#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___২৮
সময়টা নিশামুখের। দিবাবসু আকাশ পথে ঢলে পড়েছে কেবল। গুচ্ছ গুচ্ছ রক্ত অম্বর কোণে। আকাশের বুক চিরে রক্ত বন্যা বয়ে গেছে হয়ত!ফলস্বরূপ জমাট বেঁধে থোকায় থোকায় অবস্থান তাহাদের। কোনো এক বিষাক্ত বেদনা কি বিস্তর অন্তরিক্ষেও আ’ঘাত হেনেছে? যেমন করে বাড়িতে আসা অতিথিদের কটুক্তিতে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ছে শ্রেয়ার অন্তঃপুর। রক্তিম আবরণে বুঝি আচ্ছাদিত হলো ওর কোমল হৃদপিণ্ড!
শ্রেয়া চুপচাপ, নিবিড় হয়ে সোফায় বসে বসে গ্রোগাসে ভিন্ন ভিন্ন কন্ঠস্বরের বিভিন্ন প্রকার বাক্য গিলছে। কারো কারো কন্ঠস্বরে আফসোস,কারো কারো মুখের কথায় এক সমুদ্র সমান তিক্ততার মিশ্রণ। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে হাজারো শব্দের মেলা বসেছে তাকেই চিনে না বাড়ি বয়ে আসা এই অতিথিরা। ওর পাশে বসে পান চিবানো মহিলাটা অপর এক মহিলার কথার পরিপ্রেক্ষিতে গলা উচাঁলো,
‘ ভালো হয়েছে ওই মেয়েটা চলে গিয়েছে নয়ত এত সুন্দর,মায়াবী একটা বউ পেত তূর্য? এতিম মেয়ে ছিল। দেখতে কি আর অহমিকার মতো অপ্সরী ছিল নাকি?অহমিকার রূপে আমিই মুগ্ধ, না জানি তূর্যর কি হাল!’
কথাটা তীরের মতোন এসে বিঁধল শ্রেয়ার নরম মাংসপিন্ডে। ঘোমটার আড়ালে হাসল সে তাচ্ছিল্যের সহিত। বাঁকা হলো অধর জোড়া ক্ষীণ।
মেহমানে গিজগিজ অবস্থা পুরো চৌধুরী বাড়ির আনাচে-কানাচেতে। বেশ বড়সড়ভাবে বৌভাতের পূর্বপ্রস্তুতি চলছে। চেনা অচেনা অনেক মুখ এক ঝাঁক পাখি হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে চার দেয়ালের অভ্যন্তরে। তার মধ্যে হতে কিছু মহিলা শ্রেয়ার এবং প্রিয়ুর পাশে বসে নিজেদের আলোচনা, সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছে,খুলে বসেছে তিক্ততায় ভরপুর কথার ঝুলিখানি। সেই থলে ভরপুর তূর্যর আগের বউয়ের নিন্দা দ্বারা। উপস্থিত ত্রিহা বুঝলো এখানে বসা সবাই শ্রেয়াকে অহমিকা ভাবছে। কারণ সবাইকে তূর্য ও অহমিকার বৌভাতের নিমন্ত্রণ কার্ড বিলিয়ে ছিলেন মেহরিমা। বিয়েতে তেমন কাউকে ইনভাইট করা হয় নি। যাদের করা হয়েছে তাদের কেউই এখানে নেই। বিয়ের আগেই এসকল কাজ সমাপ্ত করা হয়েছিল যেন পরে ঝামেলা পোহাতে না হয়। কিন্তু বিয়েতে ঘটল অন্য কিছু। মেয়েটার ব্যাপারে যাচ্ছে তাই বলছে অনর্গল এতে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। কিন্তু প্রকাশ করছে না। তাই ত্রিহা হাতের চায়ের ট্রে টা সামনের টি টেবিলে রেখে মৃদু হাসল। বললো,
‘ এ মেয়েটা অহমিকা না৷ ওর নাম শ্রেয়া। তূর্যর সেই বছর তিনেক আগের পালিয়ে যাওয়া বউ। ‘
সবার দু অধর আপন গতিতে ফাঁক হয়ে গেল। কিঞ্চিৎ নয় অনেকখানি। তেতে উঠলো তূর্যর ছোট খালা রুনা। আজই ফিরেছেন তিনি কানাডা থেকে ছেলেমেয়ে নিয়ে। কই তাঁর বোন তো বলে নি আগের মেয়েটা কেই ফিরিয়ে এনেছে!কত করে বললো,যে মেয়ে একবার বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে মান সম্মানে, চৌধুরী বাড়ির রঙিন প্রাচীরে কলংক লেপেছে তাকে আর ফিরিয়ে না আনতে। তার নিজস্ব মতামত মেয়েটা কখনও তূর্যকে ভালোবাসতে পারবে না। ভালোবাসা মন থেকে হয়। আর মেয়েটা পাগল রূপ দেখে ছেড়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু আবারো তাকেই ফিরিয়ে আনা হলো অথচ মেহরিমা তাকে কিছুই জানালো না। বোনের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল ওনার আর তূর্যর জন্য অসীম ভালোবাসা, যা এখনও রয়েছে। তিনি শ্রেয়ার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভরা আসরে বলে উঠলেন,
‘ এই মেয়েকে ফিরিয়ে এনেছেন কেন ত্রিহা ভাবী?’
প্রশ্নের সম্মুখে ঘাবড়ালো ত্রিহা। কি বলবে ভাবছে!তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে পারছে না। তক্ষুনি গম্ভীর স্বরে পিছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
‘ চাচী কেন আনবে খালা মণি? আমার বউ আমি চিরুনী অভিযান চালিয়ে বের করে এনেছি। ‘
বলেই পকেটে দু হাত চালিয়ে গটগট করে সমুখে এসে দাঁড়াল তূর্য। সালাম দিল সবার উদ্দেশ্যে। সোফার দিকে তাকিয়ে নত মস্তকে প্রিয়ুর হাত চেপে ধরে বসে থাকা শ্রেয়াকে দেখে চক্ষুদ্বয় জ্বলে উঠলো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। বিড়বিড় করলো,
‘ বোবা একটা!’
তৎপরে রুনার দিকে দৃষ্টি তাক করে। রুনা বিস্ময়াহত চক্ষে চেয়ে আছেন। ইতমধ্যে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন মেহরিমা ও আয়ুশী। তার হাত ভর্তি করে রেখেছে একটা বড় থালা। তাতে পেয়াজু। সবার জন্য খুব যত্ন সমেত বানিয়েছেন মেহরিমা। কিন্তু এখন ওনার মুখে নিকষ কালো আঁধার নেমে এসেছে। রুনার অঙ্গভঙ্গি দেখে বুঝতে বাকি নেই পুরো ব্যাপারটা জেনে গিয়েছে সে।
তিনি পরে একান্তে বুঝিয়ে বলতেন বোনকে অথচ কি ঘটে গেল!তূর্যকে দেখে আরও অবাক হলেন। কেউ কোনো কটুবাক্য শোনায় নি তো শ্রেয়াকে!তাহলে ঝামেলা বাঁধবে তূর্য জানতে পারলে। কারণ ছেলেকে তো এই মেয়ে আঁচলে বেঁধেই ফেলেছে। এসব ভেবে ভেবে বুক ভারী হয়ে এলো ওনার। তূর্য ও রুনার উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ কি রে তোরা খালা,ভাগিনা অমন করে চেয়ে আছিস কেন?’
রুনা মেহরিমার দিকে না চেয়ে তূর্যকে নরম গলায় বললেন,
‘ এই মেয়েকে ফিরিয়ে আনলে কেন?তুমি জানো এই মেয়ে কি করেছে?’
তূর্যর শ্রেয়ার হাত ধরে টেনে দাঁড় করালো। নিজের পাশে দাঁড় করিয়ে ভাবলেশহীন জবাব দেয়,
‘ সব জানি। কিছু বলো না খালা মণি। বউটা অনেক সাধনার। ‘
এতটুকু বলে শ্রেয়ার হাত টা নিজের হাতে আবদ্ধ করে পরমুহূর্তে স্মিত হাসে। বলে,
‘ দুই বিয়ে পছন্দ না খালা মণি। তুমি তো জানোই আমি কেমন?বউ ভুলবশত রাস্তা ভুলে গিয়েছে, তাকে আমি সঠিক পথের পথিক বানাবো। তুমি চিন্তা করো না। তো কেমন আছো?’
রুনা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
‘ তুই হাসছিস?এই মেয়েটা?’
‘ তোমার হাত টা ওর মাথায় বুলিয়ে দাও না। কারো আদর পায় না ও। একটু আদর করে দিবে ওকে?’
সকলের ফ্যালফ্যাল, চমকিত নয়নজোড়া ওদের দিকেই নিবদ্ধ। রুনার অকস্মাৎ কি হলো তিনি স্বয়ং জানেন না। তবে তূর্যর কন্ঠনালি হতে মুক্ত হওয়া শব্দালংকার তুচ্ছ করতে অক্ষম হলেন। হাত বাড়িয়ে শ্রেয়ার মাথায় আদর পরশ বুলিয়ে দেয়। সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে,
‘ আর আগের ভুল টা করো না। ছেড়ে যাওয়া কখনও সমাধান হয় না। ‘
তূর্যর দিকে তাকিয়ে বললেন–‘ প্রথমবার তোর গম্ভীর মুখের হাসিতে ঘায়েল হলাম,যার ফল এটা। ‘
মেহরিমা তাজ্জব হলেন। দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলেন তার ছেলে জাদু জানে নাকি মেয়েটা?কি চমৎকার ভাবে ওনার বোনের মনটা গলিয়ে ফেলল!ভিতরে ভিতরে পুড়ছেন ওনি ছোট ছেলেকে হারানোর ভয়ে। একটা বিহিত করতেই হবে। তবে তা তূর্যর অগোচরেই। আজ ওনার তোহাশের কথা মনে পড়ছে ভীষণ। তূর্যর মধ্যে যেন ওনি তোহাশের প্রতিচ্ছবি দেখছেন। সেও এমন করত। আরিয়ানা কে কেউ একটা কথা শুনালে রেগে যেত। বলত এতিম মেয়েটার সঙ্গে এমন না করলে হয় না?কিন্তু সেই মেয়েটাই যে সহজ সরল ভঙ্গিমার পশ্চাতে কত কি লুকিয়ে রেখেছে সেটা কখনও ছেলেকে বলে কইয়ে বুঝাতে সক্ষম হন নি ওনি। অতঃপর ঘটলো বিচ্ছেদ। মা, ছেলের সম্পর্কে ভাঙ্গন। ভিতর দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল তোহাশের উচ্চারিত সেই একটা বাক্য —‘ সৎ মা বলে সতীনের গর্ভধারণ করা ছেলের সুখ সহ্য করতে পারছে না।’
________________
শ্রেয়া দেয়াল সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে মিনিট পেরিয়ে আধাঘন্টা হবে। পা ব্যাথা হয়ে আসছে ওর। সম্ভবপর হলে পা দু’টো বাড়িয়ে পুরো কক্ষের মেঝেতে তাদের স্পর্শ মেখে দিত। কিন্তু তাতে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে বিছানায় আধশোয়া হয়ে থাকা সুদর্শন একজন পুরুষ। ভালোই তো হচ্ছিল সন্ধ্যে হতে সব। সবার সাথে খেল,প্রিয়ু ও আয়ুশীর সঙ্গে টুকটাক আলাপচারিতা চলল এবং সর্বশেষে রুনা বেগমের কিছু নিয়মনীতি মনে গেঁথে পদার্পণ করলো কক্ষে। কিন্তু এসেই বাঁধলো বিপত্তি। রাগমিশ্রিত একটা কন্ঠস্বর চেঁচিয়ে বলে,’ দেয়ালের এক কোণে মিশে দাঁড়াও। ‘
সেই যে মিশলো আর নড়চড়ের দেখা মিলে নি। গলা শুকিয়ে এসেছে ওর। অন্তরআত্মা লাফাচ্ছে। তূর্যর গতিবিধি ঠাওর করতে পারছে না একদমই। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো নড়বে না৷ ঠিক ততক্ষণ নড়বে না যতক্ষণ না লোকটা ওকে নড়তে আদেশ করছে। এক প্রকার জেদ চেপে বসলো ওর। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে এমন করার মানে কি? সম্মুখে চাইতেই অক্ষিপটে ভাসে বিছানা ছেড়ে এগিয়ে আসছে তূর্য ওর দিকে।
সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ঝুঁকিয়ে পায়ের গতির দিকে নিক্ষেপ করলো। খুব দ্রুত আসছে মানুষ টা। বক্ষস্পন্দন বেড়ে অবস্থা ক্রমশ ভয়ংকর হচ্ছে ওর। আকস্মিক খেয়াল করলো সুঠাম দেহটা ওর খুবই নিকটস্থে। হেলে পড়েছে ওর চিকনচাকন দেহের পানে ঈষৎ। পুরোপুরি নয়। তবে উষ্ণ, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ওর দম আঁটকে দেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে। নজর গিয়ে ঠেকল নিঃশ্বাসের মালিকের হৃদয়স্থলের খুব কাছাকাছি, অত্যন্ত নিকটে। কক্ষের নিরবতায় শ্বাস প্রশ্বাসের আন্দোলন চলছে অনবরত। অবলীলায় কর্ণধার হচ্ছে এক কোণে একে অপরের দেহ ছুঁই ছুঁই দু’টো মানুষের।
শ্রেয়ার পিনপতন নিরবতার অন্তুিম রেখা টেনে স্ব শব্দে, দাঁতে দাঁত চেপে বাক্যবাণে জর্জরিত করলো তূর্য। কেঁপে উঠলো ও। ঝিম মেরে গেল সমস্ত মস্তিষ্ক।
‘ গাধী মেয়ে!মুখ নেই তোমার?পারতে না বলতে তোমার নাম অহমিকা না শ্রেয়া?আরে মানলাম তুমি বউ। আমার সাধনার বউ। কিন্তু নরম কন্ঠে বলা যেত না একটা বার নামটা?এভাবে অপমান সহ্য করার মানে কি?তার জন্যই আমি তোমাকে দেখতে পারি না,ভালো ও বাসি না। শুধু বউ বলে বেঁধে রাখি। চলো এখন।’
আরো জোরে ধমকে ওঠে তূর্য। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থাকল ঠাঁই। শরীর টা থেকে থেকে কাঁপছে। তূর্য কিছু না বলে যেতে নিলে সেও বেরিয়ে গেল পিছু পিছু। নিচে মেহমান দেখে জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে রিনঝিনে আওয়াজ তুলল,
‘ কোথায় যাবো স্যার?’
‘ আমার প্রেমিকা দেখতে। ‘–তূর্যর নির্লিপ্ত কন্ঠস্বর।
শ্রেয়ার মাথা ঘুরছে। প্রেমিকা দেখতে মানে?ধরা গলায় বললো,
‘ বুঝি নি স্যার। ‘
‘ বুঝাতেই নিয়ে যাচ্ছি। ‘
‘ জ্বি?’
তূর্যর দু’ পা থেমে গেল। সময় নষ্ট বিহীন তড়াক করে ঘুরে কঠিন দৃষ্টি তাক করে ওর দিক। নিমেষে নিভে গেল ও। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা নিচু করে ফেলল।
তূর্য পকেট থেকে মোবাইল টা বের করে কিয়ৎপরিমাণ সময় বাদে মোবাইলটা শ্রেয়ার মুখের সামনে ধরলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘ লুক এট দিস মিসেস শ্রেয়সী। ‘
ভয়ে ভয়ে মাথা উঁচিয়ে নেত্রযুগল রাখলো শ্রেয়া মোবাইল স্ক্রিনে। তাৎক্ষণিক চোখ বুঁজে ফেলল। ধুকপুক করতে লাগল বুক টা। দেহের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়লো এক অন্যরকম অনুভূতি। পরিস্থিতি আন্দাজ করে তূর্য কন্ঠে অত্যধিক গম্ভীরতা এঁটে বলে,
‘ আরেকবার প্রশ্ন করলে ঠিক এটা করবো আমি স্বামীর অধিকারে। অবশ্য শুনেছি এটা বেশ মধুময় ও তৃপ্তিদায়ক। তুমি চাইলে এখুনি রুমে চলো। ‘
চট করে শ্রেয়া নিজের এক আঙুল ওষ্ঠাধরে ছুঁয়ে নিজের স্পর্শে নিজেই কেঁপে কেঁপে উঠলো। আর সামনের মানুষ টার অধর জোড়া মিশলে কিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে ভাবতেই পারছে না ও। এই বুঝি ধোঁয়া বের হবে দু কপোল হতে। আঁটকে আঁটকে আসে গলার স্বর,
‘ আর করবো না স্যার। ‘
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)