সিন্ধু ইগল – (২৫)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
শিশির ভেজা প্রভাত না হলেও জলবিন্দুর পুঞ্জ ধোঁয়ার উত্তরীয়তে হরিদ বর্ণের জঙ্গল কন্যা যেন সর্বাঙ্গ মুড়ে রেখেছে। জঙ্গলের এমন রূপের জৌলুশ বিষাক্ত হৃদয়ের আত্মাকেও আত্মতৃপ্তি দেয় তৃষ্ণা নিবারণের মতো।
জলপ্রপাতের স্বচ্ছ সবুজ জলে গা সিক্তকরণের অভিপ্রায় নিয়ে আয়মান সকালটা প্রভাযুক্ত হতেই লজ থেকে বেরিয়ে পড়ে। হ্যাংওভার কেটে গেছে তার ঘুম ভাঙতেই। ধরাধামের জটিলতা থেকে যেন আজ মুক্ত সে। মনোবিকারশূন্য প্রতিবিম্ব ধারণ করে জলপ্রপাতের কিনারার পাথরটাতে বসল। মানবজীবনের দায়িত্ব, কর্তব্য, আপনজনের প্রতি অনুরাগযুক্ত অবশ্যম্ভাবী এই অধ্যায়টা তার জীবৎকাল থেকে একটা ছিঁড়ে ফেলা অংশ মাত্র। নীড় হারা পাখির জীবন বৈশিষ্ট্যের প্রতিরূপই যেন তার বৈশিষ্ট্য। আপন শব্দটির অর্থ বলতে সে বোঝে একমাত্র নিজেকে। কিন্তু এই আপনকেও তার আঁকড়ে রাখার কোনোই অনুধ্যান নেই। আপনকে ভালোবাসতে না পারার নির্মম ব্যর্থতাপূর্ণ মনুষ্য সে বলেই মর্মদেশ তার শিলাখণ্ডে আচ্ছাদিত। সামাজিক বন্ধন, পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, সঙ্গী নির্বাচন, মাতৃত্ব বা পিতৃত্ববোধ প্রকাশের মূলে কাজ করে যে অক্সিটোসিন হরমোন রয়েছে মানুষের। আয়মানের ব্যক্তিগত ধারণা, এই হরমোনের প্রভাব তার মস্তিষ্ক নিশ্চিত একেবারেই শূন্য। তাই তো সে কারও প্রতি বিশেষ মনোযোগ বা কারও প্রতি দুর্বলতাও বোধ করে না। এ নিয়ে তার অবশ্য কোনো উৎকণ্ঠা নেই। কারণ, সন্ত্রাসবাদী জীবনটাই তো এমন।
রৌদ্ররশ্মি গাছগাছালির ফাঁকফোকড় দিয়ে এখনো অবধি জঙ্গলের মাটিতে এসে পৌঁছয়নি। আয়মান তার পূর্বেই জলপ্রপাতে নেমে পড়ল। মাঝামাঝিতে ঠায় দাঁড়িয়ে ডুব দিয়ে মাথা তুলতেই জাইমাকে পাথরের ওপর বসে থাকতে দেখল সে। কিন্তু কোনো কথা আদান-প্রদান হলো না তাদের। আরও কতগুলো ডুব দেওয়া শেষে আয়মান উঠে এসে জাইমার পাশে বসল। তোয়ালেটা তুলে দিলো সে আয়মানের হাতে। মাথা মুছতে মুছতে আয়মান হঠাৎ বলে উঠল, ‘নতুন পারফিউম?’
আচমকা প্রশ্নটায় জাইমার মাঝে চিত্রবিভ্রম প্রকাশ পেল। মুখের ভঙ্গিমাতে শুধু হ্যাঁ বোঝাল সে৷ আয়মান চুল মোছা শেষে তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে ফিচেল গলায় বলল, ‘ফ্রাগ্রেন্স তো উত্তাল করে দেওয়ার মতো। আমার ধারণা কোনো ফ্লোজি মলিকাডল ছুটে এসে তোমার বুকে পড়বে।’
এমন অসভ্য কথা শুনে জাইমা বিব্রত চেহারায় ‘ধুরঃ’ বলে উঠে পড়ে বলল, ‘ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার। লজে ফেরা যাক এবার।’
আয়মান উত্তর না দিলেও তার কথার সায় দিয়ে উঠে পড়ল। লজের দিকে চলতে লাগল তারা। জাইমা চিন্তাশূন্য চেহারার পেছনে গভীর চিন্তা নিয়ে গতকালকের রাতটার কথা স্মরণ করছে। জায়িন ঘর থেকে বেরিয়েই তাকে কল করে ঘরে ফিরতে বলে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে ওর জন্য। সে লজের ভেতর হাঁটাহাঁটি করছিল তখন। ফিরে আসতেই জায়িন মুহূর্তমধ্যে তার সারা গায়ে পারফিউম মাখিয়ে দেয় অতর্কিতে। নির্দ্বিধায় বিস্মিত হওয়ার মতো ছিল কাজটি। অবশ্য তারপর জায়িনই নিজ দায়িত্বে পারফিউম মাখিয়ে দেওয়ার রহস্যটাও জানিয়ে তাকে বিস্ময়মুক্ত করে৷ আয়মান অতিরিক্ত মাতাল অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছিল ম্যাসাজ করে দেওয়ার মুহূর্তে। সেই সময়টাতে জায়িন তাকে বুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বসে অচেতন আয়মানের সারা মুখে শুধু চুমুই খেয়েছে আর ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ওকে দেখে গিয়েছে। জড়িয়ে রাখার মুহূর্তে অবশ্যই জায়িনের পারফিউম আয়মানের টি শার্টে মেখে থাকবে৷ আর ঘুম ভেঙে আয়মান তা লক্ষও করবে বলে অটল ধারণা ছিল জায়িনের। সেই ধারণা থেকে যাতে ভুলক্রমেও সন্দেহ না জাগে, তাই সে জাইমার গায়ে তার পারফিউম মেখে দিয়েছিল। বিষয়টি বিস্ময়কর ব্যাপার হলেও কিছুটা হাস্যকরও ছিল জাইমার কাছে। কত সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে বলে পকেটে করে জায়িনকে পারফিউম বয়ে বেড়াতে হলো শেষ অবধি! তবে আয়মান যে সত্যিই এই পারফিউমের স্মেল এত সুক্ষ্মভাবে আবিষ্কার করতে পারে নিজের শরীর থেকে, তা জাইমার চিন্তাধারার বাইরে ছিল মাত্র। এটা পুরুষদের পারফিউম তা বোঝার মতো ক্ষমতা থেকেই আয়মানের দৃঢ় বুদ্ধির পরিচয় মেলে। কিন্তু কার বুদ্ধির প্রশংসা জাইমা বেশি করবে তা নিয়ে অতিতর বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল।
সকালের প্রাতঃভোজ শেষ করেই আরও একবার জাইমাকে টলটলায়মান পরিস্থিতিতে ফেলে আয়মান রেইনফরেস্ট থেকে বেরিয়ে এল। জাইমা একেবারেই বুঝে পাচ্ছে না, আয়মান মূলত চাইছেটা কী? গাড়ি ভাড়া করে তারা গ্রেট ওশন রোডে লং ড্রাইভের উদ্দেশ্যে যাবে। ড্রাইংভিংটাও আয়মান নিজেই করবে। রেইনফরেস্টেই সারাদিন সারাবেলা কাটিয়ে দিলেও এর সৌন্দর্য দেখে শেষ করার উপায় নেই। অথচ সেখানে মাত্র দু’রাতের জন্য লজ নিয়েও দিনের অংশটুকু আয়মান বাইরে ঘুরেফিরে সময় পার করবে। এমন কাজের নির্দিষ্ট যুক্তি খাঁড়া করাতে জাইমা বারবার ব্যর্থ।
একটা বোতলশপের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আয়মান কয়েক বোতল ওয়াইন কিনে আনতে বলল জাইমাকে। শপটার সামনে কয়েকজন যুবক, প্রবীণ উভয় বয়সের মানুষের ছোটো একটা ভীড়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সিরিয়াল পেতেই জাইমা ওয়াইনের বোতল সংগ্রহ করে ফিরে এল। গাড়ি এবার চলতে শুরু করল গ্রেট ওশন রোডে। রাস্তার দু’ধারের বড়ো বড়ো গাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, যেন দু’পাশেই জঙ্গল। আরও সামনে এগিয়ে এবার একপাশে টিলা আর অন্য পাশে সমুদ্র। জাইমার হঠাৎ করেই সকল দুশ্চিন্তা উবে গেল যেন। ফুরফুরে মেজাজ, শান্ত মুহূর্ত। পছন্দের একটা গান না হলেই যেন নয়।
বোল্ড লুকিং নিয়ে ড্রাইভিং করা আয়মানকে সে বলল, ‘সানগ্লাসটা স্কিপ না করলেই মানাত বেশি।’
আয়মান মৃদভাবে একপেশে হাসল মাত্র। তারপরই হঠাৎ বেজে উঠল গাড়িতে ‘Bad Habits’।
So it’s gone, it’s gone
Now we’ve both moved on
Oh, that’s La La Life
That’s La La Life
Baby, let it be
Enjoy the memory
Oh, that’s La La Life
That’s La La Life
জাইমার প্রাণবন্ত আমেজে অভিব্যক্তি আড়চোখে দেখে আয়মান জিজ্ঞেস করল, ‘হিরোইন ফিল হচ্ছে না কি?’
সানগ্লাসটা চোখে নিয়ে সিটে আরাম করে হেলে বসে উত্তর দিলো জাইমা, ‘তোমার সাথে থাকতে থাকতে আজকাল হলিউডের অ্যাকশন হিরোইনদের মতো অ্যাটিটিউডস চলে আসে ভেতরে। এখনো হচ্ছে৷ ব্লু ললিপপটা থাকলেই ফুলফিল এক্সপ্রেশনটা হতো।’
হো হো করে হেসে উঠল আয়মান। তারপরই।গাড়িটা হঠাৎ ব্রেক করে সাইড করল। প্রশ্নচোখে তাকাল জাইমা ওর দিকে। গাড়ি থেকে নামতে নামতে আয়মান জানাল, ‘স্মোক করব।’
গানের ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে জাইমাও নেমে এল। আপাতত রাস্তাটা ফাঁকা। কিন্তু ওদের গাড়ির পেছনেই হঠাৎ আরেকটা গাড়ি এসে থামল। আয়মান তা দেখলেও। কিন্তু সে অবজ্ঞেয় দৃষ্টি ফেলে গাড়িটা একবার দেখে হুডের ওপর বসল। জাইমাও নির্বিকারভাবে গাড়ির গায়ের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন স্ক্রল করছে।
বিকারহীনভাবে সিগারেটে টান দিয়ে চলেছে আয়মান। ফোন স্ক্রলের ফাঁকে দু’বার ওকে দেখে জাইমা আবারও ফোনেই ব্যস্ত হয়ে রইল। পেছনের গাড়িটাও ঠায় ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। তবে খুব বেশি সময় গাড়িটার স্থায়িত্ব থাকবে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত জাইমা। সিগারেটটা শেষ হতেই আয়মান হুড থেকে নেমে পেছনের সেই সাদা গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। সোজা গাড়ির জানালাতে ঠকঠক আওয়াজ তুলল। জানালার কাচ নামিয়ে সোনালী চুলের এক শ্বেতকায় ছেলে মৃদু হাসি দিলো ওকে। তারপর মুহূর্তেই অপ্রস্তুতকর ঘটনাটা ঘটিয়ে বসল আয়মান। জানালার ভেতর দিয়েই ছেলেটার টিশার্টের বুকের ওপর চেপে ধরে নাখ বরাবর ঘুষি লাগাল লাগাতার তিন চারবার। পাশের সিটের আরেকটা ছেলে এগিয়ে আসতে আসতে আয়মান সরে আসে। জাইমা পিছু ফিরে একবার শুধু ঘটনাটা অবলোকন করে আবারও ফোনে মনোযোগ দিলো। আয়মান ফিরে এসে পকেট থেকে মোবাইল, ওয়ালেট, হাতের প্লাটিনাম ডায়মন্ডের ব্রেসলেটটা খুলে গাড়িতে রেখে রাস্তার পাশের পিলার সিসি ক্যামেরাটা একবার দেখে ঠিক তার উলটো পাশটাতে চলে গেল। ততক্ষণে গাড়ি থেকে সেই দু’টো ছেলে নেমে এসেছে। সোনালী চুলের ছেলেটার নাকের ছিদ্র থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে সমানে। অত্যন্ত রাগ নিয়ে ওরা এগিয়ে আসতেই আয়মান কোমর থেকে একটানে জিন্স প্যান্টের স্লিভার চেইনটা খুলে হাতে পেঁচিয়ে নিলো। ওরা হিট করার আগেই ও অক্ষত থাকা ছেলেটির তলপেটে সজোরে লাথি মেরে মুহূর্তেই সোনালী চুলের ছেলেটার চোয়ালে এবার ঘুষি মারল। ততক্ষণে তলপেট চেপে ধরে নিচে পড়ে কাতরাচ্ছে অন্য ছেলেটি। কোনো কথা বলারও সুযোগ না দিয়ে বড়ো বড়ো কয়েক ঘা মেরে ওদের ওখানে ফেলেই আয়মান ফিরে এল আবার গাড়ির কাছে। জাইমা ফোনটা পকেটে পুরে গাড়িতে উঠে বসল তখন। আয়মান সিটে বসতেই ও মজার ছলে বলল, ‘তোমার রীতিমতো ইয়াশ্যাকে বের হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে দেখছি।’
হাতের ব্রেসলেটটা পরতে পরতে আয়মান উত্তর দিলো, ‘তোমার পিছু নিতে নিতে এতদূর এসেছে ওরা।’
-‘হাহ্! আন্দাজি বলে দিলে।’
-‘তোমার মতো সুন্দরী নিয়ে ঘোরা আমার জন্য রিস্ক। বোরখাটা তোমাকেই পরানো উচিত।’
-‘আমাকে কোথা থেকে পেল ওরা?’
-‘বোতলশপ থেকে।’
-‘মাই গড! আমি নিজেই তো খেয়াল করিনি।’ বিস্মিত অভিব্যক্তি জাইমার।
আয়মান হঠাৎ স্মিত হেসে ওর গাল টিপে বলল, ‘সুন্দরীদের এসব খেয়াল এমনিতেও হয় না।’
—————-
সব থেকে আশ্চর্য হলো তো জাইমা সন্ধ্যায়। যখন আবিষ্কার করল একই লজেই জায়িনকে তার কিছু বন্ধুদের সঙ্গে। আয়মানের পেছনে সর্বক্ষণের জন্য গুপ্তচর নিয়োগ রেখেছে জায়িন, তা সে জানত। এখানে আসার পর সে কল না করলেও যে জায়িন লজে চলে আসবে, তাও সে জানত। তাই তো গতকাল রাতবিরেত তাকে মেসেজ করে আয়মানের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে তারপর তাদের ঘরে এসেছিল। তাই বলে শিপ থেকে সরাসরি জায়িনকে লজেই দেখতে পাবে, তা সে মোটেও আশা করেনি। কখন যে কী ঘটে যাবে, তা নিয়ে যথারীতি উত্তেজিত এবং চিন্তিত হয়ে পড়ছে সে। এত মনোমুগ্ধকর জগতে এসে এত চাপ নিতে চায় কেউ? অসম্ভব বিরক্তও জাইমা। একা একাই চারপাশ ঘুরে ফিরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলো সে। আয়মান ঘরে বসে আজ আবারও ড্রিঙ্কস নিয়ে বসেছে। এই মেয়টা যে মোটেও প্রকৃতির আস্বাদন গ্রহণ করতে আসেনি তা পরিষ্কার। এসেছে তার অজানা গোপন রহস্যের উদ্ঘাটন করতে। বিপজ্জনক হবে এখন আয়মানের আশেপাশে থাকা। নেশার মুহূর্তটা আয়মান অমানুষ ছাড়া কিছু না।
—————-
মেজাজ ভয়ঙ্কর রকম খারাপ আয়মানের। সারার বাসায় আগুন লাগার পর থেকে তার বিপদের আঁচ করতে পেরেছে সে। আর সেই বিপদের সূত্রপাত জায়িনকে হত্যা। তা বুঝতে মোটেও ভুল হচ্ছে না তার। জায়িন জীবিত না থাকলেও এই বিপদের আশঙ্কা থেকে যাবে, তা সে আন্দাজ করেনি। লন্ডন থেকে তাকে টেনে আনার মতো নিখুঁত পরিকল্পনা যে সাজিয়েছে সারার বাসায় আগুন লাগিয়ে, সে খুবই তীক্ষ্ণ বুদ্ধির। আর সেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষটিকে ধরতেই নিজেই তার কাছাকাছি এসে অবস্থান করছে। আর মেজাজ খারাপ হচ্ছে এ কারণেই, এখন অবধিও তার ওপর কোনো আক্রমণ বা কোনো প্রকার সন্দেহভাজন কিছুই চোখে পড়ছে না। কিন্তু সে তো চাইছেই কোনোভাবে তাকে আক্রমণ বা তাকে কোনো একটা ফাঁদে ফেলুক। এত বেশি ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। গ্লাসের পর গ্লাস ড্রিঙ্কস নিতে নিতে বোতলের তলা খালি হয়ে গেল। তখনই পরিচিত মধুর ও অস্ফুট ধ্বনিতে তাকে বলে উঠল, ‘তুমি খেয়াল করোনি বোতলটা খালি হয়ে যাচ্ছে তো।’
টলমল দৃষ্টিতে আয়মান চোখের সামনে আবিষ্কার করল জায়িনকে। ঘরটাতে মৃদু আলো হলেও জায়িনকে চিনতে ভুল হবে না তার। আয়মান ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠল। এই হাসির অর্থ এটাই, তার অপেক্ষার অবসান ঘটল। কিন্তু হাসিটা খুব বেশি সময় স্থায়ী হলো না ওর। নাকে স্লিপ সাউন্ড ক্লোরোফর্ম স্প্রে ছুঁড়তেই নিমিষেই ঢলে পড়ল সে ফ্লোরে। জায়িন কল করল তখন জাইমাকে। এমন একটা কাণ্ড ঘটাবে জায়িন, তা তো জাইমা জানতই। কিন্তু সেটা লজ থেকে করে বসল জায়িন, এমনটা জেনেই রাগ হলো তার। দ্রুত ফিরে এল সে ঘরে। জায়িন ওকে বলল, ‘যদিও আমার হবুবউ। কিন্তু আমি এখনি ওকে অন্যভাবে দেখে চেপে রাখা আগ্রহ, উত্তেজনার অবসান ঘটাতে চাই না৷’
কথাগুলো বলেই একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিলো সে জাইমাকে। বলল, ‘ওকে চেঞ্জ করিয়ে দাও।’
জাইমা হাসল, ‘তোমার হবুবউয়ের জামা কাপড়ের অভাব পড়েছে? না কি ওয়েডিং ড্রেস পরাতে দিচ্ছ?’
-‘ওর কোনো জামা কাপড় তো ওকে পরানো যাবেই না। ওর শরীরের একটা সুতাও যেন না থাকে। চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ অবধি সব কিছু অভিজ্ঞভাবে চেক দেবে। তাহলেই বুঝবে কেন আমার আনা ড্রেস পরতে দিচ্ছি।’
জায়িন ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। জাইমা জায়িনের কথামতো আয়মানকে জামাকাপড় বদলে দিতে গিয়ে গতদিনের মতোই আজও ওর চুলের মাঝ থেকে মিনি স্পাই ক্যামেরা পেল। যেটা আয়মান তার ফোনের সাথে কানেক্টেড করে রাখে সব সময়। এমনকি তার হাতের ব্রেসলেট, প্যান্টের স্লিভার চেইন, অবিশ্বাস্যকর জায়গাগুলোতে খুব নিখুঁতভাবে সেট করা আছে। যা চোখে পড়ার মতো নয়। জায়িন এত কিছু কীভাবে যে আন্দাজ করে রাখে, তা ভাবতেই অবাক হয় জাইমা। গতকাল রাতে জায়িন ঘরে আসার আগে তাকে বলেছিল আয়মান নেশায় তলিয়ে গেলে ওর পুরো শরীর যেন চেক করে সে। সেটাই করতে গিয়ে জাইমা এই স্পাইক্যামেরাগুলো দেখতে পায়। তাছাড়াও আয়মানের মোবাইল থেকে শুরু করে ল্যাপটপের সিস্টেম হ্যাক করে বসে আছে জায়িন। এই অসাধারণ কাজটি করেছে লুকা। দক্ষ হ্যাকার সে।
স্পাই ক্যামেরাগুলো থাকলে আয়মানকে যেখানেই নিয়ে যেত জায়িন, সেখানে অবধিই পৌঁছে যেত আয়মানের সিক্রেট গার্ডস। যারা আয়মানের বিপদ সঙ্কেত পেতেই ছুটে যাবে। সিক্রেট গার্ডসের ব্যাপারটা জাইমাই জানিয়েছিল অবশ্য জায়িনকে। কিন্তু আয়মানের এত সতকর্তা সম্পর্কে সে নিজেও একচুল পরিমাণ অবগত ছিল না। আর এই ভরসাতেই যে আয়মান নিজে এসে ধরা দিয়েছে, তা এতক্ষণে বুঝল জাইমা।
—————
নৈঃশব্দের গভীর রাতে আয়মান কখনোই স্বাভাবিক অবস্থাতে ঘুমায় না। বেশ ক’বছর ধরে এ অভ্যাস তার তৈরি হয়েছে। হয় কাজে বাইরে সময় কাটায়, নয়তো নেশায় বুঁদ থাকে, আর নয়তো এক্সারসাইজ করে থাকে। অন্যান্য সময়ে প্রয়োজনের তাগিদে বইও পড়ে সে। কিন্তু আজ প্রথম বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘুম হলো তার। এখনো যে রাতটা পুরোপুরি নিঃশেষ হয়নি তা ঘরের মাঝের আঁধার ভাবটা দেখে বুঝতে পারল। কিন্তু হ্যাংওভার কাটেনি। কারণ, কাটার মতো কিছু খায়নি সে। শোয়া থেকে উঠে বসে বিছানার হেলবোর্ডে হেলান দিলো। এক পা উঁচু করে আর আরেক পা সটান ছড়িয়ে কপালের মাঝভাগ আঙুল দ্বারা টিপতে থাকল।
ব্যালকনি থেকে ফিরে এসে জায়িন আয়মানকে অমনভাবে কপাল টিপতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘ম্যাসাজ প্রয়োজন?’
আয়মান ঘাড় কাৎ করে সরু চোখে তাকাল ওর দিকে। অনেকটা অস্বাভাবিক ভঙ্গি তা। কতক্ষণ দুজন নিরবেই দুজনকে দেখতে থাকল। মৌনতা কাটিয়ে আয়মান ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘খুব ভয় আমাকে? আমার আপীত সময়ের সুযোগটাকে দারুণভাবে কাজে লাগালে।’
বলেই এক অদ্ভুত মৃদু হাসি হাসল আয়মান৷ আর জায়িনের মুচকি হাসির তো ছুটি নেই। কিন্তু আয়মান কিছুটা হলেও থমকেছে জায়িনকে গৌরবর্ণে দেখতে পেয়ে। জায়িনের ছদ্মরূপ সে টের পেয়েছিল এক নাগারে অতগুলো দিন আটকে রাখা অবস্থাতে। কিন্তু আগ্রহ হয়নি তার ওকে স্বরূপে দেখার। আঁধার ঘরেও জায়িনের উজ্জ্বল মুখটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে।
ঘরের লাইটটা জ্বেলে জায়িন আয়মানের পাশে এসে বসল। তখনো নির্বিকার আয়মান। মৃদু ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে জায়িন বলল, ‘শরীরটাকে অ্যাস্লিপ করে রাখা বা হুইলচেয়ারের সঙ্গে শরীর বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া থেকে বেটার নয় আমার ওয়েটা।’
এ কথার উত্তর দিতে পারল না আয়মান৷ তবে জায়িন ঠিক স্বীকার করল, ‘খুব সত্যি অবশ্য তোমার কথাটাও। দুর্বল থাকার সুযোগটা ছাড়া পসিবল হতো কি তোমাকে আমার ঘরে আনা?’
-‘তো এরপর?’
মুচকি হেসে চকিতে জবাব দিলো জায়িন, ‘বিয়ে করছি আমরা।’
আয়মান নিস্তব্ধ। জায়িন ওকে পরখ করে দেখে বলল, ‘নেশাটা কাটেনি এখনো। বসো, আসছি।’
কথাটা শুনে আয়মানের নিস্তব্ধতা কাটল, সেও মুচকি হাসল। জায়িন উঠে যেতেই সে বলল, ‘নিড পাইপ অ্যান্ড কোকেন।’
দাঁড়িয়ে পড়ল জায়িন। শীতল চোখে একবার ওর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ডু ইয়্যু ওয়ান্ট টু ফাইট উইথ মি?’
আয়মান নিরব থাকল শুধু। জায়িন ওর নিরবতা থেকে উত্তর খুঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নেশা করার ইচ্ছা চাপলে সেই মানুষকে শান্ত রাখা মুশকিল। আয়মানের প্রতিটা অভ্যাস, কাজ, চলাফেরা, সব কিছু সম্পর্কে জায়িন জেনেছে এতদিনে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধু ওকে শান্ত রাখতেই সে ড্রাগসের বিষয়টাও মাথাতে রেখেছিল। কিন্তু তা কেবল সে আজকের জন্যই গ্রাহ্য করবে। এরপর আর আয়মানকে কোনোভাবেই এসব গ্রহণ করতে দেবে না। এবং খুব শীঘ্রই ওর চিকিৎসারও ব্যবস্থা করবে। আপাতত এই মুহূর্তের জন্য সে সত্যিই কোকেন পাওডার আর পাইপ এনে নিজেই টি টেবিলের ওপর সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিলো। আয়মান এক মুহূর্ত দেরি করল না তা নাক দিয়ে টেনে নিতে। এভাবে হামলে পড়ে ওকে কোকেন টানতে দেখে এবার জায়িন স্তব্ধ হয়ে গেল। এত দিন অবধি আয়মানের মারমুখ হিংস্র আচরণ, নেশার জন্য উত্তেজিত মরিয়া ভাব, এসব সম্পর্কে শুনেছেই কেবল। আর আজ স্বচোখে দেখে তার একটুও ভালো লাগছে না। এমনভাবে ড্রাগস নিতে থাকলে খুব বেশিদিন আর বাঁচবে না এই মেয়েটি। এই অবনতি অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে কতটা পারবে সে কে জানে! কিন্তু তার জন্য যা-ই করতে হোক, তা তো তাকে করতেই হবে।
-‘দেন নাও?’
প্রশ্নে আয়মান চোখ তুলে তাকাল জায়িনের দিকে। খানিকসময় চেয়ে থেকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল, ‘ইয়্যু আর আ ম্যান উইথআউট আ পে**।’
তারপরই অকস্মাৎ আক্রমণ করল জায়িনকে। ঠিক ওর চোখ বরাবর ঘুষি মেরে বসল।
_______________
সিন্ধু ইগল – (২৬)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
দক্ষ মারপিট জানা আয়মানের ঘুষির ওজন মোটেও সহনীয় ছিল না। আঘাতটা আচমকাই চোখে করার ফলে জায়িন চোখ চেপে ধরেই অপ্রস্তুতভাবে ব্যথায় কাতর হয়ে পিছিয়ে পড়ে। নিজেকে প্রস্তুত করার মতো সময়টুকু তো সে পেলই না, বরঞ্চ নেশার পর ক্রূরমতি আয়মান মুহূর্তেই আরও নির্মমভাবে তার পেটে লাথি মেরে বসে। চোখের পর এবার পেটে ভয়াবহ ব্যথা পেতেই চোখমুখ খিঁচে পেটে চেপে ধরে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে জায়িন। খ্যাপা ষাঁড়ের মতো আয়মান তারপরই আবার তেড়ে গিয়ে জায়িনের ঘাড়সমেত মাথা জাপটে ধরে পিঠে কনুই দ্বারা অনবরত আঘাত করতে থাকে। এই আঘাতের পরিমাণ বেশি হলে জায়িনের মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ারও সম্ভাবনা বেশি ছাড়া কম নয়। দম যেন বেরিয়ে আসার মতো দশা জায়িনের।
প্রথম আর দ্বিতীয় আঘাতটার পরও জায়িন মোটেও যা করতে ইচ্ছুক ছিল না, তা সে আয়মানকে আটকানোর জন্যই এবার করতে বাধ্য হলো। আয়মানের ডান পায়ের উরুতে প্রচণ্ড জোরে একবারই মুষ্ট্যাঘাত করল সে৷ উরুর ওই নরম অংশে এত জোরেই আঘাত পেল আয়মান, যেন মনে হলো ওর মাংসের ওপরসহ ভেতরের অস্থিতে গিয়েও চোটটা লেগেছে৷ পা চেপে ধরে দাঁড়িয়েও থাকতে পারল না সে। ব্যথায় চিৎকার না করলেও চোখমুখ খিঁচে ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়ল। এই একটা আঘাতেই তাকে ছিটকে পড়তে হলো! না জানে আরও কয়েকবার এমন আঘাতের মুখে পড়লে সে বসেও থাকতে পারবে না হয়তো! নিজেকে হার মেনে নিতে হচ্ছে, এমনটা ভাবতেই ক্রোধে যেন রক্ত টগবগিয়ে উঠছে ওর।
জায়িনের অবস্থাটা খুব খারাপ না হলেও খুব ভালোও নয়। পেটে আর পিঠের যন্ত্রণার থেকেও চোখের যন্ত্রণাটা সে সহ্য করতে পারছে না। মাথা ঝিমঝিম করছে, বাঁ চোখে দেখতেও কষ্ট লাগছে কিছুটা। রাগটা এই কারণেই তরতরিয়ে বেড়ে গেল ওর। গায়ের সাদা শার্টটার বোতাম না খুলেই টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে গা থেকে খুলে ছুঁড়ে মারল নিচে। আয়মান পা চেপে ধরে ততক্ষণে আবার দাঁড়িয়ে গেছে। ও যে আবার আঘাত করতে হামলে পড়বে তা বুঝতেই জায়িন আর একটা মুহূর্ত ওকে সময় না দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দু’আঙুলে এমনভাবে ওর কণ্ঠনালি চেপে ধরল যে, জায়িনের হাত ছাড়াতেই ছটফট করতে আরম্ভ করল আয়মান। আর পালটা আঘাত করা তো দূরে থাক। কিন্তু জায়িন সহজে ছাড়ল না। রাগত স্বরে চিবিয়ে বলে উঠল, ‘এই গ্যাংস্টার আয়মান হয়েছ কত বছর? পাঁচ বছর! সর্বোচ্চ ছয় বছর। আর এই জায়িন মাহতাব তৈরি হয়েছে বারো বছর। তুমি কতগুলো ক্রাইম করেছ? তুমি যখন ক্রাইম শুরু করেছ তখন আমি ক্রাইম জগতে অলমোস্ট গডফাদার।’
দম এবার যেন আয়মানের ফুরিয়ে আসছে। চোখে মুখের চেহারা কালো হতেই জায়িন ছেড়ে দেয় ওকে। একটু সময় ধরে ঘনঘন শ্বাস নিয়ে ক্রুদ্ধ চোখে জায়িনের দিকে তাকাতেই জায়িন আবার এগিয়ে আসে ওর কাছে। আয়মান সে মুহূর্তে ওকে ধাক্কা দিয়ে বলে ওঠে, ‘গডফাদারের দশা তাহলে আয়মানের কাছে খাঁচায় বন্দি বাঘের মতো হয়েছিল কী করে?’
-‘হুঁ হুঁ, তাই তো! কী করে টেরোরিস্ট আয়মান মেহরিনের কাছে মেনি বিড়ালের মতো অবস্থা হলো আমার? আমার পরিচিত যে শোনে ওই ঘটনা সে-ই অবাক হয়, বুঝলে? আসলে অতি উত্তেজনার ফল যে কতটা খারাপ হয় তা সেদিনের পরিস্থিতি দ্বারাই বুঝলাম। ওইদিনের মতো উত্তেজনা জীবনে কখনো আর কিছুতে উপলব্ধি হয়নি আমার। মানুষ ঠিকই বলে। প্রথমবার প্রেমে পড়লে সেই প্রেমী পাগল প্রেমীই হয়ে যায়। না হলে আমি সেদিন কী করে অসতর্ক হয়ে পড়লাম? তোমাকে খুব দ্রুত কাছে পেতে চলেছি। এই উত্তেজনায় দিনের বেলাতেই জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম যেন৷ আর সেখানেই কট’টা খেয়ে গেলাম।’
জায়িনের কথাগুলো শোনার ফাঁকে ফাঁকে আয়মান ওর কপালের ডানপাশে ছোট্ট একটা কাটা চিহ্নসহ গায়ের বিভিন্ন কাটা দাগ, সেলাইয়ের দাগগুলো লক্ষ করছিল। এই দাগগুলো তো আগে দেখেনি সে। গাজীপুর বাংলোতে থাকাকালীন গাছের মোটা গুড়ি কাটার সময়ই জায়িনের খোলা শরীর দেখেছিল সে। মেকআপের আবরণের নিচে এই দাগগুলো ঢাকা পড়েছিল। তাহলে কি এই দাগগুলো ঢাকতেই তার ওই ছদ্মরূপ ছিল? না আরও কোনো বিশেষ কারণ আছে?
কথা শেষ হতেই আয়মানের দৃষ্টি খেয়াল করল জায়িন। তখন আবারও এগিয়ে এল ওর কাছে। তা দেখে আয়মানও আবার ওকে মারতে উদ্যত হলেই জায়িন ওর দু’পায়ের পাতাতে পাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে ওর হাতদু’টোও তখনই এক হাতের মাঝে খুব শক্তভাবে আয়ত্ত করে নিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ইঞ্জেকশন বের করল আরেক হাতের সাহায্যে। ইঞ্জেকশনের ক্যাপটা দাঁত দিয়ে টেনে খুলে ফেলে নিমিষেই সেটা আয়মানের কোমরে পুশ করে দিলো। এর মাঝে আয়মান চেষ্টা করেও হাত বা পা মুক্ত করতে পারেনি। ধীরে ধীরে ও অনুভব করল পা দু’টো অবশ হয়ে আসছে ওর। কিছু মুহূর্ত পরই ও আর চলতে বা পা নড়াতে পর্যন্ত পারবে না। তা বুঝে উঠতেই জায়িনের দিকে কেবল রাগান্বিত দৃষ্টি ছোঁড়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না। পা পুরোপুরি অবশ হতেই পড়ে যেতে চাইলে জায়িন ওকে আঁকড়ে ধরে কোলে তুলে নিয়ে বিছানাতে শুইয়ে দিলো। আকস্মিক অবস্থাটাই আয়মান গালিটুকু দিতে পর্যন্ত ভুলে গেল। আর ওর স্তম্ভিত অবস্থার সুযোগ নিয়ে জায়িন হাতদু’টোরও একই হাল করল। ঝুঁকে পড়ে ওর কপালের ওপরে শুয়ে থাকা বাদামী, কালো বর্ণের এলোমেলো ছোটো চুলগুলো আলতো স্পর্শে গুছিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আরও অনেক চমক দেখার বাকি আছে, জাদু। তুমি এখন একটু ঘুমাতে চেষ্টা করো। আমি ফিরে আসার পর আর ঘুমাতে পারবে না কিন্তু।’
ঘরের লাইটটা অফ করে দিয়ে জায়িন বেরিয়ে গেল। আয়মান কতটা বাজেভাবে আটকা পড়ে গেছে, তা ও যথেষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে নিজের শরীরের নতুন পরিচ্ছদ দেখেই।
—————
মেলবোর্ন থেকে আটশো কিলোমিটার দূরত্বে কপারের বাসাটা। সেখানেই এখন জায়িন আয়মানকে নিয়ে থাকছে। বাসাটা কপার কিনে রেখেছে বহু আগেই। ওর পরিবারও এই বাসা কেনার কথা এখন অবধি জানে না। তাই এখানেই নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে জায়িন।
বাসা থেকে বেরিয়ে জায়িন কপারের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে। চোখ সংবেদনশীল একটি অঙ্গ। চোখের ট্রিটমেন্টটা যেন তার না নিলেই হচ্ছিল না। ব্যথাটা ক্রমশ বেড়েই চলছিল কমার বদলে। মেলবোর্নের দিকেও গিয়েছিল তারা। মূলত স্যামুয়েলের বাসাতে। এখন আবার ফেরার পথে। রাস্তায় গতিসীমা ওদের ১৪০-১৬০। গাড়িতে দু’জনই চুপচাপ। কিছুদিন পরই জায়িনের বন্ধু চারজন নিজেদের কর্মজগতে ফিরে যাবে আবার। ওদের সঙ্গে এখন ওর থাকা সম্ভব হচ্ছে না আয়মানের জন্য। তাই স্যামুয়েলের বাসাতেই সবাই দেখা করতে গিয়েছিল।
রাস্তার দুই ধারে শুধুই মাঠ। মাঠের সীমারেখা টানা যেন মুশকিল। যেতে পথে চোখে পড়ল কিছু পশুখামার। আবার সামনে এগিয়ে পাহাড়ি রাস্তা। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে দু’একটা বড়ো বড়ো লরি চলে যাচ্ছে। জানালার বাইরে শূন্য দৃষ্টি ফেলে আয়মানের কথায় ভেবে চলেছে জায়িন। এই ভাবনার মাঝে চোখদু’টো কখন যেন লেগে এল ওর। ফিরতে ফিরতে ওদের ভোর হয়ে গেল। কপার ওকে ডেকে তুলে দিতেই গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে জাইমাকে কল করল সে। কয়েক ঘণ্টার মাঝে ওর সাথে আর কথা বলা হয়নি। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না ফোনের ওপাশ থেকে।
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়েই আয়মানের ঘরে উঁকি দিলো জায়িন। কিছুক্ষণের মাঝেই অবশ ভাবটা কেটে যাবে ওর। তাই ব্যালকনির দরজাটা ভালোভাবে আটকে খাবার আনতে চলে গেল। তার কিছু সময় পরই জেগে উঠল আয়মান। বাথরুমে যাবার প্রয়োজন বোধ করতেই হাত পায়ের করুণ দশার কথা খেয়াল হলো। কিন্তু অনুভব করল পা নাড়াতে সক্ষম হচ্ছে ও। আশেপাশে তাকিয়ে কতক্ষণ ঘরের সব কিছু লক্ষ করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। তখনই জায়িন খাবারের ট্রে হাতে করে ঘরে এল। খুব সহজ স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি অপেক্ষা করছি। ফ্রেশ হয়ে এসো।’
আয়মানও অতিরিক্ত কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করল না। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসেই জায়িনের মুখোমুখি বসল। জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আমাকে ঠিক কী কাজে ব্যবহার করতে চাও?’
প্রশ্নটার অর্থ জায়িন চট করেই বুঝে ফেলল। আয়মানের ধারণা, জায়িন কোনো স্বার্থে বা উদ্দেশ্যে ওকে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ এমন ধারণাটা হওয়া অবশ্য অস্বাভাবিক কিছুও নয় আয়মানের পেশা লক্ষ করলে। জায়িন জবাব দিলো, ‘বলব। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার সবকিছু তোমাকে মানতে হবে।’
-‘সব কিছু বলতে?’
-‘আগে নাশতাটা করে নাও।’
কথাটা বলেই জায়িন জানালাটা খুলে দিলো। পর্দাটাও সরিয়ে দিলো, শান্ত গলায় বলল, ‘আমার কাজটা একদিনের জন্য নয়। সারাজীবনের জন্য।’
আয়মান কোনো জবাব দিলো না। শুধু মনোযোগের সাথে খেতে ব্যস্ত সে। জায়িন ওর পাশে এসে বসল আবার। পানির গ্লাসটাতে পানি ঢেলে ট্রের এক পাশে রেখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। খাওয়া প্রায় শেষ তখন আয়মানের। জায়িন পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেবার আগেই ও জগটা নিয়ে জগের মুখে চুমুক বসাল। হাসল জায়িন। ট্রেটা নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল সে। তবে ফিরল খুব দ্রুতই। আয়মান তখন শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়েই চুলগুলো ব্রাশ করে নিচ্ছে। জায়িন ওর পিছে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘আর একটু চড়া মাত্রার ফর্সা হলেই তোমাকে আর দেশি লাগত না।’
-‘আমি এখনি বের হবো। তুমি ডিল করতে আসবে আমার হোটেল। কাজের জন্য তোমার সঙ্গে থাকার প্রয়োজন নেই আমার।’
কথাগুলো বলতে বলতে প্যান্টের নিচটাও ভেঙে গুটিয়ে নিলো কিছুটা। কারণ প্যান্টের সাইজটা একটু বেশিই বড়ো মনে হচ্ছে ওর। জায়িন ওর কার্যকলাপ দেখে আর কথা শুনে নিঃশব্দে হাসতে হাসতে বিছানাতে আধশোয়া হয়ে গা এলিয়ে দিলো। আয়মান প্যান্টের দুই পকেটে হাত পুড়ে দাঁড়িয়ে, ভ্রুজোড়া নিজস্ব ভঙ্গিতে উঁচিয়ে ওকে দেখতে থাকল। জায়িনের ভাবগতি কিছুটা বোঝার চেষ্টা আরকি।
ইশারায় ওকে বসতে বলল জায়িন। কিন্তু আয়মান যে ওর গা ঘেঁষে বসতে একেবারেই নারাজ, তা জায়িন বুঝেও পাত্তা দিলো না। তাই আচমকা টানে ওকে নিজের কাছে এনে অনেকটা পেছন থেকে জাপটে ধরার মতো করে জড়িয়ে ধরে বসল। আয়মান কিছু বলা বা করার আগেই এক হাতে ওকে জড়িয়ে রেখে অন্য হাতে ওর সামনে বেশ কয়েকটা ছবি মেলে ধরল। মৃদুস্বরে ডাকল ওকে, ‘আয়মান, চেনা যায় ছেলেটিকে?’
_________________