সাঁঝক বাতি পার্ট ২০

0
444

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[২০]

-‘আচ্ছা বাবা, আল্লাহ কি আমাকে ভালোবাসে না?’
-‘এমন বলছো কেন সোনা?’
-‘দুষ্টু লোকটা আমার হাত কেটে নিলো। আল্লাহ কিছু করল না তো।’

তনয়ের কথা শুনে শিহাব নিশ্চুপ হয়ে গেল। ওর মনে নানান প্রশ্ন। গতকাল দাদুর সাথে নামাজ পড়েছে। হাদীস শুনেছে। জেনেছে; আল্লাহর খুব দয়াবান। আমাদেরকে খুব ভালোবাসেন। সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন। মন্দ কাজের শাস্তিও দেন। এই কথাটা ওর অবুজ মনে টোকা দিয়েছে। তাই তো! মন্দ মানে তো পঁচা কাজ। দুষ্টু লোকেরা ওর হাত কেটে দিয়েছে। সে কষ্ট পাচ্ছে। কাঁদছে। ওরা পঁচা কাজ করেছে। আল্লাহ তো সব দেখেছেও। তাহলে আল্লাহ তাদের কিছু বলল না কেন? শাস্তি দিলো না কেন? তারমানে আল্লাহ ওকে ভালোবাসে না! ছেলের কথার শিহাব উত্তর
খুঁজে পেলো না। অবুজ বাচ্চাটাকে কি বলবে? সে কি অমানুষ চিনবে? বুঝবেও না;পাপ-পূর্ণের পার্থক্য। শিহাব তমার দিকে তাকাল। তমা ভ্রু কুঁচকে ফোনে কিছু দেখে দ্রুত বেরিয়ে গেল। যেন খুব তাড়ায় আছে। শিহাব জিজ্ঞাসা করলেও সে উত্তর করল না।

তমা হাসিবকে কলে পেলো না। আজকে সকাল থেকে হাসিব নিখোঁজ। প্রশান্তের লোক’ই ওকে মেরেছে। কারণ হাসিবের লাশ ওর বাসার পাশে ফেলে গেছে। শিফার লোক তমাকে ভিডিও করে পাঠিয়েছে। শিফার ফোনও বন্ধ। গতদুইদিন ধরে শিফা ব্যস্ত। মূলত, প্রশান্তর কার্যকলাপের প্রতি নজর রাখছিল। দিগন্তের পেছনে পুনরায় লোক
লাগিয়েছিল। হসপিটালে করা অপকর্মের প্রমান
সংগ্রহ করছিল।সেও বসে নেই। সতর্কতার সাথে একবার দিগন্তের বাসাতেও গিয়েছিল। দিগন্তের মা বর্তমানে পলাতক। উনি দেশ ছেড়েছে। কারণ
শিফা উনার একটা হাত কেটে দিয়েছে। তনয়ের মতো করে। কারণ উনিই প্রশান্তকে তনয়ের হাত কাটার বুদ্ধি’টা দিয়েছিলেন। যেন শিফা নিজেকে সব সময় অপরাধী ভাবতে থাকে। তনয়কে দেখে কষ্ট পায়। মেরে ফেললেই তো সব শেষ। এরচেয়ে
ধীকে ধীকে কষ্ট দেওয়ার আনন্দটা একটু বেশি। দিগন্ত আর প্রশান্ত এসব কিছুই জানে না। তারা উনার ব্যাপারে খোঁজও রাখে না।

সাবিনা খালাও উধাও। প্রাণের মায়াতে উনিও গা ঢাকা দিয়েছে। বেঁচে থাকলে কাজের অভাব হবে না। এই সুযোগে’ই শিফা এ’বাসার সবকিছু ইচ্ছেমতো সময় নিয়ে তল্লাশি করেছে। অজানা অনেক কিছু পেয়েছেও। আর এমনভাবে চলেছে, যেন প্রশান্ত আর দিগন্ত ওকে ঘুরাচ্ছে আর সে ঘুরছে। কিছু না করে হাবার মতো বসেও আছে।
দুইভাই নাচছে নাচুক। সময়মতো লাগাম টানতে পারলেই হলো। তাছাড়া সাফার মায়ের অনেকটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। উনাকে নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে। শিফা ওর বাবা-মা’কে জানিয়েছে, সে ভালো আছে। কিছু কাজে ব্যস্ত আছে। রাফি বাইকে এক্সিডেন্ট করেছে। দুইমাস ওকে বাসাতে
থাকতে হবে। বেড রেস্ট। শুয়ে বসেই পড়াশোনা করছে। ওর এক্সিডেন্ট করিয়েছে, শিফা। এছাড়া ওকে বাসায় আঁটকে রাখাও যেতো না। সাবধান করলে, নানান প্রশ্ন করত। বাবা-মা এই চিন্তায় অস্থির থাকতেন। আর প্রশান্তের পরবর্তী টোপ ছিল রাফি। তাই ভাইকে এক্সিডেন্ট করিয়ে সেভ করল। তবুও ভাই জানে বেঁচে থাকুক। ওর পায়ে সমস্যা হয় নি। শুধু এক্স-রে রিপোর্ট ভুল তৈরি করা হয়েছে। যাতে বাসাতে থাকে। বাসাটাই ওর জন্য নিরাপদ। নয়তো অঘটন ঘটতেও সময় লাগত না। আর তমা তো আছেই ;ভয় দেখিয়ে বাসার রাখার জন্য।

শিফা যথাসময়ে সুখুর বাড়িতে এসেছে। তবে বাড়িতে ঢুকার দরজা খুঁজে পাচ্ছে না। পুরোটাই ঘুরে দেখল। না, তাও পেলো না। অদ্ভুত বাড়ি। এক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়েও কোনো লাভ হলো না।সুখু জানালা দিয়ে শিফাকে দেখে দিগন্তকে ফোন দিলো। দিগন্ত কল রিসিভ করে বলল,

-‘ওকে ভেতরে নিয়ে যা, আসছি।’
-‘ছ্যার এইডা কি ঠিক কাম হইব?’
-‘ঠিক-বেঠিক তুই শিখাবি, সুখু?’
-‘জ্বে না ছ্যার। ম্যাডাম যে রাগী তাই কইতাছি।’
-‘ম্যাডামের আপ্যায়নে যেন ত্রুটি না থাকে।’
-‘জ্বে ছ্যার।’

দিগন্ত কল কাটল। সামনে প্রশান্ত। ঠোঁটে তার কুটিল হাসি। দু’জনে পুনরায় আলোচনা আরম্ভ করল। এতক্ষণ জরুরি আলোচনায় ব্যস্ত ছিল।
ওদিকে, সুখু দৌড়ে বাগানে চলে গেল। ইয়া বড়
বাগান।এই বাড়িতে যাওয়া-আসার রাস্তাও খুব অদ্ভুত। বাইরের ম্যানহল দিয়েই এবাসায় ঢুকতে হয়। সেটা নির্জন রাস্তার পাশে তৈরি। আর ঢুকে পুনরায় ঢাকনা দিতে হয়। যাতে কেউ ক্ষুণাক্ষরে টের না পায়। শিফা ম্যানহলের পাশে’ই দাঁড়িয়ে ছিল। দরজা খুঁজতে ব্যস্ত। সুখুকে দেখে শিফাই জিজ্ঞাসা করল,

-‘এই যে ভাই, আপনি এখানকার স্থানীয়?’
-‘জ্বে ম্যাডাম।’
-‘এই বাসাটা আমার আত্মীয়ের। কিন্তু ভেতরে যাওয়ার দরজা খুঁজে পাচ্ছি না।’
-‘ওহ, আমার লগে আসেন।’

শিফা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ছেলেটা পাগল নাকি? ওকে ম্যানহলের মধ্যে ঢুকতে বলছে কেন? নাকি এটাও কারো টোপ? দিগন্ত আর প্রশান্ত খুব ধূর্ত।
আর যাই হোক, ওদের বিশ্বাস করা যায় না। সুখু
ওকে পুনরায় ডাকল। শিফা সুখুকে পরখ করল। হেংলা পাতলা ছেলেটা। কথার তালে তালে দাঁত বের করে হাসছে। বড় বড় দাঁত। পরণের শার্টের মধ্যে আরেকজন অনায়াসে ঢুকতে পারবে। এত ঢোলাঢালা। নেশা-টেশাও করে নাকি কে জানে।
শিফা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওকে দেখছে। না জানি কোন বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুখু পুনরায় দিগন্তকে কল দিলো। শিফা ওকে সন্দেহ করছে। সুখুরও বুঝতে
বাকি নেই। দিগন্ত দুইবারের বেলায় রিসিভ করে সরাসরি বলল,
-‘ ফোনটা ওকে দে।’

সুখু দাঁত কেলিয়ে ফোনটা এগিয়ে দিলো। শিফা কানে ধরতেই দিগন্ত বলল,

-‘ওর সঙ্গে যাও। ভয় নেই, সুখু আমার লোক।’
-‘আপনার লোক বলেই তো ভয়।’
-‘ সবকিছুতে নেগেটিভ ভাবাটা অসুস্থ মস্তিষ্কের কাজ। ওর সঙ্গে যাও, আমি আসছি।’

শিফা কল কেটে ফোন ফেরত দিলো। সুখু ওকে নিয়ে ম্যানহল দিয়েই ভেতরে প্রবেশ করল। মই দিয়ে নামতে হচ্ছে। লোহার প্যাঁচানো মই। সব পরিষ্কার পরিপাটি। বাইরে থেকে যে কেউ দেখে বলবে এটা দো’তলা বিশিষ্ট বাড়ি। অথচ এটা তিনতলা। একটা তলাটা সম্পূর্ণ’ই মাটির নিচে।
কেউ আন্দাজ করতেও পারবে না। সুখু শিফাকে দোতলায় নিয়ে গেল। অভিজাত্যে ভরপুর। তবে দরজা না দেখে শিফা কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করল,

-‘বাড়ির দরজা নেই কেন?’
-‘ছিল, বন্ধ কইরা দিছে।’
-‘কেন?’
-‘ছ্যার কইছে।’
-‘কোন স্যার?’
-‘দিগন্ত ছ্যার।’
-‘ওহ।’
-‘এই বাড়ি ছ্যারের। আমারে দিয়া দিছে। আমি আগে গাঞ্জা বেইচ্চাই, খাইতাম। এহন ছ্যারের লগে’ই থাকি।
-‘আপনি গাঞ্জা বেঁচতেন, খেতেন না?’
-‘জ্বে খাইতামও।’
-‘আপনাকে দেখেই বুঝেছি।’
-‘ধন্যবাদ।’

শিফা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে নিলো। এই চ্যালা’ও দিগন্তের মতোই বেহায়া। ওর’ই লোক বলে কথা।
খারাপ বললে; এরা যেন বেশিই খুশি হয়। হঠাৎ শিফা একটা বুদ্ধি প্রয়োগ করল। দিগন্তের চ্যালা অর্থাৎ দিগন্তের সব খবর ওর জানা। চ্যালাকেই চালে ফাঁসাতে হবে। তাহলে অনেক কিছু জানতে পারবে। শিফা মুচকি হেসে সুখুকে বলল,

-‘সুখু ভাই, আপনার স্যার কি এখানেই থাকে?’
-‘মাঝে মাঝে।’
-‘আর কেউ থাকে না?’
-‘থাকে।’
-‘কে থাকে?’
-‘স্বপ্নীল ভাই, আমি, দিগন্ত স্যার, আরো বেশ কয়েকজন।’
-‘প্রশান্ত স্যার থাকে না?’
-‘না, এটা দিগন্ত স্যারের আস্তানা। এখানকার কথা প্রশান্ত স্যার জানতেনও না। তবে, কিছুদিন আগে লোক লাগিয়ে জেনেছে। আর জেনেই তো
আপনাকে পাঠাল।’

সুখু কথাটা বলে হরেক পদের নাস্তা এনে সামনে রাখল। শিফা চারিপাশে চোখ বুলাচ্ছে। স্বপ্নীল এখানে জেনেও সে ব্যাতিব্যস্ত না। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় সামালাতে হবে। শিফা একটা মিষ্টি খেয়ে পানি খেলো। ভালোই খেতে! নাস্তাতে বিষ নেই, নিশ্চিত। শিফা পুনরায় গল্পে মেতে উঠল। সে সুখুর থেকে কথা বের করতে ব্যস্ত। তখন দিগন্ত এসে শিফার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। সুখু
ততক্ষণে স্থান ত্যাগ করেছে। শিফা নিশ্চুপ! এই ছেলে চূড়ান্ত পর্যায়ের অসভ্য। লাজ-লজ্জাহীন।
দিগন্ত দুই হাতে জাপটে ধরে শিফার পেটে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

-‘প্রতিটা ছোঁয়া তখনই আনন্দের হয়। যখন ওই মানুষটা হয় ভালোবাসার।’
-‘ভালোবাসেন আমায়?’
-‘না।’
-‘তুমি হাসবে কবে?’
-‘সেদিন আপনার চোখে অশ্রু ঝরবে।’
-আর খুশি হবে কিসে?’
-‘আপনার বুকে ছুরি বসাতে পারলে।’

দিগন্ত মুখ তুলে শিফার দিকে তাকাল। মেয়েটা সত্যিই হৃদয়হীনা, পাষাণ এবং নিষ্ঠুর মানবী।
নয়তো অনায়াসে এসব বলতে পারত না। বুকে না কাঁপলেও, মুখে আটকাতো। যদিও, সেও কম নয়। তবুও মেয়ের মন তো। কঠিন বলে’ই হয়তো পারফেক্ট জুটি। দিগন্ত পুনরায় শিফার পেটে মুখ গুঁজে বলল,

-‘ওহে বিনাশকারিণী তোমাকে এখানেই থাকতে
হবে। তাও আমারই সাথে। আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছাড় দিবোও না, পাবেও না। কথাটা তুমি মিলিয়ে নিও।’
-‘দিবেন না কেন?’
-‘কারণ, তুমি আমার মানসিক সুস্থিরতা।’

To be continue……..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here