সিন্ধু ইগল – (৩)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
৭
খুব মনোযোগের সঙ্গে জাকির জামাকাপড়সহ সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস প্যাকিং করে নিচ্ছে। কোথাও কিছু থেকে গেল কি না, তার জন্য বারবার চেক করে নিচ্ছে গুছিয়ে রাখা ব্যাগগুলোও। জায়িন হঠাৎ এসে দুম করে তার বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। কাজে এত বেশি মনোযোগী ছিল জাকির, কখন যে ঘরে ঢুকেছে জায়িন তা সে টেরও পায়নি। অমন করে ধপাস আওয়াজে জায়িনকে শুয়ে পড়তে দেখে খানিকটা চমকেই গিয়েছিল সে। তাই খানিকটা রাগ গলায় বলে উঠল ওকে, ‘এই শয়তান! আসার সময় নক করে এসেছিস?’
-‘তোমার ঘরে নক করে আসার মতো কোনো কিছু না কি?’
-‘না থাকল, তাও এটা একটা ম্যানার।’
কথাটা শুনে জায়িন চোখ বন্ধ অবস্থাতেই হাসতে থাকল। জাকির ছোটো ভাইয়ের সেই হাসিটা দেখে আর রাগ দেখাতে পারল না। একটা হতাশার নিশ্বাস ফেলে আবার গোছগাছে মনোযোগ দিলো। জায়িন জিজ্ঞেস করল, ‘কাল কয়টায় ফ্লাইট ভাইয়া?’
-‘তা জেনে তুই কী করবি? তুই কি সি অফ করতে যাস?’
-‘কোনোদিন যাবও না।’
-‘তাহলে জেনেও লাভ নাই।’
-‘তুমি না বললেও আমি জেনে যাই তো।’
জাকির আর কোনো কথা বলল না। জায়িন কিছুক্ষণ নিরব থেকে হঠাৎ বলল, ‘আজ রাতে আমি তোমার কাছে ঘুমাব ভাইয়া। তোমার আপত্তি আছে?’
-‘আপত্তি থাকলেও বুঝি তুই মানবি?’ মৃদু হাসতে হাসতে জবাব দিলো সে। আর জায়িন তা না দেখেও বুঝতে পারল, তার ভাই হাসছে। তার জন্য সেও হেসে উঠল।
-‘তা আজ হঠাৎ এত খুশি কেন? বউ চলে গেছে তোর। তোর তো এখন দেবদাস-এর রূপে থাকার কথা।’
নির্বিকার সুরে জায়িন বলে উঠল, ‘আমি আজ আবারও একটা খুন করেছি ভাই।’
কথাটা শুনে মুহূর্তেই আঁতকে উঠল জাকির। কিছুটা বিস্মিত চোখে চেয়েও ছিল জায়িনের দিকে। পরক্ষণেই কী ভেবে আবার আগের মতো কাজে মন দিলো। বলল, ‘এটা তো তোর পেশার অন্তর্ভুক্ত। এ আর নতুন কী?’
জায়িন ঈষৎ হাসল। বলতে চেয়েও বলতে পারল না, ‘এটা আমার পেশার বাইরে আঠারো নাম্বার খুন, ভাইয়া।’
জায়িনকে নিরব হয়ে যেতে দেখে জাকির জিজ্ঞেস করল, ‘তোর মন খারাপ হচ্ছে না মৌপ্রিয়ার জন্য?’
জায়িন প্রশ্নটা এড়িয়ে পালটা প্রশ্ন করল, ‘না গেলে হয় না ভাইয়া?’
-‘না হয় না। কী করে হয়? আমি কি এখন এ দেশের নাগরিক?’
-‘তাহলে আমাকে কেন হতে দিলে না ওখানকার বাসিন্দা?’
-‘তোকে ওখানে নিয়ে যাওয়াটাই আমার জীবনের সব থেকে বড়ো ভুল ছিল।’
-‘লিন্ডাকে বিয়ে করার থেকেও বড়ো ভুল?’
জাকির এবার একটু রেগে গেল, ‘তোকে না বলেছি এই প্রসঙ্গে কখনো কথা তুলবি না! ও মরে যাওয়ার সাথে সাথে ওর অস্তিত্বও আমার জীবন থেকে শেষ।’
-‘ওকে, লাস্ট একটা প্রশ্ন। কখনো ওর খুনীদের শাস্তি দিতে মন চায় না তোমার?’
জাকির কিছুটা থমকে গেল এ প্রশ্নে। জায়িনের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আবার পূর্বের কাজে মনোযোগ দিলো। ভাইকে গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে জায়িনও আর কোনো কথা বাড়াল না।
গোছগাছ শেষে বেশ ক্লান্ত চেহারায় জাকির বিছানাতে এসে বসল, দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে। জায়িন ভাইয়ের দিকে একবার চেয়ে জলদি উঠে পাশের সেন্টারটেবিল থেকে পানির গ্লাস এনে এগিয়ে দিলো ভাইকে। বলল, ‘বয়স তো কম হচ্ছে না। এবার তো নিজের খেয়াল রাখার মতো কাউকে আনো।’
জাকির তিন নিশ্বাসে পানিটুকু খেয়ে বলল, ‘জাকিরের খেয়াল জাকির নিজেই ভালো রাখতে পারে।’
জায়িন আরও বহু আগেই বুঝে গেছে। তার সব থেকে প্রিয় ভাইটা এ জীবনে আর দ্বিতীয় বিয়ে নামক সম্পর্কে জড়াবে না। তবুও মাঝে মাঝে ভাইকে লিন্ডার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার মনের ভেতরের কষ্টগুলো বের করে আনতে চায় সে। কিন্তু সেই চেষ্টাটা সব সময়ের জন্যই ব্যর্থ হয়।
হঠাৎ জায়িনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জাকির বলল, ‘আর তুই এই সব ভোল কবে ছাড়বি?’
-‘কোন সব?’
-‘এই যে ফর্সা চামড়াটাকে কালো বানিয়ে রেখেছিস। দেখা যায় কেমন তোকে? এমনিতেই আব্বা তোর ওপর চটে থাকেন। তার ওপর এইভাবে ওনার সামনে ঘোরাফেরা করলে কখন না যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেন।’
-‘আব্বার কথা ছাড়ো। আমার কোন জিনিসই বা তার পছন্দ! কিন্তু ললনারা যে এই চামড়াতেই মরে। আসল চামড়াতে আসলে কী করবে ভাবো একবার!’
বলেই খিকখিক করে হেসে ফেলল জায়িন।
-‘তুই কার মতো হয়েছিস বল তো? আমাদের বংশে শুনেছি আমাদের দাদার আব্বা ছিলেন কিছুটা তোর মতো। কিন্তু তিনি কোনো সময় অবৈধ মেলামেশা করেননি। ওনার স্ত্রীর সংখ্যা নাকি গুনে শেষ করা যাবে না। ছিলেন তো ভবঘুরে। দেশের যে প্রান্তে গেছেন সেই প্রান্তেই একটা করে বিয়ে করে এসেছেন। কখনো কাউকে বাড়িতে তোলেননি। হাজারটা বিয়ে করলেও ঘরের গিন্নি ছিলেন একজনই। মানে আমাদের দাদার আম্মা। কিন্তু তুই যা করে বেড়াচ্ছিস, তাতে তো তোকে আজীবন রিমান্ডে রাখলেও গুনাহ মাফ হবে না।’
জায়িন হাসতে হাসতে বলল, ‘আমাকে পাপী বোলো না। আমি একজন নির্বোধ, নিরিহ প্রেমিক।’
-‘হায়! কেন যে তোকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গেলাম?’ জাকির হতাশার সুরে বলল কথাটি। তারপরই আবার বলল, ‘জাহিদের পাশাপাশি বিজনেসটা সামলা জায়িন। ও কিন্তু তোর বা আব্বার মতো চতুর আর বুদ্ধিদীপ্ত না। ওর ওপর ছেড়ে দিস না বিজনেসটা।’
-‘তাহলে আমার এত সাধের চাকরির কী হবে?’
-‘চাকরি তো করলি কয়েক বছর। বিজনেস করার শখও তো তোর ছিল।’
-‘এখনো আছে। আর খুব শীঘ্রই আমার বিজনেস ওয়ার্ল্ডে পদার্পণ ঘটবে।’
-‘তাহলে চাকরিটা ছাড়ছিস?’
-‘ছাড়ছি, তবে এখন নয়। হাতে একটা নতুন কেস এসেছে। যার জন্যই চট্টগ্রাম থেকে চলে আসা। আর কেসটা ভীষণ জটিল। ঢাকা মহানগর পুলিশের অধীনেই আমাদের একটা ইউনিট গঠিত হয়েছে বছর তিন হলো। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম।’
-‘সিটিটিসি?’
-‘হুঁ, জঙ্গিবাদ দমন আর আন্তঃদেশীয় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে আমাদের এই ইউনিটটা। আর বর্তমান যে কেসের তদন্ত চলছে তা হলো কয়েক মাস হলো বাইরের দেশ থেকে কিছু টেরোরিস্ট ঢুকে পড়েছে এখানে। আশেপাশেই এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমজনতার মাঝে মিশে আছে। খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি না আমরা। এই কেসটার সমাধান ঘটিয়ে তারপর জব থেকে বেরিয়ে আসব।’
-‘যাক, আমার আদরের ভাইয়ের এই একটা দিক প্রশংসনীয় তার চেহারার সাথে।’
জায়িন মিটিমিটি হাসতে হাসতে ভাইয়ের দিকে চেয়ে বলল, ‘জায়িন নিজের সু্বিধা আর স্বার্থ ছাড়া কখনো চলে না ভাই।’
৮
অন্ধকারের কালো চাদর ভেদ করে ধীরে ধীরে স্নিগ্ধ, শীতল ভোরের জন্ম নিতেই মাধু বিছানাটা ছেড়ে লনে চলে এলো। এই সময়ের বাতাসটা গায়ে লাগানো তার দৈনন্দিন অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। আর সেই সাথে শিশিরে ভেজা সবুজ ঘাসের ওপর খালি পায়ে বিচরণ। কিন্তু আজ সে বড্ড বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটাল। ঘাসের ওপর উর্ধ্বমূখী হয়ে শুয়ে পড়ল সে। আজ ভোর হতে দেখবে সে এভাবেই। হঠাৎ কোত্থেকে যেন ওদের দু’বোনের সব থেকে বিশ্বস্ত সঙ্গী বুবন এসে শুয়ে পড়ল ওরই পাশে। ঘাড় কাৎ করে মাধু ওকে একবার দেখে মিষ্টি করে হাসল।
জাদু জগিং স্যুট পরে মর্নিং ওয়াকের জন্য বাইরে এসেই দেখে মাধু আর বুবনকে ঘাসের ওপর পাশাপাশি শুয়ে থাকতে। মাধু চোখ পিটপিট করে আকাশটার দিকে চেয়ে থাকার চেষ্টা করছে। চশমা ছাড়া তাকাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। জাদু এসে দাঁড়াল ওদের মাথার কাছে। মাধুকে লক্ষ করে নিজের চোখের চশমাটা খুলে মাধুর চোখে পরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভোরবেলা যেহেতু উঠিসই, আমার সঙ্গে দৌঁড়াতে যেতেও তো পারিস। একটু স্বাস্থ্য সচেতন হ।’
জবাবে মাধু তার মিষ্টি হাসিটাই দিলো বোনের দিকে চেয়ে। জাদু আর দাঁড়াল না। এক দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল বাংলো থেকে রাস্তায়। মাধু আরও কতক্ষণ ওভাবে শুয়ে থেকে অতঃপর উঠে গিয়ে সকালের নাশতা তৈরি করতে আরম্ভ করল।
নাশতা তৈরি শেষে কুকুরটাকে কিছু খাবার দিয়ে টেবিলে বসে অপেক্ষা করছিল বোনের জন্য। প্রায় দেড় ঘণ্টা হলো জাদু বেরিয়েছে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে মাধু দরজার দিকে তাকাল৷ প্রতিদিন সাতটার মধ্যে চলে আসে জাদু। আজ সাড়ে সাতটা বাজার কাছাকাছি। কিন্তু এখনো ফিরল না সে। ভ্রু কপাল কুঁচকে গেল খানিকটা মাধুর। উঠে দরজার মুখে গিয়ে দাঁড়াতেই জাদু হাঁপাতে হাঁপাতে কর্টইয়ার্ডে এসে দাঁড়াল। প্রশ্ন চোখে কপাল কুঞ্চিত করে চেয়ে আছে মাধু তার দিকে। ফোঁস ফোঁস করে কিছুক্ষণ নিশ্বাস ছেড়ে জাদু এগিয়ে এসে দাঁড়াল, মাধুকে বলল, ‘এমনটা এই এক মাসে হয়নি। মনে হচ্ছিল কেউ লক্ষ করছে আমাকে। কিন্তু সন্দেহজনক কাউকেই চোখে পড়ল না। সোজা রাস্তা ছেড়ে শেষে ভেতরের রাস্তা দিয়ে এলোমেলো দৌঁড়াদৌঁড়ি করে বাসার রাস্তায় এলাম।’
জাদুর কথাগুলো শুনে মাধুর চেহারার অভিব্যক্তি তেমন বদলালো না। তবে মনে হলো সে বিরক্ত হয়েছে কিছুটা। কেমন গম্ভীর গলায় বলল, ‘এভাবে আসার কী দরকার ছিল? সোজা রাস্তা দিয়ে আসলেই বা কী? এখানে আমরা নতুন। মানুষ আমাদের কৌতূহলী নজরে দেখতেই পারে।’
বলেই ভেতরে গিয়ে খাবার টেবিলে বসে পড়ল। জাদু আর দাঁড়াল না। ফ্রেশ হয়ে এসেই বোনের সঙ্গে নাশতা করতে বসে গেল। জাদু খেতে খেতে বলল, ‘এই যে পাশের শেখ বাড়ির আন্টি, বেশ ভালো সখ্যতা গড়েছে আমার সাথে। বেশ কিছুদিন যাই না, কাল হঠাৎ কল করেছিল আমাকে। বলছে, আমাকে নাকি বেশ মনে পড়ছে ওনার। মন মানসিকতা নাকি ভালো নেই তেমন। সময় পেলে যেন দেখা করে একটু গল্পগুজব করে আসি ওনার সঙ্গে। কেমন লাগে তোর ওনাকে?’
মাধু পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে তারপর বলল, ‘ভালো, বেশ ভালো। একটু সহজ সরল গোছের মানুষ। যেতে বলেছে যাবি। একাই তো থাকিস বাসায়। সময় কাটিয়ে আসবি মাঝে মাঝে।’
-‘তাহলে তুই ভার্সিটিতে যাবার পর না হয় দেখা করে আসব। তোকেও তো যেতে বলে।’
-‘আমি তোর মতো অত সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারি না।’
জাদু আর কোনো কথা বলল না। বোনের দিকে একটু শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আবার খাবারে মনোযোগ দিলো।
৯
আজ জায়িন সারাটাদিন বাড়িতেই কাটাবে জাকিরের জন্য। তেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে এখনো ঘুম থেকে জাগেনি। ভাইয়ের পাশেই একদম গা ঘেঁষে ঘুমিয়ে অচেতন। জাকির ফজরের নামায আদায় করে বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে এসে আবার জায়িনের পাশে এসে শুয়েছে। কপালের ওপর হাত ফেলে চোখ বন্ধ করে ছিল। ঘুম আর আসবে না তার চোখে। চোখদু’টো খুলে একবার জায়িনের দিকে তাকাল। ঘুমন্ত জায়িনকে দেখে মনের ভেতরের মেঘের আবরণটা ধীরে ধীরে কেটে গেল যেন৷ ছোটোবেলা থেকেই জায়িন বড়ো ভাই পাগল। বাড়ির সবার ছোটো সন্তান হলেও সব থেকে বেশি বকা আর মার জায়িন খেয়েছে আব্বা-আম্মার কাছে। কারণ, সেই ছোটো থেকেই জায়িন চরম পর্যায়ের দুষ্টু। আর তার দুষ্টুমিগুলোও ছিল ভয়াবহ পর্যায়ের। যার কারণে বাড়ির সবার বকা খেয়ে, মার খেয়ে তার দিন শুরু হতো আর শেষ হতো। কখনো বকা দিতে পারেনি আর গায়ে হাত তুলতে পারেনি জাকির। বাবা-মা ভক্ত থেকে জায়িন বড়ো ভাই ভক্ত এ কারণেই। আর জাকিরও ছোটো ভাইটাকে কলিজার টুকরা ভেবে এসেছে সব সময়। আজও সেই একইভাবে ভালোবাসে সে। জাকির যখন পড়াশোনার জন্য অস্ট্রেলিয়া পারি জমায় তাদের ছোটো চাচার মাধ্যমে, তখন জায়িন সবে এসএসসি পাস করেছে। সে চলে যাবার পর জায়িনের অবস্থা হয়ে গিয়েছিল শোচনীয়। নাওয়া, খাওয়া সব বাদ দিয়ে দিয়েছিল সে ভাইকে না পেয়ে। এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে জায়িন। এই খবর জানার পর জাকির পাগলের মতো দেশে ছুটে আসে। তারপর জায়িন কান্নাকাটি শুরু করে ভাইয়ের সঙ্গে যাবার জন্য। জাকিরও আর পারেনি ছোটো ভাইকে ফেলে যেতে। বহুকষ্টে জায়িনের অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করে ওদের ছোটো চাচা। এরপর জাকিরের সঙ্গেই জায়িনের পড়াশোনা চলতে থাকে ওখানে। কিন্তু জায়িনের গতিবিধি, চালচলন দেখে জাকির ওর পড়াশোনা শেষ হতেই দেশে পাঠিয়ে দেয়। ততদিনে জায়িন এক ভিন্ন চরিত্রের মানুষ হয়ে দেশে ফেরে।
বেলা ন’টা বাজতেই জাকির ডেকে তুলে জায়িনকে। বিছানাতে বসে আলস্য ছেড়ে বালিশের পাশে হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলটা হাতে তুলে নেয়। মোবাইলের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় তার তথাকথিত একজন প্রেমিকার অভিযোগ মিশ্রিত কিছু মেসেজ। তা দেখে কিঞ্চিত হেসে সে রেজাকে কল করে। সঙ্গে সঙ্গেই রেজা কল রিসিভ করে বলে, ‘গুড মর্নিং স্যার। আমি আপনার জেগে ওঠারই অপেক্ষা করছিলাম।’
-‘তুমি কি এখন ঘরে?’
-‘না স্যার, আমি নিচে বসার ঘরে ছিলাম এতক্ষণ। এখন বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আপনাকে দুর্দান্ত একটা সংবাদ জানানোর জন্য অপেক্ষা করছি।’
-‘জলদি জানিয়ে ফেলো।’
-‘আপনার আকাঙ্ক্ষিত মানুষটি আপনাদের বসার ঘরে গল্প করছে আপনার আম্মার সাথে।’
-‘জাদু?’
-‘হ্যাঁ, আন্টিই সম্ভবত আসতে বলেছিল।’
-‘সকাল সকাল খুশি করে দিলো আমাকে আম্মা।’
বলেই কলটা কেটে জায়িন বিছানা ছেড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। ব্রাশ করতে করতে আয়নাতে নিজেকে দেখতে দেখতে ভাবতে থাকল, নিজের স্বরূপেই যাবে না ছলনার রূপেই? কিছুক্ষণ ভাবনার পর নিজের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে ছলনার রূপেই নিজেকে তৈরি করে নাশতার জন্য ঘর থেকে বের হলো। ওদের বাড়িটা আধুনিক মডেলের ডুপলেক্স দো’তলা বাড়ির মতো নয়। তবে বসার ঘরটা ছোটোখাটো ধরনের একটা খেলার মাঠ বলা যায়। সদর দরজায় পা রাখতেই সরাসরি চোখ যায় ওপরে ওঠার সিঁড়ির দিকে। যেটা বসার ঘরের মাঝামাঝিতে। আর ওপরে যাবার পর করিডোর পেরিয়ে সর্বপ্রথম ঘরটি পড়ে মাহতাব শেখ আর জান্নাতি বেগমের। তার দু’পাশে চার-পাঁচটা ঘর। তিন ছেলে তাদের পছন্দমতো ঘরগুলো বেছে নিয়েছে। বাদ বাকি ঘরগুলো ফাঁকাই পড়ে থাকে।
জান্নাতি বেগম ছোটো ছেলেকে সিঁড়িতে দেখে ফুলিকে খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিতে তাড়া দেন। জাদু তখনো ঘাড় ঘুরিয়ে জায়িনের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। জায়িন নাশতার টেবিলে না গিয়ে সরাসরি মায়ের কাছে এসে বসে।
-‘সুপ্রভাত আম্মা। বড়ো ভাই জানাল আপনার নাকি মন ভালো নেই। কী হয়েছে?’
এত সুন্দর কণ্ঠ শুনে জাদু আর না দেখে থাকতে পারল না। জায়িন সিঁড়িতে থাকাকালীনই পায়ের আওয়াজ পেয়েছিল। কিন্তু তাকিয়ে দেখার ইচ্ছা জাগেনি তখন।
জায়িনকে চশমার আড়াল থেকে লক্ষ করতে গিয়ে চোখদু’টো না চাইতেই আটকে গেল জাদুর। ভীষণ মিষ্টি করে হেসে জায়িন কথা বলছে তার আম্মার সাথে। জাদু তাকে আগাগোড়া লক্ষ করতে থাকল। পরনে সাদা পলো টি শার্ট আর কালো কার্গো প্যান্ট। বেশ সৌষ্ঠবপূর্ণ বলিষ্ঠ শরীর। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ নিষ্ঠার সঙ্গে শরীরের সৌন্দর্য বানিয়েছে। জান্নাতি বেগমের কাছে জাদু শুনেছিল একবার, ছোটো ছেলে ডিফেন্সে জব করে। এর জন্যই হয়তো এত ফিটনেস বডি ছেলেটার। দেখে বোঝারই উপায় নেই বয়স বত্রিশ। তবে জাদুর সব থেকে বেশি পছন্দ হলো চুলগুলো। ভারি সুন্দর ঢেউ খেলানো চুল। জাদুর দিকে এখনো সরাসরি তাকায়নি। তাই লম্বাটে মুখটা সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছে না, মুখের ডানপাশটুকু ছাড়া। কারণ, জায়িন আর জাদু জান্নাতি বেগমের দু’পাশে বসা। যার জন্য জাদুর ঘাড় বেঁকিয়ে দেখার উপায় নেই।
কথাবার্তার প্রসঙ্গ আম্মার সাথে জায়িনই বাড়াচ্ছিল। জান্নাতি বেগম শুধু কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করে তার খেয়াল হলো জাদুর কথা তিনি ভুলে গেছেন। মেয়েটি যে পাশেই বসে আছে সেদিকের কথা খেয়াল হয়নি তার, ছেলের সাথে গল্প করতে গিয়ে। জায়িনকে বলে উঠলেন, ‘তোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমি দ্যাখ জাদুর কথা ভুলেই গিয়েছি।’
বলেই জাদুর দিকে তাকালেন, ‘ভীষণ দুঃখিত সোনা, কিছু মনে কোরো না। বয়সের সঙ্গে আমার মনও বুড়ি হয়ে যাচ্ছে।’
-‘ঠিক আছে আন্টি। কোনো সমস্যা নেই। আমি এবার তাহলে উঠি?’
-‘আমার ছোটো ছেলের সঙ্গে আলাপ করে দিই। এই যে এই হচ্ছে আমার সেই দস্যি, বেয়াড়া, চঞ্চল ছেলেটা। যার গল্পই তোমার কাছে বেশি করেছি।’
এতক্ষণে জায়িন সরাসরি তাকাল জাদুর দিকে, ‘আসসালামু ওয়ালাইকুম। মিস জাদু, রাইট?’
জাদু হালকা হেসে সালামের উত্তর নিলো৷ তারপর বলল, ‘আপনার গল্পই আন্টি বেশি শুনিয়েছেন আমাকে। ভাবিনি আপনার সঙ্গে দেখাও হয়ে যাবে।’
হঠাৎ করে জায়িনের মুখের হাসিটা গায়েব হয়ে গেল। তারপর আবার হঠাৎ করেই জাদুর মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে উঠল। আর সেই হাসিতেই জাদু বড়োসড়ো ধাক্কা খেলো। বেহায়ার মতো দৃষ্টি গেঁথে রইল তার জায়িনের মুখের দিকে। পুরো চেহারার মাঝে চোখ, কপাল, ভ্রু, নাক, ঠোঁট, গাল আর চিবুক, সবকিছুরই যেন আলাদা আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে জায়িনের। জাদু সেই প্রতিটা অংশের সৌন্দর্য আলাদা আলাদাভাবেই দেখতে মশগুল হয়ে গেল। এত কিছুর মাঝে তার হঠাৎ চোখ আটকাল জায়িনের চোখদু’টোর দিকে। জায়িন তখন তার দিকে কেমন গম্ভীর, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অথচ মুখটা তার হাসি হাসি। জাদু থমকে গেল দৃষ্টিতেই। হঠাৎ তার মনে হতে শুরু করল, এমন দৃষ্টির সঙ্গে সে এক সময় পরিচিত ছিল। কেমন যেন ভীতিবোধ হলো তার জায়িনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি নত করে ফেলল সে। তার শুধু মনে হচ্ছে এইরকম ভয় তার আরও একজনের দৃষ্টি দেখলে কাজ করত। কিন্তু কিছুতেই তাকে মনে করতে পারছে না সে।
জায়িনের সুমিষ্ট কণ্ঠে চিন্তার ঘোর কাটল জাদুর।
-‘আপনার চশমার পাওয়ার কত জাদু?’
জাদু সচকিত হয়ে জবাব দিলো, ‘মাইনাস ওয়ান।’
কথাটা শুনে জায়িন বাঁকা হাসল। তারপর বলল, ‘ভালো লাগল বেশ আপনার সঙ্গে আলাপ করে৷ মাঝে মাঝে আসবেন আমার আম্মার জন্য। সারা বাড়িতে আম্মার কথা বলার মতো মানুষের অভাব। আপনার সঙ্গ বেশ পছন্দ করেছে আম্মা। আশা করি আমাদের আবার দেখা হবে৷ আল্লাহ হাফেজ।’
জাদুও মৃদু হেসে আল্লাহ হাফেজ জানাল। তারপর জান্নাতি বেগমকে জিজ্ঞেস করল, ‘এর আগে একটি মেয়েকে দেখেছিলাম আন্টি। ও কি আপনাদের বাড়ির সদস্য ছিল?’
মৌপ্রিয়ার কথা মনে হতেই জান্নাতির বেগমের মনটা আবার বিষণ্নতায় ছেয়ে গেল। ন’টা মাসে মায়া জড়িয়ে গিয়েছিল তার মেয়েটার জন্য। কিন্তু ওর অমন অন্যায়টা তিনি একেবারেই মানতে পারেননি। মৌপ্রিয়া চলে যাবার পর থেকেই মনটা তার ভীষণরকম খারাপ হয়ে আছে। মলিন হেসে জবাব দিলেন, ‘না, আমাদের বাড়ির সদস্য নয় সে।’
জাদু আর দু’একটা কথা শেষে ‘আবার আসব’ বলে বিদায় নিলো জান্নাতি বেগমের কাছ থেকে। যাবার সময় আজ তার ইচ্ছাকৃতই নজর আটকাল ডাইনিং টেবিলে বসা মানুষটির দিকে। আর ঠিক সে মুহূর্তেই সেই মানুষটি ফিরে তাকাল জাদুর দিকে। জায়িনের সেই তাকানোর মুহূর্তটুকু ছিল কেমন যেন প্রগাঢ় চাউনি। নিমিষেই ঘায়েল করে দেওয়া চাউনি। এমন বিপজ্জনক চাউনির মুখোমুখি সে কি সত্যিই এর আগেও হয়েছে? কয়েক সেকেণ্ডের জন্য থমকে গেল জাদুর পা, যখন সেই চাউনিতে মিশল মুচকি হাসি। মনে মনে শুধাল সে নিজেকে, ‘এই হাসি আর এই চাউনিকেই কি ভয়ঙ্কর খুনী বলে?’
_________
এডিটেড নয়। ভুলগুলো ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।