শ্রেয়সী
লেখাঃখাইরুন নেছা রিপা
পর্বঃ৪১
টিকটিক করে ঘড়িটা চলছে তার আপন গতিতে৷ চাদিকে শুনশান নিরবতা। তবে এর মাঝে ফ্যানের শো শো শব্দও শোনা যাচ্ছে। বিছানায় মেয়েকে জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বিন্দু। কণাও পরম শান্তিতে চোখের পাতা বুজে আছে৷ শিশির গভীর মনযোগ দিয়ে ল্যাপটপে মাসিক পরীক্ষার প্রশ্নগুলো তুলছে। হাতে একদম সময় কম। তার ওপর কাজ করার একমাত্র সময় হলো রাতটুকু। এছাড়া তেমন কোনো সময় পায় না। মাঝে মাঝে নিজেকে রোবট মনে হয় শিশিরের। একরকম যান্ত্রিক পরিবহনের মতো সকাল টু রাত সারাক্ষণ শুধু পরিশ্রম আর পরিশ্রম করেই যেতে হয় রাতেও একটু আরাম করে চোখের পাতা বুঝবে তারও জো নেই। তবুও শিশির খুশি! প্রচন্ড খুশি। শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রিয় মুখগুলোর দিকে তাকালেই সমস্ত বিষাদ ধুয়ে-মুছে যেন শেষ হয়ে যায়। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। শিশির ল্যাপটপের স্কিণের দিকে তাকিয়েই ফোনটা রিসিভ করলো।
–আসসালামু আলাইকুম।”
সঙ্গে সঙ্গেই ফোনের ওপাশ থেকে একটা উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর কানে এসে বাজলো।
–শিশির আমি আমি৷ চিনতে পেরেছিস আমাকে?”
কয়েক সেকেন্ডের মতো কণ্ঠস্বর শুনেই হতবম্ভ হয়ে গেল শিশির। কণ্ঠস্বরটা যে বড্ড পরিচিত কারো! খানিকটা সময় নিয়ে নিজের মনকে প্রবোধ দিলো এটা কিছুতেই হওয়ার সম্ভব নয়। নিজেকে কোনোরকম শান্ত করেই শিশির জিজ্ঞেস করলো,
–আপনি কে?আসলে আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারিনি।”
–আমি শিহাব! এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলি?”
শিহাব কথাটা শুনেই মাথা ঘুরতে লাগলো শিশিরের। হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসছে। গলা কাঁপছে,মাথার ভেতর ভনভন করছে, বুকের ভেতর কম্পন বেড়ে গেছে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিলো শিশির। বাঁ-হাতে কপাল থেকে ঘাম মুছে নিলো।
–শিহাব কেমন আছিস তুই? আর এতদিন কেন যোগাযোগ করিসনি? আর কেনই বা তোর কাজিন বলেছিলো তুই মারা গেছিস? এত ধোঁয়াশার মধ্যে কেন রেখেছিলি আমাদের? আর আমি তো তোদের বাসায়ও গিয়েছিলাম। আন্টিও তো কিছুই বললো না আমাকে। এভাবে সত্যটা আড়াল করার মানে কী?”
–সব বলবো, সব! মা নিজেও সত্যটা জানতো না। মাও সত্যটা জেনেছে অনেক পরে।”
–এসবের মানে কী শিহাব? সবার কাছে নিজেকে মৃত প্রমাণ করে তুই আসলে কী বোঝাতে চেয়েছিস?”
–বিশ্বাস কর এসব মিথ্যা কথা আমি কাউকে বলতে বলিনি। সব বাবা বলেছে।”
–তাহলে তুই ভালো থেকেও কেন এতদিন যোগাযোগ করিসনি?”
শিহাব একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো যার শব্দ স্পষ্ট শিশির শুনতে পলো।
–আমি ভালো ছিলাম না শিশির। ভেবেছি মরেই যাব। আমি এক্সিডেন্ট করে অনেকগুলো মাস কোমাতে ছিলাম। এরপর যখণ ভালো হয় তখনও খুব একটা স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলাম না আমি। জানিস তুই আমার একটা পা চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেছে।”
–কী বলছিস তুই এসব? এত কিছু হয়ে গেল অথচ আংকেল সব সত্যটা আড়াল করে নিলো!”
–হ্যাঁ রে সত্যি বলছি। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। হয়তো বিন্দুর সাথে মিথ্যা বলেছি তাই আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিছে। এখন বল আমার বিন্দু কেমন আছে? আর আমার মেয়েটা? ওরা ভালো আছে তো?”
শিশির স্পষ্ট বুঝতে পারলো খুশিতে শিহাবের গলা কাঁপছে। শিশিরের বুকের ভেতর ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গেল। গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসলে। কম্পিত গলায় বললো,
–ভালো আছে ওরা। তুই এখন কই?”
–আমি এখন ঢাকার লঞ্চে। সুস্থ হওয়ার পরই আমি অনেক যোগাযোগ করতে চেয়েছি তোর সাথে বিন্দুর সাথে কিন্তু কারও সাথেই যোগাযোগ করতে পারিনি। আগের সিমটাও নেই। মাত্র মনে পড়লো তোর আইডিতে তো তোর নাম্বার দেওয়া আছে সেখান থেকেই নিলাম। তোকে আর বিন্দুকে ম্যাসেঞ্জারেও নক করেছি কিন্তু তোরা তো ফেসবুকেই আসিস না।তাছাড়া তোদের দু’জনের ফোন নাম্বারটা মুখস্থই ছিলো সেটাও ভুলে গেছি। আমি আসছি আমার বিন্দুর কাছে। নিশ্চয়ই ওকে সবাই অনেক কথা শুনিয়েছে। অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে ওকে। আমি ওর সব কষ্ট ভুলিয়ে দেব। আর ওকে আর আমার মেয়েকে কষ্ট পেতে দেব না। আচ্ছা ও এখন কোথায়?”
শিশির কী বলবে বুঝতে পারছে না। চোখ দু’টো বারবার ভিজে উঠছে। এ কোন পরিস্থিতিতে আল্লাহ এসে দাঁড় করালো ওকে৷ কী করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অসহ্য লাগছে খুব। কী করে বিন্দুকে ছাড়া থাকবে ও? এটা যে অসম্ভব। আগেও হলেও সম্ভব ছিলো। কিন্তু এখন কী করবে৷ অন্যদিকে শিহাবের সব কিছু শুনে ওর জন্যও খুব কষ্ট লাগছে। ওরই বা কী দোষ।সবই তো নিয়তির খেলা! শিশির কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছে না৷ বাধ্য হয়ে ফোনটা কেটে দিলো। ফোনটা বন্ধ করেই ফ্লোরে ছুড়ে মারলো। ছিঁটকে পড়ে ফোনের ব্যাক কভার খুলে এদিক সেদিক পড়ে রইলো। ব্যালকনিতে গিয়ে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো শিশির। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না। মনটাকে কিভাবে শক্ত করবে তাও ওর জানা নেই। বুকটা যেন এখনই খুব খালিখালি লাগছে। বিন্দু ওর জীবনে থাকবে না ভাবলেই কেমন যেন পাগল পাগল লাগে। খুব অসহ্য লাগে। দুনিয়ার সব কিছু যেন অর্থহীন লাগে। আবার অন্য দিকে শিহাব! তারই বা কী দোষ! সব ভেবে ভেবে কোন কিছুরই সমাধান করতে পারছে না। পাগলের মতো কেঁদেই চলেছে। আর বিন্দুও যদি জানে শিহাব বেঁচে ফিরেছে আর যদি ওর সাথে চলে যেতে চায় তাহলে তো কণাকেও নিয়ে যাবে। তখন কী হবে? কী নিয়ে থাকবে শিশির? নির্ঘাত মরে যাবে ও। কিছুতেই বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না।
আজকের মতো এমন কখনও কাঁদেনি শিশির। আজ নিজেকে সত্যিই খুব অসহায় লাগছে। কোনোরকম ব্যালকনি ছেড়ে এসে বিন্দুর পাশে শুয়ে পড়লো। হাত বাড়িয়ে বিন্দুকে কাছে টেনে নিয়ে আসলো৷ বিন্দুকে বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখলে যদি বুকের জ্বালাটা একটু কমে৷ বিন্দুও এসে শিশিরের বুকে মুখ গুঁজলো। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো,
–এতক্ষণে আপনার ঘুমাতে আসার সময় হলো? এত রাত জেগে কাজ করতে হবে না। পরে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আর আমাকেই জ্বালাবেন। একদিকে বাবা আর একদিকে মেয়ে। এতজনের সেবা করতে পারবো না আমি।”
কথাটা শেষ করেই শিশিরের বুকে ছোট্ট করে চুমু খেলো বিন্দু। শিশির শক্ত করে বিন্দুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কিন্তু চোখের পানি কিছুতেই বাঁধ মানছে না। কী করে শিশির ওর এই প্রাণ ভোমরাকে ছাড়া বেঁচে থাকবে? যাকে ছাড়া একটা মুহূর্তও কল্পনা করতে দম বন্ধ হয়ে আসে সেখানে বাকিটা জীবন কীভাবে একা একা পার করবে? অসম্ভব এটা! কিছুতেই পারবে না ও! পাগলের মতো বিন্দুকে আদর করতে লাগলো শিশির। মনটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। বারবার খালি মনে হচ্ছে এই একটা রাতই শুধু বিন্দু শিশিরের। তারপর অন্য কারো হয়ে যাবে। বিন্দু চলে যেতে চাইলে যে কিছুতেই শিশির আটকে রাখতে পারবে না। মরে যাবে তবুও বিন্দুকে আটকাবে না! বিন্দু ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো,
–কী হচ্ছে এসব শিশির বাবু?”
শিশির সে কথার উত্তর না দিয়ে উদভ্রান্তের মতো বললো,
–বিন্দু তুমি কী আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যাবে?”
বিন্দু ঘুমের চোখেই শিশিরকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো। কোমল স্বরে বললো,
–উঁহু কখ্খনো না। যতদিন এই দেহে প্রাণ থাকবে ততদিন আমি শুধু শিশিরের আর কারও না।”
বিন্দুর উত্তরে শিশিরের ভেতরের ঝড়টা একটু শান্ত হলো। তবুও রেশটা রয়েই গেল। বিন্দু তো বুঝতেই পারলো না শিশিরের ওপর দিয়ে ঠিক কী ভয়াবহ ঝড়টাই না বয়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই কণা কেঁদে উঠলো৷ বিন্দু শিশিরকে ছেড়ে কণাকে ফিডিং করাতে লাগলো৷ আর পেছন থেকে শিশির বিন্দুকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। কী সুন্দর একটা জীবন! খুব কী প্রয়োজন ছিলো এই নতুন ঝড়ের? ভাবতেই একটা গাঢ় নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো। বিন্দু এত জোরে শিশিরকে নিঃশ্বাস ফেলতে দেখে বললো,
–শিশির বাবু এত কষ্ট কিসের আপনার?যে এভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন?”
শিশির বিন্দুর ঘাড়ে চুমু এঁকে বললো,
–আমার বিন্দু কণা আমার কাছে থাকলে আমার আবার কিসের কষ্ট? আমি তো সবচেয়ে সুখী একজন মানুষ!”
বিন্দু শিশিরের জবাবে মিষ্টি করে হাসলো। যেটা শিশিরের বুঝতে বাকি রইলো না। প্রিয়তমাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে শিশিরও হাসলো মিষ্টি করে। সত্যিই এত এত তৃপ্তি এই সুখের মাঝে!যেটা লক্ষ – কোটি টাকা দিয়েও কেনা যায় না!
শিহাবের শুধু দেশের মাটিতে পা রাখার অপেক্ষা। কখন তার বিন্দুর মুখখানা দেখবে, আর নিজের চক্ষুদ্বয় ভঞ্জন করবে! সেই প্রতীক্ষায় অপেক্ষার প্রহর গুণছে আর মিটিমিটি হাসছে আর ভাবছে বিন্দু ওকে দেখলে ঠিক কতটা খুশি হবে!তখন বিন্দুর রিয়্যাকশন কী হবে সেটা ভেবে ভেবেই আরও বেশি ভালো লাগছে শিহাবের৷ এখন শুধু নতুন একটা দিনের অপেক্ষা! তবেই সকল অপেক্ষার অবসান ঘটবে!
আজকে দুই পর্ব দিলাম। কালকে নাও দিতে পারি৷ খুব শিঘ্রই গল্পটা শেষ করবো ইনশাআল্লাহ ?।
চলবে,,,,,,,,