শ্রেয়সী পর্ব ৩৩+৩৪

0
365

শ্রেয়সী
লেখাঃখাইরুন নেছা রিপা
পর্বঃ৩৩

বেবীর বয়স ছয় মাস পার হয়ে সাত মাসের দুই সপ্তাহ চলছে। কিন্তু বিন্দুর হিসাব মতে বেবীর বয়স দশ মাস। কবে বেবী হবে বলে বলে শিশিরের মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। শিশিরও প্রতিনিয়ত এটাসেটা বুঝ দিয়ে চলেছে৷ বিন্দু এমন একটা কাজ করেছে বলেই বিষয়টা কারো সাথে সেয়ার করতে পারছে না। তাই চুপচাপ বসে আছে। তবে বিন্দু মাঝে মাঝে এটাও ভাবে মাসের তুলনায় পেটটা তেমন ফোলেনি। বিষয়টা বেশ ভাবায় মাঝে মাঝে বিন্দুকে। পরক্ষণেই ভাবে ওর মা-চাচিদের কথা। ওনারা প্রায়ই একসঙ্গে বসলে নানার কথার মাঝে বাচ্চা জন্মানোর বিষয়টাও মাঝে মাঝে টানতেন। সেখানে এমনটাও শুনেছে বিন্দু সবার নাকি পেট বেশি বড় হয় না। তাই বিন্দুও ভেবে নিয়েছে ওরও সেই রকম হবে হয়তো। অন্যদিকে শিশিরও এই অবস্থায় কিছুতে বিন্দুকে বেশি টেনশন দিতে চায় না। তাই যথা সম্ভব বিন্দুকে হাসি-খুশি রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বিন্দু এখন বেবীর নড়াচড়া স্পষ্ট বুঝতে পারে। কখনো মাথা দিয়ে পেটের মধ্যে ঢুস মারে, কখনো পা দিয়ে লাথি মারে। বিন্দু বেশ বুঝতে পারে বেবীটা সুস্থ আছে। অবশ্য থাকবেই না কেন? শিশির যেভাবে যত্ন নেয়, না ভালো থেকে উপায় আছে। প্রতিমাসে চেকাপ করাতে ভুল হয় না। নিয়ম করে ঔষধ খাওয়া,খাবার খাওয়া সব কিছুতেই শিশিরের যত্নের কোনো ত্রুটি নেই৷ বিন্দুর কাছে বেবীর উপস্থিতি অন্যরকম এক অনুভূতি । যখনই বাচ্চার উপস্থিতি টের পায় পুরো শরীর জুড়ে এক আলাদা ভালোলাগায় হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে৷ নিজের অজান্তেই মুগ্ধতায় হেসে ফেলে বিন্দু। আলতো করে পেটে হাত বুলায়। যেন সে তার বাচ্চাকেই স্পর্শ করছে। আবার যখনই মনে পরে সবাই বাচ্চাটা নষ্ট করে দিতে চেয়েছিলো তখন চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে ওঠে৷ তাহলে যে আজ বিন্দু এই অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হতো!

বিন্দুর নিজেকে অনেকটা ভারি ভারি লাগে। হাঁটা-চলা করতেও কষ্ট হয়। এখন আর স্যালোয়ার – কামিজ পরতে পারে না। তাই শিশির পাতলা কাপড়ের কয়েকটা মেস্কি বানিয়ে দিয়েছে৷ আর এখন সেগুলোই পরে। প্রেগন্যান্সির সময় অবশ্য এই পোশাক পরিধান করাটা বেশ আরামদায়ক। রাতে একদম এপাশ-ওপাশ করে ঘুমাতে পারে না। কখনো সোজা হয়ে শুবে তো আবার উঠে খাটে হেলান দিয়ে বসে থাকবে৷ কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে একদম ঘুম আসে না৷ ওর জন্য শিশিরকেও না ঘুমিয়ে কাটাতে হয়। শিশির নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে বিন্দুর মাথায় আলতো করে হাত বুলায়। এটা যেন বিন্দুর ঘুমের ঔষধ। আর ওমনি চোখের পাতা বুঝে আসে৷ এভাবে শিশিরকে জ্বালাতে একদম মন চায় না বিন্দুর কিন্তু অন্যদিকে শিশির না থাকলে যেন ঘুমই হারাম হয়ে যেত।

শিশিরের বুকের মাঝে বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছে বিন্দু। শিশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। একসময় শিশিরও ঘুমিয়ে পড়লো। শিশিরও তো সারাক্ষণ বিজি থাকে। দুই টাইম স্কুলে ক্লাস করে কত রাতে বাসায় ফেরে তারও তো একটু রেস্ট দরকার। এই দুইমাসে যেন শিশির অনেকটা চিকন হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালির দাগ পড়ে গেছে। বিন্দুর ঘুম ভেঙে গেল। দেখলো ও শিশিরের বুকের মাঝে ঘুমিয়ে আছে আর শিশির দুই হাতে জড়িয়ে রেখেছে। শিশিরের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকাতেই এক গভীর মায়ায় পরে গেল বিন্দু। অদ্ভুত রকমের ভালো লাগছে শিশিরের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে৷ এই মানুষটা সত্যিই ওর জীবনে আশির্বাদস্বরুপ। বিন্দু নিজের আনমনেই আবারও শিশিরের বুকে মাথা রাখলো আলতো করে এই প্রথম ঠোঁট ছোঁয়ালো শিশিরের উন্মুক্ত বক্ষদেশে। আজকাল কেমন যেন অদ্ভুত অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে বিন্দুর মনে। সারাক্ষণই যেন শিশিরের গা ঘেঁষে থাকতে ইচ্ছে করে। যতটা সময় শিশিরকে চোখের সামনে দেখে মুগ্ধ হয়ে শিশিরকে দেখে। এত কেন ভালো লাগে জানে না বিন্দু। শিশিরের কিছু খারাপ লাগা দেখলেই কেন যেন কষ্ট হয়। শিশিরের খুশিতে হাসতে ইচ্ছে করে! এ কেমন অনুভূতি একদম অজানা বিন্দুর!

আজকাল শিহাবকে তেমন একটা মনে পড়ে না। মনে পড়লেও আগের মতো কেঁদে বুক ভাসায় না। শুধু বুক চিঁড়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।

খুব তৃষ্ণা পেয়েছে বিন্দুর। কিন্তু জগে একটু পানিও নেই। বোধহয় শিশির খেয়াল করেনি নাহলে এসবে তেমন ভুল হয় না শিশিরের। সত্যিই খুব মায়া লাগছে মানুষটার জন্য। সারাদিন কত পরিশ্রম করে রাতেও বিন্দুর সেবা যত্ন করে। এই মুহূর্তে আর ইচ্ছে হলো না শিশিরকে জাগাতে। নিজেই আস্তে করে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লো। হাঁটা চলা করতেও এখন কষ্ট হয়। ধীরে ধীরে পা ফেলে বিন্দু এগিয়ে গেল ডাইনিং রুমে। এক গ্লাস পানি খেয়ে আবারও রুমের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতেই হঠাৎই বিন্দু হাত টান অনুভব করলো। নিজেকে সামলাতে না পেরে পরলো গিয়ে কারো বুকের মাঝে। ডাইনিং রুমের ডিম লাইটের আলোতে মানুষটাকে চিনতে খুব অসুবিধা হলো না বিন্দুর। হাত ঝটকা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে গিয়ে সোহেলের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে গেল বিন্দু। মনে-প্রাণে আল্লাহকে ডাকছে বিন্দু। যেন এই জানোয়ারের থেকে মুক্তি পায়। বিন্দু গলার স্বর রুক্ষ্ম করে বললো,
–ভাইয়া ছাড়ুন আমাকে। এসব অসভ্যতামি করতে আপনার লজ্জা করছে না? ভুলে যাবেন না আমি এ বাড়ির বউ। আর রিদি আপনার বউ। সেই সূত্রে আমি আপনার বোনের মতো। ছাড়ুন আমাকে।”
কথাগুলো বেশ রুক্ষ্মস্বরে বললেও শরীরে একদম জোর পাচ্ছে না বিন্দু। বিন্দুর কথা শুনে সোহেল শয়তানি হাসি হেসে বললো,
–সবাইকে বোন ভাবলে চলে না বিন্দু রাণী। অনেক আগে থেকেই তোমার ওপর আমার লোভ জন্মেছে। যেদিন তোমাকে দেখেছি সেদিনই মাথাটা ঘুরে গেছে। কবে তোমাকে ভাগে পাবো সেই আশায় ছিলাম। কিন্তু তুমি তো পাত্তাই দাওনি। আজ এত কষ্টের পর পেলাম কী করে ছেড়ে দেব বলো? আমি রিদির পাশে শুয়ে থাকি ঠিকই কিন্তু মনটা পরে থাকে তোমার মাঝে।”
কথাটা শেষ করেই ভয়ংকর ভাবে হেসে ঠোঁটটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো বিন্দুর দিকে। বিন্দু নিজেকে মুক্ত করতে দিশেহারা হয়ে সোহেলের কাঁধে কামড় বসিয়ে দিলো। সোহেল ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে বিন্দুকে ছেড়ে দিতেই বিন্দু সব শক্তি দিয়ে বেডরুমের দিকে দৌড় দিলো। ঘুমের মধ্যে শিহাবের হাত পাশে পরতেই দেখলো বিন্দু নেই তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে দরজার কাছে আসতেই বিন্দু এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো শিশিরের বুকের মাঝে। উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদছে বিন্দু। শিশির ঘটনার আকস্মিকতায় পুরো স্তব্ধ হয়ে খানিকটা সময় বিন্দুকে বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখলো। বিন্দুর বুকের ধুপধাপ শব্দ স্পষ্ট শিশির শুনতে পারছে। শিশির কোমলতার সঙ্গে বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলো,
–কী হয়েছে বিন্দু?”
বিন্দু হাঁপাতে হাঁপাতে কোনরকম শুধু সোহেলের নামটা উচ্চারণ করলো। আর কিছুই বলতে পারলো না আবারও হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। সোহেলের নামটা শুনেই শরীরে রক্ত চলাচল কয়েকগুণ বেড়ে গেল শিশিরের। মাথার রক্ত টগবগ করতে শুরু করে দিয়েছে। কপালের রগ রাগে ধপধপ করে কাঁপছে। শিশির বিন্দুকে কোলে তুলে নিলো বিছানায় এনে শুয়ে দিলো। পানি দিতে গিয়ে বুঝতে পারলো রুমে কোনো পানি নেই। শিশির শুধু জিজ্ঞেস করলো,
–পানি খেতে গিয়েছিলে?”
বিন্দু মাথা নেড়ে সায় দিলো৷ শিশির পানি আনার জন্য উঠতে নিলেই বিন্দু আবারও জড়িয়ে ধরলো।
–প্লিজ যাবেন না আমাকে ছেড়ে। আমার ভয় লাগছে।”
শিশির অভয় দিয়ে বললো,
–আমি যাব আর আসবো।”
আবারও এক গ্লাস পানি এনে দিলো শিশির। খানিকটা সময় বিন্দুকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতেই বিন্দু ঘুমিয়ে পরলো। শিশির আস্তে করে বিন্দুকে শুয়ে দিলো। চোখের কোণে তখনও জল চিকচিক করছে। শিশির চোখের পানি মুছে দিয়ে বিন্দুর কপালে চুমু দিলো। তারপর দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে গেল রিদির দরজার দিকে। দরজায় কয়েকবার টোকা মারতেই রিদির ঘুম ভেঙে গেল। রিদি উঠে দরজা খুলতে নিলেই সোহেল পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রিদির পিঠে-ঘারে এলোপাথাড়ি চুমু দিতে লাগলো। রিদির ভালো লাগলেও বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে বললো,
–কী করছো ছাড়ো? ভাইয়া ডাকছে তো।”
–তোমার ভাইর কাণ্ডজ্ঞান নেই। এত রাতে এসেছে বোনের দরজায় টোকা দিতে?
রিদি বিরক্তিকর কণ্ঠে বললো,
–এটা কেমন কথা? হয়তো কোনো দরকারে ডাকছে। ”
কথা শেষ করেই রিদি বিছানা ছেড়ে উঠে এলো সোহেলের বারণ উপেক্ষা করে। বিন্দু দরজা খুলতেই শিশির হনহন করে রুমে ঢুকে সোহেলের টিশার্টের কলার ধরে বিছানা থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে আনলো। কিছু না বলেই উড়াধুড়া মারতে লাগলো সোহেলকে। রিদি এমন ঘটনায় অস্থির হয়ে দৌড়ে গিয়ে ডাকলো শিরিনা বেগমকে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো শিরিনা বেগম। রিদির এমন উত্তেজিত কণ্ঠের ডাক শুনে হতবম্ভ হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন তিনি। রিদির দিকে তাকাতেই দেখলেন ও কাঁদছে। চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছাপ। শিরিনা বেগমও উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,
–কী হয়েছে?”
–মা,ভাইয়া ওনাকে খুব মারছে।”
শিরিনা বেগম আর কিছু না বলেই দৌড়ে আসলেন রিদির রুমে পিছু পিছু রিদিও আসলো। রুমে ঢুকেই দেখলেন সোহেল ফ্লোরে শুয়ে আছে। আর শিশির এলোপাথাড়ি লাথি মারছে। শিরিনা বেগম এসে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলেন শিশিরকে। ধমক দিয়ে বললেন,
–রাত-দুপুরে এসব কী শুরু করেছিস? আর কেনই বা এভাবে মারছিস?”
শিশিরের ক্রোধ তখনও কাটেনি। শিরিনা বেগমের হাত ছাড়িয়ে বার বার তেড়ে যাচ্ছে সোহেলকে মারতে।
–সেটা তোমার গুণধর জামাইকেই জিজ্ঞেস করো।”
শিরিনা বেগম এক পলক তাকালেন সোহেলের দিকে, দেখলেন চুপচাপ সোহেল মাথা নিচু করে বসে আছে। শিরিনা বেগম কিছুই বুঝতে না পেরে বললেন,
–কী করেছে সোহেল?”
–কী করেনি সেটা বলো? ওর সাহস হয় কী করে বিন্দুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে। রুমে পানি ছিলো না। আমিও ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল করিনি। বিন্দুর পিঁপাসা লেগেছিলো আর ও আমাকে জাগায়নি। নিজেই চলে গেছে পানি খেতে আর তখন….”
শিশির আর কিছু বলতে পারলো না। কথাটা শুনেই পাশ থেকে রিদি হু হু করে কেঁদে উঠলো। শিরিনা বেগম মুখে কাপড় চেপে হায় হায় করতে লাগলেন। শিশির আবারও বলতে লাগলো,
–আর একটু হলে বিন্দু পরেই যেত। তখন কী অবস্থা হতো ওর? এই অবস্থায় যে কিভাবে দৌড়ে রুম অব্দি এসেছে আল্লাহ মাবুদ জানে। ভয়ে ও কথাই বলতে পারছিলো না। ও কোন সাহসে এই বাড়ির বউয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায়? ওর বউ কী কম সুন্দর যে অন্য মেয়েদের দিকে ওর তাকাতে হবে। মা তুমি ওকে এক্ষুণি বলো আমার বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে বলো। আমি আমার বাড়িতে এমন অজাতশত্রুকে রাখবো না। ওর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি কতটা জানোয়ার ও। বিন্দুর কী অবস্থা! এর মধ্যে ওর এসব চিন্তা কী করে মাথায় আসে!”
শিরিনা বেগম এ পর্যায়ে মুখ খুললেন। সোহেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
–বাবা বালোই রুপ দেখিয়েছো এবার বিদেয় হও। তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না৷ আমার ঘরের বউয়ের দিকে তুমি নজর দাও। আমার এমন শত্রু আমি তো পালতে পারবো না।”
সোহেল বিড়বিড় কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বললো,
–বিশ্বাস করেন মা আমি কিছু করিনি। ভাইয়া অযথা আমাকে ভুল বুঝছে।”
শিশির সঙ্গে সঙ্গেই ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় মারলো সোহেলকে।
–তাহলে তুই কী বলতে চাইছিস? ও ইচ্ছে করে তোর নামে মিথ্যে বলেছে? ওর কী লাভ তোর নামে মিথ্যা বলে?”
শিরিনা বেগম ছেলেকে বাঁধা দিয়ে বললেন,
–বাদ দে এসব। এসব নোংরা মানুষের গায়ে হাত দিয়ে নষ্ট করার মানে হয় না।”
এরপর সোহেলের উদ্দেশ্যে বললো,
–এবার তুমি বাড়ি থেকে বের হও বাপু। যা বলার আমরা তোমার গার্ডিয়ানের সাথে বলবো। আর ঝামেলা বাড়িও না।”
বিন্দু তখনই রিদির রুমে আসলো। আর শিরিনা বেগমের কথাটা শুনেই ফললো।
–আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।”
শিশির বিন্দুকে দেখেই বললো,
–তুমি এখানে কেন এসেছো?”
বিন্দু সে কথার জবাব না দিয়ে বললো,
–ওনাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দেন। এখন এত রাতে বাড়ি থেকে বের হওয়ার দরকার নেই।”
কথাটা শুনেই শিশিরে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। জোরে ধমক দিয়ে বললো,
–এক্ষুণি ঘরে যাও। পাকামী করতে কে বলেছে তোমাকে?”
বিন্দু এর আগে কখনো শিশিরের এতটা রাগ দেখেনি। চোখ জোড়া ভয়ংকর লাল দেখাচ্ছে শিশিরের। বিন্দু চোখ নামিয়ে নিলো শিশিরের চোখ থেকে। জোরে ধমক খেয়ে কেঁপে উঠলো। চোখে একদম পানি চলে এলো৷ হঠাৎ এত জোরে ধমক খাওয়ায় কিছুটা ভয়ও পেয়েছে। চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেল।
বিন্দু চলে যেতেই শিরিনা বেগম বললেন,
–এবার বের হও তাড়াতাড়ি। ”
সোহেল চুপচাপ লুঙ্গি আর টিশার্ট পরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। শিশির রিদির রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে শিরিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো,
–রিদিকে বোঝাও মা। ও যদি ওই ছেলের সাথে সংসার করতে চায় তাহলে আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারবে না। আজ বিন্দুর দিকে হাত বাড়িয়েছে। কাল অন্য মেয়ের দিকে যে হাত বাড়াবেনা তার কোনো গ্যারান্টি নেই। ওর মধ্যে মিনিমাম রেসপেক্টটুকুও নেই থাকলে এই জঘন্য কাজটা কিছুতেই করতে পারতো না। ওকে বোঝায় ভালো করে। তারপর আমাকে জানিও। আমি উকিলের সাথে কথা বলে ডিভোর্স ফাইল করবো।”

শিশির কথাগুলো বলেই নিজের রুমে চলে এলো। বিন্দু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। শিশিরের উপস্থিতি টের পেতেই চোখ-মুখ মুছে নিলো। শিশির নরম গলায় বললো,
–কাঁদছো কেন?”
–নিঃশ্চুপ!
–কী হলো? চলো ঘুমাবে।”
–আমি যাব না। আপনি যান। আর এই কাজটা কারার আগে একবার রিদির কথাও ভাবা উচিত ছিলো আপনার!”
–বিন্দু রিদি আমার বোন ওর নিশ্চই খারাপ চাইবো না আমি। আর ওর জন্য যেটা ভালো আমাকে সেটাই তো করতে হবে। ভেবেছিলাম ছেলেটা ভালোই। আর অন্য যাদেরকে জিজ্ঞেস করেছি তারাও ভালোই বলেছিলো। তাই বিয়েটা দিয়েছি। কিন্তু কে জানতো এর মনে মনে এতটা শয়তানী। যাই হোক এখন চলো ঘুমাবে।”
–ঘুমাবো না আমি।”
–মাথায় হাত বুলিয়ে দেব। আদর করবো। চুমু দেব হবে?”
বিন্দু ভেংচি কেটে বললো,
–যাব না বলছি তো যাবই না।”
–বিন্দু ফালতু টপিক নিয়ে জেদ করো না।”
–জেদ করলে কী করবেন? আবারও ধমক দেবেন তাই তো?”
–স্যরি।”
বিন্দু অভিমানী গলায় বললো,
–আমি খুব ভয় পেয়েছি তখন।”
শিশির হাত বাড়িয়ে বিন্দুকে কাছে টেনে নিলো। বিন্দুও চুপচাপ সেটিয়ে রইলো শিশিরের বুকের মাঝে। এত কেন শান্তি লাগে এই জায়গায় মাথা রাখলে! নিজেকে এইটুকু জায়গার রাণী মনে হয়। মনে হয় শিশির এই জায়গাটা শুধুমাত্র বিন্দুর নামে লিখে দিয়েছে।আজকাল নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয় বিন্দুর। আর সবচেয়ে যেটা বেশি মনে হয় সেটা হলো শিশিরের এই বক্ষদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বিন্দুর জন্য যেখান থেকে কোনো বিপদ তাকে ছুঁতে পারবে না!

চলবে,,,,,,,,

শ্রেয়সী
লেখাঃখাইরুন নেছা রিপা
পর্বঃ৩৪

মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরলো রিদি। হঠাৎ করেই চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছে সে। জীবনে এমনও একটা দিন দেখতে হবে কখনো কল্পনাও করেনি রিদি। কখনো কাউকে ভালোবাসেনি শুধু মাত্র স্বামী নামক মানুষটাকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসবে বলে৷ বিয়ের পর স্বামীর পাওনা দিতেও তো কোনোদিন আপত্তি করেনি। তাহলে কী করে পারলো তার স্বামী নামক মানুষটা এমন অমানুষের মতো কাজ করতে? জীবন তাকে নিয়ে এ কোন খেলায় মত্ত হয়েছে। এমন জীবন তো সে চায়নি। তাহলে কেন এমন হলো তার সাথে। মনে মনে যতবারই কথাগুলো ভাবছে ততবারই চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে উঠছে। কিছুতেই খনিক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বিশ্বাস করতে পারছে না রিদি। কারণ সোহেল তো কখনো কোনো বিষয়ে রিদিকে অভিযোগ করেনি এমনকি রিদিও সোহেলের কোনো চাওয়া অপূর্ণ রাখেনি। তবে কেন এমন হলো?

–মা ভাইয়া ওকে একটাবার কিছু বলার সুযোগ দিলো না। ভাইয়ার তো উচিত ছিলো ওকে এভাবে না মেরে একটাবার জিজ্ঞেস করার। এক পক্ষের কথা শুনেই অপর পক্ষকে এভাবে আঘাত করা কী ঠিক?”

শিরিনা বেগম গম্ভীর কিন্তু নরম লগায় বললেন,
–ওই মুহূর্তে কী আধেও এসব জিজ্ঞেস করার কথা মাথায় আসে? তুই ই বল!”
–মা আমি কিচ্ছু ভাবতে পারছি না। একটা বিয়ে হয়ে গেছে এখন আবার ডিভোর্স বিয়ের বয়সটাই হলো মাত্র কয়েকটা মাস আর এর মধ্যেই এত বড় একটা ধাক্কা আমি সামলাবো কী করে? আর আমার কেন যেন মনে হয় সোহেল এমনটা করতেই পারে না। ভাইয়া কিভাবে এতটা বদলে গেল? ভাবি বললো আর ও বিশ্বাস করে নিলো সবটা। আমার তো মনে হয় ভাবি হয়তো…
শিরিনা বেগম বেশ কড়া গলায় বললেন,
–রিদি অবুঝের মতো কথা বলিস না। আমি বুঝতে পারছি তোর অবস্থাটা কিন্তু তাই বলে চোখে পট্টি পরে থাকিস না। বিন্দুর কী কোনো শত্রুতা আছে তোর বা সোহেলের সাথে যে ও অযথা এমন একটা মিথ্যা বলবে? আর ওর এখন যেই অবস্থা এই অবস্থায় তোর কী মনে হয় ও এসব মিথ্যা অভিনয় করে শিশিরের মন ভুলাবে। আমাকে বলেছিস বেশ ভালো কথা শিশির শুনলে সহ্য করতে পারবে না। সবসময় তোর জন্য ও বেস্ট জিনিসটাই পছন্দ করতো। সেই ছোট বেলায় তোর বাবা মারা গেছে নিজে পড়ালেখা করেও সংসারের হাল ধরে রেখেছে। এমনও অনেক ঈদ গেছে তোর পছন্দসই জামা কিনতে গিয়ে ওর কিছুই কেনা হতো না এমনকি আমার পছন্দগুলো নিয়ে ও যথেষ্ট কেয়ারফুল ছিলো। তোকে ভালো ড্রেস পরানো, ভালো স্কুলে পরানো ভালো টিউটর ঠিক করে দেওয়া কোনো কিছুতেই ও গাফলতি করেনি কোনোদিন। আর তোর বিয়ের বেলায় ও কত খোঁজ -খবর নিয়েছিলো। সবাই ভালো বলেছিলো তাই বিয়েটা হয়েছে। আর আমিও চেয়েছিলাম তোর এখানে বিয়ে হোক। ও বলেছিলো মা আরেকটু দেখি আমিই মানা করেছিলাম। বলেছি আর কত দেখবি। সেই ভাইকে অল্প কয়েকদিনের আলাপচারিত কারো জন্য ভুল বুঝাটা নেহাত বোকামো ছাড়া আর কিছু না।”
–মা ও আমার আলাপচারিত নয়। ও আমার স্বামী। ভালোবেসে ফেলেছি আমি ওকে।”
শিরিনা বেগম একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–ভালোবাসা কখনো এক পক্ষে হয় না রিদি। তার জন্য দুই পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হয়। তুই ভালোবাসিস কিন্তু ও তো তোকে ভালোবাসে না। তাহলে এটাকে কী বলা যায়? শুধু একতরফা ভালোবাসা। জীবনে একতরফা ভালোবাসা কখনোই সুখ দেয় না রিদি শুধুমাত্র কষ্ট ছাড়া।”
–মা ভালোবাসা অত ভেবে চিন্তে হয় না। এটা হয়ে যায়। ভাইয়াকে বলে দিও আমার পক্ষে ওকে ডিভোর্স দেওয়া সম্ভব না।”
শিরিনা বেগম ক্ষুব্ধ গলায় বললেন,
–এত বছরের ভালোবাসা আজ তোর কাছে পর হয়ে গেল তাই না রিদি। মায়া হয় না ভাইটার জন্য? কী না করেছে ও। আর আজ এভাবে ভাইয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে তুই কী সুখী হতে পারবি? একটাবার ওর কথা ভাব। ওর ভালোবাসার কী কোনোই মূল্য নেই?
তোর বিয়েতে কতগুলো টাকা খরচ হয়েছে এসব লোক দেখানো। কোনো কিছু ত্রুটি রাখেনি শুধু ছেলের বাড়ি থেকে তোকে কথা শুনাবে বলে দু’হাত ভরে খরচ করেছে। আমি মানা করলেও বলতো, মা বোন তো একটাই আর ওর তো অধিকার আছে পাওয়ার বাবা থাকলে হয়তো আরও বেশি পেত। ব্যাংকে কিছু টাকা জমিয়েছিলো তোর বিয়ে উপলক্ষ্যে সেগুলোও শেষ। ধার দেনাও করতে হয়েছে৷ একসঙ্গে কত গুলো হারা পরেছে ঘর করা, নিজের বিয়ে যদিও ওর বিয়েতে তেমন খরচ হয়নি যা করেছে সব তোর বিয়েতে। সারাদিন ছেলেটা গাদার খাটুনি খাটে। সেই সকালে যায় আবার একটায় আসে। কোনোরকম খেয়ে আবার টিউশনিতে যায় তারপর বাড়ি ফেরে আবার রাত দশটায়। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালে মায়া হয় না তোর? যে এভাবে অন্য একজনকে ভালোবাসি বলছিস? তাও একটা জানোয়ারকে।”
–মা ভাইয়ার এসব দায়িত্ব।”
–বাহ্!কত সুন্দর বলে দিলি ভাইয়ার এসব দায়িত্ব। তোর কোনো দায়িত্ব নেই ওর প্রতি? তোরও দায়িত্ব আছে। নিজের দায়িত্বটা এভাবে এড়িয়ে যাস না। তোরই উচিত ছিলো শিশিরকে আগ বাড়িয়ে ডিভোর্সর কথা বলা তা না উল্টো স্বামীর গুণ কীর্তন গাইছিস।”

মায়ের বলা দীর্ঘ প্রত্যুত্তরে আপাতত আর কোনো যুক্তি খুঁজে পেল না রিদি। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফ্লোরের দিকে। শিরিনা বেগম আবারও বলতে লাগলেন,
–বিয়ে একটা মেয়ের জন্য কখনো আশির্বাদ আবার কখনো কখনো অভিশাপ। একবার ভাব তুই আজ আমাদের বিন্দুর দিকে ওর নজর পরেছে তুই তো বিন্দুর থেকে সুন্দর কম না, বিন্দুর মতোই পড়াশোনা করার অবস্থায় আছিস তবুও সোহেল কী কাজটা করলো। আজ না হয় আমরা ওকে ক্ষমা করেই দিলাম নেক্সট যে এমন একটা কাজ করবে না তার কী গ্যারান্টি। আসলে ওর চরিত্রেই সমস্যা। বিন্দুকে দেখলে তো এখন এমনিতেই মায়া হয়। কেমন শুকিয়ে গেছে খেতে পারে না। এই অবস্থায় মেয়েটাকে ওর বাজে চরিত্রটা না দেখালেই কী চলছিলো না। একবার ভাব রিদি। বিয়ে একবার হয়েছে বলেই যে আবার হবে না এমন কোনো মানে নেই। প্রতিনিয়ত কষ্ট পাওয়ার চেয়ে একবার কষ্ট পাওয়া ভালো। ভুলে যা ওকে আমরা তোকে ওর থেকে আলাদা করে ফেলবো। পড়ালেখা করবি তারপর বুঝে-শুনে বিয়ে দেব। এমন অনেক মেয়ে আছে যাদের দু’বার বিয়ে হয়। আর এটা কোনো খারাপ না। এখনও সময় আছে। শিশিরকেও আর কষ্ট দিস না।”
রিদি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মাথায় যেন কোন কাজ করছে না। কেমন মৃদু যন্ত্রণা হচ্ছে। রিদি এগিয়ে গিয়ে মায়ের কোলে নিজের মাথাটা রাখলো। গম্ভীর গলায় বললো,
–মা একটু চুলে হাত বুলিয়ে দাও তো।”

বিন্দু একটা বাচ্চার পেছনে দাৌড়াচ্ছে। বাচ্চাটা খিলখিল করে হাসছে। বিন্দু যত ওকে ধরতে চাইছে ততই দৌড়ে সামনে চলে যাচ্ছে। বিন্দু বাচ্চাটার মুখও দেখছে না। তবে তার খিলখিল হাসির শব্দ এসে কানে বাজছে। হঠাৎই কোত্থেকে যেন একটা গাড়ি এসে বাচ্চাটাকে চাপা দিয়ে চলে গেল। বিন্দু ঘুমের মধ্যেই চিৎকার দিয়ে উঠে বসলো। শিশিরেরও ঘুম ভেঙে গেল।
–কী হয়েছে বিন্দু? ”
–আমার বাচ্চাটা!”
কথাটা বলেই বিন্দু পেটে হাত রেখে বাচ্চার উপস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো। পরক্ষণেই চোখ বন্ধ করে খাটে হেলান দিলো। পুরো ঘেমে গেছে। বুকের মধ্যে ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে।
শিশির বিন্দুর ওড়না দিয়ে বিন্দুর ঘাম মুছে দিলো। মৃদু গলায় বললো,
–কী হয়েছে বিন্দু? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলে?”
বিন্দু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো।
–জানেন আমার খুব ভয় করছে। যদি স্বপ্নটা সত্যি হয় তাহলে আমি কী করবো? মরে যাব আমি!”
শিশির বিন্দুর কপালে নিজের কপাল ঠেকালো। বিন্দুর নাকে নাক ঘষে আলতো করে গাল টেনে দিয়ে বললো,
–এত চিন্তা করলে হয় পাগলী? কিচ্ছু হবে না আমাদের বাবুটার।”
বিন্দু শুধু একটু মিষ্টি করে হাসলো।

কয়েকদিন পর।
মন-মেজাজ একদম ভালো নেই রিদির। প্রতিদিন অনেকবার করে কল দেয় সোহেল। রাগে-ঘেন্নায় ফোন রিসিভ করেনা রিদি। আর শিরিনা বেগমও মেয়েকে বারণ করে দিয়েছেন। কেন যেন রিদির মনে হয় বিন্দু ওর জীবনে একটা অভিশাপ। রিদির সব তছনছ করে দেওয়ার জন্যই এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে।

সকালে নাস্তার টেবিলে কারো সাথেই রিদি কথা বললো না। শিশির কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলো। শুধু হু, হা করে উত্তর দিয়েছে। উপস্থিত সবাই বুঝতে পারছে রিদির কথা বলার বিন্দু মাত্রও ইচ্ছে নাই। তাই কেউই খুব বেশি ঘাটালো না। নাস্তার টেবিল থেকে উঠতে উঠতেই রিদি বললো,
–মা আমি কলেজে যাচ্ছি।”
–এত সকালে কলেজে যাবি?”
–নাহ্। আগে দিয়ার( ফ্রেন্ড) বাড়িতে যাব। পরে ওর সাথে কলেজে যাব। এমনিতেই তো অনেকদিন কলেজে যাওয়া হয় না।”
পাশ থেকেই শিশির বলে উঠলো,
–আমিও তো এখনই বেড়ুবো। চল আমি দিয়ে আসি।”
রিদি কটাক্ষ করে উত্তর দিলো,
–লাগবে না। আমি একাই যেতে পারবো।”
–সেটা তো আমিও জানি তুই একাই যেতে পারবি। কিন্তু আমার সাথে যেতে সমস্যা কোথায়? আমি বাইক দিয়ে নামিয়ে দিয়ে গেলাম আর দিয়াদের বাড়ি তো স্কুলের পথেই পরে।”
–বললাম তো লাগবে না।”
আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিদি নিজের ঘরে চলে গেল। শিশির রুমে এসে শার্ট-প্যান্ট পরছিলো। বিন্দু এসে বললো,
–আমার মনে হয় সোহেল ভাইকে আরেকটু সুযোগ দেওয়া উচিত। রিদির মনটা খুব খারাপ।”
শিশির শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো,
–এসব নিয়ে ভেবে নিজের মুড খারাপ করো না। এখন নিজের খেয়াল নাও। অন্যসব চিন্তা করতে হবে না। আমি গেলাম।”
কথা শেষ করেই শিশির এগিয়ে এসে বিন্দুর কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো। এটা এখন শিশিরের প্রতিদিনকার অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। বিন্দুও কেন যেন শিশিরের স্পর্শটা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। এখন শিশিরের একদিনও ভুল হয় না। স্কুলে যাওয়ার আগে বিন্দুর কপালে চুমু আঁকতে।

শিরিনা বেগম বিন্দুর উদ্দেশ্যে বললেন,
–বিন্দু আমি একটু পাশের বাড়ি থেকে আসি। রিনা আফায় একটু ডাকছে(প্রতিবেশী) কী যেন দরকারী কথা বলবে। দরজাটা বন্ধ করে দে। কোনো কাজ করতে হবে না আমি খুব শিঘ্রই চলে আসব।”
–আচ্ছা মা।”

বিন্দু দরজা বন্ধ করে এসে সাজেদা বেগমের সাথে ফোনে কথা বলছিলো। কথার মাঝখানেই কলিংবেল বেজে উঠলো। বিন্দু ফোনে কথা শেষ করে দরজা খুলে দিলো৷ দরজা খুলেই বিন্দুর আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। একে তো বাড়িতে কেউ নেই তারওপর এই শয়তান বাড়িতে পা রেখেছে।

আজ স্কুলে এগারোটা নাগাদ মাসিক পরীক্ষা শুরু হবে ক্লাস নাইনের ছাত্র-ছাত্রীদের। শিশির ভুলে প্রশ্নগুলো বাড়িতে ফেলে গেছে। প্রিন্সিপাল স্যার এসে বললো,
–শিশির প্রশ্নগুলো দেখি একবার।”
–স্যরি স্যার৷ একদম ভুলে গেছি। আমার এমনিতেও এখন ক্লাস নেই। আমি বাড়িতে গিয়ে নিয়ে আসছি।”
–তাড়াতাড়ি এসো।”
–হুঁ।

শিশির বাইক নিয়ে বেরিয়ে পরলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথেই দেখলো এক ফুসকাওয়ালাকে। বিন্দুকে শিশির অনেকবার জিজ্ঞেস করতো ওর কী খেতে পছন্দ। কিন্তু বিন্দু সেভাবে কিছুই বলেনি৷ একদিন শুধু অনেক জোড়াজুড়ির পর বলেছিলো চকবার আইসক্রিম। সেটা জানার পর শিশিরের একদিনও ভুল হয়নি বিন্দুর জন্য আইসক্রিম আনা শুধু বিন্দুর জন্যই না শিরিনা বেগম আর রিদির জন্য আনতেও ভুল হতো না। আজ ফুসকা দেখেই মনে হলো মেয়েদের তো ফুসকা খুব পছন্দের হয় কিনে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না। ওমনি শিশির ফুসকা কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

বিন্দু কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
–আ….আপনি?”
–হ্যাঁ, আমি!”
বিন্দু দরজা আটকাতে নিলেই সোহেল পা দিয়ে দরজা শক্ত করে ঠেকালো। বিন্দু দৌড়ে ঘরের ভিতর চলে যেতেই পেছন থেকে চুল টেনে ধরলো বিন্দু ব্যথায় কুঁকড়ে উঠতেই সোহেল কয়েকটা থাপ্পড় মারলো বিন্দুকে। টাল সামলাতে না পেরে সোফার কার্নিশের ওপর পরতে গিয়েও পেটে হাত দিয়ে নিজেকে কোনরকম মুক্ত করলেও কপালটা গিয়ে পড়লো কার্নিশের কাঠের ওপর। সেখানে পরেই কপাল ফেটে গেল। পরক্ষণেই সোহেল চুল টেনে দাঁড় করিয়ে গলা টিপে ধরলো। দাঁতের সাথে ঠোঁট কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে কপাল থেকেও ফিনকির মতো রক্ত বের হচ্ছে। বিন্দুর চোখ দু’টো যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। অসহায় ভঙ্গিতে অনুরোধপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সোহেলের দিকে। কিন্তু জানোয়ারটার একটুও মন গলছে না তাতে। চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসছে বিন্দুর এই বুঝি প্রাণ বায়ুটা গেল চলে!
–শালি খুব দেমাগ তোর তাই না। একবার তোকে ছুঁলে কী এমন ক্ষতি হইতো তোর? খুব সতি-সাবিত্রি ভাবিস নিজেকে তাই না? আবার এটা সবাইকে ঢোল বাজিয়ে জানাইছোস। কী ভাবছিস আমি তোকে এমনিতেই ছেড়ে দেব? তোর জন্য রিদি আমার সাথে কথা বলে না। তাহলে তোকে রেখে লাভ কী? আমার এতদিনের সম্মান তুই একদিনেই ধূলিসাৎ করে দিলি। এর পরিনাম তো তোকে ভোগ করতেই হবে।”
বিন্দু কিছু বলতে পারছে না। শুধু গোঙাচ্ছে আর দু’চোখের কোণ বেয়ে পানির ফোয়ারা বইছে। তখনই উঠোন থেকে কারো কথা ভেসে আসলো সোহেলের কানে। একজন মহিলা এসে ডাকছে শিরিনা বেগমকে।
–শিরিনা আফা বাড়িতে আছেননি?”
সোহেল ধাক্কা মেরে ফ্লোরে ফেলে দিলো বিন্দুকে। বিন্দু পেটে হাত দিয়ে মৃদুভাবে চিৎকার করলো। শরীরে কোনো শক্তি নেই। চোখ জোড়া বুঝে আসতে চাইছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। ঠোঁট আর কপাল দিয়ে তখনও রক্ত বের হচ্ছে। আস্তে আস্তে চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো!

কারো যদি গল্পটা নিয়ে কোনো আপত্তি থাকে তাহলে আমার কিছু করার নেই। গল্প আমি যেভাবে সাজিয়েছি সেভাবেই লিখবো।

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here