শ্রেয়সী পর্ব ৪৪

0
453

শ্রেয়সী
লেখাঃখাইরুন নেছা রিপা
পর্বঃ৪৪

শিহাব অপলক তাকিয়ে আছে ফোনের স্ক্রিনের দিকে। বিন্দুর আর ওর মেয়ের ছবিটার দিকে। বিন্দুর আইডি ঘুরে ঘুরে বিন্দুর আর কণার পিকগুলো দেখছে শিহাব। কতগুলো পিক বিন্দু আপলোড দিয়েছে তাও প্রায় ছ’মাস আগে। আর প্রতিটা ছবির ক্যাপশন লেখা মা ও মেয়ে! কী সুন্দর লাগছে মা মেয়েকে। শিহাব গাঢ়ভাবে দু’জনের ছবিতে অনেকগুলো চুমু খেল। কখন যে তার প্রিয় দু’টো মানুষকে চোখের সামনে দেখবে একটু ভালোবেসে ছুঁয়ে দেবে সেই চিন্তাতেই মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে। ভাগ্যিস বিন্দু পিকগুলো আপলোড দিয়েছিলো নয়তো তো জানাই হতো না ওর আর বিন্দুর এত সুন্দর একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। এই পিকগুলো দেখার পর থেকেই যেন শিহাবের অস্থিরতা আরও দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। তাই তো একরকম অসুস্থতা নিয়েই বিদেশ ছেড়ে দেশে ফিরে আসা। কিন্তু কে জানতে দেশে এসেই শুনতে হবে বিন্দুর অন্য কারও সাথে বিয়ে হয়ে গেছে। শিহাবের ধারণা ছিলো বিন্দুর এখনো বিয়ে হয়নি। কিন্তু সব ধারণা যে এভাবে মিথ্যে হয়ে যাবে কে জানতো! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো নাক-মুখ দিয়ে।

ঘড়িতে একটা বাজে। কিন্তু শিশিরের চোখের পাতায় ঘুমের চিহ্নটুকুও নেই। যত ভাবনা সব বিন্দুকে ঘিরে। বিন্দুর এই অদ্ভুত ব্যবহার আরও বেশি ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে শিশিরের মনে।
বেশ শব্দ করেই শিশিরের ফোনটা বেজে ওঠলো। ফোনের রিংটোনে ভাবনায় ছেঁদ পড়লো শিশিরের। বিন্দুকে আস্তে করে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ফোনের স্ক্রিনে ওইদিন শিহাব যে নাম্বারটা থেকে কল করেছে সেই নাম্বারটা দেখেই বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলো শিশিরের। ফোনটা রিসিভ করবে না করবে ভেবেও রিসিভ করে ফেললো। তখনই ওপাশ থেকে শিহাবের গম্ভীর স্বরে বললো,
–কি রে ঘুমোসনি এখনো?”
–নাহ্। কী বলবি বল?”
–মনে আছে তো কালকের কথা?”
–হুঁ।”
–খুব তো বোকা বানাতে চেয়েছিলি আমাকে।”
–মানে?”
–অভিনয় করিস না তো। অসহ্য লাগে তোকে আমার। বন্ধু হয়ে কিভাবে পিঠে ছুরি বসাতে হয় তোকে না দেখলে জানাই হতো না।”
শিশির মিহি গলায় বললো,
–তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমি তোর কোনো ক্ষতি করিনি শিহাব। যা হয়েছে এটা হয়তো বিধাতার চাওয়া ছিলো।”
শিহাব বেশ গর্জন করে বললো,
–একদম বিধাতা বিধাতা করবি না। আল্লাহ এমন কিছু চায় নাই। তুই জোর করে এসব করছোস আর এখন আল্লাহর দোহাই দেস। তুই তো হইলি একটা মিথ্যুক। সেদিন তো বেশ কায়দা করে আমার মেয়ের কথাটা চেপে গেছিলি। ভাগ্যিস আমি বিন্দুর আইডিতে আমার মেয়ের পিক দেখেছিলাম।
আবার নিজের মেয়ে বলেও দাবী করিস। লজ্জা করে না তোর? ওইদিন লঞ্চে আমি ওদের কথা জিজ্ঞেস করলাম তখনও কিছু বললি না চুপচাপ সব কিছু এড়িয়ে গেলি। এসব কেন করেছিস সেটা তো তখন বুঝতে পারিনি। তোর পেটে যে এত বদ সেটা তো আদৌ আমার জানার কথা না। ভাগ্যিস তোদের বাসায় যাওয়ার আগেই আমি বিন্দুদের বাসার কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সাহস করে বিন্দুদের বাসায় ঢুকতে পারিনি। আর কী পরিচয়ে ঢুকবো সে নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। ওদের বাড়ির পাশে ওই রহমত না কী যেন নাম ওনার চায়ের দোকানে বসলাম। চা খেতে খেতে হুট করে বিন্দুর কথা জিজ্ঞেস করতেই বললো,
“ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে বছর দেড়েক আগে। একটা মেয়েও হইছে৷ জামাই মাশআল্লাহ বেশ ভালোই পাইছে সাজেদ আলী। মনের মতো জামাই। আইজকাইল সবার ভাগ্যে এমন জামাই জোটে না।”

তখন কথাটা শুনেই আমি যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য পাথর হয়ে গেছিলাম। আমি ভেবেছি তখনও বিন্দুর বিয়ে হয়নি। কত আশা নিয়ে আসলাম আমি। আর শেষে এমন কিছু শুনতে হয়ে এসব আমার কল্পনাতেও ছিলো। একটা মুহূর্তের জন্যও ভাবিনি বিন্দুর বিয়ে হয়ে যেতে পারে। আর যখন ওনার কাছে জানতে পারলাম বিন্দুর জামাইয়ের নাম শিশির। তখনই আমার রাগটা মাথায় চড়ে গেল। তোকে ওইদিন লঞ্চে থেকেই ফোন করলাম তবুও তুই কিছু বললি না৷ তোদের বাসায় আজ সকালে চা খেয়েছি শুধুমাত্র তোর মায়ের দিকে তাকিয়ে নয়তো তার চায়ে আমি ইয়ে করি। থু…। আর তুই কী সুন্দর ইনিয়ে-বিনিয়ে আমাকে ভুল বুঝাতে চাইলি। পরে যখন দেখলি আমি নাছোড়বান্দা তখন সবটা স্বীকার করলি। তবুও মেয়ের কথাটা বললি না।”
–শিহাব আমি তোকে সবই বলতাম। কিন্তু তুই আমাকে কথা বলার মতো সুযোগই দেস নাই। তোর এই পরিস্থিতিতে কথাগুলো বললে তুই সহ্য করতে পারবি না ভেবেই আমি অমন আমতা আমতা করেছিলাম। বিশ্বাস কর এছাড়া আর কিছু না। ”
–তোকে বিশ্বাস! এত কিছুর পরেও? হাউ ফানি! যাই হোক তোর সাথে আমার কথা বলতেও রুচিতে বাঁধছে। কালকে আমার মেয়ে আর বিন্দুকে নিয়ে আসবি। আমি আমার চেকটাও নিয়ে আসবো। এমাউন্টা বসিয়ে নিস কেমন? যত পারিস বসিয়ে নিস আমার কোনো আপত্তি নেই! ”
–একটা কথা ছিলো।”
–বল?”
–তুই এটা কী করে ভাবিস শিহাব একটা মেয়ের বিয়ে ছাড়া প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কী করে থাকে? সমাজ কী ছেড়ে কথা বলে কাউকে? তোর তো এটা ভাবাই উচিত ছিলো বিন্দুর বিয়ে হয়ে গেছে। একটা মেয়ের বিয়ের আগে প্রেগন্যান্ট হওয়া যে তার জন্য কত বড় লাঞ্ছনার এটা কী তোর অজানা? এটা বিদেশ নয় শিহাব, এটা বাংলাদেশ। এখানে সমাজ কারও বিপদে এগিয়ে না আসলে কী হবে এগিয়ে এসে কাউকে ঠিক অপমান করতে এদের একটুও বাঁধে না। আর এ সকল প্রতিকূলতা থেকে বিন্দুকে রক্ষা করতেই বিয়েটা করা। আর আমি তো তখন জানতাম তুই মরে গেছিস।”
–যাই হোক এখন এসব বলে লাভ নেই। তোর আমাকে যখন প্রথম ফোন করেছি তখনই সব বলে দেওয়া উচিত ছিলো। আর আমি তো এখন বেঁচে আছি তাহলে আমার মেয়ে কেন তোর আশ্রয়ে বড় হবে? তার তো নিজের বাবা চলে এসেছে। তাহলে কেন সে তার বাবার পরিচয়ে বড় হবে না? কেন বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হবে? যাই হোক এখন এসব চিন্তা বাদ দে। তোকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। কাল ওদের সকাল সকাল নিয়ে আসবি। আমি দক্ষিণের ওই পার্কটায় অপেক্ষা করবো।”

কথা শেষ করেই শিহাব ফোন রেখে দিলো। শিশির মুখে হাত চেপে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। এতটা অসহায় কেন লাগছে! সত্যিই কী বিন্দু ওকে ছেড়ে চলে যাবে? হাতের ফাঁক দিয়েও যেন কান্নার শব্দ বাহিরে বেড়িয়ে আসছে। বিন্দু দরজায় দাঁড়িয়ে স্বামী নামক মানুষটার অস্থিরতা দেখছে। মানুষটা কেমন ছটফট করছে। বিন্দুও কেঁদে ফেললো নিঃশব্দে। পুরো রাত নির্ঘুম কেটেছে শিশিরের। তবে বিন্দুও যে পুরো রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি সেটা শিশির বুঝতেই পারলো না।

সকাল সকালই বিন্দু নাস্তা রেডি করলো। কিন্তু শিশির কিছুই খেতে পারছে না। খাবার টেবিলে বসে শুধু নাড়াচাড়া করছে। বিন্দু ধমক দিয়ে বললো,
–সমস্যা কী আপনার? খাবার সামনে নিয়ে এমন নাড়াচাড়া করতে নেই। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন।”
কথাটা বলেই বিন্দু চুপচাপ খাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি। কত সহজ করে কথাও বলছে। শিরিনা বেগম শিশিরের ভাবভঙ্গি দেখে বললেন,
–শিশির কী হয়েছে রে তোর?”
শিশির ফ্যাকাসে গলায় বললো,
–কিছু না মা।”
–তাহলে তোকে এমন কেন লাগছে। কাল থেকেই তোকে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে।”
এর মধ্যেই বিন্দু বলে উঠলো,
–মা আমি একটু আপনার ছেলের সাথে বেড়ুবো।”
শিশির অবাক হয়ে বিন্দুর দিকে তাকিয়ে রইলো। কারণ শিশির এখনো এমন কিছুই বলেনি বিন্দুকে।
–শিশির তোর স্কুল নেই আজ?”
–মা আমি একটু ছুটি নিয়েছি দুইদিন।”
–হঠাৎ ছুটি?”
–শরীরটা ভালো লাগছে না মা!”
–আবার জ্বর-টর আসলোনি?”
কথা শেষ করেই শিরিনা বেগম নিজের চেয়ার ছেড়ে এসে শিশিরের কপালে হাত রাখলেন।
–কই জ্বর তো নেই তাহলে কী হয়েছে?”
–মা এমনিতেই স্বাস্থ্যটা ভালো লাগছে না। তাই ছুটি নিয়েছি।”
–তা যাবি কোথায়?”
–যাব….!”
শিশিরকে তোতলাতে দেখে বিন্দুই ফট করে বলে উঠলো,
–মা অনেকদিন তো কলেজে যাইনি। তাই এক বান্ধবীর বাসায় যাব। সামনেই তো টেস্ট পরীক্ষা নোটস আনতে হবে।”
–ওহ্। তাড়াতাড়ি চলে আসিস কেমন?”
–হুঁ। রিদি ভাবছি কণাকে নেব না। গরমে ওর কষ্ট হবে তুমি একটু রাখতে পারবে ওকে?”
–হ্যাঁ ভাবি পারবো।”

বিন্দু খাওয়া শেষ করেই এসে তৈরি তে শুরু করলো। শিশির রুমে এসেই বললো,
–কোথায় যাবে তুমি?”
–ভুলে গেলেন নাকি? শিহাবের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। ”
–কিন্তু আমি তো তোমাকে কিছুই বলিনি এখনো।”
–এত কথা না বাড়িয়ে তৈরি হয়ে নেন তো।”
–হুঁ।”

বিন্দু আজ খুব সুন্দর করে সাজলো। পরনে একটা সবুজ শাড়ি হাত ভর্তি চুড়ি, কপালে কালো টিপ, চোখের নিচে গাঢ় কাজলের রেখা, কানে ঝুমকো আর গলায় একটা ছোট্ট লকেটের চেইন। বিন্দু আয়নায় ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখেছে। শিশির এবারে পুরোই সিউর বিন্দু আজ নির্ঘাত চলেই যাবে। কান্না পাচ্ছে খুব তাই ব্যালকনিতে চলে গেল। বিন্দু সেখানে গিয়ে শিশিরের সামনে দাঁড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো।
–দেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে?”
শিশির এক পলক তাকিয়ে বললো,
–অনেক সুন্দর। ”
বলেই আবার অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। বিন্দু শিশিরের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
–মাশআল্লাহ বলুন।”
শিশির ম্লান হেসে বললো,
–মাশআল্লাহ আমার বউটাকে খুব সুন্দর লাগছে!”
বিন্দুর ঠোঁটে স্ফীত হাসি।
–উফ চুমু খান তো তাড়াতাড়ি। এত সেজেছি কই বউকে একটু আদর-টাদর করবেন তা না মুখ ঘুরিয়ে প্যাঁচার মতো করে রেখেছেন। নেন নেন কপালে একটা চুমু খান তো।”
এবারে শিশিরের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। শিশির অন্যদিকে ফিরে চোখের জল আড়াল করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। বিন্দুর খুব কান্না পাচ্ছে তবুও ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখে বললো,
–ওই দেখো মেয়েদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদে। এখন নো কান্নাকাটি। তাড়াতাড়ি চুমু খান তো।”
কথাটা শেষ করেই মাথাটা নুইয়ে রইলো।
শিশির গভীরভাবে চুমু আঁকলো বিন্দুর কপালে। তারপর বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো। বিন্দু ধরা ধরা গলায় বললো,
–এই বলুন না আমাকে সুখী সুখী মনে হচ্ছে না আপনার?”
এই কথার অর্থ শিশির বুঝতে পারলো না। চুপচাপ বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখলো তার প্রাণ ভোমরাকে! বিন্দু শিশিরের বুকের মাঝে সেটিয়ে আছে৷ এখানেই যে তার জীবনের বড় সুখ! এই সুখ ছেড়ে সে যাবে কোথায়! তাহলে যে তার মরণ হবে!

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here