#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩১
অনুভূতিরা বেসামাল। দমিয়ে রাখা প্রণয়ের পুনর্বার জাগরণ। প্রিয়ুদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে শ্রেয়া বুকে হাত রেখে স্পন্দন পরখ করছে। হৃদস্পন্দন। চলছে কি তা নাকি এখনও থমকে রয়েছে?ভয়ংকর পবনের খেলা চলছে সমগ্র প্রকৃতি জুড়ে। স্পর্শ করছে শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে,উন্মুক্ত বাঁকা কোমরে। কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ সমীরণ বইছে শ্রেয়ার বক্ষস্থলেও। থেমে থেমে উতালপাতাল গর্জন হচ্ছে। চিকন ওষ্ঠযুগলের বেশ খানিক জায়গা মৃদু, তৃপ্ত হাসির দখলে। তূর্যর এত কাছে আসা,ওকে শোনানো সেই মাদকতা মেশানো বাক্যগুলো সবকিছু যেন ওর নামেই উৎসর্গ করেছে মানুষ টা। বউকে এমন শুনাতে ইচ্ছে হলেই শোনাবে?অনুভূতির গভীরতা থেকে সৃষ্ট হয় যেসব শব্দাংশ সেগুলো এমনি এমনি যাকে তাকে বলা যায় না, যার তার কাছে ব্যক্ত করা যায় না৷ আর প্রখরত্বও একদিনে হয় না। হতে হতে অত্যধিক সময়ের প্রয়োজন পড়ে। খুব,খুব,খুব। কেউ একজন সত্যি বলেছিল যখন শ্রেয়া তার কথার মর্মার্থটা বুঝতে সক্ষম হবে সেদিন কিয়ৎক্ষণের জন্যে হলেও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটবে এবং অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল তা।
ছোট থেকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্ন দেখত শ্রেয়া। যেমন দেখত বাবা ওকে বুকের মধ্যে গুটিয়ে নিয়ে বলতেন ” আমার কলিজার টুকরা শ্রেয়সী। আমার রাজকন্যা। ” আবার কেউ হাত বাড়িয়ে ইশারা করতো কাছে আসার। জেগে জেগে দিনদুপুরেও নানা ধরনের স্বপ্নে নিমগ্ন হয়েছে,কল্পনায় এঁকেছে মুঠো ভর্তি ভালোবাসার সংলাপ এক কাল্পনিক দেশের রাজকুমারের সহিত৷ কিন্তু কোনো দিন বাস্তবতার চাদরে মোড়ানো হয় নি তাদের। টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গেছে সর্বদা কিংবা ভেঙে খন্ডিত দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। অতঃপর অন্য এক রাজকুমার নয় তবে একজন সুদর্শন পুরুষের প্রেমে মোহিত হয় ও। না দেখেই তাহার প্রতি জন্ম নেয় বিশাল বিশাল অনুভূতি। সেই স্বপ্নও ভাঙ্গে। বিক্ষিপ্ত হয় মন। তৎপরে সেই সুদর্শন পুরুষ নিজের অবয়ব প্রদর্শন করে, কাছে টানে,পূরণ করতে ব্যস্ত ওর ভালোবাসা পাবার স্বপ্ন টা অপ্রকাশ্যে,অতি সন্তর্পণে।
প্রিয়ু ওকে দাঁড় করিয়ে সেই যে নিচে নামল আসার কোনো খবরাখবর মিলছে না। প্রায় ঘন্টা তিনেক পূর্বে প্রিয়ুদের বাড়িতে এসে তূর্য আর ও। পথিমধ্যে একটা কথাও বের হয় নি গম্ভীর সেই পুরুষালী কন্ঠস্বর হতে। কিন্তু শ্রেয়ার তনুমনের তরঙ্গ একটুও কমে নি,একটুও না। শ্বাসরুদ্ধকর ছিল মুহুর্ত খানি। তূর্য কতটা অবলীলায় কন্ঠে মাদকতা মেশালো,কতটা নেশাক্ত বাক্যদ্বয় ওর কর্ণে ঢেলে সরে গেল নিরবে,নিশ্চুপে!তখন থেকে একটা কথাও বলে নি। এখানে এসে প্রিয়ুর দাদি,মামী সবার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে রাশেদার দেখানো রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। শ্রেয়া সাথে সাথে যায় নি রুমে। কারণ দর্শানো হলে ও একটাই দেখাতো স্পন্দনের ভার। এতই অস্বাভাবিক লাগছিল স্পন্দন যে শরীর টা বড্ড টালমাটাল করছিল। ইনিয়েবিনিয়ে থেকে যায় প্রিয়ুর মামীর নিকট কতক্ষণ। তারপর দেখে পাঞ্জাবি পাল্টে একটা কালো শার্ট সুঠাম দেহে জড়িয়ে তূর্য নেমে এসেছে ডান পাশের সিঁড়ি ভেঙে। আয়ুশও আসে সাথে। রাশেদা কোথাও যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে জানায় দু’ভাই একটু বাহিরে যাবে। ব্যাস তারপর আর কি!প্রস্থান ঘটায় দু’জনেই। শ্রেয়ার এতে লাভই হয়েছে। আপাতত তূর্যর মুখোমুখি হতে চাইছিল না৷ বউ ভেবে প্রেমময় বাক্য নিবেদন করেছে কখন না বলে বসে চলো আরও ভিন্ন ভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করি,যেগুলো জামাই বউ সম্পর্কিত!এমন বাঁকা ত্যাড়া,গম্ভীর ধাঁচের লোকই কেন ওর বর হতে হলো?সবকিছু কি প্রকাশ্যে হতে পারে না?ওর মতোন গাধার মাথায় এত এত কথার আসল অর্থের সমাধান হবে?এত না বুঝার মধ্যে একটা বাক্য ভালোই মস্তিষ্কে ধারণ হয়েছে নিখুঁতভাবে এবং সেটার অর্থও জেনে গেছে শ্রেয়া।
পশ্চাৎ দিক থেকে কোমরে হাত পড়তেই অদূরে ফেলা দৃষ্টি সংকুচিত হয়ে আসে শ্রেয়ার। ছোট ছোট হয় চক্ষু জোড়া। ঝটকা দিয়ে হাত টা সরিয়ে তড়তড় করে ঘুরে দাঁড়ায় ও। প্রিয়ু সশব্দে হেসে উঠে। হাসির দাপটে দেহে ঢেউ খেলছে। চাঁদের ময়ূখ ও ছাদে লাগানো বাতির ধিমে ধিমে আলোয় তার মুখশ্রীতে অজস্র মুগ্ধতার সমারোহ। কি স্নিগ্ধ মেয়েটা!শ্রেয়া বিমোহিত নেত্রে চাইতেই প্রিয়ু হাসি থামিয়ে ভ্রুঁ নাচালো। দুষ্টমি ভরপুর কন্ঠে বললো,
‘ ভাইয়া ধরলে নিশ্চয়ই চুপসে যেতি,নিজেকে সপে দিতি। আমি একটু ভালোবেসে ধরলাম কেমন ঝাড়া মা’রলি!আহা!বান্ধবী এমনই। বিয়ের পর জামাইয়ের মধুমাখা আদরে সব ভুলে যায়,সব।’
শ্রেয়ার হাসি পাচ্ছে মেয়েটার কথায়,কান্ডে। অকস্মাৎ ছোঁয়ায় ভয়ের তাড়নায় সরিয়ে দিয়েছিল। যদি জানত এটা প্রিয়ু তাহলে কখনও এটা করতো না। সুযোগ পেয়ে ভালোই পিঞ্চ মা’রছে সে।
শ্রেয়া ইচ্ছে করেই হা হুতাশ করে। মিনমিন করে বলে,’ আদর?হু।এমন আদর করে আমি শুধু বান্ধবী না, একদম দিন দুনিয়া ভুলে বসি। ‘
প্রিয়ু ঠিকঠাক শুনলো না৷ দখিনা বাতাসে কথা উড়িয়ে নিয়ে গেল বোধহয়। আরেকটু কাছে এসে প্রশ্ন করে,
‘ কি বললি শ্রেয়ু?বুঝি নি তো।’
‘ কিছু না৷ তোকে কখনও ভুলব না। সম্ভব না। আমাকে দাঁড় করিয়ে কোথায় গিয়েছিলি?’
প্রিয়ু আঙুল দিয়ে ছাদের মেঝেতে ইশারা করে। শ্রেয়ার চক্ষু গিয়ে ঠেকে সেদিকটায়। দেখে মেঝেতে ছোট্ট একটা ট্রে তে দু কাপ চা। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় হাত ওর। মৃদু চেঁচিয়ে ওঠে,
‘ লেট লতিফ উপাধি টা তুই এমনি এমনি পাস নি প্রিয়ু। চা এনে এই বাতাসে এতক্ষণ রেখে দিয়েছিস?বলতে এত দেরি কেন করলি?এখন এই ঠান্ডা শরবত তুই গিল। ‘
মুহুর্তেই ফোঁস ফোঁস শব্দ সৃষ্ট হয়, ‘ ভালো করলেও দো’ষ। কত কষ্ট করে বানিয়ে এনেছি৷ আজ পর্যন্ত জামাইকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়ালাম না,বয়ফ্রেন্ড থাকতে রান্না করে খাওয়াই নি। আর তুই আমার হাতের রান্না খেয়েছিস কিন্তু কখনও প্রশংসা করিস নি। অভিশাপ দিচ্ছি তূর্য ভাইয়ার প্রেশারে তোর একেকটা লম্বা কেশ অল্প বয়সে বুড়ি যেন হতে পারে। ‘
যতক্ষণ না এই চা নামের ঠান্ডা শরবত শ্রেয়ার কন্ঠনালি বেয়ে পরিপাক গ্রন্থিতে পৌঁছাবে ঠিক ততসময় চলবে প্রিয়ুর কথা নামক অত্যা’চার। তাই বিনা বাক্যে কাপ হাতে উঠিয়ে নেয় ও। ছোট ছোট চুমুক দেয় তাতে। এতটাও ঠান্ডা হয় নি। দুই বান্ধবী মিলে গেইটের দিকে নয়ন তাক করে কাপে ঠোঁটের স্পর্শ মাখছে। আকস্মিক উভয়ের চক্ষে একটা দৃশ্য বিঁধে। তূর্য ও আয়ুশ ফিরেছে। এতে অবাকতার বিষয় নেই। কিন্তু চমকপ্রদ হলো তাদের হাতের এক গাদা ব্যাগপত্র। প্রিয়ুর অবাক কন্ঠস্বর,
‘ ভাইয়া আর আয়ুশ কি শপিং করার জন্য বাহিরে গিয়েছিল? ‘
‘ আমি তো জানিনা। ‘– পাশ থেকে প্রতুত্তর করে শ্রেয়া।
‘ চল নিচে যাই। ‘
শ্রেয়ার মন উসখুস করছে। প্রিয়ু এমনভাবে বলছে যেন ওরা বাচ্চা আর নিচে ওদের জন্য গিফট নিয়ে আসা হয়েছে। তাড়াহুড়ো করে ছুটে গেলে পরে তূর্য হেয়ালি করে বলবে,’কি বাচ্চা বউ গিফট এনেছি ভেবেছ?’ এক চুল পরিমাণ ছাড়ও দিবে না। কিন্তু প্রিয়ুর সাথে সেটা শেয়ার করতে পারলো না সে। যেতে হলো অগ্যতা।
নিচে এসে দেখে এলাহি কান্ডকারখানা। বাজার করে এনেছে বাড়ির দু জামাই এটা বলে বলে রাশেদা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছেন। মন ভরে দোয়া করছেন। তিনি কখনও ভাবেন নি এত দায়িত্ববান হবে শ্রেয়া ও প্রিয়ুর জামাই। এমন করে শশুর বাড়ির মানুষজনদের খেয়াল রাখবেন। রান্নার জন্য বিভিন্ন জাতের শাকসবজি, গরুর গোশত, মুরগি সব এনেছে। সবার জন্য অনেক গিফটও হাজির। শ্রেয়ার মন বলছে দুই ভাই পুরো বাজার মাথায় তুলেছে। রান্নাঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু অবলোকন করছে ও। রাশেদার মুখে তূর্যর প্রশংসার ফোয়ারা। প্রিয়ুর মামী হেসে হেসে বলছেন,
‘ শ্রেয়া ভালো মনের মেয়ে,তাই হাসবেন্ড পেয়েছে লাখে একটা। এই লক্ষী মেয়েটাকে আমার ঘরে তুলতে পারলাম না। তোর একটা বোন যদি থাকত রে শ্রেয়া। এত সুন্দর কেন তুই?ভেতর,বাহির দু’টো সুন্দর হওয়া দরকার ছিল?এখন আমার আফসোস হচ্ছে কেন তোকে দেখলাম। এখন তোর মতোন একটা মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে পেতে ইচ্ছে করছে। ‘
প্রিয়ু ফিসফিস করে, ‘ মামী তূর্য ভাইয়া শুনলে বলবে তার বউ কেঁড়ে নেওয়া হচ্ছে। ধীরে ধীরে বলো। দোয়া করে দিলাম তোমার বারো বছরের ছেলের জন্য অন্য একটা রুপবানের দেখা পাবে জলদি। ‘
মানুষ যখন পায় সবকিছু একসাথে পেয়ে যায় বোধহয়। এ যে শ্রেয়া ভালোবাসা চেয়েছিল ছোট থেকে এখন না চাইতেও সবার ভালোবাসা পাচ্ছে ও। ওর ইচ্ছে করছে এগুলো বাক্সবন্দি করে রাখতে। যদি কখনও দুঃখের দিন আসে,বাক্স মুক্ত করে একটু একটু করে ভালোবাসা নিবে ও।
রাশেদা লেবুর শরবত বানালেন। কয়েকটা গ্লাস ট্রে তে তুলে নেয়,আরেকটা ধরিয়ে দেয় শ্রেয়ার হাতে। বললেন,
‘ তূর্য রুমে চলে গিয়েছে। ওর শরবত টা রুমে দিয়ে আয় মা। ক্লান্ত লাগছিল খুব। সারাদিন এতিমখানায় ছিল, এখন আবার বাজার করে এসেছে। তাড়াতাড়ি যা। ‘
শ্রেয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। ধীরস্থির পায়ে আসে রুমের দরজা অব্দি। প্রথমে হাতের সাহায্যে এক দু’টো শব্দ তুলে। এতেই কাজ হয়ে যায়। অন্দর হতে ভেসে আসে,’ কাম ইন। ‘
দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো ও। তূর্য হাতের একটা ব্যাগ সোফার উপর রাখলো। পরক্ষণেই ওর দিকে তাকালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। কপালে ভাঁজ। দ্রুত হেঁটে এসে এক প্রকার ছিনিয়ে নেয় শরবতের গ্লাস টা। দু চুমুকে সবটা শেষ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ তুমি আমার কাপড় আনলে ভালো কথা কিন্তু শর্ট প্যান্ট আনলে না কেন?গত রাতগুলোতে আমাকে দেখেছো রাতে ঘুমানোর সময় থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পড়ে ঘুমাই। তবুও আনো নি যে?’
শ্রেয়া হতভম্ব,নির্বাক। তূর্য মিছে বলে নি৷ লোকটার বোধ হয় আগে থেকেই ওর মতে, অর্ধেক প্যান্ট পড়ে ঘুমানোর অভ্যেস। কিন্তু ওর কেমন লাজুক লাজুক ভাব হচ্ছিল ওইসব ধরতে। ফলস্বরূপ লম্বা লম্বা শার্ট প্যান্টই ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছে। এখন কি জবাব দেবে?সুদুত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। বদনে লজ্জার অন্ত নেই। তূর্য আঁড়চোখে চেয়ে গলা ঝেড়ে ফিচেল কন্ঠে বললো,
‘ তোমার শাড়ি হতে শুরু করে ছোট বড় সাইজ সব নিজ হাতে কিনলাম, আর তুমি আমার একটা শর্ট প্যান্ট আনার কথা বলাতে বেহুশ হয়ে যাওয়ার অবস্থা? মিসেস শ্রেয়সী আমার ভবিষ্যৎ ডুবিয়ে দিও না। আগে থেকে শক্ত হও,প্রস্তুতি নাও। যেকোনো সময় কিন্তু ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়ে যেতে পারে। ওয়া*র্নিং দিয়ে রাখলাম। ‘
শ্রেয়া অপ্রতিভ হলো। লজ্জা ও ভীরু ভীরু মন নিয়ে বললো,’ খেতে নিচে আসবেন। ‘
কথাটা বলে তড়িঘড়ি করে পালিয়ে আসে। সেখানে থাকাটাও দমবন্ধকর ছিল।
______________
মেহরিমা বাহিরে আসলেন স্বামীর খোঁজে। দূরে চোখ ফেলতেই দেখে নুরুল চৌধুরী পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে রেখেছেন। আজও হয়ত ক্ষমা চাইছেন মনে মনে প্রিয় সেই নারীর নিকট শত শতবার। সেদিকে আর পা বাড়ালেন না তিনি। বুড়ো বয়সেও অন্তরে তীব্র জ্বলন হয়। হিংসায় নয় বরং নুরুল চৌধুরীর জীবনের প্রথম নারী হতে না পেরে। তোহাশের মা অনেক ভাগ্যবতী। মেহরিমাও কপাল গুণে এ বাড়ির বউ হয়ে ছোট একটা সুন্দর বাচ্চা ছেলে পেয়ে গিয়েছিলেন। কত মায়া মমতা মিশিয়ে মা বলে ডাকত সে। বুকের সাথে মিশে গিয়ে বলত নতুন মা তুমি অনেক সুন্দর। আমাকে আদর করো বেশি বেশি। সময়ের প্রেক্ষিতে তিনি বুঝলেন পৃথিবীতে সব নারী সংসার সাজায় না,কেউ কেউ ঘরও ভাঙ্গে। বিচ্ছেদ ঘটায় মনের। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে তোহাশের জন্য মন পুড়ে ওনার। জন্মদাত্রী না হোক মমতা মিশিয়ে বড় করেছেন তিনি তাকে। রুমে এসে কেঁদে উঠলেন। দুই সন্তানের জননী হয়েও তিনি আজ একা। মনোমালিন্য ছেলেদের সঙ্গে। মা ভালো চায় এটা কি সন্তানেরা বুঝে না?
.
.
খাবারের পর্ব শেষ করে কক্ষে পা রাখে শ্রেয়া। এসেই সংশয়ে পড়ে যায় ও। তূর্য সোজা হয়ে শুয়ে আছে। মুখের উপর মোবাইলের আলো। মনোনিবেশ সম্পূর্ণ তাতেই। শ্রেয়ার দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রধান কারণ হলো গত রাতগুলো তূর্যর আদেশ মোতাবেক খাটেই শুয়েছে, প্রিয়ুদের বাড়িতেও কি তার পাশেই একই বিছানায় ঘুমাবে?এখানে তো টাকা পোষানোর প্রশ্নই ওঠে না তবুও কি বিছানায় থাকতে দিবে?নাকি নাটকের মতোন বলবে নিচে থাকো?ঠিক কতবছর চলবে লোকটার হেয়ালিপনা,অভিনয়?অতীব চিন্তায় মশগুল থাকার এক পর্যায়ে খেয়ালে আসে তূর্য ওঠে বসেছে। কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বললো,
‘ চিন্তা করতে করতে মুহুর্তের মধ্যে একটুখানি শুকিয়ে গেলে৷ নিশ্চয়ই আধা কেজি কমে গেছে ওজন। এদিকে এসো শ্রেয়সী। ‘
তাজ্জব হলেও গুটি গুটি পায়ে কিছু টা এগিয়ে গেল ও। আলতো, নরম স্বরে বললো,
‘ আমি কোথায় থাকবো স্যার?’
তূর্য আবারও সটান হয়ে শুয়ে পড়ে। দাঁতে দাঁত চি’বিয়ে বলে,
‘ বুকে। ‘
‘ কি?’
হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে শ্রেয়ার নরম সরম দেহ টা বিছানায় ফেলল তূর্য। ভয়ে হকচকিয়ে গেল শ্রেয়া৷ সহসায় ধরাস ধরাস করে কাঁপলো সমগ্র অঙ্গ প্রতঙ্গ। অনুভব করলো ওর গলায় শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয়ের গাঢ় ছোঁয়া। ক্রমশ গভীরে পরিণত হয় তা। শাড়ি ভেদ করে বলিষ্ঠ হাতের চাপ পড়ে উদরে। আনমনে, অস্থিরতায় তূর্যর ঘাড়ে খামচে ধরতে নেয় ও। তখনই তূর্য কঠিন সুরে শা’সায়,
‘ একদম না। শরীরে নখ বিঁধলে আমি কিন্তু সীমালঙ্ঘন করে ফেলবো। তুমি কি তাই চাইছো?’
শ্রেয়া নিমীলিত চক্ষুদ্বয়ের পল্লব নাড়ে। তূর্য ওর জবাবের অপেক্ষা করে না। শ্রবণনালির সান্নিধ্যে মুখ রাখে। বলে,
‘ আমি তো বউ কোথায় থাকে সেটা প্র্যাক্টিক্যালি দেখাচ্ছিলাম। তুমি এখন আমাকেই ধৈর্য্যহীন করার তোরজোড় চালাচ্ছো বউ?’
হুট করে পুরো কক্ষ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। কারেন্ট চলে গিয়েছে। তূর্য এটা নিয়েও কথায় শোনায়। গাঢ় স্বরে বলে ওঠে,’ সবকিছু কেমন তোমার পক্ষ হয়ে আমাকে কিছু একটা ইশারা করছে। ‘
শ্রেয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ। তর সইল না আর। চোখ মুখ খিঁচে মনের চিন্তা টা বাস্তবায়ন করেই ছাড়ল।
#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩২
মানস্পটে বিষাদ ছুঁয়েছে। সহস্র সহস্র তাহাদের পরিমাণ। শূণ্যতায় খাঁ খাঁ করছে অন্তকরণ। কবে আসবে বর্ষণ? জলধারার শীতল আলিঙ্গনে হিম হবে ভিতর কোন ক্ষণে?আষাঢ়ে জল আদৌ কি স্পর্শ করবে ভূমিকে?প্রচন্ড তাপদাহে তারা যে ফেটে চৌচির কিন্তু শ্রেয়ার ন্যায় নয়। ওর শূন্য,তৃষ্ণার্ত অন্তরের উত্তাপ নিভানোর কাজ টা কখনও আকাশ ভেঙে নেমে আসা বৃষ্টির দ্বারা সম্ভব নয়। এ অগ্নিতেজের শীতলীকরণ হবে কেবল, কেবল তূর্য নামক শ্রাবণ মাধ্যমে।
মানুষ টা সেই যে গত সপ্তাহে গেল আর একটা খোঁজ খবরও নেই। এ বাড়িতে তূর্য বিহীন কেটে গেল শ্রেয়ার সাতটা দিন। তন্মধ্যে বেশ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলোও শ্রেয়াকে এতটা আঘা-ত করে নি,যতটা করছে প্রিয় সেই পুরুষের অনুপস্থিতি। হলদে দ্যুতিতে খোলা বারান্দায় হলুদ পাখি সেজে চেয়ারে বসে আছে শ্রেয়া। চেহারায় প্রিয়র মোহে অমানিশা ও মলিন ভাব।
তূর্য প্রিয়ুদের বাড়ি থেকে পরের দিন সকালে বিদায় নিয়ে সোজা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। একটা শব্দও বলে যায় নি শ্রেয়াকে যাওয়ার আগে। শুধু আয়ুশকে জানিয়েছে শ্রেয়াকে যেন বাড়িতে নিয়ে যায় সাথে। হঠাৎ সাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। শ্রেয়া তখনও গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল। উঠে প্রিয়ুর কাছ থেকে এসব শুনে অত্যন্ত বিস্মিত হয়। মনে ভয় জমে। তূর্য কি তাহলে রাত্রির অর্ধভাগে ঘটে যাওয়া ঘটনার রেশ ধরে অকস্মাৎ চলে গেল!কেন যে ও অমন করতে গেল! যাওয়ার পরের দু দিন বাদে শ্রেয়া চৌধুরী বাড়িতে ফিরে আসে। ওকে দেখেই মেহরিমা সকলের সামনে তেঁতে উঠলেন। সুযোগ পেয়ে কথা শুনালেন,’ কি এমন হলো ভাইয়ের শশুর বাড়ি থেকে আমার ছেলেকে সকাল সকাল চট্টগ্রাম চলে যেতে হলো?আগেও শান্তি দিলে না,এখনও না। ‘
কথাগুলো শুনিয়ে চলে যান তিনি।
তূর্যর খালা বার কতক জিজ্ঞেস করে তার হঠাৎ চলে যাওয়ার কারণ কিন্তু বরাবরই প্রতুত্তরে পরাজয় মেনে নেয় শ্রেয়া। তারপর! তৎপরে গুণে গুণে আরো কয়েকটা দিন কেটে গেল। অনেক বার মোবাইল হাতে নিয়েও কল দিতে গিয়ে ফিরে আসে শ্রেয়া। প্রচন্ড দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে ও। এত জেদ,রাগ!তাহলে রাগই কি করেছে? নয়ত কেন এতদিনে একটা বারও কল,মেসেজ কিছুই করলো না?
বারান্দার রেলিংয়ে শ্রেয়া মাথা ঠেকিয়ে রইল। মোবাইলটা পড়ে আছে চেয়ারের একপাশে। চোখ দুটো অশ্রুতে টলমল অবস্থা। তূর্যর দেহের কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ, হেয়ালিপনা, ত্যাড়া বাঁকা শব্দ মিলে একেকটা বাক্য,গম্ভীর,তেজী ভাব সবকিছু ওকে বড্ড পোড়াচ্ছে। মনস্পৃহা জাগছে এখনই বাস ধরে ছুটে যেতে চট্টগ্রাম। আয়ুশও অনেকবার কল দিয়েছিল কোনো হদিস নেই তার। কোথায় গেল?এক সপ্তাহ সহ্য করেছে, আর পারছে না শ্রেয়া। পাশ থেকে হাতড়ে ফোনটা হাতে নেয়। তূর্যর নাম্বারে ছোট্ট একটা বার্তা পাঠায় বহু সাহস জুগিয়ে, ‘ আসসালামু আলাইকুম স্যার। ‘
মিনিট পেরোয় কিন্তু অপর দিক হতে কোনো উত্তর মিলে না। এ যাত্রায় নিজেকে দমিয়ে রাখা কঠিন হতে কঠিনতম হয়ে পড়ে। অতি সন্তর্পণে গড়ায় জল। ভিজায় শ্বেত কপোল যুগল। ঠিক সেই মুহুর্তে পিছন থেকে চেনা একটা স্বর ডেকে ওঠে,
‘ নতুন বধূ নিচে চলো খাইবা। ‘
শ্রেয়া ফিরে না। এ অবাধ্য জলের সাক্ষী করতে চায় না ও কাউকে। কাঁদলে কাঁদবে শক্তপোক্ত সেই বক্ষে মাথা এলিয়ে। তবুও কান্নাগুলোও তার নামে হোক,দেখুক সে। সেও জানুক শ্রেয়া আজ সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত হয়েছে তার তার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জটিলভাবে প্রকাশ করা অনুভূতিদের সম্পর্কে। কিছু কিছু জিনিস কখনো ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভবপর হয় না,তার মধ্যে একটা হলো মানব কন্ঠনালি গলিয়ে উন্মুক্ত হওয়া শব্দাংশ। শতাধিক বার চাওয়া সত্ত্বেও শ্রেয়া ফিরিয়ে নিতে পারছে না। যার দরুন মিলছে বিচ্ছেদের অসুখ। সে এক নিদারুণ অসুখ। শ্রেয়ার নরম মনে অঢেলভাবে বিস্তার লাভ করছে তা। কর্ণবিবরে আবারও প্রবেশ করে রহিমার তড়তড়ে স্বর,
‘ ও নতুন বধূ!খাইবা না?’
‘ খাবো না খালা। ‘–ভাঙা ভাঙা কন্ঠে তৎক্ষনাৎ জবাব শ্রেয়ার।
রহিমা পিছন থেকে চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
‘ মন খারাপ তোমার?কথা হয় নাই তূর্য বাবার লগে?’
শ্রেয়ার অভিমান বেড়ে গেল। ঠান্ডা গলায় বললো,’ না। লেকচারার সাহেবের সময় আছে নাকি?কাউকেই তো ফোন দিচ্ছেন না?’
‘ কে কইল কাউরে দেয় না?তুমি যেদিন বাবা রে পুরোপুরি চিনে যাইবা সেদিন কইবা খালা এমন একটা জামাই আমারই হোক। ‘
শ্রেয়া বিস্ময়াহত। ব্যগ্র কন্ঠে সরব করে বলে,
‘ ফোন দিয়েছেন তিনি?’
রহিমা খালা যেন প্রশ্নটা উপেক্ষা করলো। বললো,
‘ এহন আইয়ো আমার লগে। মেলা রাত হইছে। তোমারে খাওয়াইয়া আমি ঘুম দিমু। ‘
শ্রেয়া খেয়াল করেছে তূর্য যাওয়ার পর থেকে প্রিয়ু ও খালা ওর খেয়াল রাখছে। বিশেষ করে রহিমা খালা। এ বাড়িতে একমাত্র ওর জন্য যদি কারো অতিরিক্ত দরদ থাকে তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে রহিমা খালাই প্রকাশ করছে। মায়ের মতোন আচরণ ওনার। শ্রেয়ার বড্ড আনচান করে আজকাল মনটা মা’কে দেখবার। কিন্তু সেটা তো কোনো কালেই সম্ভব না। রহিমা খালাকে দেখেই ও তৃপ্তি মেটায়। মেহরিমা ও ফাতেমা চৌধুরী হাঁটতে বসতে কথা শুনিয়ে যায় ওকে। ক্ষণে ক্ষণে উপলব্ধি করেছে ও স্বামী বিহীন শশুর বাড়িটা মেয়েদের জন্য কখনও শান্তির স্থান না। মনের সন্দেহ ব্যক্ত করে প্রশ্ন করে শ্রেয়া,
‘ আপনি আমার জন্য এত চিন্তা করছেন কেন খালা?’
‘ তোমার দায়িত্ব জানি কেউ একজন আমারে দিয়ে গেছে। এ বাড়িতে তার ভরসার জায়গা টা আমি। এইডা আমার কত বড় পাওয়া তুমি বুঝবা না নতুন বধূ। সবসময় আমার জীবনডা দিয়া হইলেও তোমার খেয়াল রাখমু। ‘
শ্রেয়া হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। অবাক হলেও কথা বাড়ালো না। দু হাতে চোখ মুছে ওষ্ঠদ্বয়ে হাসি মাখে। মিছে হাসি। বলে,
‘ আম্মা,বাবা,প্রিয়ু সবাই খেয়ে নিয়েছে?’
‘ হু। তুমিই বাকি। বড় স্যার তোমারে ডাকতাছিল। আমি কইছি তুমি পরে খাইবা। কিন্তু প্রিয়ু রইছে। কইল তোমার লগে নাকি খাইব।’
‘ আচ্ছা। চলুন। ‘
শ্রেয়া আগে আগে বারান্দা ছেড়ে চলে গেল। রহিমা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে হাতের মোবাইল টা কানে নিয়ে বলে উঠলো ফিসফিস করে,চুপিসারে,
‘ সুস্থ হইছো নি কিছুটা?মাইয়াডা তোমারে ছাড়া দুঃখ পাইতাছে। ‘
অপরপাশ থেকে তাৎক্ষণিক কর্ণধার হয়,’ মা কি ওকে বেশি কথা শোনাচ্ছে?’
মোক্ষম সময় পেয়ে রহিমা গড়গড় করে বললো,’ শুধু তোমার মা?আম্মাও ছাড় দিতাছে না। এহন যদি তোমার কথা শুনে তাইলে তো নতুন বধূরে একদম ছাড়ব না। তোমার মা’র মায়া দয়া যে কই পালাইছে। আগে কত ভালা আছিল। ‘
‘ আচ্ছা ওর খেয়াল রাখবেন। ‘
কথাটা বলতে দেরি তবে কলটা কাটতে বিলম্ব করে নি মানুষ টা। রহিমা হতাশামিশ্রিত নিঃশ্বাস ফেলে দ্রুত গতিতে নিচে যায়।
_________
তন্দ্রা নিয়ে গায়েব হয়েছে তূর্য। শ্রেয়ার ঘুম পায় না। নিশীথিনী তে হাটতে বের হলো বাগানের দিক টায়। বাড়ির সব মেহমান এক দু দিন থেকেই চলে গিয়েছে। রুনা খালা এই ক’দিন ছিলেন কিন্তু তিনিও নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। একটা মাস বাংলাদেশে কাটিয়ে আবার কানাডায় চলে যাবেন। গুড়ি গুড়ি বর্ষণ হচ্ছে। একটু একটু করে দেহ স্পর্শ করছে। এটা অত্যন্ত উপভোগ করছে শ্রেয়া। কিছুদূর হেঁটে আসতেই চক্ষে বিঁধে নুরুল চৌধুরী বাগানে পাতানো বেঞ্চিতে বসে আছেন মাথা নত করে। অবলীলায় ঠাহর করলো সে আধবয়স্ক এই মানুষ টা কোনো কারণে ভীষণ ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। ঘরে ফিরে যাওয়ার মত পোষণ করে ও। তথাপি পাও বাড়ায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে থেমে যেতে হয়। নুরুল চৌধুরী হাসিমুখে ডাকে ওকে। শ্রেয়া আজ একটা জিনিস খেয়াল করলো ওনার কন্ঠে গম্ভীরতা নেই নিত্য দিনের মতোন,এ মুহুর্তে উপস্থিত শুধু শুধুই বিষাদ। মাথায় ঘোমটা সমেত ও বেঞ্চির কাছে এসে দাঁড়ায়। নম্রতার সহিত বললো,’ জি বাবা!’
‘ এত রাতে বাহিরে কেন তুমি?’
শ্রেয়া মৌনতা পালন করলো। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। নুরুল চৌধুরী নিজ থেকেই বললেন,
‘ বুড়ো শশুরের পাশে একটু বসবি মা?কিছু কথা বলতে চাই তোকে। ‘
অপ্রস্তুত হলো শ্রেয়া। দূরত্ব রেখে এক কোণে বসলো। কখনো তো বাবার সান্নিধ্যে যাওয়া হয় নি,বাবার আদর কেমন হয় সেটাও ওর জানা নেই। ছোট্ট করে বলে উঠলো,
‘ বলুন বাবা। ‘
‘ তূর্যর সাথে কথা হয় নি তোর তাই না?ছেলেটা আমারও ফোন তুলছে না। যাই হোক, প্রিয়ুর কাছ থেকে শুনলাম সামনের সপ্তাহে তোদের পরীক্ষা। তিন দিন পর পাঠিয়ে দিব তোদের। তখন আমাকে গিয়ে জানাস তো আমার ছেলেটা কেমন আছে। ওদের মন মতোন বাবা আমি হতে পারলাম না। না পারলাম পরিবারের ভালো কর্তা হতে। তোর শাশুড়ী এ কদিন তোকে অনেক কথা শুনিয়েছে,আমি খেয়াল করেছি। আসলে ওর দো’ষ নেই। আমরা সবাই পরিস্থিতির শিকার। মনের একটা ভয় থেকেই এমন করে। তোহাশের মতো তূর্যকে হারিয়ে ফেলার ভয়। ‘
‘ কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি বাবা?’— খুঁত খুঁত স্বরে অনুমতি চাইল শ্রেয়া। নুরুল চৌধুরী নির্দ্বিধায় বললেন,
‘ আমি জানি তুই কি প্রশ্ন করবি। সম্পর্কে তোর শশুড় হতে পারি কিন্তু তুই আমার মেয়ে। তোকে প্রথম দিন থেকে নিজের মেয়ে ভেবে আসছি আমি। বাবার জীবনের কয়েকটা কথা জানার অধিকার মেয়ের রয়েছে। আমিও আমার মেয়েকে শেয়ার করতে চাই।
তোহাশ আমার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। আমার বড় ছেলে। তোহাশের মা মায়া ছিল আম্মার বান্ধবীর মেয়ে। গ্রামের মেয়ে ছিল। বড্ড পড়ালেখার ঝোঁক ছিল মেয়েটার। তখন সবে সে মেট্রিক দিয়েছে। ওর ক্লাসের সকল মেয়েদের প্রায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার মাথায় ভূত চাপে সে ইন্টার পাস করবে। ওদের গ্রামে তখন কোনো কলেজ করা হয় নি। আম্মা এটা শুনে তার বান্ধবীকে বুঝিয়ে মায়া কে এখানে নিয়ে আসে। ‘
এটুকু বলে শব্দ করে হেসে উঠলেন নুরুল চৌধুরী। পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে মুখ মুছলেন। শ্রেয়া যেন ঘোরে আছে। নুরুল চৌধুরী সামনের দিকে তাকিয়েই বলে উঠলেন,
‘ অবাক হচ্ছিস?জানিস তোর মধ্যে ঠিক মায়ার স্বভাব। চুপ করে সব সহ্য করা,জবাব না দেওয়া কথায় কথায়। ও একদম এমন ছিল। তোর প্রথম শাশুড়ী থাকলে তোকে কলিজায় ঢুকিয়ে রাখত। তুই তো ওরই প্রতিচ্ছবি মা। মায়ার চুপচাপ স্বভাবে আমি সবথেকে বেশি মুগ্ধ হয়েছিলাম। এত শান্ত মেয়ে আমি কখনও দেখি নি। এই যে পেয়ারা গাছ টা দেখছিস না?এটা ওর জন্যই লাগানো। অনেক পছন্দ ছিল ওর পেয়ারা। অবশ্য এটা আমি আগে লাগাই নি। ওর মৃ*ত্যুর পর লাগিয়েছি। অনেক পর। তোহাশ তখন ভার্সিটিতে পড়ে।’
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)