থেকে নিজে কে আটকাতে পারে না। ছবি হাতে নিয়ে তার মুখ লাল হয়ে আসে৷ রাগে চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করছে তবে শপিংমলের সুইমিংপুলে মানুষটাকে দেখা আর তার ধারণা সত্যি। আবরাজ তবুও ঠোঁটের কোণে বাঁকা হেঁসে টেনে বলে উঠলো,
-“বাহ পিকচার গুলো জাস্ট এমেইজিং।”
ছবিগুলো সত্যি সুন্দর। আবরাজ ফিজা কে কোলে নিয়ে হাঁটছে। কোনটাতে ফিজা পেছনে পেছনে হাঁটছে আবরাজ সামনে তারপরও জুনায়েদ অবাক হয়। আবরাজ এটা এতোটা স্বাভাবিক ভাবে নেওয়ার কথা নয়। তার ভাবনার মাঝেই আবরাজ আবারও গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“ফটোগ্রাফার কোথায়?”
মিস্টার জি আঁড়চোখে ওনার পেছনে দাঁড়ানো বিদেশি ছেলেটার দিকে চায়। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে কয়েক সেকেন্ড পরই তার দেহ টা ফ্লোরে লুটিয়ে পরলো। গান পাউডারের গন্ধে মূহুর্তের নাকে লাগে। জন নাক কুঁচকে নেয়। মিস্টার জি জনের থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবরাজের দিকে তাকাতেই দেখলো আবরাজ গানের নলে ফু দিচ্ছে। যেখান থেকে মাত্রই একটি গুলি বেরিয়ে কারোর জীবন নিয়েছে। মিস্টার জি এবং জুনায়েদ দুজনেই বোধহয় অবাক হয়েছে। আবরাজ সচারাচর এই কাজ করে না। তাদের সাথে কাজে অন্তত খুব প্রয়োজন ছাড়া এটা সে পূর্বে কখনোই করে নি। আবরাজ ওঠে দাঁড়াল। গান টা জনের হাতে দিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে কাঁধ উঁচিয়ে বলে উঠলো,
-“আপনার এই সাম্রাজ্যে ধ্বংস করতে আবরাজ খানের খুব বেশি টাইম লাগবে না। এখন আপনি ডিসাইড করুন আমার বউয়ের দিকে নজর দিবেন না-কি নিজের সাম্রাজ্যে বাঁচাবেন। যদি আমার বউয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে যান। তাহলে আপনার সাম্রাজ্যে আর আপনার এই লাল-নীল জীবন কোনটাই থাকবে না। আর সেকেন্ড অপশন বেছে নিলে আপনার জন্য ভালো। সো চয়েস অনলি ওয়ান অপশন।”
#চলবে…..
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]