সম্পর্কের বন্ধন পর্ব ৫

0
503

#সম্পর্কের_বন্ধন
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৫

“দুহাতে ঘোমটা তুলেই ইভানের কপাল কুঁচকে গেলো।”
তার অর্ধাঙ্গিনী চোখ বন্ধ রেখে বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু পড়ছে।ভূত প্রেত আসর করলে যেমন দোয়া পড়ে তেমনি কিছু একটা পড়ছে মনে হচ্ছে।

ইভান গলা পরিষ্কার করে রাশভারি কন্ঠে বলল,’চোখ খুলে তাকাও।নাকি সারারাত এভাবেই কাটাবে?

একরাশ অস্তিত্ব নিয়ে চোখের পাতা খুললো তুহা।ইভানের সাথে তিন-চারবার দেখা হলেও আজকে কেমন অস্বস্তি আর লজ্জরা ঘিরে রেখেছে তাকে।চোখ বন্ধ করে মনে মনে দোয়া পড়ছিলো।বুক হাঁপরের ন্যায় ওঠানামা করছে।শরীর মৃদু কাঁপছে।যেনো বাঘের খাঁচায় পড়েছে তুহা।
ইভানের তীক্ষ্ণ চোখ একবার তুহার মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরোখ করে নিলো।চোখদুটো সরু হয়ে আসলো।তার অবচেতন মন বলছে মেয়েটার মধ্যে জড়তা কাজ করছে।অথচ বিয়ের আগে কতটাই না স্ট্রং দেখিয়েছিলো নিজেকে।

বিরক্তি ঝেড়ে ইভান বলল,’এগুলো চেঞ্জ করে আসো।এভাবে আর কতক্ষণ?বিরক্ত লাগছেনা তোমার?
তুহা মাথা নেড়ে উঠে পড়লো।একটা শাড়ি সাথে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
ইভান বিছানায় ছড়ানো ফুলগুলো ঝেড়ে নিচে ফেলে দিলো।বিয়ের ঝামেলায় বড্ড ক্লান্ত সে।গতরাতে ও ঘুমোতে পারেনি।এখন চোখদুটোকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার পালা।

এতক্ষণে নিজেকে কিছুটা হালকা মনে হচ্ছে তুহার।বিয়ের সাজসজ্জা পরিবর্তন করে সুতির শাড়ি অঙ্গে জড়িয়ে নিলো।মেকাপ ধোয়ার পর মুখের উজ্জ্বলতা যেনো বেড়ে গিয়ে স্নিগ্ধ লাগছে।মাথায় আঁচল টেনে রুমে ঢুকলো।খাটের দিকে চোখ যেতেই দেখলো ইভান সটান হয়ে শুয়ে পড়েছে।উপরের ফুল ঠিকই আছে কিন্তু খাটের উপরের ফুলসব নিচে পড়ে আছে।

তুহার ভ্রু আপনা-আপনি কুঁচকে গেলো।ইভানের পাশে এসে দাঁড়াতেই ইভানের নির্লিপ্ত কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে ঠেকলো।
কপালের উপর একহাত রেখেই ইভান বলল,’এ দুদিনে নিশ্চয়ই তেমার উপর অনেক ধকল গেছে।রেস্টের প্রয়োজন আছে।আপাতত ঘুমিয়ে পড়ো।আমিও বড্ড ক্লান্ত।তুহা আর কথা বাড়ালোনা।সত্যিই সেও ক্লান্ত একের পর এক ঘটনায়।

ইভানের বিপরীতে মুখ করে একপাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো তুহা।চোখের পাতা বুঝতেই মানসপটে ভেসে উঠলো কিছু দৃশ্য।

সেদিন তুহা রাদিফের কাছ থেকে কিচ্ছু লুকায় নি।তৃষার কুমিল্লাতে এত তাড়াতাড়ি আসা।চুল কা/টা,ইভানকে নিয়ে ঝামেলা সবকিছুই খুলে বলেছিলো।

সব শুনে রাদিফের চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো।রোষানল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তুহার দিকে।কর্কশ কন্ঠস্বরে বলল,’ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চড় মা/রি তোকে।এতকিছু হয়ে গেলো আর ফ্যামিলির কেউ কিচ্ছু জানলোনা?যদি বড় কোনো ঝামেলা হয়ে যায় তখন নিজে একা সামলাতে পারবিতো?

তুহা নতজানু হয়ে রইলো।তার কাছে চাচাকে দেওয়ার মতো কোনো উত্তর নেই।

সেদিন রাদিফ সরাসরি তৃষাকে ইভানের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলো।সাবধান করে দিয়েছিলো যাতে কোনো ধরনের ঝামেলা না করে।তৃষা ও সেদিন বাধ্য মেয়ের মতো চাচার কথায় চুপ রইলো।কিন্তু তার মনে যে অন্য কিছু আছে সেটা কে জানতো?দুই তিনদিন সবার সাথে ভালো স্বাভাবিক ব্যবহার করেছে।যেনো রাদিফ আর তুহার মনে হয় তৃষা সব কিছু ভুলে মেনে নিয়েছে ভাগ্যকে।

একটা মানুষের সাথে থাকতে থাকতে মানুষ তার রগে রগে পৌঁছে যেতে পারে।কার স্বভাব কেমন সে সম্পর্কে অবগত হতে পারে।তেমনি তৃষার স্বভাব সম্পর্কে ও রাদিফ আর তুহা ভালোভাবেই অবগত ছিলো।

বিয়ের দিন তৃষা তুহার মায়ের কাছে গিয়ে বলেছিলো যেনো তুহাকে শরবত দিয়ে আসে।মেয়েটা সকালের পর থেকে আর কিছুই খায়নি।
শাহিনুর মনে মনে বেশ খুশি হলেন তৃষার কথায়।মেয়েটা কত খেয়াল রাখে তুহার।এক গ্লাস শরবত বানিয়ে নিয়ে তৃষাকে বলল,’দিয়ে আসতে।

তৃষা বলল,’এই ভারী লেহেঙ্গা ধরবো নাকি শরবতের গ্লাস?তুমি বরং কাউকে ডেকে দাও।
শাহিনুর তুহার একটা ফুফাতো বোনকে ডেকে আনতে গেলেই তৃষা তুহার শরবতে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয়।
শাহিনুর এসে তুহার শরবত পাঠিয়ে দেয়।তৃষা পিছু পিছু যায়।

শরবত হাতে নিয়ে তুহা দরজার পাশ থেকে তৃষাকে সরে যেতে দেখে কিছু একটা বুঝলো।একটু সরে গিয়ে শরবত টুকু খাটের নিচে ফেলে খালি গ্লাস উপুড় করে রাখলো।

ঘুমের ভান ধরে পড়ে রইলো দেখতে যে তৃষা কি করে।কোমরে আগেই ফোন গুঁজে নিয়েছে।
তুহা চোখ বন্ধ করার দুই মিনিট পরেই তৃষা রুমে ঢুকে তুহাকে ওয়াশরুমে আটকে রাখে।তুহা কোমর থেকে ফোন বের করে রাদিফকে কল দিয়ে সব জানালো।

রাদিফ তৃণাকে নিয়ে এসে দেখলো তৃষা সাজ সম্পুর্ন করে ঘোমটা টেনে বসে আছে।দরজা বন্ধ করে দিয়ে রাদিফ তৃষাকে সজোরে চড় মা/র/লো।

আকস্মিক ঘটনায় তৃষা হতভম্ব হয়ে গেলো।ঘোমটা সরে গিয়ে তার মুখশ্রী ভেসে উঠলো।চোখের সামনে রাদিফের আহত বাঘের ন্যায় র/ক্তচক্ষু দেখে কলিজা কেঁপে উঠলো।চেহারা র/ক্তশূন্য হয়ে গেলো।এই বুঝি ছোট চাচা সব জেনে গেলো।তৃণা কোনো কিছুই বুঝতে পারছেনা।শুধু রাদিফ যা করতে বলছে সেটাই করছে।

রাদিফ ওয়াশরুমের দরজা খুলে দিতে বলাতে তৃণা দ্বিরুক্তি না করেই দরজা খুলে দিলো।তুহা হুড়মুড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলো।
তৃষাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে তুহাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো রাদিফ।
বাইরে দিয়ে দরজা লক করে একটা তালা এনে ঝুলিয়ে দিলো।

বিয়ে বাড়ির সোরগোলের কারণে তৃষার কন্ঠস্বর আর কারো কানে গেলোনা।সবাই এদিকেই ব্যস্ত ছিলো।
বিয়ের সম্পুর্ণ কাজ ঠিকভাবে মিটে যেতেই রাদিফ বাড়ির সবাইকে সবটা জানালো।

————————————————————★

ড্রয়িংরুমে সবার সামনে মাথানিচু করে বসে আছে তৃষা।চোখমুখের অবস্থা বিধ্বস্ত।গাল লাল হয়ে ফুলে আছে।দুগালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ।দাঁতের পাশ লেগে ঠোঁট কে/টে যাওয়ায় র/ক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে আছে।ঘাড় অব্দি চুলগুলো এলোমেলো।শরীরে কয়েক ঘা লাঠির আঘাত।
এতক্ষণে এই বাড়িতে তান্ডব বয়ে গেছে।কয়েকজোড়া র/ক্ত/চক্ষু তৃষাকে ভষ্ম করে দিচ্ছে।
কেউই আর রাতের খাবার খায়নি।বলতে গেলে খাওয়ার মতো অবস্থায় কেউ নেই।

বাবা,মা ভাই সবার হাতের চ/ড়,থা/প্প/ড় খেয়ে চুপসে আছে তৃষা।আফসান আদরের মেয়ের অন্যায়ের পক্ষে কোনো আপোষ করেননি।লাঠি নিয়ে এতবড় মেয়েকে মা/র/তে গেছেন।কয়েক ঘা দেওয়ার পর তুহার বাবা মা এসে থামিয়েছেন।
ভাইয়ের চোখের দিকে তাকাতেও আফসানের লজ্জা করছে।এই মেয়ের জন্য আজ তাকে ছোট ভাইয়ের সামনে মাথা নিচু করতে হচ্ছে।

শাহিনুর স্তব্ধ হয়ে রইলেন।এতদিন তৃষাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবেসেছেন।আর সেই মেয়ে পিঠ পিছে ছু/রি বসিয়েছে।

তুরাগ চোখ সরিয়ে নিলো বোনের উপর থেকে।প্রমির কোনো ভাবান্তর হলোনা।বিয়ের পর থেকে তাকেও কম খোঁচায়নি তৃষা।সব সময় নিজেকে উপরে রাখার জন্য যাকে যাকে ছোট করার তাকেই ছোট করেছে।

তৃষার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হলোনা।সে প্রথম থেকেই নিশ্চুপ ছিলো।হঠাৎ আফসান এক কান্ড করে বসলেন।কাঠকাঠ গলায় বলে দিলেন,’আজ থেকে আমার আর কোনো মেয়ে নেই।’আমার একটাই ছেলে আছে।

সবাই বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো আফসানের দিকে।এতক্ষণে তৃষা চোখ তুলে তাকালো।চোখে পানি চিকচিক করছে,ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।অনড় দৃষ্টি বাবার দিকে।চোখের পলক ফেলছেনা।ভেতরে হাহাকার,র/ক্ত/ক্ষরণ বইছে।সমস্ত রাগ গিয়ে তুহার উপর পড়ছে।
কাউকে কিছু না বলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো তৃষা।
আয়না চমকে উঠে বললেন,’কি বলছো তুমি এসব?’
মেয়েটা ভুল করেছে তাকে অন্যভাবে শাস্তি দাও।ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও।
আফসান নিজের সিদ্ধান্তে অনড় রইলো।

সবাই মিলে চেষ্টা করেও আফসানকে বোঝাতে সক্ষম হলোনা।
তৃষা হনহনিয়ে নিজের ট্রলি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো।শাহিনুর গিয়ে তৃষার সামনে দাঁড়ালেন।তাকে আটকানের চেষ্টা করতেই তৃষা শাহিনুরকে ঝাড়া মে/রে নিজের সামনে থেকে সরিয়ে দিলো।শাহিনুর খানিকটা সিটকে গেলেন।আফসান সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,’দেখলেতো তোমরা?যে নিজের ভুল স্বীকারই করেনা সে আবার প্রায়শ্চিত্ত করবে?
যেতে দাও ওকে।দেখি কতদূর যেতে পারে?

তৃষা বাসা থেকে বেরিয়ে একজনকে ফোন করে জানায় তার বাসায় আজকের রাতটা উঠতে চায়।

——————————————————

ভোরের মৃদু আলো ছলকে উঠে আলোকিত করে উঠলো ধরনীর বুক।ল্যাম্পপোস্টের বাতি সব নিভে গেছে।পাখির কিচিরমিচির শব্দ শ্রুতিমধুর হয়ে কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হচ্ছে।ইভান নামায পড়ে এসেছে মসজিদ থেকে।তুহা ও আজ ভোরেই উঠে পড়েছে।ইভান মসজিদে যাওয়ার আগে ডেকে দিয়ে গেছে।নামায পড়ে তুহা বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়ালো।নামায পড়াতে মনটা ফুরফুরে হয়ে প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে।ভোরের স্নিগ্ধ প্রকৃতি দেখার সৌভাগ্য কেবল যারা নামায পড়তে ওঠে তারাই উপভোগ করতে পারে।এতদিন তুহা ঠিকমতো নামায পড়তোনা।সকালে মায়ের জোরাজোরিতে উঠে নামায পড়লেও আবার ঘুমিয়ে পড়তো।

ইভান জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে আলমারি খুললো।একটা খাম হাতে নিয়ে নিয়ে বারান্দায় গেলো।
গলা ঝেড়ে নিয়ে তুহার দিকে খামটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’এখানে তোমার দেনমোহর পরিশোধ করা আছে।’এই টাকা তোমার।

তুহা খাম হাতে না নিয়েই ইভানের চোখে চোখ রাখলো।মন্থর কন্ঠে বলল,’আমিতো চাইনি এই টাকা।’

ইভান বিস্তর হেসে বলল,’এটা চাইতে হয়না।এটা তোমার প্রাপ্য।এই টাকা তুমি কি করবে সেটা তুমি জানো।নাও।
তুহার হাতে খাম গুঁজে দিয়ে পকেট থেকে একটা বক্স বের করলো।একটা সোনার চেইন বের করে তুহার গলায় পড়িয়ে দিলো।ইভান চমৎকার হেসে বলল,’বিয়ের প্রথম রাতের উপহার।কালরাতে দুজনেই ক্লান্ত ছিলাম বলে এখন দিলাম।

তুহা গলায় হাত রেখে হাসলো।অদ্ভুত রকম ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো মন মস্তিষ্ক।
তুহার ভাবনার মাঝেই ইভানের নিস্প্রভ কন্ঠস্বর কানে বাজলো।
আমরা দুজন স্বামী-স্ত্রী হলেও এখনো আমাদের মধ্যে কোনো ধরনের বোঝাপড়া নেই।সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের দুজনেরই।তাই দুজনের দিক থেকেই সাপোর্ট থাকতে হবে।আমার দিক থেকে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।হয়তো আমাদের দুজনেরই কিছুদিন সময় লাগবে।আমি সেই সময়টা দিতে চাচ্ছি।

তুহা একের পর এক মুগ্ধ হচ্ছে ইভানের কথায়।মনের ভেতর কাল রাত থেকে যে খচখচানিটা ছিলো সেটা এখন অনেকটাই লাঘব হয়ে গেছে।দুজন দুজনকে ভালো করে বুঝতে হলে সম্পর্কটাকে সময় দেওয়া উচিত।তুহা ইভানের কথায় সম্মতি জানালো।
ইভান ঈষৎ হেসে রুমে ফেরত আসলো।

বেলা বাড়তেই মান্নতা এসে তুহাকে ডেকে নিচে নিয়ে গেলো।অনেকেই নতুন বউ দেখতে এসেছে।তুহা হাসিমুখে সবার কথার উত্তর দিচ্ছে।
#চলবে……….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here