সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ২১+২২

0
1956

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___২১

নিমীলিত চোখ মেলে অনিমেষ চেয়ে রইল শ্রেয়া। বারান্দায় হলুদ রঙের আলো ছড়িয়ে আছে। দমকা হাওয়ায় বাধাহীন শাড়ির আঁচল সরে গিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেদিকে কোনো হুঁশ নেই ওর। অন্দরমহলে যে ঝড় উঠেছে তার নিকট বাহ্যিক অংশের এলোমেলো অবস্থা নিছক। সামনাসামনি, অদূরবর্তীতে দাঁড়ানো রোষপূর্ণ চাউনি নিক্ষেপ করে রাখা ব্যক্তির দিকে চেয়ে চেয়ে কেঁপে উঠছে অন্তর। শ্রবণগ্রন্থিতে বার বার বাজছে তূর্যর ক্রুদ্ধ মিশ্রিত সেই বাক্যগুলো। বিশেষ করে সর্বশেষ উচ্চারিত শব্দাংশগুলো যেন গলা চেপে ধরেছে,হৃদপিণ্ড ক্ষত করেছে খানিকটা। তবে বিষাদ জনক হলেও এটাই হবার ছিল হয়ত। কেন মেনে নিবে তূর্য তাকে ছেড়ে যাওয়া, নিজের স্বার্থে পালিয়ে যাওয়া মেয়েটাকে?অহমিকা কেন ছেড়ে গিয়েছিল কারণটা ওর জানা নেই, তবে নিজ প্রয়োজন ছাড়া যায় নি নিশ্চয়ই। তাহলে তার আর অহমিকার মাঝের তফাত কই?তূর্য অহমিকাকে ক্ষমা করে নি, ওকে কেন করবে?অপরাধ টা সমান। শাস্তি সমান হয় নি।

ফিরিয়ে আনার দু’টো হেতুর প্রথম টা খুব ভালোভাবে বোধগম্য হলো শ্রেয়ার। অর্ধাঙ্গিনী বলেই ও একটা সুযোগ পেয়েছে যেটা মিলে নি অহমিকার। সেই কারণের জোরেই ও দ্বিতীয় বার স্বামীর জীবনে ফিরে আসতে পেরেছে। তার মানে তূর্য ওকে সম্পূর্ণ রূপে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে। ক্ষমা চেয়ে নিবে ও। দোষ যেহেতু করেছে ক্ষমা চাইতে কিসের লজ্জা?কম্পনরত কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি। আপনাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত টা ভুল ছিল। বিয়ের পরদিন যখন শুনলাম আপনি,,

গলা ধরে এলো শ্রেয়ার। কষ্টের প্রখরত্ব, তেজ বড্ড। কন্ঠনালি জড়িয়ে আসছে স্বামীকে পাগল বলে সম্বোধন করতে। কেউ যেন ওর বাকশক্তি কেড়ে নিয়েছে। পারবে না বলতে। দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল ভেজা মেঝেতে। ছিটা বৃষ্টিতে সব ফোঁটা বেঁকে এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় বারান্দার অনেকখানি জায়গা। দৃষ্টি নিম্নদিকে নিবদ্ধ ওর।

তূর্য দেয়াল থেকে হাত সরিয়ে এনে বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসল। শ্রেয়ার দিকে দৃষ্টি মেলে ধরতেই বক্ষস্পন্দন ছুটতে শুরু করে নিয়ন্ত্রণহীন,অস্বাভাবিকভাবে। তড়িঘড়ি করে চোখ সরিয়ে মাথার চুল টেনে ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
‘ নিজের কথা সমাপ্ত করবে নাকি আমাকে বলতে দিবে?এখনও শিক্ষা দেওয়ার সূচনা টা-ই হলো না, আর তুমি দিন দুনিয়া ভুলে গেলে। আচঁল ঠিক করো,নইলে আমি করতে গেলে কিন্তু রেহাই পাবে না। নারীর কোমল দেহ দ্বারা পুরুষের শারীরিক চাহিদা মিটাতে কিন্তু ভালোবাসা লাগে না, ভালোবাসা উজাড় করে দিতে হয় নারী মন জিততে। এ মুহুর্তে তোমার অঙ্গের সৌন্দর্য কিন্তু আমার ভিতরকার অস্থিরতা হিংস্রতায় পরিণত করার চেষ্টা করছে। তুমি কি চাও?প্রেম মিশিয়ে ছুঁই নাকি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে?’

শ্রেয়ার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। প্রেম?চাহিদা?তূর্যর প্রতিনিয়ত কাছে আসা,লজ্জা দেওয়া এসবে কি প্রেম ছিল না?মাথাটা ধরে আসছে। শাড়ির আঁচল টেনে বুকে জড়িয়ে ধাতস্থ স্বরে বললো,
‘ আমার প্রতি ভালোবাসা নেই আপনার?না থাকলে হৃদয়ের টান কেন বললেন?’

তূর্য ঠোঁট কামড়ে তাচ্ছিল্যের সহিত হাসে। বলে,
‘ এই হৃদয়ের টান টা-ই তোমাকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করেছে। তার মানে কি?অল্প কয় দিনের পরিচয়ে আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি?এমনটা নয়। ‘
অতি সূক্ষ্ম,উত্তপ্ত একটা নিঃশ্বাস খোলা আকাশ পানে বিমোচন করে দিল। ঘুরে বসল শ্রেয়ার দিকে। ততক্ষণে শ্রেয়া উঠে দাঁড়িয়েছে।
তূর্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

‘ যেদিন জানতে পারি আমি বিবাহিত, আমার মানসিক অসুস্থতার সুযোগে পরিবার যত্নআত্তির জন্য একটা এতিম মেয়েকে আমার বউ করে এনেছে সারা শরীর গরম হয়ে উঠে। মাথায় রক্ত চেপে বসে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সুস্থ হবার কয়েক মাসেও কথাটা আমার কানে পৌঁছায় নি। জানতে পারলাম চট্টগ্রাম যাবার ঠিক আগের দিন। বুঝলাম কয়েক মাসে কেউ বলে নি তার মানে বছর চলে গেলেও বলবে না। তাই আড়ালে আমার হারিয়ে যাওয়া বউয়ের খোঁজ চালালাম। শুধু যে বউ পালিয়েছে সেটা জেনেছি তা নয়,এটাও জেনেছি বাসর রাতে বউ আমার হাতে আহত হয়েছে। তার পরের দিন পালিয়ে গিয়েছে মেয়েটা। অভিযান চালিয়ে প্রথমে খুঁজে বের করি সেই কাজী কে যিনি আমাদের বিয়ে পড়িয়েছিলেন,তার মাধ্যমেই মেয়ের নাম জানতে পারি ‘হুমায়রা তাসনিম’। লোক লাগিয়ে এই নামের মেয়েটার ছবি,অন্যান্য তথ্য বের করি। ছবি পেলাম একটা ছোট বেলার। তথ্য পাই নি খুব একটা,সব কাগজ উধাও হয়ে গিয়েছিল। ঠিক উধাও হয় নি,আমার মা সরিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েটাকে এক নজর দেখার ইচ্ছে ছিল,সংসারের কথা ভাবি নি। কারণ স্বার্থপর মেয়েদের ঘৃ*ণা করি আমি। মেয়েটার ছোট বেলার একটা ছবিই পেলাম। সেই ছবিই কাল হয়ে দাঁড়াল তোমার জন্য, আমার জন্যও।

আগে না দেখা বউকে দেখতে চেয়েছিলাম, তার ছোট কালের ছবি দেখে সেই ইচ্ছে দ্বিগুণ হয়ে গেল। মানুষ মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের কথাতেই চলে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ তার মস্তিষ্কের চেয়ে হৃদয়ের দেওয়া ইশারাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। আমি আমার বউয়ের জন্য টান অনুভব করি। তার বর্তমান মুখটা দেখার টান। তাকে নিয়ে সংসার করার টান। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসি নিজ হাতে তাকে বের করার জন্য। সেদিনই ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেক টা স্টুডেন্টের রেজিষ্ট্রেশন কাগজগুলো মেইল করেন স্যার চেক করার জন্য। সেখানেই একটা ছবি ও নাম দেখে আমার খোঁজার ইতি টানতে হয়। তোমার ছবি,তোমার নাম। শিউর হবার জন্য তোমার বাবা মা’র, পরিবারের ব্যাপারে তথ্য বের করতে গিয়েই শুনি তোমার বাবা পাগল ছিল। তোমার মা’কে খু*ন করেছে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে। এম আই রাইট?’

তূর্য তার দীর্ঘ কথার সমাপ্তি ঘটায় একটা প্রশ্ন রেখে। শ্রেয়া অবাক চোখে চেয়েছিল এতটা সময়। প্রশ্নের উত্তরে নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,
‘ হ্যাঁ। ‘
তৎক্ষনাৎ কর্ণধার হয় তূর্যর তীর্যক কন্ঠস্বর,
‘ তোমার বাবা মা’য়ের প্রেমের বিয়ে ছিল। তোমার বাবা মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বলে কখনও তোমার নানার পরিবার তাদের মেনে নেয় নি। বিয়ের এক বছরের মাথায় তোমার বাবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে মানসিক রোগী হয়,তখন তুমি গর্ভে। চাইলে কিন্তু তোমার মা তোমার পাগল বাপকে ছেড়ে চলে যেতে পারত। বড় বাড়ির মেয়ে নিঃসন্দেহে অন্যকেউ বিয়ে করে ফেলত। কিন্তু কেন যায় নি বলো তো?হয়ত তোমার মা বুঝত পরিস্থিতি মোকাবেলা না করে, নিজের স্বার্থের জন্য ছেড়ে যাওয়াটা উচিত না। প্রেম,ভালোবাসা এতটাই তুচ্ছ? যেই মা কখনও নিজের পাগল স্বামীকে ছেড়ে যায় নি তার মেয়ে স্বামী পাগল জানতেই জান হাতে নিয়ে পালিয়েছে। ‘

শ্রেয়ার সর্বাঙ্গে কম্পন ছড়িয়ে পড়ল। টলমলে পায়ে তূর্যর কাছে এগিয়ে এসে কিছু বলতে চাইলে তূর্য হাত ধরে সামনের চেয়ারে বসিয়ে দিল ওকে।
‘ কাপছো কেন?আমি মেরে’ছি তোমাকে?নাকি অন্যভাবে ছুঁয়েছি। মা’রলে, আদর করলে কাঁপবে তাছাড়া তোমার শরীরের কম্পন যেন আমার চোখে না পড়ে। আর কি বলবে সেটা জানা আমার। তুমি নিজের অতীতের কথা ভেবে ভয় পেয়ে অবুঝের মতোন পালিয়েছ?’

দুর্বোধ্য হাসল তূর্য। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে গাঢ় করে বললো,
‘ সিরিয়াসলি? অবুঝ শব্দটা মেনে নিতে পারলাম না। শুনেছি তোমার মতেই নাকি বিয়ে হয়েছিল?তাহলে রাতারাতি মতামত পাল্টে গেল কেন?মত নিশ্চয়ই ভালোবেসেই দিয়েছিলে সুখে থাকার আশায়?যখন দেখলে হাসবেন্ড পাগল বাবার কথা মনে করে ভয়ে পালালে। সেই ভয়ের পিছনেও কিন্তু তোমার স্বার্থ লুকিয়েছিল। পাগল স্বামীর সাথে সুখী হতে পারবে না এটাই মুখ্য কারণ চলে যাওয়ার। জীবন তো একটাই যদি অন্যের জন্য সেটা বিলিয়ে দাও তাহলে আর সুখ এলো কই?ভালো থাকার জন্য গিয়েছিলে,সুস্থ হয়ে শিক্ষা দিতে ধরে বেধে নিয়ে এলাম বউ। ছেড়ে যাওয়া কোনোকিছুর সলিউশন হয় না। তোমার মা’য়ের চরিত্র টার প্রতি সম্মান জেগেছে, আর তোমার চরিত্রটা আমাকে বিক্ষিপ্ত করেছে। তবুও তুমি খুব ভাগ্যবতী। স্বার্থপরদের আমি ঘৃ*ণার লিস্টে রাখি, তুমি সেখানে জায়গা করতে পারলে না। আমার পরিবার তোমাকে ধোঁকা দিয়েছে বলে সমাজের সামনে স্বীকৃতি দিয়েছি৷ তবে তুমি আমার হৃদয়েরও টান। এতদিন যা যা করেছি একটু ইচ্ছে করে করেছি,জ্বালিয়ে আনন্দ পেয়েছি, বাকিটা স্বামীর দায়িত্ববোধ থেকে। সবসময় করে যাবো। যে আমাকে যা-ই বলুক আমি নিজের মর্জিতে চলা মানুষ।’

কথাগুলো বলে চেয়ার ছেড়ে দ্রুত বেগে রুমে চলে গেল তূর্য। শ্রেয়া সেদিকে তাকিয়ে কাঁদতে চাইল। চক্ষু কোল জলে ভরপুর। তূর্যর একটা কথাও ফেলে দেওয়ার না। সত্যিই তো ভালো থাকার জন্যই ছেড়ে গিয়েছিল ও। কিন্তু যতক্ষণে বুঝ হলো সঠিক কাজ করে নি ততক্ষণে মেহরিমা ওর জন্য চৌধুরী বাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়েছে । এটা কখনোই বলবে না ও তূর্যকে। কখনো না। মা, ছেলের মাঝে প্যাচ লাগিয়ে কারো পরিবার নষ্ট করার ইচ্ছে নেই। যার পরিবার নেই সে-ই বুঝে পরিবারের মর্ম।
__________
রুমে যাবে কি-না যাবে না ভাবতে লাগল শ্রেয়া। ঝরঝরে বৃষ্টির আরম্ভ হয়েছে। বসে আছে অনেকক্ষণ হবে প্রায়। তূর্য ওকে রুমে ডাকে নি। তাহলে কি জায়গা দেবে না রুমে?ধীর গতিতে হেটে আসল। উঁকি দিয়ে দেখে বিছানায় অর্ধ উদোম দেহে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে তূর্য।

ধবধবে ফর্সা পিঠ দেখে শ্রেয়া ঢোক গিলল। তূর্যর কথায় কষ্ট পায় নি ও। বরঞ্চ পরখ করেছে তার মন টা। অনুশোচনায়,অনুতপ্ততার অনলে দগ্ধ হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। এমন একটা মানুষকে ফেলে কি করে যেতে পারল ও?কি সুন্দর করে ওর ভুলগুলো ধরিয়ে দিল,বুঝিয়ে দিল। তূর্যই সঠিক। কিন্তু বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসছে এটা ভেবে তূর্য ওকে ভালোবাসে না। ভাবতেই বিষাক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল ভিতরটা। অগোছালো জীবনটা অবিন্যস্তই থেকে গেল।

সারাদিনের ক্লান্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। বিছানার দিকে তাকাতেই ফুলগুলো দেখে হাহাকার ধ্বনি তোলে শ্রেয়ার বুকটা। মেঝেতে শোয়ার কথা ভাবতেই তূর্যর রাগান্বিত, গম্ভীর কন্ঠধ্বনি ভেসে আসে,
‘ এত টাকা দিয়ে বাসরঘর সাজিয়েছি তুমি নায়িকা সেজে মেঝেতে ঘুমানোর জন্য? তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে,ঘুমিয়ে আমার ফুলের টাকা উসুল করে দাও। ‘

শ্রেয়া বিস্ময়কর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিষ্পলক, নির্নিমেষ। একটা লোক কিছুক্ষণ আগেও কঠোর গলায় কথা বলে আবার হেয়ালিপনা করে কেমন করে?শাড়ি সামলে বিছানায় উঠতেই তূর্য ওর দিকে মুখ করে শুইয়ে পড়ল। শীতল কন্ঠে বললো,
‘ শুয়ে পড়ো। ‘

শ্রেয়া ঢের অস্বস্তিতে পড়ে গেল। শুয়ে পড়ল বেশ দূরত্ব রেখে। নিমিষেই তূর্য ঘোর লাগানো স্বরে বলে উঠে,
‘ দূরত্ব রেখে শুয়েছো ভালো কথা৷ দেখো খালি শরীর পেয়ে আবার চুমু খেতে খেতে রাত পার করে দিও না৷ তোমার চোখে আমি স্পষ্ট ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি আমার জন্য, সো সুযোগ পেয়ে লেগে যেও না আবার। পরে যা হবে তার দায়ভার তোমার। কেঁদে কেঁদে ভাঙা গলায় বলতে পারবে না,স্যার আপনি আমাকে ভালোবাসা ছাড়া এত নিষ্ঠুরভাবে কামড়ালেন কেন?’

শ্রেয়া ঝটপট শাড়ি ঠিক করে উল্টো ঘুরে শুইয়ে পড়ল। গলা শুকিয়ে এসেছে ওর। তূর্যর মুখোমুখি হওয়া মানেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। লজ্জায় দুই কপোলে তপ্ততা ছেয়ে গেছে। পরক্ষণেই ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে পড়ে হৃদয়স্থল এটা মনে পড়তেই তূর্যর সব তো ওকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য, জ্বালানোর জন্য বলা।
_______________

তজবি হাতে নিয়ে বসার ঘরে এলেন ফাতেমা চৌধুরী। রহিমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’ তাড়াতাড়ি চা দে। তূর্য আওনের আগে চা খাইয়া রুমে গিয়া অসুখের ভান ধইরা পইড়া থাকমু। এনে আইয়া চা না খাইলে শান্তি লাগে না৷ যা যা। ‘

রহিমা হেসে রান্নাঘরে চলে গেল। খানিক সময় বাদে ফিরে আসে হাতে চা নিয়ে। ঘড়িতে তখন সবে সাতটা। এখনও মেহরিমা,ত্রিহা কেউই রুম থেকে বেরোয় নি। চা দেখেই খুশিতে হাতে নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বলে উঠলেন,
‘ প্ররাণ ডা জুড়ায় গেছে রে রহিমা। ‘
‘ আমার জীবন নষ্ট কইরা আর কি কি জুড়াইছে তোমার?’

গম্ভীর কন্ঠ শুনে চা মুখ থেকে ছিটকে পড়ল ফাতেমার সাদা কাপড়ের উপর। বয়স্ক ত্বক কুঁচকে গেল নিমিষেই। ভয়ে সেঁটে গেলেন তিনি। হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন। দেখলেন,তূর্য বড় বড় পা ফেলে ওনার সামনের সোফায় বসেছে। পড়নে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট,কালো টি-শার্ট। মুখভঙ্গি কঠিন৷ রহিমাকে কফি দিতে বলে ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
‘ কাপড় টা নষ্ট করে ফেললে?এমন বাচ্চামু করো কেন ফাতু?এই বাচ্চামু করেই বুঝি বউ জুটিয়ে দিলে আমার কপালে?যাক উপকার হলো। তাকিয়ে দেখো তো,আমার স্কিন আজ অনেক গ্লো করছে তাই না?’
ফাতেমা চৌধুরী ভীত হয়ে মুখ কাচুমাচু করে বসে আছেন। তাঁর উত্তরের অপেক্ষা না করে আরেকটু নিচু কন্ঠে বললো তূর্য,’ সবই বউয়ের কামাল। ‘

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___২২

ঘুম ভেঙে শ্রেয়া নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড বিস্মিত হলো। কপালে ভাঁজ পড়ল এক দু’টো। অঢেল চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। প্রথমবার শাড়ি পড়ে ঘুমিয়ছে আশ্চর্যের কান্ড হলো গা থেকে একটুও সরে যায় নি। বাঁধাবিহীন শাড়ি ঘুমের ঘোরে উড়তেও পারত এত সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু হলো বিপরীত। দেহ থেকে সরলো না। শ্রেয়া চক্ষু মেলে দেখে শাড়ি একদম ঠিক আছে। পা থেকে উপরে উঠে নি,বুক থেকেও সরে নি৷ অথচ রাত্রের অনেকখানি প্রহর কেটেছে ওর শাড়ির ভাবনায়। ইতস্তত বোধ হওয়ায় তূর্যকে একটা বার বলতে পারে নি কাঁথার কথা। ভেবেছিল কাঁথা দিয়ে গা ঢাকা দিলে মান ইজ্জত বেঁচে যাবে। এখন দেখা গেল সব ঠিক আছে। তবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারে নি। কি করে সম্ভব! যেখানে থ্রি পিসই ঠিকঠাক থাকে না, শাড়ি?এ যেন অবিশ্বাস্য, বিস্ময়কর ব্যাপার স্যাপার। তবুও মান সম্মান বেঁচে গেছে তূর্যর সমুখে এতেই ঢের।

চুলগুলো হাত খোঁপা করে বিছানা ছাড়ে শ্রেয়া। মানুষ সাধারণত ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে ছুটে ব্রাশ করতে কিন্তু ও গেল বারান্দায়। উদ্দেশ্য নতুন প্রত্যুষে ঢুলুঢুলু আবছা দৃষ্টে চৌধুরী বাড়ির সৌন্দর্য দেখবে। ভিতরকার নয়,বাহিরের। বৃষ্টিতে ভিজে এখনো পিচ্ছিল হয়ে আছে বারান্দার মেঝে। শুকনো কাপড় দিয়ে মুছলে কিংবা রোদ্দুরের দেখা মিললেই শুকিয়ে যাবে। সূর্যকে কৃষ্ণ মেঘ আড়ালে রেখে ঘাপটি মেরে অম্বরে বসে আছে দিব্যি। এক প্রকার লড়াই চলছে তাদের মাঝে। হয়ত লড়াইয়ে মেঘ বৃষ্টি হয়ে নামবে নয়ত দিবাকর মেদিনীতে রশ্মি বিলিয়ে উজ্জ্বল করে তুলবে প্রকৃতি।

শ্রেয়া বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়েই দেখতে পেল নুরুল চৌধুরী দু’হাত পেছনে আড়াআড়িভাবে বেঁধে হাঁটাহাটি করছেন বিরতিহীন। ওনার পাশেই বাগানের একাংশ জুড়ে নানান ফুলের গাছ। ফুলের গাছগুলোর সমাপ্তি রেখা যেখানে টানা হয়েছে সেখানেই অবস্থিত একটা পেয়ারা গাছ। বেশ বড় বড় পেয়ারা ঝুলে আছে তাতে। থেকে থেকে তিনি বারংবার চক্ষু নিক্ষেপ করছেন গাছটায়।

পাতার চেয়ে পেয়ারার পরিমাণই বেশি লাগল শ্রেয়ার কাছে। অবিলম্বে খালি রুমে ফিরে আসল। শশুর যদি সাতসকালে পুত্রবধূকে এলোমেলো অবস্থায় দেখেন তাহলে তা খুবই নিন্দাজনক। বলতে পারে মেয়েটা অগোছালো, অভদ্র। ফলস্বরূপ তড়িঘড়ি করে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়ল। ভেবে ভেবে অবাক হচ্ছে তূর্য কখন উঠলো? ওকে কেন একটা বারও ডাকল না?গেল কোথায়? রাতের অনেকখানি সময় ও ব্যয় করেছে তূর্যর কথাগুলো চিন্তা করে। ভাবল,তূর্য সঠিক কিন্তু ওর ভীতি টাও ফেলনা নয়। মানুষ টা ওকে ভালো না বাসুক নিজের দিক থেকে ভাবনাগুলো খোলামেলা করবে। তিন বছর আগে হাল ছেড়ে দিয়ে যে ভুল করেছে সেটা পুনর্বার ঘটাবে না। তূর্য ভালোবাসে না তাই বলে ওর গলা তো চেপে ধরে নি, তাহলে কেন নিজের অন্তঃপুরের অনুভূতিদের সাথে বেই-মানি করবে?যা বলবে সোজাসাপ্টা।

কাঠ দ্বারা তৈরি কারুকার্য নির্মিত আলমারি খুলে একটা কালো রঙের মাঝে লাল পাড়ের শাড়ি হাতে তুলে নিল। গোসল সেড়ে এসে ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে বসে রইল বিবশ মুখে। কোনো কিছুই গোছাতে পারছে না ও। কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। এ মুহুর্তে প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য যে খুবই প্রয়োজন। হাউমাউ করে চিৎকার করে কাঁদতে পারলে কিছুটা শান্তি মিললেও হয়ত মিলতে পারে। কেন ওর জীবনে সবকিছু সহজভাবে হয় না। যা-ই পেতে চায় কঠিন সাধনার পরও পায় না৷ অভাগীদের জীবন এমনই বোধহয়!অক্ষিকোটর ছাপিয়ে জলধারা নেমেই এলো অবশেষে।

ফাতেমা চৌধুরী বসে বসে তজবি পড়ছেন চোখ বুঁজে। তূর্যর কথার জবাবে তখন বিমূঢ়তায় বাক হারা হয়ে পড়েন। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিরীহ মুখ করে পালিয়ে যেতে চায় কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলেন না। পেলেনও না। তবে ছেলে এসে বাঁচিয়ে দিলেন ওনাকে। নুরুল চৌধুরী তূর্যর পাশে বসে রহিমার কাছে চা চাইলেন। বাহির থেকে হেঁটে ফিরেছেন তিনি। নামাজ পড়তে বেরিয়েছিলেন,রাস্তায় হাঁটলেন তৎপরে বাগানে। হাঁটাহাঁটির অভ্যেস টা উনি যৌবন বয়স থেকেই রপ্ত করেছেন। তখন তিনি একা হাঁটতেন না,পাশে থাকতেন ওনার প্রিয় মানুষ। সকালে,সন্ধ্যায় হাঁটার নাম করে লুকিয়ে বাঁচিয়ে কতশত প্রেমময় কাব্য লিখেছেন তা সীমাবদ্ধ থেকে যায় দু’জনের মধ্যেই। সেই প্রিয় মানুষ টা একটা প্রাণ রেখে গেল দুনিয়ায় অথচ তিনি কথা দিয়েও আগলে রাখতে ব্যর্থ হলেন। এক বুক হতাশা মিশ্রিত নিঃশ্বাস নিঃশব্দে নাসারন্ধ্র গলিয়ে বাহিরে মুক্ত হয়। গম্ভীর স্বরে বলেন,
‘ তোমার বউ উঠেছে তূর্য?’
‘ কেন?বউ সমেত আমাকেও ঘর ছাড়তে হবে?’

সোফায় মাথা এলিয়ে বসেছিল তূর্য। বাবার কথায় সোজা হয়ে বসল। ছেলের ত্যাড়াবাকা কথায় নুরুল চৌধুরীর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ফাতেমাও তজবি পড়া বন্ধ করে কান পেতে রইলেন পরবর্তী কথা শোনার অপেক্ষায়। তিনি হারে হারে টের পাচ্ছেন দ্বন্দ্ব একটা আজ লাগবেই। বাপ,ছেলে দু’জনই ত্যাড়া প্রকৃতির, রগচটা স্বভাবের। মিলে গেল খাপে খাপ। আগে গ্রামে পাশের বাড়িতে ঝগড়াঝাটি হলে তিনি কোমর বেঁধে লেগে পড়তেন উপভোগ করার জন্য। তার মতে,সুন্দর দৃশ্য। কিন্তু বিয়ে বসে যখন ইট পাথরের নগরীতে পা রাখলেন আশেপাশের মানুষের ঝগড়া, চুলোচুলি দূর কান পেতে চাপা আওয়াজটাও শুনতে পান না। ওনার দ্বন্দ্ব কলহ দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা টা মাঝে একবার পূরণ হয় আরিয়ানার মাধ্যমে। আরিয়ানা বাড়িতে পা রাখতেই চৌধুরী বাড়ি গরম হয়ে উঠে,আর আগুনের তেজ কমে আসত তূর্য বাড়িতে পা রাখলেই। দিনগুলো ভারী মজার ছিল।

নুরুল চৌধুরী শক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,
‘ ত্যাড়ামো কবে ছাড়ছো?তোমাকে বিয়ে করতে অনুমতি দিয়েছি বলে লাফ দিয়ে আমার ঘাড়ে চেপে বসবে?লেকচারারের চাকরি ছেড়ে বিজনেসে জয়েন করো। একা হাতে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। আয়ুশও নিজের পেশা ছাড়তে রাজি না,আমরা দু ভাই বুড়ো বয়সে কত করবো?সে নাহয় আগে থেকেই এই পেশায় নিয়োজিত কিন্তু তুমি কেন বিজনেস ছেড়ে ছুঁড়ে এই পেশায় লেগে পড়লে?’

তূর্য নির্বিঘ্নে জবাব দেয়, ‘ কারণ টা আপনার অজানা নয়। আমি মানুষের কাছ থেকে অপবাদ কুড়াতে পারবো না। লোক মুখে শুনতে পারবো না বড় ভাইকে সবকিছু থেকে সরিয়ে নিজে একা বাবার টাকা ভোগ করছি। আসল কথা তো কেউ জানে না। সমাজের মানুষ একটা কারণ পেলে হাজারো কারণ বানাতে দ্বিধাবোধ করে না। একজন বলেছে,পরবর্তীতে শতজন বলবে। ‘

‘ যে বলেছে তার সাথেই তো ভালোই যোগাযোগ রাখছো। ‘

নুরুল চৌধুরীর কথা শুনে তূর্য অধর কার্নিশ বাঁকিয়ে বলে,’ ভাই তো। ভাই ফেলে দেওয়া যায় না। আমাকে হাজার টা কঠিন কথা বললেও মাথায় থাকবে মানুষ টা আমার ভাই। সে দূরে গিয়েছে বলে আমিও দূরে সরে আসব নাকি?’

‘ তাহলে তার কথা ধরে রেখে আমার বিজনেস সামলাচ্ছ না কেন?’

‘ আপনার সবকিছুতে প্রথম অধিকার আপনার বড় ছেলের। ভাই আসুক,নিজের ভাগ বুঝুক অবশিষ্ট থাকলে বাকিটা আমি বুঝে নিব। আর চাচার ভাগের টা সম্পূর্ণ আয়ুশ ও আয়ুশীর। তাছাড়া আমি আপনার কম টাকা নেই নি। এখনও আপনার দেয়া টাকা আছে আমার একাউন্টে। বাড়ির বড় ছেলে অন্যের অধীনে চাকরি করছে, আমি কেন বাবার টাকায় চলব আর?’

‘ ঠিক আছে। যে ছেলে বাবা মা’য়ের উপর মিথ্যা আরোপ লাগিয়ে চলে যায় তার ব্যাপারে আর কিছু শুনতে চাইছি না। তোমার বউকে ডাকো,কথা আছে। তোমার মা সব বলেছে আমাকে তিন বছর আগে মেয়েটা এ বাড়িতে পুত্রবধূ হয়ে এসেছিল। আমি ওই মেয়েটার কোনো দোষ পেলাম না৷ পেলাম তোমার মা’র, আমার মা’র। ‘

ছেলের কথা শুনে বিষম খেলেন ফাতেমা। রহিমা রান্নাঘর থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এসে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,’ আমি জানতাম আম্মা আপনের পানি লাগব। লন,খাইয়া লন। ‘

নুরুল চৌধুরী দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বয়স্ক মা’কে সন্তান হয়ে বকাঝকা কিংবা রাগ দেখানোর সাধ্য নেই তার। এতিম মেয়েকে বাড়ির বউ করেছে নিঃসন্দেহে উত্তম কাজটাই করেছেন, তাই বলে মেয়েটাকে ঠকানো!এটা মানতে পারলেন না তিনি। একদিক হতে তূর্যর প্রতি গর্ববোধ করছেন মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনার জন্য,সমাজের চোখে বউরূপে স্বীকৃতি দিয়ে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছে বিধায়। আজকাল কেউ কাউকে তার প্রাপ্য সম্মান টুকুই দিতে নারাজ।

মেহরিমা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলেন। শ্রেয়াকে তিনি কখনও ক্ষমা করতে পারবেন না। ভয় হয় সেও যদি আরিয়ানার মতোন আধো ভাঙ্গা পরিবারটাকে সম্পূর্ণ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়!
________________

শ্রেয়া জানালার ধারে দাঁড়ানো। বিমর্ষ মনে, স্থির নেত্রে বাহিরে তাকিয়ে। নিচে গিয়ে সবার সাথে কথা জমাতে ইচ্ছে করছে। যদিও সে অল্পস্বল্প কথা বলে। এত বড় একটা পরিবার কিন্তু ওর সাথে কথা বলার কেউ নেই। বিয়ের পরের সকালে নাকি পরিবারের সদস্যরা নতুন বউকে ডাকতে আসে, কই কেউ এলো না। হিসেব-নিকেশে সে পুরাতন বধূ তবুও রহিমা খালার ডাক অনুয়ায়ী সে এখনও নতুন বধূ রয়ে গেল। অকস্মাৎ চুলে প্যাঁচানো তোয়ালে টান পড়তেই হকচকিয়ে গেল। ধুকপুক করতে লাগে বুক। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই নিষ্প্রাণ আঁখি যুগলে বিঁধে তূর্য ওর অতীব কাছাকাছি। সুঠাম হাতে তোয়ালে ধরে অতি নিখুঁতভাবে চুল মুছে দিচ্ছে। সযত্নে ঝেড়ে দিচ্ছে চুলের পানি।

শ্রেয়া মোহগ্রস্ত নয়নে তাকিয়ে রইল। কিন্তু বহুক্ষণব্যাপী স্থায়ী হলো না তা। সময়ের পরিমাণ টা ছিল অত্যধিক কম,হয়ত কয়েক সেকেন্ড। তূর্যর কন্ঠে গম্ভীরতা,’ এভাবে তাকালে ঘাড় সারাজীবনের জন্য বাঁকা হয়ে যাবে। মুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই, স্বামীর দায়িত্ব পালন করছি। ভালোবাসা খুঁজতে যেও না। ‘

তির্যক,তীক্ষ্ণতেজী কন্ঠে শ্রেয়ার মুগ্ধ দৃষ্টি উবে গিয়ে চক্ষু কোটরে একরাশ বিষাদ জড়ো হলো। শূণ্য হলো মর্মদেশ। সকল যত্ন কেবল স্বামীর দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে!অবিলম্বে অন্তরাত্মার চিৎকারে বক্ষস্থল চিনচিন করে উঠে। অনুভূত হয় তূর্য সরে গেছে। কিন্তু যাওয়ার পূর্বে আঁচল দ্বারা ঢেকে দিয়েছে ওর উন্মুক্ত কেশ। ঘুরে দেখল বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। ইতমধ্যে শুয়ে পড়ল?আবার চোখের পাতায় হাত রাখা। এত কম সময়ে ঘুমায় না কেউ, তা শ্রেয়ার অজানা নয়। একপাশে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল তূর্যকে ঠিক কিভাবে কথাগুলো বললে বুঝবে। ডাকলো ভয়ে ভয়ে,
‘ স্যার। ‘
‘ এখানে স্যার নেই। আমি আছি, আমার বউ আছে। বাচ্চা কাচ্চা নেই তবে সময়ে হলে ডাউনলোড হবে,রুমও দখল করবে। ‘

তূর্যর নির্লিপ্ত অভিব্যক্তিতে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল শ্রেয়া। বুঝল অনেক মেপে মেপে কথা বলতে হবে এই লোকের সাথে। নাহলে কোনদিক থেকে লজ্জার পুকুরে ধাক্কা মেরে ডুবিয়ে দিবে তা অভাবনীয়, কল্পনা হীন। রয়েসয়ে রিনঝিনে কন্ঠে বলতে চাইল,
‘ আমি আপনার সাথে কিছু কথা স্পষ্টভাবে বলতে চাই। সুযোগ দিলে বলব। ‘
তূর্য হাত সরিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। কপালে কতশত ভাঁজ। হয়ত বুঝার চেষ্টা করছে নয়ত চিন্তা করছে সুযোগ দিবে কিনা!সুন্দর গড়নের মুখের আদল দেখে ঠাহর করে নিল শ্রেয়া। প্রতীক্ষিত হয়ে তাকিয়ে থাকল জবাবে হ্যাঁ শব্দ শোনার। শুনল তবে তূর্য সাথে আরো কয়েকটা বর্ণ, শব্দ সংযুক্ত করলো,’ এখন নই,দুপুরে নিরিবিলিতে শুনবো। ‘

শ্রেয়ার বলতে ইচ্ছে করলো রুমে কি নিরবতার অভাব, অনটন?এত রুক্ষ কেন আপনি স্যার?ভালোবাসি বুঝে ফেলেছেন বলেই রুষ্ট ব্যবহার করছেন?

দরজার ঠকঠক আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো ও। দরজা তো ভেজানো ছিল, তূর্য ঢুকে লাগিয়ে দিয়েছে কি?মন্থরগতিতে পৌঁছে খুলতেই দেখে প্রিয়ু লাল একটা শাড়ি পড়ে ঘোমটা দিয়ে একগাল হাসি নিয়ে উপস্থিত, সঙ্গে আয়ুশী। দু’জনেই ওকে ঠেলে রুমে উঁকি দিয়ে তূর্যকে শোয়া অবস্থায় দেখে যেই প্রশ্ন টা করলো তাতে লজ্জায় কেঁপে উঠলো শ্রেয়া। চাপা স্বরে বললো,’ কি ধরনের প্রশ্ন প্রিয়ু?শুনবেন উনি। ভাসুর আর জা কে নিয়ে এমন কথা বলছিস নির্লজ্জ মেয়ে। ‘

প্রিয়ুর নরম ওষ্ঠ জুড়ে হাসি খেলে গেল। শ্রেয়াকে টেনে রুমের বাহিরে আনতেই শুনতে পায়,’ আমার বউকে প্রশ্ন করে মে’রো না আবার। বেচারি অনেক লাজুক ও ভীতু টাইপের। ‘

লজ্জায় মাথা কেটে যাওয়ার উপক্রম শ্রেয়ার। প্রিয়ু ও আয়ুশী তূর্যর কন্ঠ শুনে দমে গেলেও, পরমুহূর্তেই শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে হাসি চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। বিফলে গেল না প্রয়াস।
দরজা বাহির থেকে টেনে ভিড়িয়ে দেয় শ্রেয়া। প্রিয়ু ফিসফিস করে বলে,
‘ আমি তো ঠিকি বলেছি,রুম থেকে বের হোস নি না?মনে হয় না স্যার তোকে বের হতে দিয়েছে। দেখলি না এখন কেমন করে বলল?ইশ!কি ভালোবাসা!আর আমি তোর বান্ধবী ছিলাম,থাকব। সো আমার একটা হক আছে। চল আয়ুশীর রুমে চল গোপন কথাগুলো সেড়ে নেই।’
শ্রেয়ার সাদামাটা বাক্য,’ যাবো না। ‘

‘ চুপ থাক। ‘ –বলে টেনেটুনে আয়ুশীর রুমে নিয়ে আসল প্রিয়ু। তূর্যর রুমের সাথেই ওর রুম টা। আয়ুশী কে বললো,তুমি একটু আমার জন্য পানি নিয়ে আসবে?অধর জোড়া প্রশস্ত করে আয়ুশী চলে গেল। শত হোক প্রিয়ু ননদের সামনে তার ভাইদের কথা বলতে পারবে না। কেমন যেন লাগে। আয়ুশী প্রস্থান ঘটাতেই তার কন্ঠে প্রবল উৎকন্ঠা,
‘ স্যার তোকে খুব ভালোবাসে তাই না শ্রেয়া?রাতে অতীত নিয়ে কিছু বলেছে?তুই খুশি তো এখন?’

শ্রেয়া মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মস্তিষ্কের সাড়া মেনে নিল। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। হাসল স্মিত। সাথে সাথেই প্রিয়ু ওর শাড়ির আঁচল কিছুটা টেনে গলার নিচের অংশ হতে সরিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে বলে,’ এটাই আমাকে উঁকি দিয়ে জানান দিচ্ছিল স্যার তোকে আপন করে নিয়েছে। ‘

প্রিয়ুর চাহনি অনুসরণ করে নিজের গলার নিচে বুকের ঠিক উপরের অংশে চোখ রাখল। ভালোভাবে দেখতে না পেরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিমেষে রক্ত হিম হয়ে গেল ওর। বুকে বজ্রপাত পড়লো যেন। কামড়ের গাঢ় চিহ্ন!

#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here