সম্পর্কের বন্ধন পর্ব ৯

0
441

#সম্পর্কের_বন্ধন
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৯

রজনীর চাঁদ শূন্য স্তব্ধ আকাশে ঝলমলে নক্ষত্র মিটিমিটি জ্বলছে। মৃদু বাতাসে গাছের দু’একটা শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে একই ছন্দে। একহাতে শাড়ি সামলে অন্যহাত মুক্ত অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছে তুহা। শক্তপোক্ত পেটানো শরীরের অধিকারী মানবটি দ্বিধাহীন ভাবে তুহার মুক্ত হাত নিজের বন্ধনীর মধ্যে আবদ্ধ করে নিয়েছে। এলোমেলো চুলে ভ্রু জোড়ায় ঢেউ খেলানো ভাঁজ ফেলে সিএনজি দেখে চলেছে শ্যাম পুরুষটি।
একটা সিএনজি পেয়ে ভাঁড়ার কথা তুলতে গিয়ে পেছনের সিটে চোখ পড়লো ইভানের। ঠোঁটে চেপে রাখা ঠোঁট জোড়া শিথিল করে সিএনজি ড্রাইভারকে ইশারা করলো চলে যেতে। তারা যাবেনা।

তুহা ভ্রু কুঁচকে বলল,’সিএনজি চলে যেতে বললেন কেনো?’ আমরা আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো?

ইভানের নজর অন্য সিএনজি খুঁজছে। এর মাঝেই গম্ভীর কন্ঠে বলল,’পেছনের সিটে দুজন ছেলে ছিলো। আমাকে সামনে বসতে হতো। না তুমি অস্বস্তি আর জড়তায় ঠিকমতো বসতে পারতে, আর না পেছনে দুজন ছেলের সাথে বসা তোমার জন্য সেফ ছিলো। তার উপর এখন অন্ধকার রাত।

ইভানের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তুহা দমে গেলো। মুগ্ধ নেত্রে চেয়ে রইলো লম্বাটে শ্যাম চেহারায়। মাঝেমাঝে লোকটার গা জ্বালানো কথায় ভীষণ করে রাগ হয়। আবার মুহূর্তেই তার প্রতি সম্মান আর মুগ্ধতায় হৃদয় ভরে ওঠে।
ইভান খালি সিএনজি পেয়ে দাম দস্তুর করে তুহাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠে বসলো। সামনেই সিএনজি থামাতে বলে দু’জনের জন্য রাতের খাবার কিনে নিলো।

একটা সাততলা ইট পাথরে তৈরি ভবনের সামনে নেমে ভাঁড়া মিটিয়ে তুহাকে নিয়ে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেলো ইভান। তুহা চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিল্ডিংটি পরখ করছে। গুণে গুণে পাঁচতলায় এসে থামলো ইভান। তার দেখাদেখি তুহাও থামলো। পকেট থেকে চাবি বের করে ফ্ল্যাটের দরজা খুললো। ভেতরে ব্যাগ রেখে তুহার দিকে মুগ্ধ করা নির্মল হাসি উপহার দিয়ে ইভান বলল,

“স্বাগতম আপনাকে বিবি সাহেবা।আমার এই ছোট্ট কুটিরে আপনার চরণ ছুঁইয়ে আমাকে ধন্য করুন।”

ইভানের বলার ভঙ্গিমা পরোখ করে তুহা সরু চোখে চেয়ে থেকে কিয়দংশ সময় পার করেই ফিক করে হেসে দিলো। সাথে ইভান ও হাসলো।
তুহা ভেতরে প্রবেশ করতেই ইভান আলো জ্বালিয়ে দিলো। তুহা ঘুরে ঘুরে ফ্ল্যাট দেখছে। ইভান চাবি নিয়ে রুমে ঝোলানো তালা খুলছে।
ছোট্ট ফ্ল্যাটটাতে দুটো বেডরুম। একটাকে গেস্ট রুম বলা চলে। ছোট একটা কিচেন,সামনে বড় করে ডাইনিং স্পেস। জায়গাটা একটু বড় খোলামেলা হওয়ায় একপাশে সোফা রাখা আছে। তুহা ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি রেখেই আওড়ালো,

‘আমার ছোট্ট সংসার।আজ থেকে আমার হাতের ছোয়ায় সিক্ত হবে এই ঘরের প্রতিটি কোনা।’

ইভানের রুম থেকে ভারী কন্ঠস্বর কর্ণকুহুরে এসে ঠেকলো। বাইরে থেকে জার্নি করে এসেছো আগে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নাও।
তুহা ইভানের কন্ঠের উৎস খুঁজে সেই রুমের দিকে ধীর গতিতে পা বাড়ালো।

ইভান গায়ের জামাকাপড় ছাড়িয়ে পাতলা টিশার্ট আর ট্রাউজার গায়ে চাপিয়ে নিয়েছে।
তুহাকে ওয়াশরুম দেখিয়ে ইভান রান্নাঘরে পা বাড়ালো।

জামাকাপড় নিয়ে তুহা ওয়াশরুমে ঢুকেই কল ছেড়ে দিলো। জার্নি করেছে,রাস্তার ধূলাবালি আর ঘামে শরীর প্যাচপ্যাচে হয়ে আছে। একটা গোসলের প্রয়োজনবোধ করতেই তুহা আর দেরি করলোনা। চট জলদি গোসল সেরে বেরিয়ে আসলো। জলে সিক্ত চুল মুছতে মুছতে সারাঘরে চোখ বুলিয়ে নিলো। রুম থেকে বেরিয়ে চারদিকে উঁকি দিয়ে রান্নাঘরে ইভানের দেখা মিললো।

সে দুটো প্লেট হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। ডাইনিং এ হাতে থাকা দুটো খাবারের প্লেট রেখে তুহাকে বলল,’খাবার খেয়ে নিতে। নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসলো।
খাবার থেকে উষ্ণ ধোঁয়া ছড়াতে দেখে মনে হচ্ছে ইভান খাবারগুলো গরম করে এনেছে। কি দরকার ছিলো এখন খাবার গরম করার? আসার সময়ই তো কিনে এনেছে।

খাবার শেষে তুহা নিজেই প্লেট দুটো রান্নাঘরে নিয়ে গেলো। ইভানকে আর হাত লাগাতে দেয়নি।
লম্বা একটা ঘুমের প্রয়োজন আছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে ক্রমশ। চোখ দুটো খনে খনে জ্বলে উঠে জানান দিচ্ছে আমার বিশ্রাম প্রয়োজন। ইভান বিছানার বালিশ ঠিক করে একপাশে শুয়ে পড়েছে।
তুহা এসে অপর পাশে শুয়ে পড়লো। খাটের দু’প্রান্তে দুজনের বাস। মাঝে দেড়হাত সমান জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। মাঝের এই দূরত্ব ঘুছিয়ে দেওয়ার জন্য আরো কিছু সময় বাকি। দুটো প্রেমজ হৃদয় এক হওয়ার অপেক্ষা। তবেই এই দূরত্ব ঘুছে যাবে চিরতরে।

সকালের প্রভাতছটা আলো চোখেমুখে আঁচড়ে পড়তেই ঘুম ছুটে পালালো চোখ থেকে। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে কানে। একবার এক শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ কিছু একটা খুঁজে চলেছে। আড়মোড়া ভেঙে লম্বা একটা হাই তুললো ইভান। পাশে তুহা নেই। তুহা কি করছে আঁচ করতে পেরেই পা বাড়িয়ে রুম থেকে বের হলো। ডাইনিং স্পেসে দাঁড়িয়ে গলার স্বর উঁচু করে ইভান বলল,’রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসো।’

তুহা রান্নাঘর থেকে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে ইভানকে দেখে নিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,’সব জিনিস পত্র কই?’
এখন সকালে খাবো কি?বাসায় দেখি রান্না করার মতো কিছুই নেই চাল,ডাল ছাড়া। এখন কি সব মিলিয়ে খিচুড়ি করবো?

ইভান সামনে আরেক পা বাড়িয়ে কপালে আঙ্গুল ঘষে বলল,’সকালের খাবার আমি নিয়ে আসবো বাইরে থেকে। অফিস থেকে আসার সময় বাজার করে আনবো। তুহা সায় জানিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। ইভান ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
তুহা বেডরুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। আশেপাশে আরো কতগুলো বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলো একজন কেশশূন্য মহিলা বাসার দারোয়ানকে কিছু একটা বলে ধমকে যাচ্ছে। দারোয়ান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
মহিলার গায়ের রং ফকাফকা ফর্সা মনে হচ্ছে। মাথায় একটাও চুল নেই। মাথাটাও ফর্সা দেখা যাচ্ছে। আবার হাত উঁচিয়ে মাথায় কাপড় তুলছেন মহিলা।

ইভান গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিচে যাওয়ার আগে তুহাকে বলে গেলো যাতে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে রাখে। তুহা শুনলো কিনা কে জানে?
ইভান নিচ থেকে খাবার কিনে উপরে আসার সময় পাঁচতলায় তার বারান্দার দিকে তাকালো। তুহা গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ইভান পাশে তাকালো। বাড়িওয়ালার বউ দারোয়ানের উপর অনেকক্ষণ যাবত চেঁচামেচি করছেন। তুহা সেটাই দেখছে। ইভান উপরে এসে দেখলো দরজা খোলা। তুহা দরজা লাগায় নি। খাবার টেবিলের উপর রেখে বারান্দায় গিয়ে তুহাকে ডাকলো।

চলো খাবার নিয়ে এসেছি। তোমাকে না দরজা লাগাতে বললাম,লাগাওনি কেনো?

তুহা পেছন ঘুরে অবাক হয়ে বলল,’আপনি খাবারের জন্য নিচে কখন গেলেন?

ইভান ডাইনিং এর দিকে যেতে যেতে বলল,’তুমি যখন বাড়িওয়ালার ঝগড়া দেখছিলে তখন গেছি।

তুহা জিব কেটে বলল,খেয়াল করিনি আমি আপনি বেরিয়েছেন। আচ্ছা উনার মাথার চুল কোথায়? ইভান চেয়ার টেনে বসে বলল,’কড়া ডোজের ঔষধ খেয়ে চুল সব ঝরে গেছে।
তুহা নিজের চুলে হাত দিয়ে কিছু ভাবছে।

ইভান গম্ভীর কন্ঠে বলল,’খাচ্ছো না কেনো? পেটে খাবার গেলে পরে ঠান্ডা মাথায় চুল নিয়ে গবেষণা করতে পারবে।

তুহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে নিজের প্লেট টেনে নিলো।
খাবার শেষ করে ইভান অফিসের জন্য নিজেকে তৈরি করে চুলে বার কয়েক হাত বুলিয়ে নিয়ে তুহার উদ্দেশ্যে বলল,’দারোয়ান দুপুরের খাবার এনে দিয়ে যাবে। আমি আসার সময় বাজার সব নিয়ে আসবো।

ইভান দরজা পর্যন্ত গিয়ে একবার পেছন ফিরলো। তুহা এদিকে ফিরেই তাকিয়ে আছে। ইভান তার সেই নজরকাড়া হাসি উপহার দিয়ে দরজা লাগাতে বলে বেরিয়ে পড়লো। তুহা দরজার কপাট ধরে উঁকি দিয়ে একবার ইভানকে দেখে দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজেও মুচকি হাসলো। সারাদিন কিভাবে কাটবে সেটাই ভাবতে লাগলো।

অফিসে প্রবেশ করতেই সবাই ইভানকে বিয়ের জন্য অভিনন্দন জানালো। ইভানের কয়েকজন কলিগ যারা বন্ধুর মতোই। তারা এগিয়ে আসলো ইভানের দিকে। তৃষা আগেই অফিসে এসেছে। সবার সোরগোল শুনে নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে দেখলো ইভান অফিসে এসেছে।

মুখ ঘুরিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো। ল্যাপটপে আঙ্গুলের বিচরণ চালিয়ে কাজে মন দিলো।

ইভান নিজের কেবিনে গিয়ে ব্যাগ রেখে ল্যাপটপ বের করলো। বসের সাথে গিয়ে দেখা করে নিজের কাজে ফিরলো।

তৃষা নিজের সম্পন্ন কাজ বসের কাছে জমা দিয়ে বসের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছে। বস বিরক্তি ঝেড়ে কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,’আপনি কি করেছেন মিস তৃষা?’আপনি তো এই কাজে নতুন না। কালও ভুল করেছেন আজও ভুল করছেন। আপনি কি কাজটা বুঝেননি নাকি?

তৃষা নতমস্তকে মৃদুস্বরে বলল,’সরি স্যার।আমার ভুলটা আমি ধরতে পারছিনা। ভুল ধরিয়ে কাজটা বুঝিয়ে দিলে পরেরবার আর ভুল হবেনা।

বস ফাইলটা টেবিলের উপর শব্দ করে রেখে তিরিক্ষি মেজাজে বললেন,’প্রথমে কাজটা পারবেন বলে এখন বলছেন কাজ বুঝেননি? আপনাকে কি এখন আমি ধরে ধরে শিখিয়ে দেবো? মিস্টার ইভানের কাছ থেকে কাজটা বুঝে নিবেন। যতটা সময় লাগে লাগুক। সময় নিয়ে কাজ করবেন তবে কাজটা পারফেক্ট হওয়া চাই।
এবার আপনি আসতে পারেন।

তৃষা ‘জি স্যার’ বলে বসের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো। ঠোঁটে ঈষৎ বক্র হাসি। সাথে বসকে সমস্ত ক্ষোভ মিশিয়ে ঝেড়ে নিলো মনে মনে।

ইভানের কেবিনের সামনে গিয়ে মন্থর কন্ঠ বলল,’মে আই কামিন মিস্টার ইভান?’

ইভান ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে দরজার দিকে তাকালো। পরপরই ল্যাপটপে চোখ রেখে বলল,’কামিন।’

তৃষা ইভানের সামনে চেয়ার টেনে বসলো। ফাইলটা সশব্দে টেবলের উপর রেখে ইভানকে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করছে।

ইভান ল্যাপটপে হাত চালাতে চালাতেই বলল,’কি কাজে এসেছেন?’

তৃষা আড়মোড়া ভেঙে সুর টেনেই বলল,’কাজ ছাড়া কি তোমার কাছে আসা যায় না?’

ইভান থামলো। কঠোর দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে বলল,’কাজ ছাড়া অন্য কোনো প্রয়োজন থাকার কথা নয়।’

তৃষা ব্যঙ্গ হেসে বলল,’বউ কি ভীষণ সুন্দরী?’

ইভান দায়সারা ভাবে উত্তর দিলো,’যদি অফিসের কোনো কাজ থাকে তবে সেটা বলুন। অন্যথায় আপনি আসতে পারেন। সামনেই দরজা খোলা আছে। আর আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করার আগে ভেবে দেখবেন এটা কর্মস্থল,বাসা নয়।

তৃষা রুষ্ট চোখে চেয়ে গটগট পায়ে হেঁটে দরজা পর্যন্ত এসে আবার পেছন ফিরে বলল,’কাজটা পরে বুঝে নেবো।’

ইভান নিজের কাজে মন দিলো। তৃষা কি বললো না বললো তাতে ওর কিছুই যায় আসেনা।

দুপুরে ব্রেক টাইমে ইভান দারোয়ানের নাম্বারে কল দিলো।তুহাকে খাবার এনে দিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে।
কাল আসার পথে বাবা তুহাকে একটা নতুন ফোন দিয়েছেন। অবশ্য ইভান বলেছিলো সে নিজেই কিনে দেবে। বাবা যেহেতু দিয়েছেন তাই আর ওর কেনার প্রয়োজন নেই। এখনো ফোনে সিম সেটিং করা হয়নি বিধায় তুহার নাম্বারে কল দিতে পারলোনা।
#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here