সিন্ধু ইগল, পর্ব:২৭+২৮

0
706

সিন্ধু ইগল – (২৭)
ইসরাত জাহান দ্যুতি

যেন খুব নোংরা কিছুর গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে আয়মানের। নাক, মুখ সেভাবেই কুঁচকে ফেলে শীতল গলায় বলে উঠল সে, ‘আমাকে জলদি ছাড়ো! ছেড়ে কথা বলো। তোমার পারফিউম স্মেলটা পছন্দ হলেও তোমার সঙ্গিনীর পারফিউমটা খুবই সস্তা।’
বলতে বলতেই জায়িনের থেকে ছুটে দূরে সরে এসে বসল। চেহারাতে ভীষণ বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘তুমি ফ্রেশ হওনি? রাতে যে স্লাট নিয়ে ঘুমিয়েছ তার গন্ধ শরীরে মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছ!’
-‘আরে ধুরঃ! ফ্রেশ হয়েই এসেছি। শার্টটা চেঞ্জ করা হয়নি। তুমি আমার কাছে এসে বসো তো। অনেক জরুরি তথ্য জানানোর আছে তোমায়।’ সময় অপচয়ে নারাজ। এমন মুখভঙ্গি জায়িনের।
স্বাভাবিক সুরেই আয়মান জবাব দিলো, ‘তোমাকে এখন আমার নর্দমার ময়লা পানির মতো দুর্গন্ধময় লাগছে। গত সন্ধ্যার মতো ঝামেলা না চাও তো দূরেই থাকো।’
জায়িন বক্র দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ফোঁস করে একবার নিঃশ্বাস ছাড়ল। শার্টটা গা থেকে খুলে ত্যক্ত জিনিসের মতো নিচে ফেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হলো? এখন আর সমস্যা?’
-‘প্রচুর সমস্যা। তুমি বুঝবে না আমার ব্যাপারটা।’
হাতের ছবিগুলো বিছানাতে ফেলে দিলো জায়িন এবার। কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘এবার কী সমস্যা বলো? তোমার সমস্যার আগে সমাধান করি।’
-‘আমার সমস্যার সমাধান তোমাকে করতে হবে না। তুমি ছবিগুলো আমার হাতে দাও। কাকে ফ্লোগিং দিতে হবে আমি দেখছি।’
কথাটা শোনার পর জায়িন কী মুখভঙ্গি দেবে বুঝতে পারল না। আবার হাসতে গিয়েও থেমে গেল। কিন্তু জিজ্ঞেস করল, ‘ইন্টিমেসি ব্যাপারটাতে তোমার এই ফোবিয়া টাইপ এক্সপ্রেশন কেন?’
-‘ফোবিয়া টাইপ নয়। এটাকে ফোবিয়াই বলা চলে৷ ইন ফ্যাক্ট আমি এদের সঙ্গও অপছন্দ করি। যার কারণে লিয়ার সঙ্গে প্রায় রাতেই আমার ঝামেলা, মারামারি হতো। আর এই তোমার শরীরের কাটাকাটি, সেলাই কি মিশনে গিয়ে পাওয়া? না ক্রাইম করতে গিয়ে? সাদা শরীরে চোখে বাঁধছে বারবার।’
-‘মিশনে গিয়ে। বহুত আছে এসব কাটাছাটা। শুধু গায়ে না। পা, মাথা, সব জায়গাতেই।’
আয়মান তা শুনে একটু হেসে উঠল, ‘ইস! এত যত্নে গড়া সুন্দর শরীরে কত স্পট! খারাপ লাগে তোমার, না? তা শুধু কি এই প্রফেশনের জন্যই ছদ্মবেশে থাকতে? না এই দাগগুলো ঢাকতে?’
-‘আমাকে দেওয়া মিশনগুলো কখনোই সহজ, সাধারণ হতো না। খুবই ক্রিটিক্যাল আর ডেঞ্জারাস হতো। অধিকাংশ সময় আমাকে মেকআপ লুকেই থাকতে হয়েছে। আর এসব দাগ বা স্পট নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। বারবার সার্জারি করে এসব ঢেকে ফেলা কোনো ব্যাপার না আমার জন্য। কিন্তু তার প্রয়োজনবোধ করিনি কখনো। তবে তোমার চোখে বাঁধলে সেটাও করতে রাজি আছি।’
শেষ কথাটাই জায়িনের ফিচেল হাসি দেখে আয়মান জিজ্ঞেস করল, ‘আমার চোখে বাঁধাতে না বাঁধাতে তোমার কী আসে যায়? লিয়াকে নিয়ে ঘুমাতে পেরেছ, এতেই সন্তুষ্ট থাকো।’
-‘তোমার সমস্যাতেই তো আসে যায় আমার।’
বলতে বলতে আবারও আয়মানকে টেনে কাছে আনল। মৃদস্বরে তারপর আদেশ করল, ‘একদম স্থির থাকবে। যাকে দেখবে, দেখার পর তাকে তোমার ফ্লোগিং দিতে ইচ্ছা হয় কি না বোলো।’
রাগ হলেও আয়মান সয়ে গেল জায়িনের সান্নিধ্য। হঠাৎ একটা ছবি তার নজর সম্মুখে পড়তেই মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকাল সেদিকে। তারপরই একই মানুষের আরও কিছু ছবি দেখতে থাকল সে আগ্রহ নিয়ে। জায়িন লক্ষ করে আছে আয়মানের গভীর দৃষ্টিতে। বুঝতে পারছে না সে, আয়মানের স্মৃতিশক্তি এতখানি খারাপ হতে পারে কী করে? যেখানে আলিয়া তাকে চিনে ফেলতে পারল, সেখানে আয়মানের তো আরও বেশি চিনতে পারার কথা তাকে। অথচ সেই ছোটো সময়ের ছবিগুলো দেখার পরও আয়মানের অভিব্যক্তি যেন না চিনতে পারার মতোই। জিজ্ঞেস করে বসল ও, ‘তুমি আমাকে চিনতে পারছ না কেন, আয়মান?’
নজর তুলে তাকাল আয়মান ওর দিকে, ‘স্কুল ড্রেস পরা এই ছবিগুলো তো তোমার টিনএজ সময়ের, তাই না? কিন্তু আমাকে দেখাচ্ছ কেন?’
-‘এমন কিছু বোঝাতে চাইছ তুমি, তোমার নয় দশ বছর বয়সের স্মৃতিগুলো হারিয়ে গেছে?’ উত্তেজিত হয়ে পড়ে জায়িন বলে উঠল। আয়মান হাতের ইশারায় তাকে শান্ত হতে বলে ছবিগুলো আবার দেখতে থাকল। তারপর হঠাৎ করেই কেমন বিস্ময় আর বিষণ্ণ ভরা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘নক্ষত্ররাজ!’
আয়মানের স্তিমিত স্বরে ডেকে ওঠা ওই নামটা শুনে জায়িনের বক্ষঃস্থলে মৃদু স্ফুরণ ঘটল। এগিয়ে গেল ওর আরও কাছে। অভিমানী গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী সমস্যা আয়মান? এত কেন সময় লাগল চিনতে?’
আয়মান বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে একবার ছবি দেখতে থাকল, আরেকবার জায়িনকে। বলে উঠল, ‘এখন তোমার ফেসটা ফ্যামিলিয়ারই লাগছে। আমি আসলে তোমাকে ঠিক ভুলে গিয়েছিলাম।’
কথাটা বলতেই আয়মানের স্মৃতিপটে ভেসে উঠল হঠাৎ ষোলো বছর আগের দুঃসহ সময় কাটানো পাঁচটা বছরের মুহূর্তগুলো। আরও অনেক কিছুই তার মনে পড়তে থাকল, যে স্মৃতিগুলো সে নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলেছিল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল তার, চোখের কোল ডু্বে এল অশ্রুতে। খুব বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল সে। কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করল এবার। বিড়বিড় করে বলতে থাকল, ‘খুব মিস করতাম তোমাদের৷ আব্বু, আম্মু, তুমি, নিশাবু, কেউ-ই তো আসতে না আমাকে দেখতে।’
আয়মানের হঠাৎ এমন আচরণে জায়িনের মনে হচ্ছে এবার, ও মানসিক কোনো ব্যাধিতে ভুগছে। এমন যা কিছু ঘটেছে ওর সঙ্গে, যার ফলস্বরূপ হঠাৎ হঠাৎ ও অস্বাভাবিক আচরণ করে। ওর হাতদু’টো নিজের মুঠোতে ধরে বলল, ‘আমি তোমাকে খুঁজেছিলাম। কিন্তু আমি তো তোমাকে চিনতে পেরেছি ঠিক। তোমারও তো আমাকে চেনার কথা ছিল। আলিয়া আমাকে যেভাবে চিনে ফেলেছিল, তুমি চিনতে পারোনি কেন?’
জিহ্বার ডগা দিয়ে শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিলো আয়মান। জায়িন তাকে খুঁজেছিল, এই কথাটি শোনা মাত্রই আবেগী সুরে সে জিজ্ঞেস করল, ‘ডিড ইয়্যু ফাইন্ড মি?’ অক্ষিকোটরে তখনো জলে থইথই।
জায়িন মাথা উপর নিচ দুলিয়ে হ্যাঁ বলল।
-‘কিন্তু আব্বু আম্মু বোধ হয় আমাকে খোঁজেনি।’
জায়িন কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে সত্যি ছিলে?’
-‘শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র? ওটাকে তো জেলই বলে, তাই না?’
-‘আমাদের দেশের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কেবল নামেই। তবে এখন অনেকটাই ভালো। আমার তোমার শেষ দেখা হওয়ার পর থেকে তোমার সঙ্গে কী হয়েছিল আয়মান? আমি বোধ হয় সঠিকটা জানি না। তুমি আমাকে জানাবে?’
আয়মান প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে চোখে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের শেষ দেখা? সেটা কবে ছিল?’
আহত চোখে চেয়ে জায়িন জবাব দিলো, ‘অনেক কিছু ভুলে গিয়েছ তুমি, আয়মান। আমার নামটা মনে গেঁথে রয়েছে শুধু।’
-‘নামটা খুব কঠিন ছিল। এটা ডাকতে আমার কষ্ট হতো। কিন্তু তাও তুমি বকা দিতে এই নাম না বলতে পারার জন্য। তাই মনে পড়ে গেছে।’
-‘আশা করছি, তুমি চাইলে আরও অনেক কিছুই মনে করতে পারবে৷ ছোটো সময়ের সব স্মৃতিই সব বাচ্চাদের মনে থাকে না। কিন্তু তখন তুমি ক্লাস ফাইভে ছিলে। ওই সময়ের স্মৃতিও কি ভোলার মতো?’
-‘আমি সবটা ভুলিনি। এটা সত্য, তোমাকে ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার সঙ্গে ওই সময়ের স্মৃতিগুলো আমার মনে পড়ছে এখন। এর জন্য তোমার স্কুল ড্রেস পরা এই ছবিগুলো সাহায্য করেছে।’

গভীর দৃষ্টিতে জায়িনের স্কুল ড্রেস পরা ছবিগুলো দেখতে দেখতে কিছুটা নস্টালজিক হয়ে পড়ল আয়মান৷ জায়িনেরও অবশ্যই একই অবস্থা বলা যায়। কিন্তু সেই আবেগমাখা স্মৃতিগুলো মনে করার থেকেও বেশি কৌতূহলী ও আয়মানের সঙ্গে হওয়া দুর্ঘটনাগুলো জানার জন্য। তবে সে একটু সময় দিলো আয়মানকে। সেই সময়ের দিনগুলোর কথা স্মরণ করা যে খুবই জরুরি ওর জন্য।
—————-

জাকির তখন ঢাকা অনার্স করছে। ছেলের থাকা আর পড়াশোনার সুবিধার জন্য উত্তরাতে মাহতাব শেখ একটি ফ্ল্যাট কিনে দেন ছেলেকে। ইন্টার পাস করার পরই জাকির সেই ফ্ল্যাটে একজন কাজের লোক নিয়ে থাকতে শুরু করে। ছোটো থেকেই জায়িন বড়ো ভাই পাগল ছিল বলে ভাইয়ের সঙ্গে থাকার জন্য সেও জিদ ধরে আব্বা-আম্মার কাছে। বাধ্য হয়ে জাকির জায়িনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে উত্তরার সেই বাসায়। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটো ভাইয়ের সব কিছুর প্রতি খেয়াল রাখায় ঘাটতি ছিল না তার।

উত্তরা হাই স্কুল এন্ড কলেজে পড়াশোনা করে তখন জায়িন। সময়টা তার ক্লাস টেনের। এসএসসি পরীক্ষা সামনে বলে স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট টিউটর, সব জায়গাতেই শিক্ষকরা পড়াশোনার ভীষণ চাপ দিচ্ছিলেন। একদিন বেলা এগারোটায় তপ্ত রোদের মাঝে ফটোকপি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। কোচিং থেকে দেওয়া কিছু শিটের পাতা কপি করে নেওয়ার জন্য। হঠাৎ একটি মেয়ে এসে তার শার্টের কোণা ধরে তাকে ডেকে আহ্লাদী গলায় বলে ওঠে, ‘আঙ্কেল! এই আঙ্কেল! আমাকে একটু রাস্তাটা পার করে দেবেন?’
ষোলো বছর বয়সে কোনো মেয়ে থেকে আঙ্কেল ডাক শোনা কতটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার! আর সেই সাথে রাগ, বিরক্তি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। খুব গরমে জায়িন শুরুতেই বিরক্ত ছিল। পাশে তাকিয়ে যখন দেখল বেশ সুস্বাস্থ্যের এক মেয়ে স্কুলড্রেস পরনে আর ঘাড়ে স্কুল ব্যাগ ঝুলিয়ে অনবরত আঙ্কেল ডেকে যাচ্ছে তাকে, তখন বিরক্তির সঙ্গে রাগেরও উদ্রেক ঘটল তার নিমিষেই। যদিও সবে মাত্র কিশোর জায়িনের মুখে হালকা খোঁচা দাড়ি আর গোঁফের জন্ম নিচ্ছে মাত্র। তবুও আঙ্কেল ডাক শোনার মতো চেহারা নিশ্চয়ই হয়নি। কিন্তু তার উচ্চতা তখনই পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চিতে এসে ঠেকেছে। লম্বা হিসেবেই কি মেয়েটা তাকে আঙ্কেল ডাকল? অথচ মেয়েটা নিজেও তো হাই স্কুলে পড়ার উপযোগী। তাহলে নিশ্চয়ই ফাজলামি করতে চেয়েছে মেয়েটি! এমনটা ভেবেই এক ধমক লাগিয়ে দিলো সে মেয়েটাকে, ‘এই! আঙ্কেল কে তোমার?’
ধমক খেয়েই সঙ্কুচিত হয়ে এল মেয়েটির মুখটা। সে যে ভয় পেয়েছে, চোখ মুখ ছাপিয়ে তার প্রকাশ ঘটল। ওপরের ঠোঁটটা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে কামড়ে ধরে ভীত চোখে তাকিয়ে রইল জায়িনের দিকে। মিনমিন সুরে বলল, ‘বড়ো মানুষকে আম্মু আঙ্কেল ডাকতে বলেছিল। স্যরি আঙ্কেল!’
-‘বড়ো মানুষকে আঙ্কেল ডাকতে বলেছে আম্মু। সেটা তো ঠিকই বলেছে। কিন্তু আঙ্কেল বয়সী মানুষদের তুমি চেনো না?’ আগের সুরেই বলে উঠল জায়িন।
মেয়েটাও সেই আগের মতোই মিনমিন করে জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ চিনি তো। বড়ো মানুষদের আঙ্কেল বলে।’
জায়িনের রাগ এবার আরও বেড়ে গেল। মেয়েটা কি বোকাসোকা না কি আসলেই ফাজলামি করছে? বুঝতে পারছে না সে। ওদিকে শিট ছাপানো হয়ে গেছে তার। দোকানদারের ডাক পড়তেই সে দোকানের ভেতর চলে গেল, মেয়েটার দিকে একবার গরম চোখে তাকিয়ে। টাকা দিয়ে ফটোকপি কাগজগুলো নিয়ে বেরিয়ে এসে আর পেল না মেয়েটাকে। কিন্তু একটু সামনে তাকাতেই দেখতে পেল, আসলেই মেয়েটা রাস্তা পার হওয়ার জন্য আশেপাশে তাকিয়ে বড়ো মানুষকে খুঁজছে৷ এগিয়ে গেল ওর কাছে। ওকে দেখা মাত্র মেয়েটা আবারও আগের মতো কাঁচুমাচু মুখ করে ফেলল। জায়িন বিনা বাক্যে ওর হাত ধরে রাস্তা পার করে ওপাশে নিয়ে এসে দাঁড়াল। তারপর একবার ওর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, ‘আমি যদি আঙ্কেল হই তোমাকেও তো তাহলে আন্টি বলা যায়।’
এমন একটা কথায় মেয়েটা বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর বলল, ‘আন্টি হবো কেন? আন্টিরা তো কত বড়ো হয়। আমি তো ক্লাস ফাইভে পড়ি। আন্টিরা কি ক্লাস ফাইভে পড়ে?’
-‘এই! তুমি ঠিক বড়ো বলতে কী বোঝো বলো তো?’
মেয়েটা সেই বোকার মতোই তাকিয়ে থাকল নীরবে। জায়িন আবার বলে উঠল, ‘আন্টিরা যদি ক্লাস ফাইভে না পড়ে তাহলে আঙ্কেলরা কি ক্লাস টেনে পড়ে? আর তুমি ফাইভে পড়ো কে বলবে? নিঃসন্দেহে তুমি ক্লাস সিক্স বা সেভেনে।’
-‘কীভাবে? আমি তো ক্লাস ফাইভেই পড়ি।’
-‘তোমার গ্রোথই বলে দিচ্ছে তুমি কীসে পড়ো।’
বাস্তবিকপক্ষে মেয়েটির নাদুস-নুদুস শারীরিক গঠনের জন্য একেবারেই বোঝার উপায় নেই যে, সে মাত্র ক্লাস ফাইভে। জায়িনের কথার ভাবার্থ মেয়েটি কিছু না বুঝে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকল একটু সময়। তারপর হঠাৎ আশেপাশে চোখ বুলাতে শুরু করল সে। তাকে কিছু খুঁজতে দেখে জায়িন জিজ্ঞেস করল, ‘কী খুঁজছ তুমি?’
-‘ওই যে ওখানে একটা চটপটি, ফুচকা, হালিমের দোকান থাকে। সেটা কোথায় আজ?’
-‘তুমি জানো না আজকে ফ্রাইডে? স্কুলড্রেস পরে চলে এসেছ। দিবা শাখা, প্রভাতী শাখা সবই তো ফ্রাইডেতে বন্ধ থাকে।’
-‘কিন্তু দোকানদার তো স্কুলে পড়ে না। সে কেন আসেনি?’
-‘সে আজ স্কুলের সামনে কেন আসবে? আজকে কি স্টুডেন্টস আছে? সে এসেছে ঠিকই, অন্য জায়গায় গিয়ে বসেছে।’
এটা তো মেয়েটা একটুও জানত না। সে যে মায়ের অনুপস্থিতিতে বাসার কাজের মেয়েটাকে মিথ্যা বলে চটপটি খেতে চলে এল, তা কি এখন আর হবে না? মনটা খুব খারাপ করে ফেলল সে। যেন এখনি কেঁদে দেবে। জায়িন মনোযোগ দিয়ে তখন মেয়েটার হাবভাব বুঝতে চেষ্টা করছে।
সে জিজ্ঞেস করল জায়িনকে, ‘আপনাকে তাহলে কী বলে ডাকব?’
-‘তুমি আঙ্কেল ডাকা ছাড়া আর কিছু জানো না? কোন বয়সের মানুষকে কী ডাকতে হয় সেটাও বোঝো না?’
-‘আম্মু তো আমাকে শুধু আন্টি আঙ্কেল ডাকতে বলে বড়োদেরকে।’
জায়িনের তখন আর বুঝতে বাকি নেই, তার সামনে ঝুঁটি করা চুলের হৃষ্টপুষ্ট ফর্সা মেয়েটি আদতেই বোকার সর্দার। এবার ওর একটু হাসিই পেল। দেখতে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল হলেও উচ্চতাতে অনেকটাই কম তার তুলনায়। যার জন্য তাকে নজর ঝুঁকিয়ে রেখে কথা বলতে হচ্ছে, আর মেয়েটা মাথা উঁচু করে বলছে। স্মিতহাস্য চেহারায় জায়িন ওকে বোঝাল, ‘দেখতে লম্বা হলেই সে আঙ্কেল অথবা আন্টি হয়ে যায় না। তোমার আম্মু আন্টি আঙ্কেল বলতে শিখিয়েছে ওনাদের, যারা তোমার আম্মু আর আব্বুর মতো বড়ো। তাদেরকেই বড়ো বলেছে তোমার আম্মু। আর এই যে আমাদের মতো যে মানুষগুলো, তাদেরকে ভাইয়া অথবা আপু বলতে হয়। বৃদ্ধদের দাদু বা নানু ডাকতে হয়।’
-‘হ্যাঁ, শেষেরটা জানি। আপনাকে তাহলে ভাইয়া ডাকব?’
উত্তরে জায়িন হেসে হ্যাঁ বোঝাতে মাথা দু্লাল।
-‘আচ্ছা। দোকানটা এখানে কখন আসবে আপনি জানেন ভাইয়া?’
-‘কেন? তুমি কি ততক্ষণ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?’
মেয়েটাও মাথা দুলিয়ে ইশারায় হ্যাঁ বোঝাল।
-‘শাহীন ভাই মানে দোকানদার আজ আর এখানে আসবে না। তুমি কালকে স্কুলে আসলেই পাবে।’

আর কিছু বলল না মেয়েটা। জায়িনকে ঠিক আছে বলে এবার রিকশা খুঁজতে থাকল। জায়িনও আর দাঁড়াতে চাইল না। সে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কী ভেবে যেন পেছন ফিরল। তারপর আবার এগিয়ে গেল ওর কাছে। জিজ্ঞেস করল, ‘নাম কী তোমার?’
-‘আয়মান মেহরিন।’ চট করেই উত্তর দিলো মেয়েটি।
-‘তোমার মতোই তোমার নামের স্বাস্থ্য। তুমি কি একাই আসো স্কুলে?’
-‘না, নিশাবু রোজ নিয়ে আসে আর নিয়ে যায়।’
-‘তাহলে আজকে তোমার নিশাবু কোথায়?’
-‘টিভি দেখছিল। আমি স্কুলে আজ একাই আসব বলে চলে এসেছি।’
-‘আজকে যে শুক্রবার। তা জেনেও তোমার নিশাবু আসতে দিলো?’
-‘নিশাবু টিভি দেখতে বসলে সব ভুলে যায়।’
কথাটা বলতে বলতে আয়মান একটু হেসে ফেলল। হাসলে তখন আয়মানের গালদু’টো ফুলে গিয়ে চোখ ডুবে যেত। আর ঠোঁটের মাঝে ছোট্ট করে একটা টোল পড়ত। সেই হাসি মুখটা আর ঠোঁটের মাঝের টোলটা দেখে জায়িনের খুব ভালো লেগেছিল। তার কখনো জানা ছিল না গালের মাঝে টোল পড়া ছাড়াও নিচের ঠোঁটেও ক্ষুদ্র একটা টোল পড়তে পারে। ব্যাপারটা খুব চোখে লেগেছিল ওর। আর আয়মানের অমন নাদুসনুদুস স্বাস্থ্যের হাস্যোজ্জ্বল ফোলা গালটাও ভীষণ মনে ধরেছিল। ওকে জিজ্ঞেস করল তখন, ‘তাহলে কি একা যেতে পারবে?’
-‘হ্যাঁ, একাই তো এসেছি।’
-‘শুধু চটপটি খেতেই কি মিথ্যা বলে একা একা চলে এলে?’
আয়মান কোনো জবাব দিতে সাহস পেল না। তার জানামতে, বড়োরা এসব ব্যাপারে বকাবকি করে। হয়তো জায়িনও তাকে বকবে এভাবে একা আসার জন্য। কিন্তু তার ধারণা বদলে জায়িন তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি তোমাকে চটপটি খেতে নিয়ে যাব। যাবে আমার সাথে?’
আয়মান মুহূর্তেই মাথা নেড়ে না বলল। জায়িন তখন বলল, ‘আমি তোমার স্কুলেই পড়ি। ক্লাস টেনে। আম্মু নিশ্চয়ই বলেছে, অপরিচিতরা কিছু বললে বা কিছু খেতে দিলে না বলতে?’
উত্তর দিলো না আয়মান। বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল ওর দিকে। জায়িন ওর মনের অবস্থা বুঝে বলল, ‘আচ্ছা, কাল আমাকে স্কুলে দেখলে তো বিশ্বাস করবে? আমি তোমার স্কুলেই পড়ি?’
এবার আয়মান মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ প্রকাশ করল।
-‘ঠিক আছে। আমার ছুটির পর দাঁড়িয়ে থাকব স্কুলের গেটের সামনেই। তুমি গেটে ঢোকার সময়ই দেখতে পাবে।’
—————-

বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে জায়িন নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তার জীবনের সব থেকে বড়ো সত্য, সে এখন আর পনেরো ষোলো বছর পূর্বের সেই শুদ্ধ মনের জায়িন নেই। পরোক্ষভাবে আয়মানের সুন্দর জীবনের ধ্বংসের সাথেই তার সেই স্বাভাবিক জীবনেরও ধ্বংস ঘটেছে। বিধাতা যে তাদের দু’জনের ভাগ্যের যোগসূত্র করে রেখেছেন আশ্চর্যভাবে! নয়তো সে কেন কয়েক মাসের পরিচিত বাচ্চা মেয়েটাকে হারিয়ে পাগলপ্রায় হবে? আর সেই পাগলামো দেখে তার পরিবার কিছু না বুঝেই পাঠিয়ে দিলো অস্ট্রেলিয়া বড়ো ভাইয়ের কাছে। ওই বাচ্চা মেয়েটার জন্য পাগল না হলে সে নিশ্চয়ই এখানে আসত না? আর না সে ধীরে ধীরে এখানের বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের পরিবেশের মতো নিজেকে গড়ে তুলত! এই বন্ধুদের সঙ্গ না পেলে হয়তো জীবনের করা প্রথম দুঃসাহসিক দুর্ঘটনাটাও ঘটাত না। এই দুঃসাহসিক মনোভাব, অত্যন্ত ক্রোধ তার মাঝে থাকলেও তা প্রকাশের সুযোগ পেত না এই দেশে না এলে। এখন তার আর আয়মানের জীবনের গতিপথ একইরকম হলেও তাদের দু’জনের চারিত্রিক সকল বৈশিষ্ট্যের তফাৎ যে দিন আর রাতের মতো। আয়মানকে ধরে রাখাও তাই বেজায় মুশকিল। কিন্তু সে তো এই মেয়েতে আটকা পড়ে গেছে বহু আগেই৷ হয়তো আয়মানের দেখা আর দ্বিতীয়বার না পেলে ওকে আবার ফিরে পাওয়ার জিদ আসত না তার মাঝে। বলা অপরিহার্য, একই মানুষের প্রেমে দ্বিতীয়বার পড়েছে সে। তাই তো এবার আরও বেশি কষ্টসাধ্য হবে সেই মানুষটিকে ছেড়ে থাকা। দু’হাতে চোখ মুখ ডলে সে উঠে ব্যালকনিতে এল। যেখানে আয়মান কাউচে বসে নিশ্চিন্তে সিগারেটে টান দিচ্ছে। একটু আগেই জায়িনকে সিগারেট এনে দিতে বাধ্য করেছে সে।

আয়মানের কাছে গিয়েই বসল সে। সবটা মনে পড়ার পরও আয়মানের অভিব্যক্তি আগেও যেমন ছিল এখনো তেমনই। তাই জায়িনকে বলল, ‘তুমি প্লিজ আমার সাথে ঘেঁষাঘেঁষির চেষ্টা করবে না, জায়িন। আমি তোমাকে কিন্তু বলেছি আমার প্রবলেমটা।’
কথাগুলো শোনার পর জায়িন এবার ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বসল।
-‘তো তুমি আমাকে ডাকবে না ওই নামটাতে?’
-‘তুমি এমন কিছু কেন বোঝাতে চাইছ যে, আমি তোমার সৌলমেট? আর ওই নামে ডাকাতে বা না ডাকাতে কী এসে যায়?’
জায়িন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল, ‘মানুষের প্রতি মায়া, ভালোবাসার অনুভূতি মরে আছে তোমার।’
-‘তো একজন টেরোরিস্টের থেকে তুমি এর থেকে বেশি আর কী আশা করো? তোমার মাঝেও আমি এমন কিছু আশা করেছিলাম। কিন্তু তুমিও দেখি সেই সব নমিন্যাল প্রেমিকদের মতো!’
ওকে ছেড়ে খানিকটা সরে বসে ওর আঙুলের ফাঁক থেকে সিগারেটটা নিয়ে নিলো জায়িন, ‘আজাইরা কথা রাখো। আর আমাকে শুরু থেকে জানাও, মান।’
-‘ওকে, তুমি আমার এক সময়ের ওয়েল উইশার ছিলে বা এখনো আছ। এ বিশ্বাস থেকেই বলতে ইচ্ছা করছে।’
বলতে বলতে কাউচে গা এলিয়ে বসল সে। জায়িন তার পাশে বসেই উৎসুকভাবে চেয়ে আছে ওর দিকে।
_________________________

সিন্ধু ইগল – (২৮)
ইসরাত জাহান দ্যুতি

-‘স্কুল ছুটির পর তোমাকে আশেপাশে যখন চোখ বুলিয়ে খুঁজতাম, তুমি দূর থেকে আমাকে ডেকে উঠতে “আমার বোকারানি! এই যে এদিকে আমি।” তখন তো সত্যিই খুব বোকা ছিলাম। আমাকে বোকা কেন বলতে তাও বুঝতাম না৷ আমার বন্ধুরাও আমার কত শত কার্যকলাপে মাথায় গাট্টা দিয়ে বলত “গর্ধব তুই একটা!” আমাদের বাসা থেকে খালামণির বা চাচ্চুর বাসা রিকশায় যেতে ভালোই সময় লাগত। খালামণিদের বাসায় সেদিন বিকালে ঘুরতে গিয়েছিলাম আম্মুর সাথে। সেদিন তোহাদেরকেও খালামণি বাসায় ইনভাইট করেছিল। তোহা, ওর বড়ো ভাই আর ওর আম্মু এসেছিল। এই তোহা হচ্ছে আমাদের ক্লাসমেট ছিল। আমার আর আলিয়া দুজনের সঙ্গেই মিশত ও। চাচ্চু সেদিন বাসায় ছিল না। আর আমার আব্বু তো তখন বিদেশ।’
বিদেশ শব্দটা উল্লেখ করার পর হঠাৎ করে আয়মান হেসে উঠল, ‘এই নক্ষত্র, আমি বিদেশ বলতে কী জানতাম এটা তোমার মনে আছে?’
জায়িন প্রশ্নটা শুনে আয়মানের হাতের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল, আয়মান মিটিমিটি হাসছে ওর দিকে চেয়ে। কপট বিরক্ত দেখিয়ে ও বলে উঠল, ‘প্রথম কথা, তুমি আমাকে শুধু নক্ষত্র বা শুধু রাজ বলে ডাকবে না৷ নক্ষত্ররাজ একত্রে উচ্চারণ করবে।’
-‘ধুরঃ! আমার এখনো তোমার নাম পুরোটা ডাকতে কষ্ট লাগছে। সম্ভব না।’
-‘সম্ভব করিয়ে ছাড়ার ক্ষমতা তো আমার আছেই। যাই হোক, দ্বিতীয় বিষয়টা তুমি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলে মাত্র। তোমাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার আব্বু কী করে? তুমি বলেছিলে আব্বু বিদেশ থাকে। জানতে চাইলাম কোন দেশে? তুমি বললে বিদেশে। আমি মাত্র দু’দিনেই বুঝে গিয়েছিলাম তোমাকে, কোন মাত্রার বোকা তুমি! তুমি যে বিদেশ বলতেও একটা আলাদা রাষ্ট্রকে বুঝতে সেটা ভেবে তো আমার এখনো সেদিনের মতোই দমফাটা হাসি পাচ্ছে।’
-‘হুঁ, সেদিন তুমি বিদেশ কী বুঝিয়ে দিয়েছিলে। তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে আজ অনেক কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে।’
-‘আরও অনেক কিছুই মনে পড়বে। এখন মেইন কথাতে আসো।’
প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে আয়মান বলতে শুরু করল, ‘আমার চাচ্চু আর আমার ছোটো খালামণির বিয়ে হয়েছিল। এ জন্যই তখন বলছিলাম চাচ্চু বা খালামণির বাসায় যেতে রিকশাতে ভালোই সময় লাগে। চাচ্চু নিজের ব্যবসা শুরু করার পর আলাদা বাসা নিয়ে থাকত। তো ওইদিন আমি, আলিয়া আর তোহা বাসার ছাদে এসেছিলাম খেলতে আর ছাদের ফুলগাছগুলো দেখতে। আলিয়ার সঙ্গে আগেরদিন স্কুলে হয়তো তোহার ঝগড়া হয়েছিল। তাই সেদিন তোহা ওর সাথে কথা বলছিল না। আমার সঙ্গে ঘুরছিল বেশি। আলিয়া এমনিতেই তো আমার পছন্দের জিনিসের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হতো। সেটা এখনো৷ আর সেই জিনিসটা যা-ই হোক, ও নিজের করতে চাইত। তোহা যে আমার সঙ্গে বেশি কথা বলছে, শুধু আমার সঙ্গে ঘুরছে তা ওর খু্ব খারাপ লাগছিল। বারবার তোহাকে ডাকলেও তোহা ওর সঙ্গে কথা বলছিল না। আমি আর তোহা ছাদের গাছগুলো দেখতে দেখতে অনেকটা কর্ণারে চলে এসেছিলাম। আলিয়া তখন রাগ করে ছাদের মাঝে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছিল আর কাঁদছিল। আমি ওকে কাঁদতে দেখে আমাদের কাছে ওকে ডাকি। ও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এসে দাঁড়ায় আমাদের সঙ্গে। তোহা ওকে দেখে আরও বেশি করে আমার সঙ্গে গল্প করতে থাকে। ও তোহাকে তখনো বারবার ডাকছিল, কথা বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তোহা ওর সাথে একেবারেই কথা বলছিল না বলে ও খুব রেগে গিয়ে তখন ওকে ধাক্কা মারে৷ ছয় তলার ছাদ থেকে তোহা নিচে পড়ে যায়। আসলে ও ভাবেনি যে তোহা নিচে পড়ে যেতে পারে। আমার দৃষ্টি আগে থেকেই তখন নিচে ছিল। তোহার মাথা ফেটে রক্ত ছড়িয়ে সারা মুখ রক্তে মেখে যাওয়া দৃশ্যটুকু দেখে আমি চিৎকার করতেও ভুলে গিয়েছিলাম। আমার তখন কেমন লাগছিল আমি ঠিক এক্সপ্লেইন করতে পারব না। আলিয়ারই বা কীরকম লাগছিল সেটাও আমি জানি না। কারণ আমি ওর দিকে তাকাইনি৷ ও কখন আমার পাশ থেকে ছুটে নিচে চলে গিয়েছিল জানি না। নিচে গিয়ে কাকে কী বলেছিল সেটাও জানি না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আম্মু দৌঁড়ে ছাদে আসে। আমাকে ছাদের কিণারাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আম্মুর যেন কী হলো। আম্মু কেঁদে উঠল শব্দ করে। তখন আমি পিছু ফিরে তাকাই। আর ছুটে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলি, “আম্মু! তোহা পড়ে গেছে! ওর মাথা ফেটে গেছে!” আম্মু আমাকে প্রথমে জড়িয়ে ধরলেও পরে ছেড়ে দিয়ে কতগুলো থাপ্পড় মারে আর বলতে থাকে, “কী করলি তুই? কত বড়ো সর্বনাশ ডেকে আনলি? কী করব তোকে নিয়ে এখন? ইয়া আল্লাহ! কী হবে এখন?” আম্মু প্রথম সেদিন আমাকে মেরেছিল। আমি কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করি আম্মুকে, “তুমি আমাকে মারলে কেন?” আম্মু আর কিছু বলার আগেই খালামণি আসে। সেও আমাকে দু’টো থাপ্পড় মেরে কাঁদতে থাকে৷ আর বলে কী করে ফেললাম আমি। সেদিনের সারাটা রাত আম্মু আমাকে নিয়ে খালামণিদের বাসাতেই ছিল। জড়িয়ে ধরে খালি কেঁদেছে। কেউ সেই রাতে ঘুমায়নি। শুধু আমি ছাড়া। সবাই খুব টেনশনে ছিল তা আমি বুঝতে পারলেও ভয়ে কথা বলছিলাম না। যদি আবার মেরে বসে, তাই। আমি তখনো জানতে পারিনি আলিয়া পুরো দোষটা আমাকে চাপিয়ে দিয়েছে। কতটা বোকা ছিলাম!
ওইদিনই তোহাকে হয়তো কবর দিয়ে দেওয়া হয়। তার পরের দিন দুপুরের ঘটনা৷ আম্মু, চাচ্চু আব্বুকে ফোনে ট্রাই করছিল বারবার। কিন্তু আব্বুকে পাওয়া যাচ্ছিল না ফোনে। তারপর দেখি হঠাৎ করেই তোহার আব্বু সাথে আরও কে কে যেন বাসায় পুলিশ নিয়ে আসে। খুব চিৎকার, চেঁচামেচি হচ্ছিল৷ আমাকে মারতে তোহার আব্বু বারবার এগিয়ে আসছিল। আর বাকিরা ওনাকে আটকাচ্ছিল। কতক্ষণ ওই সব ঝামেলার পর মহিলা কনস্টেবল এসে আমাকে টানতে শুরু করে। আম্মু আর খালামণি খুব কাঁদছিল আর আটকাতে চাইছিল আমাকে। আমি যে তোহাকে ধাক্কা দিইনি, আলিয়া দিয়েছে তা কেউ কানেও তোলেনি বোধ হয়। সেদিন থেকে আমার চারপাশে নতুন জগত আবিষ্কার করলাম, নক্ষত্ররাজ। শিশু মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত এক অপরাধে দোষী প্রমাণিত হলাম। যেহেতু সুস্থ মস্তিষ্কে খুনের অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে, আর তা প্রমাণও হয়েছে, তাই দশ বছর মেয়াদে আটকাদেশে প্রদান করল আমাকে। কিন্তু বিচারপতির বোধ হয় আমাকে দেখে করুণা হয়েছিল। তাই কমিয়ে এনে তা মেয়াদ পাঁচ বছর করে পরবর্তীতে। তারপর থেকেই আম্মুর কোল ছাড়া ঘুমাতে না পারা আমি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঁচটা বছর কাটালাম। প্রথম কয়েক মাস আম্মু আসত, খালামণি আর চাচ্চু আসতো। কিন্তু হঠাৎ তাদের সবার আসা বন্ধ হয়ে গেল। আব্বুও আসেনি পাঁচটা বছরে। ওই পাঁচটা বছরে কী ঘটেছিল তা এখনো অজানা আমার। কেন তারা আসেনি আমার কাছে?’

জায়িন পাশ থেকে পানির বোতল উঠিয়ে আয়মানকে এগিয়ে দিতেই ও ভ্রু কুঁচকে ফেলে, ‘সিগারেট থাকলে দাও। আসার পর থেকে বিরক্ত হয়ে আছি কিন্তু।’
পানির বোতলটা পূর্বের স্থানে রাখতে রাখতে জায়িন বলল, ‘আরেকটা বিষয় অজানা আমার। শুরু থেকেই জানার আগ্রহ ছিল। কিন্তু তখন জানা হয়নি। আলিয়া আর তুমি দু’জন আসতে আলাদাভাবে। আর যেতেও দুজন দু’দিকে। তোমরা এক সঙ্গে কেন থাকতে না? ব্যাপারটা কি এমন আলিয়া তোমার খালামণির বাসায় থাকত?’
-‘এমনই। আমরা ছোটো ছিলাম তো। তাই আসল ব্যাপারটা জানতাম না। খালামণির মা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না নাকি। আম্মু তার ছোটো বোনকে খুব ভালোবাসত। তাই আমি আর আলিয়া জমজ হতে আম্মু আলিয়াকে খালামণি আর চাচ্চুর হাতে তুলে দেয়। ছোটো থেকেই আমরা তখন জানতাম আমরা কাজিন। আপন বোন নই। অনেক কিছুই জানলাম তো জেল থেকে ফিরে এসে। কত কিছু আবিষ্কার করলাম তখন!’
-‘কত কিছু বলতে কী কী?’
-‘থাক ওসব। আমার যাবার ব্যবস্থাটা করো তো দ্রুত। এখানে ফাউ সময় কাটাচ্ছি। কাজ আছে অনেক।’
কাউচ ছেড়ে উঠে হাসতে হাসতে জায়িন জিজ্ঞেস করল, ‘জাইমাকে সমুদ্রে ফেলবে?’
স্বাভাবিকভাবেই তাকাল আয়মান জায়িনের দিকে, ‘মানুষটা তুমি বলে ওকে ছাড় দেওয়া উচিত নয়। তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও ও বিশ্বাসঘাতকতা করত। তাই ওকে খতম করাই বেটার।’
-‘ও তোমাকে ভালোবাসে, তোমার প্রতি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তুমি কিছু করার আগেই ও নিজে খুন করত তাকে৷ আমি বলেই সাপোর্টটা আমাকে দিয়েছে।’
ঠোঁটটা কিঞ্চিৎ সময় কামড়ে রেখে তারপর ছেড়ে দিয়ে খানিকটা হাসতে হাসতে আয়মান জিজ্ঞেস করল জায়িনকে, ‘কী এমন দিলে ওকে? এত সুন্দরভাবে বশ মেনে গেল তোমার?’
আয়মনের ঠোঁটের কোণের হাসিটা প্রগল্ভা যুবতীদের মতো ছিল। জায়িনের যা অসহ্য লেগেও ভালো লাগল আবার। কেমন করে যেন ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল সে। তারপর হঠাৎ ওর কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘তোমাকে বিয়ে করব আর ওকে সুন্দর একটা ঝুট-ঝামেলা ছাড়া জীবন দেবো। এবং দিয়েছিও৷ তুমি সুস্থ থাকতে তো কোনোদিনও ওকে মুক্তি দিতে না। আমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। সেই প্রতিশ্রুতি রেখেছি। তাই বশ মেনে গেছে।’
-‘প্রথম কথাটা তুমি কী বললে? আবার রিপিট করো তো!’
হাসিটা ঠোঁটের কোণা থেকে মিলিয়ে গেলেও তবে গম্ভীরতাও দেখা গেল না আয়মানের চেহারায়। যেন জায়িনের কথাটাকে সে মজাই ধরে নিয়েছে। আর জায়িন তার সেই ভাবতত্ত্ব বুঝে তা ভুল প্রমাণিত করে দিতেই চট করে ওর ঠোঁটে চুমু খেয়ে বসল। ঘটনাটা অপ্রত্যাশিত হলেও আয়মান তখনো কেন যেন শান্ত এবং নীরব রইল। শুধু স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল জায়িনের দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে জায়িন কিছু একটা বুঝে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল, ‘সময়টা ষোলো বছর পর৷ আমিও এখন আর সেই ভালো ছেলে নেই। আমার বোকারানিও এখন আর বোকা, অচঞ্চল নেই। আমরা দুজনেই এখন একই জগতের অত্যন্ত কঠোর মানুষ হলেও আমাদের লক্ষ্য ভিন্ন। আমার লক্ষ্য আমি আমার বোকারানিকে ধরে রাখব আমার কাছে। যার জন্য নিজের মায়ের দেশ ছেড়ে চলে আসা, আবার ফিরে আসা সেই আন্ডারওয়ার্ল্ডে। তার হাতে মরতে মরতে বেঁচে গেলাম। তাকেই ছেড়ে দিই কী করে? তুমিও যে সেই পুরোনো নক্ষত্ররাজের মতো আমাকে ট্রিট করবে না, তাও আমার জানা। এখান থেকে যাবার আশা ছেড়ে দাও। তুমি হারিয়ে যাবার পর আমার সাথে কী হয়েছে তার অনেক কিছুই তুমি জানো না। জানি জানার প্রয়োজনবোধও করো না। এতগুলো বছর পর কীসের টানে সব ছেড়ে ছুঁড়ে তোমাকে বেঁধে রাখতে চাইছি, তা জানতে হলে আমাকে তোমার বিয়েটা মাস্ট করতে হবে।’

কথাগুলো শেষ হতেই আয়মান ব্যালকনি থেকে বাইরে তাকাল। বাসার সামনের লন দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘বাসাটা কি তোমার?’
-‘আমি তোমার পালানোর উপায় রাখিনি, জাদুরানি।’
এবার তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল আয়মান জায়িনের দিকে। জায়িন মৃদু মৃদু হাসছে। এই হাসির অর্থ যে আয়মানের অভিসন্ধি সে ধরে ফেলেছে, তা আয়মান বুঝতেই রাগ হতে শুরু করল ওর। হঠাৎ হাসি থামিয়ে জায়িন কিছু স্মরণ হওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘ওয়েট ওয়েট! আমি তোমাকে জাদুরানি বলেও ডাকতাম। কারণ, তুমি আমার কাছে থাকলেই সব কিছু ভালো লাগত। একদম জাদু করার মতো আমার মন ভালো হয়ে যেত। তাই জাদুরানিও ডাকতাম মাঝে মাঝে। তুমি কি আমার দেওয়া নাম স্মরণ রেখেই নিজের ছদ্মনাম রেখেছিলে? কিন্তু তোমার না আমাকে মনে ছিল না?’
গুরুত্বহীন সুরে জবাব দিলে আয়মান, ‘একটা ছদ্মনামের প্রয়োজনবোধ করতে হঠাৎ ভাবতে ভাবতে জাদু নামটাই মাথাতে এসেছিল। মনে হচ্ছিল এই নামটাতে আমাকেই ডাকা হতো। কে ডাকত? তা আমার মনে আসছিল না। আর মনে করার চেষ্টাও করিনি৷ গুরুত্ব দিইনি। এইটাই কারণ। তাছাড়া তোমার কথা তখনো মনে আসেনি। আর আমার নামের সাথে মিল রেখেই আলিয়ার নাম রাখা।’
তবুও জায়িনের মনটাতে ভালো লাগার আবেশ অনুভব হলো৷ আবারও আয়মানের কাছে এগিয়ে এসে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে মৃদুস্বরে বলল, ‘আমাকে তুমি ভুলে গেলেও তোমার মন আর মস্তিষ্কে আমি অদৃশ্য অবস্থাতে অধিষ্ঠিত ছিলাম। প্রেমের তির অন্তঃকরণে আমার তো গেঁথেছিলই টিন এজ সময়ে। তোমারও গেঁথেছিল। কিন্তু আমার বোঝার ক্ষমতা থাকলেও তোমার ছিল না।’
বলেই দাঁড়াল সে, রুমে ফেরার জন্য পা বাড়াল। আয়মান চুলের মাঝে হাত ডু্বিয়ে ব্রাশ করতে করতে তখন বলে উঠল, ‘ভালো সম্পর্কটাকে তুমি নষ্ট করতে চাইছ, নক্ষত্ররাজ। শক্তি দিয়ে আমাকে ধরে রাখার ক্ষমতা তোমার হলেও ব্রেইনিং দিয়ে হয়নি।’
-‘তুমি বিশ্বাস করো?’
পেছন ফিরে থাকা অবস্থাতেই শুধু ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল জায়িন। আয়মান উঠে এসে ওর পিছে দাঁড়াল তখন। জবাব দিলো, ‘কনফিডেন্সের সঙ্গেই বলছি।’
জায়িন জবাব শুনে প্রশস্ত হাসল শুধু।
______________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here