সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ২৫

0
1702

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___২৫

শ্রেয়া ব্যাথায় ডালা টা ছেড়ে কোমর ঢলতে উদ্যত হয়। তখনি লম্বা,বলিষ্ঠ একটা হাত ওর পিছন থেকে ডালা টা টেনে ধরে। উপলব্ধি করে শ্রেয়া ওর পিঠ ঠেকে গিয়েছে একদম মানুষ টার শক্তপোক্ত, প্রশস্ত বক্ষে। কারো বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে ও।তপ্ত, গাঢ় নিঃশ্বাসের আলিঙ্গন সমগ্র ঘাড় জুড়ে। স্পর্শ, নিঃশ্বাস সবটাই যেন চেনা। মানুষ টার গা থেকে মন মস্তিষ্ক, দেহ মাতাল করা ঘ্রাণ হুড়মুড়িয়ে নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করছে। অতি সন্তর্পণে শ্বাস টেনে নেয় ও। মুহুর্তেই শুরু হয় অন্তঃকরণে অনুভূতিদের বিচরণ।

শ্রেয়া মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চাইলেও পারে না, ব্যক্তি টা আরও সন্নিকটে চলে আসে। অপর হাত দিয়ে পেয়ারা দু’টো ডালা হতে মুক্ত করে ছেড়ে দেয়। নিমিষেই দেহ টা শ্রেয়ার পিঠের সঙ্গে আরো একটুখানি মিশিয়ে শ্রবণগ্রন্থিতে ফিসফিস করে বলে,
‘ বাঁকা, অনাবৃত কোমর টা যদি আমি বাদে অন্য কেউ দেখে ফেলত?এমন করে স্বামীর হক মে’রে দিবে?একটু সাবধানে থাকা যায় না?বোকাসোকা, গাধী বউ নিয়ে তো জ্বালায় পড়লাম। ‘

তাজ্জব বনে গেল শ্রেয়া। পা দুটো ভূতলে অনড়। কাঁপছে না একটুও। ঘাড় বাঁকিয়ে চাইল না পর্যন্ত। ইতমধ্যে লজ্জা-শরমে অভ্যন্তরে তোলপাড় আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। তূর্য এখনও ওর গায়ের সাথে মিশে। সহ্যশক্তি শূন্যের কোঠায় চলে আসছে শ্রেয়ার। দেহের ভার ছেড়ে দিয়ে চোখ বুঁজে দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে মনস্পৃহা জাগছে। স্পষ্টত শুনতে পাচ্ছে রণঢাকের আওয়াজ। কি সুন্দর বাজছে ভিতরে!প্রিয় মানুষের নিকটে কত অদ্ভুত, ভয়ংকর অনুভূতি কাজ করে এ মুহুর্তে উপলব্ধি করতে সক্ষম ও। কখনও এতটা কাছে আসা হয় নি। সাক্ষাৎ হওয়ার পর থেকে কখনই দূরত্ব ঘুচিয়ে নিজ থেকে স্বইচ্ছায় তূর্য মিশে নি ওর কাছাকাছি এসে। পরম আনন্দে,সুখে,অনুভূতির সংমিশ্রণে অন্তরে অনাবিল শান্তির সমীরণ বয়ে যাচ্ছে বাঁধা বিহীন। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ীত্ব লাভ করলো না৷ তূর্য সরে গিয়ে বললো,

‘ এদিকে ফিরো। ‘

শীগ্রই ঘুরে দাঁড়াল শ্রেয়া কোনো প্রকার ভণিতা না করে। তূর্য কপাল কুঁচকে চিরাচরিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘ বাহিরে এসেছো কার সাথে?’
‘ আমার সাথে এসেছে ভাইয়া। ‘

পিছন থেকে বলে উঠলো আয়ুশী। পাশে মালী কাকা দাঁড়িয়ে। তার হাতে বড় লম্বা একটা বাঁশ। তূর্য হাতের পেয়ারা দু’টো শ্রেয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’ ধরো। ‘

শ্রেয়া কাঁপা কাঁপা হাতে নিয়ে নেয় সেগুলো। তূর্য মালী কাকার কাছ থেকে বাঁশ টা নিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, ‘ আপনি যান কাকা। ‘
অতঃপর নিজেই পেয়ারা পাড়তে শুরু করে। অকস্মাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললো আয়ুশীর উদ্দেশ্যে,’ অনুমতি নিয়েছিস তোরা এ গাছের পেয়ারা ছোঁয়ার? ‘

আয়ুশী আমতাআমতা করে বলে,’ বড় আব্বু একবার বলেছে আমরা চাইলেই খেতে পারব। তুমি তো পেয়ারা পছন্দ করো না তাই নিউজ টা তোমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি৷ ‘

‘ এত সহজে বাবা তোদের খাওয়ার অনুমতি গ্র্যান্টেড করে দিল?দিতেই পারে, যার অতি মহামূল্যবান রেখে যাওয়া জিনিস আগলে রাখার বদলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, এই সামান্য পেয়ারা গাছ আর কি!’

শ্রেয়া খেয়াল করলো তূর্যর কন্ঠে তাচ্ছিল্য, উপহাস। একটা পেয়ারা গাছের পেছনে এত রহস্য? এটা কি নুরুল চৌধুরীর খুব প্রিয়?হতেই পারে!নতুবা সকালে অমন ঘুরে ঘুরে দেখে ছোট্ট ছোট্ট নিঃশাস কেন ফেলছিল। তূর্য আরও তিনটে পেয়ারা আয়ুশীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাতে লেগে থাকা ময়লা ঝেড়ে নেয়। তৎপরে হনহন করে ঢুকে যায় সৌন্দর্যে ভরপুর দু’তলা বাড়িটার ভেতরে। স্তম্ভিত হয়ে স্থবির, অনিমেষ নেত্রে চেয়ে থাকে শ্রেয়া মানুষ টার যাওয়া অব্দি। ও বুঝে পায় না এমন কেন এই লেকচারার?মুখের আদলের পরিবর্তন ঘটে ক্ষণে,ক্ষণে। এই মেঘ,এই বৃষ্টি। আবার কখনও কড়া, তপ্ত রৌদ্দুর।

প্রিয়ু ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে আয়ুশ একমনে টেবিলের সামনে বসে খাতায় কি একটা জহুরি চক্ষে চেক করছে। হয়ত ভার্সিটির কোনো জরুরি কাগজ হবে। খুব বেশিদিন ছুটি পায় নি সে। দু’দিন বাদেই আবার নিয়মিত ক্লাস করাতে যেতে হবে। উঁচানো গলায় ডাকল প্রিয়ু,
‘ চার চোখ লেকচারার বাহিরে যাবো আমি। ‘
‘ যাও।’– সিধে সাধা, সোজা জবাব আয়ুশের। দৃষ্টি টেবিলের উপর বিছিয়ে রাখা কাগজেই মগ্ন।
প্রিয়ু ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে স্থির হলো। মুখে লজ্জা মেখে আওড়ালো,
‘ একা একা যেতে পারব না। কেমন লজ্জা লাগে!তুমি দিয়ে এসো না। ‘
নিমিষেই ফিক করে হেসে দিল আয়ুশ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি সংবরণ করে বললো,
‘ গত রাতে কোথায় ছিল এই লজ্জা? তুমি যদি পারতে আমাকে রক্তাক্ত করেই দম নিতে। কিন্তু আমার শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে গেল। ‘
কথাগুলো শুনে প্রিয়ু স্তব্ধ। কানের কাছে তবলা বাজছে যেন। রি রি করে উঠে সমস্ত কায়া। আঁচল দিয়ে মুখ লুকিয়ে বলে,
‘ নির্লজ্জ! ‘
সাথে সাথেই আয়ুশের কন্ঠে নির্লিপ্ততা, ‘ অনলি ফর ইউ। ‘
পরক্ষণে মুখের আকৃতির বদল হয়। কন্ঠে জড়তা নিয়ে বলে উঠে,’ একটা প্রশ্ন করবো প্রিয়ু?’
‘ হ্যাঁ করো। ‘
সম্মতি পেয়ে আয়ুশের নিঃসংকোচ বাক্য, ‘ বড় আব্বুর কথায় শ্রেয়া কষ্ট পেয়েছে, ওর সাথে একটু বেশি বেশি থেকো। মেয়েটা তোমার উপর ভরসা করে খুব। ভাইয়ের ব্যাপার টা বুঝতে পারছি না। শ্রেয়ার হয়ে যখন কথা বলল বেশ ভালো লেগেছে, এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছে মেয়েটাকে অত্যন্ত ভালোবাসে সে৷ কিন্তু! এত সহজে সবকিছু ভুলে আপন করার পাত্র না তূর্য ভাই। ‘

প্রিয়ু অত ভাবল না। বিলম্ব না করে উত্তেজিত সুরে বললো,’ আরে তুমি জানো না স্যার একদম আপন করে নিয়েছে শ্রেয়ু কে। আমি তো প্রমাণও দেখেছি। অযথা চিন্তা করো না। ‘

আয়ুশের ভ্রুঁ যুগল ললাট স্পর্শ করে,’ প্রমাণ?’

চেহারায় রক্তিম আভা ফুটে ওঠে প্রিয়ুর। চোখ জোড়া নত হয়। অধর কোণে ঈষৎ স্মিত হাসি।
‘ ওই তুমি যেটা আমাকে দিয়েছো আমি সেটা শ্রেয়ার গলার নিচে দেখেছি। ‘
নিমিষেই আয়ুশ সজোড়ে বুকে জড়িয়ে নিল সম্মুখে নত মস্তকে দাঁড়ানো প্রিয়ুর নরম দেহ খানি। প্রিয়ু প্রচন্ড বিস্মিত হলো। ধ্বক করে কেঁপে উঠে নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে পড়ে ওর হৃদযন্ত্র। পিঠে হাতের বাঁধন দৃঢ় হতে অত্যধিক দৃঢ় হয়। হয়ত আয়ুশ ওকে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলতে চাইছে।

হাত দু’টো বাড়িয়ে প্রিয়ুও চেষ্টা করলো আয়ুশের সুঠাম শরীর টা নিজের দু হাতে বন্দী করার। শ্রেয়ার ব্যাপারটা এমন খোলাখুলি করে বলা উচিত হয় নি প্রিয়ু বুঝতে পারল। শত হোক ক্ষত সহজে শুকায় না। ও ভালো করে চিনে আয়ুশকে। উপর থেকে শক্ত খোলসে আবৃত তার নরম মনটা। অনায়সে কোনো কষ্ট ভুলতে পারে না। তাই বলে ওকে ভালোবাসে না এমনটা নয়। পিছুটান সবারই থাকে। খুব কম মানুষ, যারা কঠোর হৃদয়ের তারাই পারে সেই পিছুটান ফেলে এগিয়ে যাবার। আবার অনেকে এগিয়ে যায় ঠিকি কিন্তু মনের কোণে থেকে যায় না পাওয়ার, অতৃপ্ততার বিষাদ,বেদনা। আয়ুশ ওকে বাহুতে বন্দী রেখেই আনন্দিত গলায় বলে,’ এবার আর কোনো চিন্তা থাকল না আমাদের। ভালো থাকুক মেয়েটা। ‘
_____________

প্রিয়ুকে নিচে না পেয়ে একটা পেয়ারা হাতে রেখে বাকিগুলো আয়ুশীকে দিয়ে দিল শ্রেয়া। বললো,
‘ প্রিয়ুকেও দিও। ‘
আয়ুশী মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুমি প্রিয়ু ভাবী কে অনেক ভালোবাসো তাই না ভাবী?’
শ্রেয়া নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। মস্তিষ্ক খাটিয়ে চিন্তা করলো কতক্ষণ, কয়েক সেকেন্ড। ঠিক উত্তর মিলল না। মিহি কন্ঠস্বর ওর,
‘ ঠিক কতটুকু ভালোবাসি পরিমাপ করা মুশকিল। কারণ আমার এতটুকু আসা অবধি ওর অনেক অবদান। ভালোবাসি বললে শব্দ টা কম হয়ে যাবে আয়ুশী। প্রিয়ু আমার প্রিয় একজন মানুষ। আমার প্রিয়র তালিকায় চাইলেই কেউ যোগ হতে পারে না। মানুষগুলোর দেওয়া ভালোবাসা,যত্ন গুলোই তাদের আমার প্রিয় নামক তালিকায় যুক্ত করে। আপাতত শুধু দু’টো মানুষই হতে পেরেছে। ‘
‘ সেই দু’জনের আরেকজন ভাইয়া?’
আয়ুশীর প্রশ্নে শ্রেয়া নিরুত্তর। বাধ্য হয়ে ও ফের প্রশ্ন করলো। ঠোঁট দুটো নড়ে উঠলো শ্রেয়ার। অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে বলে,’ হুম। ‘

তৎক্ষনাৎ দু’জনের কর্ণগোচর হয় কারো গম্ভীর, তেজি স্বর। হকচকিয়ে যায় শ্রেয়া। উপরের দিকে তাকাতেই দেখে তূর্য সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখ কুঁচকানো। ঠোঁটে ফিচেল হাসি। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল শ্রেয়া। তূর্য শুনে ফেলে নি তো?ও সরাসরি ভালোবাসি বলে নি,কখনও বলতেও পারবে না। ভয় করে যদি তূর্য ফিরিয়ে দেয়?এমনিতেই প্রকাশ না করতেই সুদূরে ঠেলে দিয়েছে। এছাড়া শুনলে ওকে কথার মাধ্যম ব্যবহার করে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে।

তূর্য লহু স্বরে ডাকল পুনর্বার,’ উপরে আসো শ্রেয়সী। ‘

সোফায় ফাতেমা চৌধুরী, ত্রিহা বসেছিল। ওনাদের কানেও পৌঁছাল কন্ঠস্বর। তাৎক্ষণিক মুখ বাঁকালেন ফাতেমা। বিড়বিড় করলেন দাঁতে দাঁত চেপে,’ কালা জাদু জানে এই মাইয়া জামাই বশ করার। ‘
ত্রিহা নরম কন্ঠে বললো,’ তূর্য শুনলে রেগে যাবে আম্মা। ‘
ফাতেমা চৌধুরী চোখ রাঙিয়ে গিয়ে কিছু বলতে চাইলে ত্রিহা সোফা ছেড়ে উঠে গেল। এগিয়ে এসে সিঁড়ির মুখে দাঁড়ানো শ্রেয়ার কাঁধে হাত রেখে বললো,’ যাও। ‘
মাথা নেড়ে সিঁড়ির প্রত্যেক ধাপ অতিক্রম করে শ্রেয়া তূর্যর কাছাকাছি যায়। স্থির হতে না হতেই হাতের কব্জিতে চাপ প্রয়োগ করে রুমে নিয়ে আসে তূর্য। টেনে খাটে বসায়। দরজা লক করে এসে বসলো শ্রেয়ার পাশে। চাহনি প্রগাঢ়,তুখোড়। শ্রেয়া মুখো ভঙ্গি পুরোপুরি বুঝার আগেই তূর্য হাত বাড়িয়ে হেঁচকা টানে বক্ষে এনে ফেলল ওর কোমল দেহ টা। ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিল সঙ্গে সঙ্গে। গভীরভাবে ডুবিয়ে দেয় রুক্ষ শুষ্ক ওষ্ঠাধর।

ওষ্ঠ যুগলের উষ্ম ছোঁয়ায় শীতল স্রোত নেমে গেল শ্রেয়ার শিরদাঁড়া বেয়ে। শিরা উপশিরায় প্রবল অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল। সইতে না পেরে হাতের আঁজলা মুঠো ভর্তি করে নিল তূর্যর কয়েকটা চুল। খামচে ধরলো কঠিন ভাবে।

#চলবে,,,!
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here