সাঁঝক বাতি পার্ট ২২

0
399

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[২২]

-‘বেইমানীর জন্য ভাইকেও ছাড়ি নি। দেহ থেকে গলাটা আলাদা করে দিয়েছে। এখন তুইও একই পথে হাঁটছিস!’

শিফা নির্বাক। ভাই মানে প্রশান্ত? প্রশান্তর লাশ ছিল! দিগন্ত প্রশান্তকেও মেরে দিয়েছি? কেন? সে কিসের বেইমানী করেছে? ভাইকে মেরে দরজার সামনে ফেলে এসেছে। তাও নৃশংসভাবে। বুকও কাঁপে নি? সে আদৌ মানুষ! আবার ইচ্ছে করেই এসব সবাইকে জানিয়েছে। এতে ওর লাভ কি? দিগন্ত কেন সবাইকে জানাচ্ছে? সে কেন’ই বা মৃত্যুকে আহ্বান করছে? এখন পুলিশ তো উঠে পড়ে লাগবে। একে একে সবার পাপকর্ম বেরিয়ে আসবে। শিফা আর ভাবতে পারছে না। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। দিগন্ত শিফাকে টেনে রুমে নিয়ে গেল। স্বজোরে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দুই গালে হাত রেখে বলল,

-‘ ভালবাসতে হবে না। তবে ভালোবাসতে দে।’
-‘কেন এসব করছেন?’
-‘আসক্তিতে ডুবে গেছি। তাই একটা তুই এর প্রয়োজন।’
-‘ভালোবাসা ভালো। তবে ভুল মানুষকে নয়।’
-‘মুগ্ধতায় আঁটকে গেলে এ মন ঠিক ভুল খুঁজতে যায় না। শুধু চায়, ভালোবাসায় সিক্ত হতে।’

শিফা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। দিগন্তকে বড্ড অচেনা লাগছে। এই কি সেই দিগন্ত? যার শরীরে অহংকার আর ইগোতে পরিপূর্ণ ছিলো। কথায় কথায় অপমান করত। মারত! অকারণে কষ্ট’ও দিতো। ওরা একে অন্যের প্রতিপক্ষ। এ শত্রুতার জোরে ওদের সম্পর্ক। লোক দেখানো বিয়ে। এত অভিনয়। এত পাপ। হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই। সেই শত্রু’ই ঘুরে ফিরে ওর প্রেমে পড়ল? এটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? নাকি এটাও অভিনয়? সে নিখুঁত অভিনেতা। ওর পক্ষে সব সম্ভব। তাছাড়া দিগন্ত এক নারীতে সন্তুষ্ট ছিল না। সে ভিন্ন স্বাদ নিতে অভ্যস্ত। তাহলে? তখন দিগন্ত মৃদু হেসে শিফার দুই গালে ঠোঁট স্পর্শ করল।শিফা দিগন্তের থেকে
সরে বসে বলল,

-‘প্র প্র প্রশান্ত..!’
-‘মেরে দিয়েছি। সব বেইমানদের নিঃশেষ করে ফেলেছি।’
-‘কেন?’
-‘আমার কলিজায় হাত বাড়িয়েছিল। সাবধান করেছিলাম, শুনি নি।’
-‘সত্যি নাকি এটাও নতুন কোনো চাল?’
-‘দেখবে?’

কথাটা বলে দিগন্ত ওকে দো’তলায় নিয়ে গেল।
সর্বশেষ রুমটাতে প্রবেশ করল। শিফার একহাত দিগন্তের হাতের মুঠোয়। শক্ত করে ধরে আছে।
রাত তখন সাড়ে দশটা। চারদিকে নিস্তব্ধতা। এ বাড়িতে ওরা তিনজন ছাড়া কেউ নেই। শিফার অজানা ভয়ে বুক কাঁপছে। দরদরিয়ে ঘামছেও।
দিগন্ত কি দেখাতে নিয়ে এসেছে, কে জানে! তবে
রুমটা প্রচুর ঠান্ডা। শরীর শিউরে উঠছে। দিগন্ত
ওকে দাঁড় করিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। সামনে অনেক বড় বক্স। কফিনের মতো। উপরটা বেশ চকচকে। দিগন্ত শিফাকে কাছে ডেকে বক্স খুলতে ইশারা করল। শিফা এগিয়ে এসে কম্পিত হাতে
বক্স’টা খুলল। আর খুলে’ই চিৎকার করে উঠে দিগন্তের বুকে মুখ লুকালো। থরথরিয়ে কাঁপছে।
দিগন্তের বুকের শার্ট শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে।
যেন বুকের মধ্যেই ঢুকে যাবে। শিফার হাত হঠাৎ
ঢিলে হয়ে গেল। দিগন্তের বুকে ঢলে পড়ে জ্ঞান হারাল। ওর মস্তিষ্ক অতিরিক্ত চাপ নিতে পারে নি। ফলস্বরুপ, মস্তিষ্কও কিছুক্ষণের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দিগন্ত ওকে জাপটে ধরে বুকে আগলে কফিনের ঢাকনা দিয়ে শিফাকে কোলে তুলে নিলো। ওর মুখে ফিচেল হাসি। সে হাসতে হাসতে শিফাকে কোলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াল। কফিনের মধ্যে পড়ে রইল, প্রশান্তর মাথা। শুধুই মাথা। চোখ দুটো খোলা। তাকিয়ে আছে। দিগন্ত ইচ্ছে করে ওর চোখ বন্ধ করে নি।
ঠান্ডা বরফে রাখার ফলে সেভাবেই আছে।আর
ওর কপালে লিখা ‘বেইমান’। হঠাৎ কেউ দেখলে ভয় পাওয়াও স্বাভাবিক। যেমন, শিফা পেয়েছে।

সেদিন, শিফা প্রশান্তর বেরিয়ে যাওয়া পর দিগন্ত উপস্থিত হয়েছিল। খুব স্বাভাবিক ছিল সে। তবে প্রশান্ত ওকে দেখে ঘাবড়েও গিয়েছিল। কারণ সে এখানে আসত না।আর এ স্থানটা চেনারও কথা না। প্রশান্তের কার্যকলাপে দিগন্ত খোঁজও রাখত না। যে যার মতো চলতো।প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলত না। এজন্য প্রশান্ত অবাক হয়েছিল।দিগন্ত শিফার পিছু এসেছিল? নাকি অন্যকিছু? একথা
জানতে প্রশান্ত জিজ্ঞাসাও করেছিল।

-‘হট’স্ আপ ব্রো?’
-‘লেটস্ টক এবাউট দা মেইন পয়েন্ট?’
-‘ইয়াহ্, হুয়াই নট!’

তখন দিগন্ত আরাম করে বসে প্রশান্তকে সুন্দর করে বলেছিল,

-‘ শিফাকে রেপ করার জন্য তুলে আনতে লোক পাঠিয়েছিল। ছোট্ট তনয়ের হাতটাও কেটেছিলে।
ওর বাবাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিলে। সাফাকে মেরেছো তাও আমার নাম জড়িয়ে। হাসিবকেও মারলে। শিফার বাবাকে পুলিশের দেওয়ার ফন্দি এঁটেছো। আমাদের ইন্টিমেন্ট অবস্থার ভিডিটাও রাখতে চেয়েছিলে। শিফাকে ইন্টিমেন্টের প্রস্তাবও দিয়েছিলে। তাও আমার’ই কাছে। এসব মেনেও নিয়েছিলাম। এখন আবার শিফাকে আমার’ই বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছো, কেন? তোমার বাবাকে মেরেছি তাই?

-‘ভাই তোর এত বুদ্ধি কেন রে? সবকিছু বুঝেও নিয়েছিস? তা সত্যি করে বলত, শিফাকে তুই ভালোবাসিস?’
-‘না।’
-‘তাহলে ওকে রেপ করলে তোর লাগছে কেন?’
-‘আমার কলিজায় টান মেরে আবার আমাকেই জিজ্ঞাসা করছো, লাগছে কেন?’
-‘ওহ হো। কিন্তু ভাই ওকে আমার চাই-ই চাই।’
-‘সেই সুযোগ তুমি পাবে না।’

প্রশান্ত ওর কথা শুনে হাসতে লাগল। দুই হাতে তালি বাজিয়ে হাসছে। হাসতে হাসতে বেডে বসে পড়ল। যেন মজার কাহিনী শুনেছে। দিগন্তর যা
বলেছে সত্যি। এসব কাজগুলো সব করেছে।তবে
কয়েকটাতে সফল হতে পারে নি। দিগন্ত’ই হতে দেয় নি। কিভাবে যেন দিগন্ত জেনে যেতো।আর
ওর কাজে বাঁধা পড়ে যেতো। নিহাকে দিয়ে ওদের রুমে ক্যামেরা লাগিয়েছিল। কিন্তু সেই ক্যামেরা আর হাতে পায় নি। শিফাকে রেপ করে মারা ওর বড্ড শখ। শিফার মৃত্যু যন্ত্রনা উপভোগ করতে
চাইত। করতোও। আজ অথবা কাল। বাবাকে
স্বচক্ষে মরতে দেখেছে। সেদিন কিছু বলতে পারে নি। আড়ালে দাঁড়িয়ে শুধু দেখেছে। বদলা তো নিতে হবে।এজন্য শিফাকে উসকে দিয়ে দিগন্তকে মারতে চেয়েছিল। দিগন্ত মারা গেলে রাজত্ব আর রাণী দু’টোই তার। মূলত, এই কারণেই শিফাকে সেদিন ছেড়ে দিয়েছিল। আর নোংরা পরিকল্পনা
করে রেখেছিল। কিন্তু দিগন্ত ওকে সুযোগই দেয় নি। সে পানি খেয়ে গ্লাস রেখে আচমকা প্রশান্তর
গলায় ছুরি চালিয়েছিল। প্রশান্ত টু শব্দ করতেও পারে নি। ধারালো ছুরিতে একনিমিষেই গলা’টা পার করে দিয়েছে। আর একটা কথায় উচ্চারণ করেছে,

-‘তোমায় বাঁচিয়ে রাখলে আমার বুকেই ছুরি’টা চালাতে। সুযোগ দিতে না পারার জন্য আমি সরি।’

তারপর দিগন্ত প্রশান্তর মাথাটা সঙ্গে এনেছিল। আর রক্তাক্ত দেহটা ওদের বাসার সামনে রেখে এসেছিলো। যখন কেউ বেইমানী করে। তখন সে ভুলে যায়; ব্যাক্তিটাকে চিনে। অথবা ওর কাছের কেউ। শিফাতে হারাতে গিয়ে নিজেই হেরে গেছে। প্রাণ নিতে গিয়ে মন উৎসর্গ করে ফেলেছে। ওর
রন্ধে রন্ধে ছড়িয়ে গেছে, প্রনয়ের ব্যাধি। শিফাতে আসক্ত সে। এই আসক্তির লাগাম টানতে ব্যর্থ।
কমানোর চেষ্টা করলে শতগুন বেড়ে যাচ্ছে। মন পুড়ছে।আবার অপ্রকাশিত রাখতেও অক্ষম সে। কুলুষিত মনে পবিত্র প্রণয়ের আগমন ঘটেছে।যা কল্পনাও করে নি। একটু একটু করে জেদী মানবী ওর মনটা ছিনিয়ে নিয়েছে। উন্মাদ করে দিয়েছে।
ওকে প্রেমিক পুরুষ করে তুলেছে। যেটা ক্ষুণাক্ষরে টেরও পায় নি। আর যখন টের পেয়েছে তখন অনেকটা দেরী হয়ে গেছে।

রাত তখন আড়াইটার কাছাকাছি। গভীর রাত।
নিস্তব্ধ চারিপাশ। শিফা দিগন্তের বাহুডোরে। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মুখজুড়ে সিগ্ধতায় ভরপুর।
আদুরে দু’টো গাল। চিকন গোলাপি রাঙা ঠোঁট। এলোমেলো চুল। জুবুথুবু পোশাক। একজোড়া চোখের মালিক নিষ্পলকভাবে ওকে দেখছে।তার
মোহময় দৃষ্টিতে। দেখার শেষ নেই। তৃষ্ণা মিটছে না। এই তৃষ্ণা হয়তো মিটবে না। মিটাতেও চায় না। দিগন্ত এতক্ষণে কতবার শিফার গালে ঠোঁটে ছুঁইয়েছে হিসাব নেই। কতবার বুকে চেপে ধরেছে, তাও অজানা। কতশত উক্তি বলেছে তাও হুশে নেই। সে শুধু জানে, রাগ, জেদী, এই মেয়েটাই
ওর মানসিক সুস্থিরতা। এর মাঝেই ওর ভালো থাকা। ওকেই ওর চায়।দিগন্ত হেসে শিফার ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে দিলো। শিফা বিরক্তিতে দিগন্তর
বুকে মুখ ঘষে ঘুমে তলিয়ে গেল।নিশ্চিন্তের ঘুম।
দিগন্ত নিঃশব্দে হাসছে।শিফাকে জ্বালাতে ভালো লাগে। দিগন্ত একটু এগিয়ে শিফার কানে কানে বলল,

-‘তুই যত দূরত্ব বাড়াবি। আমি তত ভালোবাসা বাড়িয়ে দিবো। আমার মৃত্যুর পূ্র্ব মুহূর্তেও তোকে পাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করব। কারণ, তুই আমার অপরিপূর্ণ জীবনের; ‘একমাত্র সাঁঝক বাতি।’

To be continue……..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here