সিন্ধু ইগল – (২১)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
গত তিনদিন যাবৎ জায়িন অভুক্ত। সামান্য পানিটুকুও তাকে পান করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। পুরো দু’দিন তার হাত আর পা অবশ করে রেখেছিল আয়মান। দয়া দেখিয়ে সেই অসাড়তা থেকে তার হাত, পা মুক্তি পেলেও টানা তিন দিন অভুক্ত থাকার ফলে জায়িন এখন অনুভূতিনাশক বিনা ইঞ্জেকশনেই নিস্তেজ হয়ে আছে। বদ্ধ ঘরটাতে পর্যাপ্ত বাতাসেরও অভাব। প্রথমদিন আয়মান তার সামনে এলেও এরপর আর তার দেখা পায়নি জায়িন। শুধু জাইমা এসে কয়েকবার দেখে যায় তাকে। অবশ ভাব কেটে যাওয়ার আগে সে জ্ঞান হারিয়েছিল। জ্ঞান ফিরে পাবার পর থেকে সে নিজেকে হুইলচেয়ারে হাত, পা, শরীর বেঁধে রাখা অবস্থাতে আবিষ্কার করে৷
কাতর কণ্ঠে বেশ কয়েকবার জাইমাকে ডেকেছিল সে পানি দেওয়ার জন্য। আয়মানের বারণ উপেক্ষা করে জায়িনকে দয়া দেখাতে পারেনি জাইমা। কিন্তু শেষবার সে আবারও জাইমার কাছে অন্তত কয়েক ফোঁটা হলেও পানি চেয়ে অনুরোধ করল। জাইমা তাকে তখন বলল, ‘যাকে ধরতে এত দূর ছুটে এসেছ তার মনটা পশুর মতো। সেখানে কারও জন্য যেমন কোনো অনুভূতি জন্মায় না, তেমন কারও জন্য দয়া মায়াও নেই।’
মলিন মুখটা খানিক উঁচু করে জায়িন কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘বিশ বছর বয়সে যখন আমি প্রথম এক বিশ্বাসঘাতককে খুন করি। সেই মানুষটি মৃত্যুর আগে জীবনের শেষবারের মতো তারায় ঝলমলিত রাতের আকাশটা খোলা মাঠে শুয়ে দেখতে চেয়েছিল। আমার তিনজন বন্ধু তার বদলে তাকে সেদিন মৃত্যুর আরও কাছে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না, সে অপূর্ণ অভিলাষ নিয়ে মরে যাক। এরপর শেষ নিঃশ্বাস ছেড়েছিল সে খোলা সবুজ মাঠের বুকে শুয়ে রাতের নক্ষত্র ভরা আকাশটা দেখতে দেখতে। আয়মান মেহরিন অনুভূতিহীন। তুমি তো নও।’
বলেই চোখদু’টো বুজে নিস্তেজ ভঙ্গিতে মাথাটা নুইয়ে ফেলল সে।
এরপর দ্বিধাবোধ কাটিয়ে জায়িনকে নিজ হাতেই পানি পান করিয়ে দেয় জাইমা। কিন্তু তার জন্য চরম মূল্য দিতে হয় তাকে আয়মানের কাছে। সে নিজেই আয়মানকে জানায়, জায়িনকে সে পানি না দিয়ে থাকতে পারেনি। তখন আয়মান নেশার মাঝে মত্ত। এই সময়টাতেই তার দ্বিতীয় সত্তা প্রকাশ পায়৷ যার সঙ্গে তার স্বাভাবিক সত্তার কোনো মিল নেই। আর এই দ্বিতীয় সত্তাকেই প্রত্যেকে সাইকো বলে থাকে। সমস্ত হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সে নৃশংসভাবে মানুষও হত্যা করতে পারে এই অবস্থাতে। খুব খারাপভাবে সে জাইমাকে আঘাত করে বসে, জায়িনকে পানি দেওয়ার অপরাধে৷ সারা সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে আয়মানের ঘরে ভাঙচুরের শব্দ পেয়ে ছুটে গিয়ে দেখতে পায় জাইমার করুণ অবস্থা। ওই মুহূর্তে সে আয়মানের হাত থেকে জাইমাকে না ছাড়ালে হয়তো জাইমার মৃত লাশই দেখতে হতো। দু’বছর কাজের মাঝে এমনটা প্রথমবার হয়নি জাইমার সঙ্গে। কিন্তু তারপরও সে আয়মানকে ত্যাগ করতে পারে না।
————–
তিন দিন চার রাত পেরিয়ে রোদ্দুরে মোড়া সোনালী সকালটা আজ দেখতে পেল জায়িন। আবছা দৃষ্টিতে ঠাওর করল সে, কমলা রঙা ফতুয়া ধরনের কোনো জামা পরা একটি মেয়ে ঘরের জানালাটা খুলে দাঁড়িয়ে আছে জানালার সামনে। তবে মেয়েটা যে আয়মান নয়, এটুকু চিনতে অসুবিধা হলো না ওর৷ তাহলে কি সে জাইমা? মৃদু কম্পনযুক্ত জড়ানো কণ্ঠে ডেকে উঠল জায়িন, ‘জাইমা! তুমি ওখানে?’
জায়িনের নিস্তেজ গলায় ডাকটি শুনে জাইমার বুকের কোথাও একটুখানি ধুক্ করে উঠল হঠাৎ। এমনটা কেন লাগল? চকিতে পেছন ফিরে তাকাল সে। সূর্যের আলোর সরু দীর্ঘকায় রশ্মি গিয়ে ঠেকেছে জায়িনের সারা শরীরে। দুর্বল বদন তুলে চোখদু’টো পিটপিট করে দেখতে চাইছে তাকে। কেমন যেন অদ্ভুত মায়া হতে লাগল তার, রোদ্দুরে মাখা জায়িনের আদুরে মুখটা দেখে। বারবার তার মনে হতে লাগল, এমন যন্ত্রণা পাওয়ার যোগ্য নয় এই পুরুষটি। জায়িনের মুখটা যেন কেমন মায়াভরা আর পবিত্র উপলব্ধি হয়। অথচ এই পুরুষটিও নাকি খুনি আর বহু নারীতে আসক্ত! কোনো খুনি, নারী আসক্ত পুরুষ নিশ্চয়ই পবিত্র হতে পারে না৷ তবুও এমন উপলব্ধি কেন হচ্ছে? শান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে দাঁড়াল সে জায়িনের কাছে। এবং খুব কাছে। ঝুঁকে পড়ে জায়িনের চোখের গভীরে যেতে চাইছে যেন সে৷ জায়িনের ক্ষীণ দৃষ্টির চোখজোড়া প্রথম দিনের থেকেও আজ বেশি ভালো লাগছে জাইমার। সেই চোখে চেয়েই সে স্বগোতক্তি করে উঠল, ‘আফসোস! তুমি আমার আপন পুরুষ নও।’
জায়িন দেখতে পেল জাইমার মুখের আহত জায়গাটুকু। ডান গালে কানের খুব কাছাকাছিতে ছুরি কিংবা অন্য কোনো ধারাল কিছু দ্বারা কেটে যাওয়া দাগ। জাইমার লাল ফর্সার সারা মুখটাও কেমন এক রাতেই শুকিয়ে গেছে। কপালের বাঁ পাশে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ। চট করেই জায়িন সত্যিটা বলে ফেলল, ‘সামান্য আমাকে পানি দেওয়ার অপরাধে এত জখম! আর যদি আমাকে খাইয়ে দিতে?’
ভাবনাতে ব্যাঘাত ঘটল জাইমার, জায়িনের প্রশ্নে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে জবাব দিলো, ‘তোমাকে ব্রেকফাস্ট করাতেই এসেছি। পানি দেওয়ার অপরাধে পানিশমেন্ট পেলেও তুমি আজ থেকে খাবার খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছ। হয়তো আয়মানের দয়া হয়েছে তোমার প্রতি।’
-‘আর এই জখম?’
জাইমা কোনো উত্তর দিলো না। মুখটা চুপসে আছে তার। ব্যথার যন্ত্রণা বলে প্রকাশ না করলেও চেহারাতে ঠিক প্রকাশ পাচ্ছে৷ ওর জন্য অনেকটাই খারাপ লাগছে জায়িনের। জিজ্ঞেস করল ওকে, ‘পারমিশন দিয়েছে তোমাকে?’
-‘উহুঁ, অর্ডার করেছে। তোমার কী মনে হয়? তোমার জন্য আমার মায়া উতলে উতলে পড়ছে? যে তোমাকে খাবার খাওয়ানোর অনুমতির জন্য ঘ্যানঘ্যান করেছি আয়মানের কাছে?’
ম্লানমুখে মৃদু হাসল জায়িন, বলল, ‘কথা বলতেও শক্তি জরুরি। সেটুকুও বোধ হয় আমার খুইয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তবুও বলছি। আমার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে।’
ঘরের কোণে একটা টেবিল আছে৷ টেবিলের ওপর খাবারের প্যাকেটগুলো রাখা ছিল। সেগুলো খুলতে খুলতে জাইমা জিজ্ঞেস করল, ‘কী ক্ষমতার কথা বলছ?’
জায়িন উত্তর দিলো না। মাথা ঝুঁকিয়ে রেখে মৃদুভাবেই হাসতে থাকল। একটা টুল টেনে জাইমা জায়িনের সামনে বসল খাবার হাতে নিয়ে। জায়িন চেয়ে দেখল, খু্ব সুস্বাদু খাবারই আনা হয়েছে তার জন্য। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অবাক হওয়ার মতোই। তার দৃষ্টিভঙ্গি দেখে জাইমা বুঝতে পারল হয়তো জায়িনের একটুখানি অবাক হওয়ার বিষয়টা।
-‘তিন চারদিন না খাইয়ে রেখে হঠাৎ এত ভালো খাবার কেন দেওয়া হচ্ছে? আসলে এই ব্যাপারটাতে আমি নিজেও বিস্মিত৷ আয়মানের কোনো কাজ পরিষ্কারভাবে বোঝা মুশকিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে নেশা কাটিয়ে আমাকে দেখতে ছুটে আসে আমার ঘরে৷ এসে ভীষণ স্যরি বলে। মার দেওয়া জায়গাগুলোতে নিজেই মেডিসিন দিতে থাকে। তারপর হঠাৎ তোমাকে দেখতে আসার আগে খাবারগুলো ধরিয়ে দেয় হাতে। মুচকি হেসে বলে তোমার সাধ পূরণ করবে সে। অর্থাৎ তোমাকে না মারা অবধি তুমি প্রতিদিনই এমন খাবার পাবে।’
-‘কতদিন বাঁচিয়ে রাখতে চায় সে আমাকে?’
-‘তিনদিন।’
-‘আচ্ছা, তাহলে এই তিনদিন যেন সে আমার আশেপাশেও না থাকে৷ এটাও আমার সাধ হিসেবে যেন ধরে নেয় সে।’
খাবারটা জায়িনের কাছে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, বলব। এখন খেতে শুরু করো।’
জায়িন খাবারগুলোর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি নিজ হাতেও খেতে পারব না, তাই না?’
-‘উহুঁ।’
-‘তাহলে তুমি আমাকে খাইয়ে দিচ্ছ?’
-‘ওহ্হো! যুক্তিতে তো সেটাই আসছে তাহলে।’
হেসে উঠল জায়িন। জাইমা তার হাসি দেখে বলল, ‘বলতেই হবে, তুমি মানুষটা খুঁত বিহীন তৈরি হয়েছ। সব কিছুই নজরকাড়া তোমার। এই প্রথম তোমার হাসি দেখছি বলে সুন্দর লাগছে? না কি প্রকৃতই তোমার হাসিও সুন্দর?’
এ প্রশ্নেও জায়িন উত্তর হিসেবে হাসল। তারপর বলল, ‘আমার দিকে পলকহীন চেয়ে থাকো। নিজেই বুঝবে তাহলে।’
জাইমা একটু হেসে ওকে খাওয়াতে শুরু করল।
-‘কী কপাল তোমার দেখছ? বন্দি হয়েও কোনো সুন্দরী মেয়ের হাতের সেবা পাচ্ছ। এমনটা কখনো হয়?’
জাইমার এ কথাতেও জায়িন শুধু হাসল৷
—————
সেদিন থেকে পুরো তিনটা দিনই জাইমাকে জায়িনের সঙ্গেই থাকতে হয়েছে। আয়মানও জাইমার ভরসাতে জায়িনের আশেপাশে আসেনি৷ কারণ, জাইমা প্রতিটা মুহূর্তের খবরাখবর তাকে পৌঁছে দেয়।
শেষ তিনদিনের মাঝে জায়িনকে অবশের জন্য কোনো ইঞ্জেকশন না দিলেও আয়মান আসবে জেনে জাইমা আবার জায়িনের হাত আর পা অবশ করে দেয়, হুইলচেয়ারে বেঁধে রাখার পরও। তারপর বেরিয়ে যায় সে। তার কিছুক্ষণ পরই আয়মান এসে দাঁড়ায় জায়িনের সামনে। জায়িনের কথা মতোই শেষ তিন দিন ওর সামনে আসেনি। তাকে দেখে জায়িন ঘাড় হেলে থাকা অবস্থাতেই ফিচেলসুলভ কথা শোনাল, ‘আমার রোম্যান্সে তুমি এতটাই ভীত! যাক, জায়িন মাহতাবের আর কিছুতে ভয় না পাও। অন্তত তার আদরকে তো ভয় পেয়েছ।’
আয়মান মৃদু হেসে জায়িনের সামনে প্রথম দিনের মতোই হাঁটু গেড়ে বসল। জায়িন গভীর অনুরাগ নিয়ে দেখতে থাকল আয়মানের স্মিতহাস্য মুখটা। কিছুটা অস্বাভাবিকতা দেখতে পায় সে আয়মানের সব রকম অভিব্যক্তিতে। সেদিন জাইমাও বলছিল, আয়মানকে দুই সত্তাতেও এক সঙ্গে দেখা যায়। একই মুহূর্তে কখনো স্বাভাবিক, আবার হিংস্র, অস্বাভাবিক। জায়িনেরও এই মুহূর্তে হঠাৎ মনে হচ্ছে, আয়মানের স্বাভাবিকতাও অন্য সব সুস্থ স্বাভাবিক মানুষদের মতো নয়। ছোটোবেলাতে আয়মান মোটেও এমনটা ছিল না। এত বছর পর আয়মানকে নতুনভাবে দেখাটা অস্বাভাবিক নয়। বড়ো হলে অনেক কিছুই মানুষের পরিবর্তন হয়। কিন্তু স্বভাব চরিত্রে নিশ্চয়ই অস্বাভাবিকতা আসে না? তাহলে এমনটা হওয়ার বিশেষ কারণ কী? আয়মানের সরল মুখের হাসিটাও মাঝে মাঝে কেমন বোকা বোকা ধরনের লাগে যেন।
জায়িনের অভিনিবেশ কাটল আয়মানের বক্রোক্তিতে, ‘আমাকে এমন আনব্লিঙ্কিং দেখার কারণটা নিশ্চয়ই এটা, লিয়ার মতো আমাকে আর ছুঁতে পারলে না?’
জায়িন নিরব রইল। আয়মান হাসতে হাসতেই বলতে থাকল, ‘ব্যাপারটা কেমন, তাই না? তোমার এই চোখ, চোখের দৃষ্টিতে সত্যিই কিছু একটা ছিল। যেটা আমার ভীষণ চেনা লাগত। আর মনে হতো, এই চোখের সামনে আমি না জনি কতবার চোখরাঙানি খেয়েছি হয়তো। অজান্তেই কেমন ভয় হতো তোমার চোখদু’টোতে তাকালে। কিন্তু তুমি মানুষটাকে খুন করার মতো অ্যাবালিটি আমার যখন তখন ছিল। তারপরও এমন একটা ড্যামড্ ফিল কেন হতো জানি না। অসহনীয় কোনো যন্ত্রণাকেও যেখানে আমি কেয়ার করি না। সেখানে তোমার মতো প্লে বয় এক ডিটেক্টিভের সি ইগলস খ্যাত চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না আমি? শেম অন মি! টাট্!’
-‘এই মুহূর্তে তুমি আমার ডেথ ট্র্যাপ। যেটা আমি আর তুমি দু’জনেই জানি। এ কারণে তোমার মাঝে সেই ভয়টা এখনো জীবিত থাকলেও সেটাকে তুমি উপলব্ধি করতে পারছ না। কিন্তু তুমি এখনো উইক আমার এই চোখেই। আর তাই আজীবনই নিজেকে এভাবেই ধিক্কার জানাতে হবে তোমার। এবং এটাও সত্য আয়মান। আমার চোখ, চোখের চাউনি সত্যিই তোমার চেনা। তোমার কি মনে নেই? এই যে তোমার ড্যামড্ ফিলটা হয় আমার চোখ দু’টো দেখলে। এক সময় তুমি সত্যিই বহুবার আমার চোখরাঙানি খেয়েছ।’
হো হো শব্দে হেসে ফেলল আয়মান। হাসার জন্য কিছু সময় সে কথা বলতে পারল না। হাসিটা থামতেই সে বলল, ‘এই গল্পগুলো লিয়াকে বললে ও এতক্ষণে সত্যিই বিশ্বাস করে নিতো। আবেগে গলে গলে পড়ত। এ জন্যই তো এত সহজে তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল নিজেকে অতি চালাক ভাবা বোনটা আমার। বাই দ্য ওয়ে, যেটা জানতে তোমার সামনে আসা। হোয়্যার ইজ মাই সিস্টার?’
-‘সি ইজ নো মোর।’ হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় উত্তর দিলো জায়িন।
কথাটা শোনা মাত্রই আয়মানের হাসিটা বিলীন হয়ে গেল। চোখজোড়ার চঞ্চলতাও নাশ হতে থাকল যেন। বিষণ্ন এক মেঘমেদুর ধীরে ধীরে গ্রাস করে তুলল তাকে। কতক্ষণ থমকে থেকে কেমন তোতলানো শব্দ উচ্চারণ করল সে, ‘ইয়্যু ওয়ান্ট টু স্কেয়ার মি?’
-‘নট রিয়্যালি।’
ঠোঁট কামড়ে, কপাল কুঁচকে, চিন্তিত ভঙ্গিতে দৃষ্টি নিচে নামাল আয়মান। হঠাৎ করে ঠোঁটটা ছেড়ে জিহ্বার ডগা দিয়ে ঠোঁট’দু’টো ভিজিয়ে নিলো সে। কুঁচকানো কপালটা ধীরে ধীরে মসৃণ হলো আবার। কিন্তু মানসিক ত্রুটিপূর্ণ মানুষের মতো কেমন যেন দেখাল তাকে। কপালে ভাঁজ পড়ল আবার তার, চোখের তারা এদিক ওদিক ঘোরাতে থাকল। ঠোঁট কামড়ে আবার কী যেন ভাবল। জায়িন পুরোটাই লক্ষ করতে থাকল আয়মানের ভাবভঙ্গি। হঠাৎ এমন কেন দেখাচ্ছে ওকে? কী সমস্যাতে ভুগছে আয়মান? ও কি সত্যিই মানসিকভাবে অসুস্থ? অপেক্ষা করতে থাকল জায়িন, এরপর আয়মান কী বলে তাকে তা শোনার আশায়।
কতক্ষণ ধরে আয়মান কিছু ভেবে জায়িনকে ভার গলায় বলল, ‘ওকে তুমি মারোনি। খুব কষ্টে রেখেছ ওকে, তাই না? কিন্তু কেন? ও তোমাকে স্যাটিসফাইড করত। আমার সঙ্গে বিট্রে করেছে সে তোমার জন্য। সি ডিসার্ভস হ্যাপিনেস ফ্রম ইয়্যু।’
জায়িন নিরবে হাসতে থাকল। তা দেখে আয়মান রেগে যাচ্ছে ভীষণ। সেই সাথে তার মাঝের অস্বাভাবিকতাও ফুটে উঠছে। চোখ বোজা অবস্থায় কপাল কুঁচকে মাথা চুলকাতে থাকল সে। আচমকা বিদ্যুৎ গতিতে দাঁড়িয়ে পড়ে জায়িনকে উদ্বিগ্ন সুরে বলতে থাকল, ‘তোমাকে আকর্ষণ করার শুরুটা আমি করলেও শেষটা কিন্তু ও-ই করেছে। ওয়েল, আমি তোমাকে এক্সপ্লেইনড করছি।’
কথাগুলো বলেই আবার সে মাথা চুলকাতে থাকল অস্থির ভঙ্গিতে। বিড়বিড় করে স্বগোতক্তি করছে, ‘কোথা থেকে শুরুটা হয়েছিল যেন?’
জায়িন তা শুনতে পেল। ওকে সাহায্য করতে বলল, ‘যেদিন সকালে প্রথমবার তোমাকে প্রিয় বলে ডেকেছিলাম। ঠিক তার পরেরদিন বিকাল থেকে।’
কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকাল আয়মান ওর দিকে। মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সেদিন বিকালে আমার বদলে ও গিয়েছিল তোমার খোঁজ নিতে। তারপর তোমার ওপর অ্যাটাক হলে অধিকাংশ দিনই ও তোমায় দেখতে গিয়েছে, তোমার খোঁজ নিয়েছে। আমি নই। আমি হয়তো দু’বার গিয়েছিলাম। এরপর একদিন সন্ধ্যায় তুমি বাংলোর সামনে এসে কল করেছিলে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য। কিন্তু সেদিন আমি বাসাতেই ছিলাম না। তোমাকে ট্র্যাপে ফেলতেই আমার নাম্বারটা ওকেও ব্যবহার করতে হতো। ওইদিন তুমি আমার সঙ্গে না, লিয়ার সঙ্গেই ইন্টিমেট হয়েছিলে। এটা তো তুমি নিশ্চয়ই লিয়ার থেকে পরে জেনেছ। তোমাদের বাসায় ঘনঘন যাওয়া-আসা, তোমার সঙ্গে বাইরেও ঘোরাঘুরি করা, সবটাই আমার বদলে লিয়া ছিল। ও তোমাকে সত্যিই পছন্দ করত। আরে তোমরা তো আমার সঙ্গে ডাবল গেমও খেলেছ। আমার অগোচরে কতবার ইন্টিমেট হয়েছ। এরপরও কেন ওকে টর্চার করেছ?’
-‘রিল্যাক্স জাদুরানি! এত ছটফট কেন করছ ওর জন্য? সে তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তোমাকে কতবার খুন করার চেষ্টাও করেছে।’
-‘উহুঁ, রিভেঞ্জ নিতো ও। আমি ম্যাডেন্ড অবস্থায় ওকে বাজেভাবে হিট করতাম৷ ও রেগে গেলে সেটারই রিভেঞ্জ নিতে আমাকেও বাজেভাবে হিট করত। মাইন্ডলেস হয়ে যেত রাগে। রাগ কমলে এরপর ও নিজেই আমাকে কেয়ার করত। আর এটা আমিও করতাম।’
-‘সিরিয়াসলি! তোমাদের দু’বোনের কিছু ব্যাপার টোটালি ব্লিয়ার।’
-‘ওকে টর্চার করে তুমি একদম ভালো করোনি। কতটুকু ব্যথা সহ্য করেছ ও জানি না। কিন্তু তোমার মৃত্যু ওর ব্যথার থেকেও কষ্টকর হবে। এর আরও একটা কারণ আছে। আন্দাজ করো তো কারণটা কী?’
জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থাকল জায়িন ওর দিকে। আয়মান মুচকি হেসে বলল, ‘জাইমাকে প্রলুব্ধ করতে চেয়েছ। তাকে অ্যাট্রাক্টেড করতে চেয়েছ নিজের প্রতি।’
বেশ চমকাল জায়িন। তার চমকিত চেহারাটা দেখে আয়মান কিছু সময় হাসল। তারপর বলল, ‘ও ইয়াহ্, সে আমাকে সবটাই জানিয়ে দিয়েছে। সবাই লিয়ার মতো নয়, হ্যান্ডসাম। এবার তোমার দুর্ভাগ্য। জাইমা তোমাকে তোমার মতো করে সার্ভিসও দিয়েছে। আর আমার বিশ্বাসও রেখেছে।’
কথাগুলো বলেই আয়মান হাসতে হাসতেই দ্রুত পায়ে চলে গেল ঘর থেকে। আর ওর যাবার পথে চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কিছুই বলার রইল না জায়িনের।
—————
এর আগে যতবার জায়িন মেলবোর্ন এসেছে বন্ধুদের সাথে, ততবারই মুগ্ধ হয়ে ঘুরে ফিরে দেখেছে শান্ত মহিমান্বিত সমুদ্রনিকটবর্তী শহরটা। দক্ষিণসাগরের চমৎকার বিশাল বিশাল ঢেউয়ে গা ভিজিয়েছে। সবুজের ছাউনি ঘেরা রেইনফরেস্ট চষে বেরিয়েছে, গাছে গাছে কোয়ালার লাফঝাঁপ, চুনাপাথরের পর্বত দেখে উপভোগ করেছে। আর আজ সে বেলস বিচের সামনে আছে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য। যখন সে ভাই, বন্ধুদের সাথে সুন্দর মুহূর্তগুলো কাটিয়েছে, তখন কি সে একবারও জানত এখানটাতেই তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে?
বিচে জায়িনের হুইলচেয়ারের পিছে আয়মান দাঁড়িয়ে দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে নিলো। তারপর মিষ্টি হাসিটা ঠোঁটে নিয়ে জায়িনকে বলল, ‘চলো যাওয়া যাক এবার?’
সামনেই থেমে আছে একটি প্রাইভেট বোট। দু’জন ছেলের সাহায্যে জায়িনকে বোটে ওঠানোর পর আয়মান কাউকে কল করে কথা বলতে বলতে বোটে উঠল। গভীর রাতই বলা যায় এখন। জায়িন সবটা দেখে আন্দাজ করে নিলো, বোটটা ভাড়া করা নয়৷ যার বোট, সে অবশ্যই আয়মানের খুব পরিচিত কেউ। অথবা আয়মানের নিজরেই। বোটের ক্যাপ্টেন আর আয়মান ছাড়া মাত্র দু’জন এখন এখানে। যাদের অ্যাটিটিউডস বডিগার্ডের মতো। আর তাদের সাজপোশাকও। তাকে ধরে ফেলার পর থেকে আয়মান এত যত্নসহকারে আটকে রেখেছে যে, সে কোনোভাবেই কারও থেকে সাহায্য গ্রহণ করতে পারবে না। নয়তো তার একটা মেসেজেই এমন শত শত দেহরক্ষী এসে খুঁজে নিতো তাকে। এখন এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। সামনে যা হবে, তা তো তাকে মেনে নিতেই হবে।
বোট চলতে শুরু করেছে৷ কথা বলা শেষে আয়মান বোটের ওপরে চলে গেল। তারপরই জায়িনকেও তুলে নিয়ে এল সেই দু’জন। নিরবে কত সময় চারপাশটা দেখতে থাকল আয়মান। আর জায়িন দেখতে থাকল ওকে৷ সময় যেতে যেতে ঘণ্টা একটা পার হলো। একটা ঘণ্টা নিরবেই কেটেছে ওদের৷ আয়মান স্থির দাঁড়িয়ে ছিল আগের মতোই। বোটটা সমুদ্রের মাঝামাঝিতে। ফিরে এসে দাঁড়াল সে জায়িনের সামনে। তবে ওর দিকে তাকাল না। শুধু বলল, ‘তুমিই প্রথম কোনো মানুষ, যে আমার থেকে বিনা আঘাতে খুন হচ্ছো।’
কথাটা শেষ করা মাত্র ছেলেদু’টো হুইলচেয়ারে ওকে বাঁধা অবস্থাতেই তুলে ফেলে দিলো সমুদ্রে। আয়মান সেদিকে তাকালও না। বোটটাও আর এক সেকেণ্ডের মতো সেখানে দাঁড়ায়নি। চলন্ত অবস্থাতেই জায়িনকে ফেলা হয়েছে।
______________