সিন্ধু ইগল – (৩০)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
দরজায় ঠোকা পড়ল দু’তিন বার। এমন একটা সাধারণ ঘটনাতেও আয়মানের হাসি পেল খু্ব। কণ্ঠ উঁচু করে বলল দরজার ওপাশের মানুষটাকে, ‘অনুমতি আছে।’
দরজা ঠেলে জায়িন নাশতার প্লেট নিয়ে ঢুকল ঘরে। আয়মানের বদ্ধ ঠোঁটে তখন মৃদু হাসি। কেমন যেন দুষ্টুমি খেলা করছে সেই হাসিতে। এমন প্রতিক্রিয়ার অর্থ বুঝতে পারল না সে। নাশতা নিয়ে এগিয়ে ওর কাছে বসলে আয়মান ওর খুব কাছে ঝুঁকে এল। জায়িন তখনো স্থির, স্বাভাবিক। তবে ভেতরে ভেতরে কৌতূহল জাগছে তার প্রচুর।
-‘কী হয়েছে?’
এ প্রশ্নে আয়মান ওর কানেকানে ফিসফিস করে বলল, ‘পালিয়ে যাব।’
জায়িনের ঠোঁটে এবার ফুটে উঠল তার ঈষৎ হাসিটা। পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে দু’জন দু’জনের দিকে চেয়ে আছে মুচকি হাসি নিয়ে। কিছু বলার জন্য আয়মানের কানের কাছে মুখটা নিয়ে এলেও চট করে ওর গালের পাশটাতে চুমু খেয়ে বসল সে, তারপর কানেকানে বলল, ‘এত দারুণ অভিনয়ে আমি মুগ্ধ, জাদুরানি।’
বলেই সরে এসে নাশতার প্লেটটা এগিয়ে দিলো ওর কাছে। খেতে খেতে আয়মান জিজ্ঞেস করল, ‘মেইড কি সব সময় তোমার সেবায় নিয়োজিত থাকে?’
-‘আমার কী সেবা দেবে তারা?’
-‘রাতের সেবা।’ মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল আয়মান।
-‘আমিই চব্বিশঘণ্টা আমার বউয়ের সেবায় থাকি, আমার আর সেবা নেওয়ার সময় কই?’
-‘তুমি কিন্তু বেশ সিকিউরিটির মধ্যে রেখেছ আমাকে। দুর্দান্ত।’
-‘বউটাই আমার এত দুর্দান্ত৷ তাকে কি আর হেলাফেলার ভেতর ছেড়ে রাখা যায়? না হলে দেখা যেত এই দু’দিনে দু’জন মেইড খাল্লাস।’
বিপরীতে আয়মান আর কিছু বলল না। খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে। এঁটো প্লেটটা নিয়ে যাবার জন্য দাঁড়াতেই পেছন থেকে ডেকে উঠল আয়মান, ‘তুমি কি আমাকে রেসপেক্ট করো, জায়িন?’
হঠাৎ এমন প্রশ্নের কারণ বুঝতে প্রশ্ন চোখে তাকাল জায়িন ওর দিকে, জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’
-‘আর অন্যদের?’
-‘সেটা তো নির্ভর করে তারা মানুষ কেমন তার ওপর।’
আয়মান ঠোঁট কামড়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে চেয়ে থাকল ওর দিকে। জায়িন তা দেখে কাছে এগিয়ে এসে চোখের ওপর পড়ে থাকা ওর ছোটো ছোটো চুলগুলো কপালের এক পাশে সরিয়ে দিতে দিতে কোমল স্বরে বলল, ‘তুমি মানতে চাইছ না মান, তুমি আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু তোমার এটা বোঝা উচিত, তুমি স্বীকার না করলেও জায়িন তা বুঝে ফেলেছে বহু আগেই। তোমাকে আমি কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু দিতে হবে। আ’ম স্যরি ডিয়ার।’
বলে আর দাঁড়াল না ও। দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। আর তার শেষ কথার অর্থ বুঝতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আয়মান।
_____________
সন্ধ্যার পর থেকে সময় যত এগোচ্ছে, অস্থিরতা ততই বাড়ছে আয়মানের। তার মনে হচ্ছে কত কাল যেন পানি পান করে না সে। আজ দুপুরে সে অনেকটা বিস্মিত হয়েছিল। যখন জায়িনের পরিবর্তে কোনো এক মেইড এসে তার খাবার দিয়ে যায়৷ প্রথমে সে ভেবেছিল, হয়তো তার সকালের কথার জন্যই জায়িন মেইড পাঠিয়েছে। কিন্তু অত্যাশ্চার্য বিষয়, এতে সে রীতিমতো বিরক্ত হয়েছিল। তার জবান স্বীকার না গেলেও অন্তরাত্মা স্বীকার যায়, সে চেয়েছিলই জায়িনের আগমন। কিন্তু সময় যেতে যেতে একটা সময় বুঝতে পারল সে, জায়িন আজ তার আশেপাশেও নেই। এতে অবশ্য তার সুবিধা হলেও সন্ধ্যার পর থেকেই হঠাৎ করে অস্থিরতা বাড়তে থাকে তার৷ নেশার চাহিদা যেন সে আজ কোনোভাবেই দমিয়ে রাখতে পারছে না। রাতের খাবার দিতে আসা মেইডের জন্য সে অপেক্ষা করতে থাকল।
রাত দশটা পেরিয়েও কোনো মেইডের দেখা না পেয়ে রাগটা ক্রমশ বেড়ে গেল। ঘরে ভাঙচুর করার মতোও কোনো আসবাব নেই। জায়িন যেন আগে থেকেই সবদিক থেকে সর্তক ছিল আগেভাগে। তাই এক বিছানা ছাড়া কোনো প্রয়োজনীয় আসবাব সে রাখেনি এ ঘরে। দরজার ওপর ক্ষুধার্ত, হিংস্র বাঘের মতো আঘাত করতে থাকল সে। চিৎকার করে ডাকতে থাকল, ‘ওপাশে আছ কে? আমার প্রয়োজন তোমাদের কাউকে।’
কারও সাড়া নেই। আয়মান বুঝে গেল, জায়িনের নিষেধাজ্ঞাতেই তার ঘরে কেউ আসবে না। তাতে রাতে না খেয়েও তাকে থাকতে হতে পারে আজ। কিন্তু তাকে একা ছেড়ে জায়িনের কোথাও যাওয়ার কথা নয়। এই ঝুঁকিটা তো সে সুস্থ মস্তিষ্কে নেবে না। তাহলে কি বাইরে এতটাই কড়া নিরাপত্তা বসিয়েছে সে?
সত্যি সত্যিই সারা রাতে তাকে একজনও খাবার দিতে এল না। তার ক্ষুধাটা হয়তো রাতের খাবারের জন্য নয়। ছিল নেশার ক্ষুধা৷ শরীর যেন তার দুর্বল হয়ে এল এক রাতেই। সে রাতে জায়িনও এল না। বিছানার ওপর হাত পা ছড়িয়ে এলোমেলোভাবে শুয়ে রইল সে। চোখের দৃষ্টিতেও সব ঝাপসা লাগছে তার। বিড়বিড় করে জায়িনকে গালি দিতে দিতে ঘুমে তলিয়ে গেল এক সময়।
খুব ভোরে চোখ মেলে তাকাতে হলো কারও স্পর্শে। জায়িন তাকে উঠিয়ে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে বলছে, ‘স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অপশন হয়তো নেই আমার। তাই বলে কি কাউকে ভালোবেসে তাকে নিয়ে বাঁচার অধিকার নেই? আমি তোমাকে সত্যিই খুব চাই, মান। আমাকে মেনে নাও। নয়তো যে তোমাকেও টর্চার করতে হবে আমায়।’
আয়মান একটুও নড়ল না। বুকের ভেতরেই মুখটা গুজে প্রশ্ন করল সে, ‘টর্চারটা কীভাবে করবে জায়িন?’
-‘হয়তো তোমার কল্পনারও বাইরে।’
-‘বিয়েটা আমি করব না, নক্ষত্ররাজ।’ কেমন সুর তুলে বলে উঠল সে কথাটা।’
কিন্তু জায়িন যেন একেবারেই মজা করার মেজাজে নেই। আয়মানের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘আমার অতি জঘন্য একটা বৈশিষ্ট্য আছে। যে জিনিসে একবার চোখ যায়, তা নির্দয়ভাবে হলেও জয় করি। অন্যের হলে তা ছিনিয়ে নিই। বলা যায় অন্যের মুখের খাবারও শিকার করার গল্প আছে আমার৷ কিন্তু তোমার বেলাতে তা ভিন্ন। সুস্থচিত্তে আমি পারব না তোমাকে শারীরিকভাবে আঘাত করতে। কিন্তু সত্য হলো, সেই তোমাকে পেতেই তার থেকেও কষ্টদায়ক আঘাত তোমাকে করতে হবে আমার। যদি আমায় মেনে না নাও।’
ওর বুকের মাঝ থেকে সরে এল আয়মান, জিজ্ঞেস করল, ‘গতকাল ছিলে কোথায়? আমার খোঁজটা নেওয়ার সময় পাওনি!’
মুচকি হাসল জায়িন, ‘আমার শালিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। অবস্থা ভালো এখন।’
-‘এতটাই টর্চার করেছিলে?’
-‘চাইনি। কিন্তু বাধ্য করেছিল সে।’
-‘হঠাৎ এখানে আনলে যে ওকে? কী কারণ?’
-‘তোমার সর্বনাশ করতে।’
কথাটার সুর যেন কেমনই ছিল। যেন সত্যিই সামনে ভয়ানক কিছু ঘটতে চলেছে আয়মানের সঙ্গে। আর আয়মানও তা টের পাচ্ছে৷ নিজের বিপদের আগাম ইঙ্গিত সে যেন কীভাবে টের পায়।
-‘কী করতে চাইছ তুমি?’
-‘আপাতত খুব শীঘ্রই বিয়ে।’
-‘আমার বোনকে নৃশংসভাবে আঘাত করেছ, জায়িন। সেই রাগটা এখনো দমিয়ে রেখেছি। আমাকে আর খেপিয়ে তুলো না। সব থেকে খারাপটাই হবে তাহলে তোমার সঙ্গে।’
-‘বোনকে মারার জন্য রাগটা এই প্রথমবার দেখছি তোমার চোখে। মানে ব্যাপারটা এমন, তুমি মারবে কাটবে, তুমি ক্ষতি করবে। কিন্তু অন্যের বেলায় তা মেনে নেবে না। তাই তো?’
-‘এক্সাক্টলি। কিন্তু সেটাও আমি ভুলে যাব। যদি আমাকে ছেড়ে দাও।’
বিছানা ছেড়ে জায়িন উঠে পড়ল, আলতো হেসে বলল, ‘গতকাল রাতে ইচ্ছে করেই অভুক্ত রেখেছিলাম তোমায়। কারণটা নিশ্চয়ই জানো। চাইনি কোনো নিরপরাধ তোমার হাতে প্রাণ হারাক। নেশাটা ত্যাগ করার অভ্যাস করতে হবে তোমায়।’
ঘরের আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করল আয়মান, ‘ক্যামেরাগুলো কোথায় কোথায় বলো তো?’
-‘খুঁজে নিয়ো। আসছি একটু পরই, তোমার খাবার নিয়ে।’
_______________
আলিয়ার বেডের পাশেই উৎসুকভাবে তার দিকে চেয়ে বসে আছে রেজা। তার ভারি রাগ হচ্ছে এই ভেবে, এত বেশি তেজ কেন থাকবে একজন মেয়ের? তাও আবার অসহনীয় আঘাত পাবার পরও? এটুকু সে বুঝতে পেরেছে, জায়িন ছাড়া আলিয়াকে সোজা করা বেজায় মুশকিল। অধৈর্য গলায় সে বলে উঠল, ‘তাহলে আপনি শুয়েই থাকুন। স্যার এসেই না হয় আপনাকে আদর করবে। তখন যদি মুখ খুলতে ইচ্ছা হয়।’
কপালের ওপর হাত ফেলে সিলিঙের দিকে চেয়ে আছে আলিয়া নিরুদ্বেগ চেহারায়। রেজার কথাগুলো কানে বাজতেই সে ঘাড় ফিরে তাকাল ওর দিকে, ‘মানকে কোথায় রেখেছে, জায়িন?’
-‘আমার প্রশ্নের জবাব নেই। অথচ নিজে প্রশ্ন করছেন?’
-‘আমাকে সহজে মুক্তি দিয়ো না তোমরা। প্রয়োজনে মেরে ফেলো৷ একবার ছুটে গেলে জায়িন, মান কেউ-ই শান্তি খুঁজে পাবে না আর।’
দরজার মুখে এসেই কথাটা শুনতে পেল জায়িন। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সে বলল, ‘এমনিতেও শান্তিতে নেই। তোমাদের দু’বোনের মতো আজ পর্যন্ত কোনো ঘাড় তেরিয়া মেয়ে দেখিনি আমি। আর তুমি ডায়লগ ছাড়ছ ভালো কথা৷ তাই বলে বেডে শুয়ে শুয়ে? ছুটে গিয়েও এমন থ্রেটগুলো দিলে ভয় পেতাম।’
রেজা চেয়ার থেকে উঠে পড়ল আলস্য ভঙ্গি নিয়ে, ‘আমি একটু ঘুরে আসি স্যার। ভালো লাগছে না আর এই একজনের মুখ দেখতে দেখতে।’
এই প্রথম রেজার কথা শুনে জায়িনের সাংঘাতিক হাসি পেল। আলিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল, কটমট করে চেয়ে আছে রেজার দিকে। হাসিটা আটকিয়ে সে রেজাকে বলল, ‘ভালো একজন লেডি সাইক্রিয়াটিস্টের প্রয়োজন, রেজা।’
-‘পুরুষ কেন নয়, স্যার?’ চোখে মুখে দুষ্টুমি ভাব রেজার।
জায়িন কপাল কুঁচকে ফেলল, ‘মজা কোরো না তো। মোটেও আমার জন্য বলছি না। পুরুষের সঙ্গ মানেই আয়মানের মাথা গরম করে দেওয়া। এখন অবধি যথেষ্ট শান্ত আছে সে।’
-‘চিন্তা করবেন না স্যার। যে ক’টা দিন আছি, প্রত্যেকটা ঘণ্টায় কাজে ব্যয় করব। আসছি এখন।’
সে বেড়িয়ে যেতেই জায়িন চেয়ারটাতে বসে আলিয়ার ডান হাতটা নিজের দু’হাতের মুঠোতে ধরল, হাতের আঙুলগুলো নিয়ে বাচ্চাদের মতো খেলতে খেলতে বলল, ‘কখনো ভেবেছ একজন মানুষকে দু’চোখ ছাড়া, নাক ছাড়া, কান ছাড়া, দুই ভ্রু ছাড়া, চুল ছাড়া, হাত পায়ের আঙুল ছাড়া কেমন দেখা যায়?’
প্রশ্নটা ছুঁড়ে আলিয়ার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাল। আলিয়া বলল, ‘যদি মান অনায়াসেই তোমাকে মেনে নিতো, আমি সম্পূর্ণভাবেই তোমাকে হেল্প করতাম। বুঝতে পারছ না তুমি। আমি কেন তোমায় হেল্প করছি না।’
-‘ক্রোধ, হিংসা, আক্রোশ। এই তিনটাই মূল কারণ। মানকে নিয়ে তোমার খুব চিন্তা। এ কথা আমায় বিশ্বাস করতে বোলো না।’
-‘কী করলে বিশ্বাস করবে? ও আমার বোন। এই বোন ওয়ার্ডটার জন্যই ওর প্রতি আমার কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও মায়া আছে। তবে এটা সত্যি। আমার আজকের এই পরিণতির জন্য ও দায়ী। যার জন্য ওকে আমি ছেড়ে দেবো না।’
-‘তোমার হয়ে না হয় আমিই ধরব।’ হাসতে হাসতে বলল জায়িন।
সেই হাসিটার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আলিয়া বলে উঠল, ‘কত সুন্দর এই হাসি। আর এটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়াল।’
-‘তোমার এই পরিণতির জন্য তুমিই দায়ী। একজন স্বার্থপর আর বিশ্বাসঘাতক তুমি। শাস্তি তো তোমার প্রাপ্য ছিলই। জানে মারিনি, তা কি তোমার ভাগ্য নয়?’
-‘সে তো অবশ্যই। আমাকে মুক্তি দাও। আমি মুক্তির আগে তোমাকে সবটা জানাব ওর ব্যাপারে।’
-‘আমিও না চাই, তুমি নিজের ক্ষমতা দেখাও আমাকে। আটকে রেখে আসলেই মজা উপভোগ করতে পারছি না আমি।’
-‘কথা দিচ্ছ তবে?’
গম্ভীরভাবে সম্মতি জানাল জায়িন তার প্রশ্নে। শোয়া থেকে উঠে বসল আলিয়া। জায়িনের মুখোমুখি বসে ফিচেল গলায় বলল, ‘আমাকে একটা রাত ডেডিকেট করো, জায়িন।’
জায়িন ঠোঁট টিপে হাসল, ‘তোমার আমার মিলটা ঠিক এই জায়গাতে বলেই এখনো তোমাকে সুস্থ রেখেছি।’
-‘আমি সত্যিই অপেক্ষাতে থাকব। তোমাদের বিয়ের পর হলেও আপত্তি নেই আমার।’
চেয়ারে গা এলিয়ে বিছানাতে পা দু’টো সটান তুলে দিয়ে বসল সে।
-‘এখন তো শুরু করো। আর কত সময় নেবে? রেজার মতো মানুষও ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে তোমার কাছে এসে। ভাবতে পারছ কী পরিমাণ জ্বালাচ্ছ?’
আলিয়া কিছুক্ষণ চুপ থাকল। চোখদু’টো আঙুল দিয়ে ডলে তারপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল জায়িনের দিকে, ‘ও একজন মানসিক রোগী। এটা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছ এত দিনে। মানসিক সমস্যাটা শুরু হয়েছিল ওর পনেরো বছর বয়স থেকেই। মানে জেল থেকে ছাড়া পাবার পরই। তবে সেটা আমরা ধরতে পারিনি কেউ। একুশ বছর বয়সে এয়ারপোর্ট থেকে ওকে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে অ্যারেস্ট করে। দীর্ঘ ন’মাস জেলে ছিল। যে টর্চারটা ওকে করা হয়েছিল তা শুধু ওর শারীরিকভাবেই ক্ষতি হয়নি, মানসিক সমস্যাটাও হয়ে যায় খু্ব। সুস্থ হওয়ার পরও জেলে থাকতে ওই টর্চারের মুহূর্তগুলো ও ভুলতে পারত না। আর সেটাই ওকে ভয়ঙ্কর করে তোলে। টেরোরিস্ট না হয়েও যে শাস্তিটা ওকে ভোগ করতে হলো, সেটাই ও জীবনের এক মাত্র লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়। ড্রাগস, মার্ডার, মানি, এসব ওর কাছে ভাত মাছ হয়ে যায়। ওকে হেল্প করার জন্য আমাকেও ওর মতো হতে বাধ্য করে। মানে ওর হাতে সাংঘাতিক মারধোর খেতে হয়েছিল আমায়। ওই সময় ও এত বেশি ভায়োলেন্ট হয়ে গিয়েছিল, যে আমি ওকে হেল্প না করতে চাইলে ও আমাকেও মার্ডার করতে ভাবত না। ওকে কাবু করার এই একটাই দিক। সেই সময়ের টর্চার সিনগুলো পুর্নবার ওর সামনে তুলে ধরা। এতে হয়তো তুমি ওকে কাবু করতে পারবে। কিন্তু অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে এতে।’
-‘মস্তিষ্ক পুরোপুরি বিকৃত হয়ে যেতে পারে?’
-‘হুঁ।’
-‘এতে তো তোমার খুশি হওয়ার কথা।’
-‘তুমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছ না আমার কথা৷ ভাবছ, আমি মন গড়া কথাগুলো বলছি?’
-‘হতেও তো পারে৷ যে তুমি ওকে খুন করতে চেয়েছ বহুবার, সেই তুমি ওর ক্ষতি হলে খুশি হবে না?’
-‘রাগের বশে আমরা দু’জনই দু’জনকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছি। কিন্তু আমি ওর মৃত্যু চাই না। আর এটাও চাই না, ও মানসিক ভারসাম্য হারাক। যেভাবে আছে, ওকে সেভাবে ভালো থাকতে দাও জায়িন।’
-‘তোমাদের দু’বোনের দু’জনের প্রতি দু’জনের টানটা আছে খুব। কিন্তু সেটা খুব অদ্ভুত। ওর মানসিক অবস্থাটা আমি যতটুকু বুঝেছি, তাতে ও ক্ষণিকের জন্য হঠাৎ হঠাৎ স্বাভাবিক ভারসাম্য হারায়। কিন্তু পুরোপুরি ভারসাম্য হারানোর চান্স নেই।’
-‘আমার কাছে মনে হয়।’
-‘তোমার মনে হওয়াকে আমি গুরুত্ব দিচ্ছি না।’
-‘তোমার ইচ্ছা।’
-‘আমি ওর প্রধান উইকনেস জানতে চাই আলিয়া।’
কঠোর সুরে বলে উঠল জায়িন। তার চেহারাতেও রাগটা ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে। আর কোনো অত্যাচার সহ্য করতে চায় না আলিয়া। এবার সে সত্যিই মুক্তি চায়। শুকনো ঠোঁটজোড়া জিহ্বার ডগা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে কয়েকবার ঢোঁক গিলল।
-‘কসম জায়িন। আয়মান বুঝে যাবে আমিই জানিয়েছি তোমায়। হয়তো সেদিন ও আমায় সত্যিই খুন করতে চাইবে।’
ধমকে উঠল জায়িন, ‘নাটক বন্ধ করো আলিয়া। নয়তো আমিই তোমাকে খুন করে ফেলব।’
কথাটা শেষ হতেই আলিয়া এক নিঃশ্বাসে বলে দিলো, ‘আমাদের বায়োলজিক্যাল ফাদার। যার অস্তিত্ব নেই বলেই জানে সবাই। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন। আয়মান সবার থেকে তাকে লুকিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে।’
সিন্ধু ইগল – (৩০)
শেষ অংশ
ইসরাত জাহান দ্যুতি
সব কিছু যেন এখনো ধোঁয়াশা। এমন একটি গল্প আছে আয়মান, আলিয়ার জীবনে যা পরিপূর্ণ না জানা অবধি কোনো সমাধানে নামতে পারছে না জায়িন। আজ তার কাছে চূড়ান্তরূপে স্পষ্ট। তার জীবনের থেকেও বহুগুণ জটিল এই দু’বোনের জীবন। আলিয়ার বলা তথ্যগুলো জানার পরও কিছু একটা ক্ষুদ্র ফাঁক রয়েই গেছে। জেল থেকে মুক্তির পর পাঁচ কি ছ’মাস আয়মানের সঙ্গে কারও যোগাযোগ ছিল না। বলা যায় করতে পারেনি কেউ। ওই সময়টার পরই আয়মান একাকী জীবন বেছে নেয়। ধীরে ধীরে তৈরি করে নিজেকে সন্ত্রাসী রূপে। কিন্তু মাঝের ওই মাসগুলো নিজেকে কোথায় এবং কেন গোপন রেখেছিল সে? এটুকু পরিষ্কার, এই সন্ত্রাস দুনিয়াতে আয়মান নিজে থেকে প্রবেশ করেছে। সে কোনো প্রকার বাধ্য হয়নি বা তাকে কেউ টেনে আনেনি। আর তার নরক দুনিয়াতে নিজের বোনকেও সামিল করেছে সে। এটা কি শুধুই তার প্রয়োজনের স্বার্থে? না পুরোটাই প্রতিশোধ থেকে? তা ঠিক স্পষ্ট নয় জায়িনের কাছে৷ আয়মানকে কেন সন্দেহ করা হয়েছিল সন্ত্রাসবাদী হিসেবে? তখন আয়মানের বাবাই বা কোথায় ছিলেন? তাকে লুকিয়েই বা কেন রাখতে হচ্ছে সবার থেকে?
আয়মানের পূর্বেই আলিয়াকে লন্ডন পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আঠারো বছর বয়সে। তাহলে আয়মানকে কেন তখন দেশে রাখা হয়েছিল? দু’বোনের জীবন পরিচালনায় এত ব্যবধান কেন? জায়িনের মনে পড়ল, স্কুলেও আয়মান আর আলিয়া একত্রে আসত না। হয় আগে আয়মান আসত স্কুলে নয় আলিয়া। তখন এত কিছু নিয়ে ভাবেনি সে। আর এসব বোঝার মতো বয়সটাও তখন ছিল না। আলিয়া তার বাবার সন্ধান জানালেও সেই বাবার প্রতি তার বিশেষ কোনো টান সে দেখতে পায়নি ওর মধ্যে। এদের পারিবারিক ইতিহাসটা খুব রহস্য রহস্য লাগে। অথচ আয়মানের যে বাবার প্রতি খুব ভালোবাসা আছে, এটা তো বোঝায় যায় সারা দুনিয়ার থেকে তার বাবাকে লুকিয়ে নিরাপদে রাখায়। আচ্ছা আদৌ কি আয়মানও তার বাবাকে ভালোবাসে? কেননা বর্তমান আয়মানের চরিত্রকে মনস্টারের সঙ্গেও তুলনা করলে ভুল হবে না। তার মাঝে কোনো মানুষের জন্য দুর্বলতা থাকা খুবই আশ্চর্যজনক। প্রশ্ন রয়ে যায় হাজার হাজার৷ যা সাজাতে লাগলে প্রশ্নের সাগরে ডুবতে হয়। তবে যত প্রতিকূলতাই থাকুক, একটা সুন্দর জীবনের জন্য আয়মানকে খুবই প্রয়োজন জায়িনের। তাই প্রথম কাজটাই হলো আয়মানকে স্থায়ী ও বৈধভাবে নিজের জীবনে জড়ানো৷ তারপর ওর চিকিৎসা। আর তারপর সব থেকে জরুরি হলো আয়মানের সন্ত্রাসবাদী জীবনের অবসান ঘটানো। তার জন্য যে কোনো ধরনের ঝুঁকি আর চুক্তি করতেও সে রাজি। টাকায় যদি সুখই না অর্জন করতে পারে, তবে সেই টাকায় হবেটা কী?
____________
নিজের জবান ঠিক রাখতে আলিয়াকে সত্যিই মুক্তি দিলো জায়িন। তবে যাবার পূর্বে আলিয়া বেশ রাগিয়েই দিয়ে গেছে তাকে। জায়িনকে বলা তার শেষ কথাটা ছিল, ‘আমার বিশ্বাস, খুব শীঘ্রই মানও মুক্তি পাবে তোমার থেকে।’
খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই বলে গেছে কথাটি আলিয়া। এই কথার বিপরীতে জায়িন কঠোর কোনো আঘাত করতেই পারত ওকে। কিন্তু আলিয়াকে আঘাত করার থেকেও অতি জরুরি ওকে চোখে চোখে রাখা। ওকে তো মুক্তি দেওয়া হয়েছে এ কারণেই। ওর পদক্ষেপ আর ওর স্বাধীন সময়কে নজরবন্দি রাখার মাধ্যমেই অজানাকে জানা আর ওদের বাবার সঠিক সন্ধান জানা হবে। কারণ, আলিয়া এতটাই ধূর্ত! তাকে সবটা জানিয়েও যেন আবার সবটাই আড়ালে রেখে গেছে সে।
সারাটা দিন রেজাকে নিয়ে আলিয়ার গতিবিধি লক্ষ রাখতে রাখতে আজ জায়িন তার সব থেকে বড়ো ভুলটাই সম্ভব করে ফেলল। যে ভুল আর শুধরানোর সুযোগটাও রইল না। সন্ধ্যার সময় আকস্মিক কলটা আসতেই তার অনুস্মরণ হয়, আয়মানকে আজ সে একটুও নজরে রাখেনি। বাসার সামনে এসে পৌঁছতেই দেখে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ, আশেপাশের মানুষের ভীড় জমে গেছে। আয়মানকে দেখা শেষ মুহূর্তটা চোখে ভেসে উঠল তার। ওর শেষ কথা, শেষ দৃষ্টি বিনিময়, ঠোঁট চেপে ধরে শেষ হাসিটা মনে পড়তেই দু’চোখ ঝাপসা হতে থাকল। চারপাশে আঁধার পুরোপুরি দেখার পূর্বেই পাশে ভয়ার্ত আর বিস্মিত অভিব্যক্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা রেজার কাঁধ চেপে ধরল সে। মুহূর্তেই চমকে উঠে রেজা পাশ ফিরে চেয়ে জায়িনকে দেখে আরও বেশি আঁতকে উঠল। দ্রুত জাপটে ধরল ওকে, ‘বি স্ট্রং স্যার! আয়মানের কিছু হয়নি। বিশ্বাস রাখুন।’
কথাটা কানে বাজলেও নিজেকে শক্ত করতে পারছে না জায়িন। দু’জন পুলিশ এগিয়ে এল। তাদের দেখে জায়িন উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ভেতর থেকে কাউকে উদ্ধার করা গেছে?’
-‘এখন অবধি না। আপনি ঠিক আছেন?’
রেজা গাড়ি থেকে পানির বোতল এনে দ্রুত পানি এগিয়ে দিলো জায়িনকে। কয়েক ঢোঁক পানি গিলে একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলাল সে। মোবাইলটা বের করে আয়মানের দুপুরের খাবার খাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়টুকুই শুধু দেখতে পেল। তারপর আর কিছু দেখা গেল না৷ ক্যামেরাগুলো নষ্ট করে দেওয়া হয়েছো। রাত এগারোটা অবধি চলল বাড়ির আগুন নেভানোর কাজ। ভেতর থেকে পোড়া লাশগুলো উদ্ধার করা গেছে। নিরাপত্তা কাজে যারা নিযুক্ত ছিল, তারা এই দুর্ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই বিস্ফোরণ ঘটে যায় ভেতরে। এতে কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড নিহতও হয়। বাকিরা অতি দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসে। রেজার বিশ্বাস, এই লাশগুলোর মাঝে আয়মান নেই। জায়িনেরও বিশ্বাস এমনটাই। তবুও আয়মানকে হারানোর একটা নিদারুণ ভীতি যন্ত্রণা তাকে অসুস্থ বানিয়ে রেখেছে।
লাশগুলো চিহ্নিত করার পর জায়িন পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারে। রেজা তাকে সামলাতেই ব্যস্ত। তাই বাকি দিকে নজর দিতে পারছে না সে। তবে জায়িন এর মাঝে তার বন্ধুদের অবগত করে ফেলেছে। খুব শীঘ্রই তারা আসছে আবার মেলবোর্ন। আলিয়ার শেষ কথাটা অনবরত কানে বেজে চলেছে জায়িনের৷ ওর কথা মনে আসতেই জায়িন রেজাকে সতর্ক করল আলিয়ার ব্যাপারে। পুলিশের সঙ্গে কথা শেষ করে স্পট থেকে চল এল ওরা৷ সমস্ত টেনশন ছেড়ে আলিয়াকে নজরে রাখার কাজটাই মনোযোগ সহকারে করতে থাকল। জায়িন অবশ্য অপেক্ষাতে আছে, আয়মানের একটা ফোন কলের আশায়। এও তার বিশ্বাস, খুব তাড়াতাড়ি আয়মান তার সাথে কথা বলবে। কী করে অগ্নিকাণ্ড ঘটাল সে? আর তার এই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় জানার পর জায়িন এই মুহূর্তে কেমন বোধ করছে? এটুকু জানতে হলেও আয়মান তাকে কল করবে। কিন্তু তা কখন? তার যে আর ধৈর্য মানছে না।
(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের সমাপ্তি)