শ্রেয়সী পর্ব ২৩+২৪

0
357

#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ২৩

ভুল সেটাকেই বলা যায় যেটা মানুষ না জেনে-বুঝে করে। কিন্তু সত্যিটা জানার পরেও যদি মানুষ সেই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটায় সেক্ষেত্রে সেই কাজটাকে আর ভুল বলা যায় না বরং সেটাকে অন্যায় বলা হয়৷ অনেক ভেবেছে শিশির। শেষমেশ নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়েছে এটা ভেবে এই সত্যিটা সে কাউকেই জানাবে না৷
প্রথমত, বিন্দু এটা জানতে পারলে এ বাড়িতে এক মুহূর্তও থাকতে রাজি হবে না। এমনকি সাজেদা বেগমও এটা জানতে পারলে মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন। তখন বেবির ব্যাপারে সবাই জানতে পারলেও খুব একটা সমস্যা হবে না। তখন সবাই বুঝবে এটা শিশিরেরই বাচ্চা। কারণ অনেক বাচ্চাই তো সাত-আট মাসে জন্ম নেয়। কিন্তু কথা হলো শিরিনা বেগম কিছুতেই ছেলের বউকে বিয়ের সাথে সাথেই বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে রাজি হবেন না।
দ্বিতীয়ত, শিরিনা বেগমকে সত্যিটা জানালে তিনি উল্টো সাজেদা বেগম আর সাহেদ আলীকে দোষী ভাববেন। তারা কী করে নিজেদের মেয়ের এত বড় সত্যিটা আড়াল করেছে সেটা নিয়ে হয়তো ঝগড়া- বিবাদও লেগে যেতে পারে। তখন দুই ফ্যামিলির মধ্যে এখনকার যেই বন্ডিংটা তৈরী হয়েছে সেটা নিমিষেই ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। তাছাড়া শিরিনা বেগম এখন যেমন বিন্দুকে ভালোবাসেন সত্যিটা জানলে কখনোই আর ভালোবাসবেন না। হয়তো কথায় কথায় অনেক কথা শুনাবেন। কারণ কোনো মা’ই চাইবে না তার ছেলের সংসারে একটা অবৈধ বাচ্চার জন্ম হোক। আর সেটা যদি অন্যের বাচ্চা হয় সেক্ষেত্রে তো আরও আগেই না। আর রিদির এখন যেমন একটা রেসপেক্ট রয়েছে বিন্দুর প্রতি কিন্তু সত্যিটা জানলে এই রেসপেক্ট হারিয়ে ফেলবে বিন্দু। কারণ সবাই এই ব্যাপারগুলো অনেক খারাপ চোখেই দেখে। কেউই মানুষটাকে ব্লেইম করতে ছাড়ে না।

আর শিশির ভেবে নিয়েছে সে আলাদা রুমে থাকবে না। কারণ এটাতে সন্দেহের তীর এসে বিন্দুর দিকেই যাবে। শিশির আর বিন্দু এক ঘরেই থাকবে তবে দূরত্ব বজায় রেখে। শিশিরের জীবনের ইচ্ছে ছিল তার ভালোবাসার মানুষটাকে সে বৈধভাবে স্পর্শ করবে অবৈধভাবে নয়। যাকে সত্যিকারের ভালোবাসে তাকে অবৈধভাবে স্পর্শ করে অপবিত্র করার কোনো মানে হয় না। যেটা তার একান্তই নিজের সেটাকে পবিত্রভাবেই গ্রহণ করাই তো শ্রেয়। কিন্তু আজ নিজেকে সবচেয়ে বেশি অসহায় লাগছে। না জেনে বুঝেই বিন্দুকে সেদিন জড়িয়ে ধরেছিল শিশির। যখনই কথাটা মনে পরে ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড কষ্ট পায় শিশির। কারণ সে যে তার ভালোবাসার মানুষটাকে পবিত্রভাবে স্পর্শ করতে চেয়েছিল। যেই ছোঁয়ার মধ্যে থাকবে না কোনো অবৈধের ছোঁয়া।

আজকে শিশিরদের বাড়ি থেকে সবাই যাচ্ছে বিন্দুকে আনতে। শিরিনা বেগম অনেক বলার পর শিশির তৈরি হয়ে নিয়েছে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য। বিন্দুর মা আজ অনেক তড়িঘড়ি করে সব সামলাচ্ছেন মেয়ের শ্বশুরবাড়ির মেহমান আসবে বলে কথা। অনেক রকমের পিঠা বানিয়ে রেখেছেন মেয়ের সাথে দেওয়ার জন্য। এটা প্রাচীন বাংলার একটা রীতি। যেটা বহুকাল আগে থেকেই এ দেশের মানুষেরা পালন করে আসছে। মেয়ে যখন শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসে তারপর যখন শ্বশুরবাড়ি থেকে বউকে নিতে আসে তখন মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে এই সব তত্ত্ব দেওয়া হয়। সাথে আরও অনেক মালামাল দেওয়া হয় মেয়ের সঙ্গে। যেমন কাচের জিনিসপত্র এছাড়াও হাড়ি-পাতিল অনেক কিছু। বিন্দুদের বাড়িতে যতক্ষণ ছিলো একরকম অস্বস্তি কাজ করেছিল শিশিরের মধ্যে। মনে হয়েছিল শিশির সবাইকে জেনে-বুঝে ঠকাচ্ছে৷ কিন্তু কী বা করার সত্যিটা বলে সবাইকে কষ্ট দিতে যে তারও মন মানছে না৷ আসার সময় যখন দেখলো শিশির এসব মালপত্র গাড়িতে তুলছে তখন শিশির সাহেদ আলীকে বললো,
–বাবা এসব কী? প্লিজ এসব আমি নিতে পারবো না। আপনার মেয়েকে নিয়েছি এটাই আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া। আর আপনাদের ভালোবাসা আর আশির্বাদ পেলেই আমি জীবনে সুখী আমার এছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই।”
সাহেদ আলী হেসে বললেন,
–আমাকে যেহেতু বাবা মানো। বাবার কথাগুলোও রাখো এগুলো নিয়ে যাও। মনে করো এগুলো আমার ভালোবাসা।”
প্রত্তুত্যরে শিশির আর কিছুই বলতে পারলো না। সবার থেকে বিদায় নিয়ে বিন্দুকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। কিন্তু নিজের রুমে পা রাখলো না। রাতে আর শিরিনা বেগমকে কোনো রান্নাই করতে হলো না সাজেদা বেগম বক্স ভর্তি করে অনেকগুলো খাবার দিয়ে দিয়েছেন সেহরীর জন্য আর আসার সময় সবাই খেয়ে এসেছে তাই আর কেউই কিছু খেল না। সবাই প্রচন্ড টায়ার্ড। তাই সকাল সকাল শুয়ে পরলো। বিন্দুও নামজ শেষ করে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল। শিশির বাড়ি এসেই মসজিদে চলে গিয়েছিল নামজ সেরে এসে রুমে ঢুকলো। তখনই নজর পরলো বিন্দুর স্নিগ্ধ মুখের পানে। শিশির মশারিটা টানিয়ে দিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। যতদিন বাচ্চাটা জন্ম না নেয় ততদিন শিশির এই ব্যালকনিতেই কাটবে। তারপর বিয়ে করে একেবারে বৈধভাবে বিন্দুকে অর্জন করবে। তার আগে এই দূরত্বটা বজায় রাখাই ভালো।
ভালোবাসার মানুষটার জন্য যদি এইটুকু করতে না পারে তাহলে সে কেমন প্রেমিক পুরুষ! ব্যালকনিতে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারের ওপর হেলান দিয়ে শুয়ে পরলো। মাথায় নানান ভাবনা ঘুরপাক খেলেও বেশিক্ষণ তা স্থায়ী হলো না। তার আগেই চোখজোড়া ঘুমে বুঝে এলো। হঠাৎই শিশরের গায়ে দমকা হাওয়া এসে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে শিশিরের ঘুম ভেঙে গেল৷ পুরো ঘর অন্ধকার। বুঝাই যাচ্ছে লোডশেডিং হয়েছে। বাহিরে বাতাসের প্রচন্ড দাপট তার সাথে আকাশও বেশ গর্জন শুরু করে দিয়েছে। শিশির তাড়াতাড়ি রুমে আসলো। লুঙ্গিতে গুঁজে রাখা ফোনটা নিয়ে আলো জ্বালিয়ে রুমের মধ্যে ঢুকলো। তখনই নজরে এলো বিন্দু বিছানায় বসে কাঁদছে। শিশির মশারিটা একটু উঁচু করে মাথাটা ভেতরে নিয়ে বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলো,
–কী হয়েছে বিন্দু?”
ওমনি বিন্দু শিশিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
–আপনি এমন কেন? আমার ভয় লাগে না বুঝি? বাহিরে কত জোরে জোরে বাতাস বইছে ঘণ ঘণ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর আপনি আমাকে এখানে একা ফেলে কোথায় চলে গেলেন? রাতে এমনিতেই আমার খুব ভয় লাগে।”
হেঁচকি তুলে কথাগুলো বলে থামলো বিন্দু। শিশির তখনও স্থির হয়ে বসে আছে। কিন্তু বিন্দু শিশিরকে ছাড়ার নামই নিচ্ছে না। এ পর্যায়ে শিশির গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
–বিন্দু শুয়ে পরো আমি এখানে আছি৷ আর ভয় পাবে না।”
বিন্দু সঙ্গে সঙ্গে শিশিরকে ছেড়ে দিলো। কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে বিন্দুর। একটু তো সান্ত্বনাও দিতে পারতো। এতটা কঠিন হৃদয়ের কেউ কী করে হয়৷ তার শিহাব তো একদম ব্যাতিক্রম। শিহাবের কথা মনে পরতেই মুখে ওড়না চেপে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। শিশির নির্বাক হয়ে বিন্দুর কান্না দেখছে। না কিছু বলছে না সরে আসছে সেখান থেকে। হঠাৎ শিশির বিন্দুর হাতটা ধরলো। ওমনি ঝটকা দিয়ে ফেলে দিলো। শিশির কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
–প্লিজ কান্না থামাও। ”
–নাহ্ থামাবো না। কেন থামাবো? যত ইচ্ছা কাঁদবো আমি৷ আপনি এখান থেকে চলে যান।”
–শিহাবকে খুব মিস করছো তাই না?”
–আপনাকে কেন বলবো? আপনি এসব বুঝবেন না।”
–না বললে বুঝবো কী করে?”
–বুঝতে হবে না। এখান থেকে যান। মহান হতে চেয়েছিলেন হয়ে গেছেন আর কী?”
শিশির বিন্দুর কাথা শুনে হালকা হাসলো তারপর বললো,
–আচ্ছা এখন শুয়ে পরো।”
তখনি বিন্দু শিশিরে টি-শার্টের কলার ধরে বললো,
–কেন বিয়ে করেছেন আমাকে? খুব অসহ্য লাগে আপনাকে। আমি শিহাবকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি!”
বলতে বলতেই আবার কাঁদতে লাগলো। শিশির বেশ মিহি গলায় বললো,
–যে নেই তার প্রতি মায়া বাড়িয়ে কোনো লাভ আছে বিন্দু? এতে তো তোমার নিজেরই কষ্টই বাড়বে। ভুলে যাও না সবকিছু।”
বিন্দু মুখ ঝামটা দিয়ে বললো,
–আপনি এসবের কিছুই বুঝবেন না৷ কত সহজে ভুলে যেতে বললেন। অবশ্য আপনি এসব সম্পর্কের মানে কী বুঝবেন! কখনো জড়িয়েছেন এসব সম্পর্কে! সবার সবকিছু বুঝার মতো ক্ষমতা নেই৷ যেমন আপনার। তাইতো খুব সহজেই বলে ফেললেন সব ভুলে যেতে।”
শিশির গম্ভীর স্বরে বললো,
–বিন্দু এটা যে বিধাতার নির্ধারিত নিয়ম। পৃথিবীতে নতুন কেউ আসবে আবার পুরাতন কেউ চলে যাবে৷ আর এটাই হয়। আর বাকি রইলো সম্পর্ক। বিন্দু সম্পর্ক অনেক রকম হয়। বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক, ভাই-বোনের সম্পর্ক, পাড়া-প্রতিবেশির সাথে সম্পর্ক, বন্ধুর সাথে সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। প্রত্যেকটা সম্পর্কতেই আমরা একে-অপরের সাথে পবিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ। সেখানে একজনের জন্য বাকি সম্পর্কগুলো নষ্ট করা নেহাতই বোকামি ছাড়া আর কিছু না। প্রতিটা সম্পর্ককেই সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত।”
বিন্দু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
–বাহ্ স্বামী হয়ে গিয়েছেন তাই সুন্দরভাবেই এসব সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন। তাই না?”
–নাহ্ বিন্দু। আমি চাইলে প্রথম রাতেই সম্পর্কের দোহাই দিয়ে তোমার কাছে অনেক কিছু চাইতে পারতাম। কিন্তু আমার তো এমন কিছু চাওয়া নেই বিন্দু। আমার চাওয়া তোমার মনে আমার জন্য একটুখানি জায়গা করে নেওয়া। জানি এই কথাগুলোও খুব হাস্যকর মনে হবে তোমার কাছে। কিন্তু এটাই সত্য।”
বিন্দু কিছু বলতে চাইছিল। শিশির থামিয়ে দিয়ে বললো,
–শুয়ে পরো। আবার সেহরী খেতে উঠতে হবে। আমি এখানেই আছি৷ ভয়ের কিছু নেই। আর কাঁথা লাগবে তোমার?”
বিন্দু মাথা দু’দিকে দুলিয়ে না বললো। শিশির বিছানা ছেড়ে এসে ব্যালকনি থেকে চেয়ারটা নিয়ে এসে খাটের পাশে বসে রইলো। বিন্দু কিছুটা অবাক হলো শিশিরের কাজে। কেন শিশির বিন্দুর সাথে এক বিছানায় ঘুমায় না। হঠাৎ কী করে এতটা চেঞ্জ হয়ে গেল শিশির!

চলবে,,,,,

#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ২৪

কাল ঈদ অথচ কোনো আনন্দই হচ্ছে না বিন্দুর৷ একটা ঘূর্ণিঝড় হুট করে এসেই বিন্দুর জীবনের সব রঙগুলো উড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে। প্রতিবছর ঈদের আগের দিন রাতে দু’হাত ভর্তি করে মেহেদী পরতো বিন্দু। দিনগুলো কতই না সুন্দর ছিল। কে জানতে এইবার ঈদ আসার আগেই জীবনের সব রঙ ধুয়ে-মুছে যাবে। হারিয়ে যাবে সেই সুখের দিনগুলি। কত ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন বুনেছিলো হৃদয় নামক ছোট্ট ঘরটায়। আজ সেখানে কোনো স্বপ্ন নেই। আছে একবুক শূন্যতা। স্বপ্ন দেখা মানুষটাই তো তার জীবনে নেই তাহলে কাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনবে?
অনেকক্ষণ এলোমেলো চুলে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। আর একাগ্রচিত্তে পরিমাপ করে চলেছে জীবনের পাওয়া-না পওয়ার দাঁড়িপাল্লা। কে বুঝতো এত সহজেই জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাওয়াগুলো না পওয়াতে পরিণত হবে। চোখ জোড়া কখন যে জলের স্রোতে ভিজে উঠেছে একদম টের পেলো না বিন্দু। হঠাৎ রিদির ডাকে ভাবনা ছেড়ে বাস্তবে পদার্পণ করলো। বাঁ’হাতের উল্টো পিঠে বেখেয়ালি ভাবে মুছে নিলে চোখ থেকে ঝড়ে পরা অশ্রু কণাগুলো। তারপর চোখে – মুখে একটু ম্লান হাসি ঝুলিয়ে রিদির দিকে ফিরে বললো,
–কিছু বলবে?”
–এখানে এসো। তোমাকে মেহেদী পরিয়ে দেই।”
–না তুমি দেও। আমার ভালো লাগছে না।”
–তা বললে তো হবে না। নতুন বউয়ের হাতে মেহেদীর রঙ লাগবে না এটা কী করে হয়?”
রিদির জোড়াজুড়িতে অগত্যা বাধ্য মেয়ের মতো এসে খাটের ওপর বসলো। রিদি অনেক সুন্দর করে দু’হাত ভর্তি করে মেহেদী লাগিয়ে দিলো বিন্দুকে। হঠাৎ হাতের দিকে নজর পরতেই নিশব্দে ভেতরটা হু হু করে উঠলো। হাতের তালুর মাঝ বরাবর ‘ S ‘ লেখা দেখেই মনের ভেতরের সুপ্ত ঝড়টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। নিজের চোখের জল আড়াল করার জন্য বিন্দু কোনোরকম বললো,
–রিদি আমি একটু আসছি।”
কথাটা কোনরকম শেষ করেই দৌড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। সেই সাথে বস্ত হয়ে পরলো চোখের পানি মুছতে৷ নিশব্দের কান্নাটা ফুঁপিয়ে উঠতে চাইছে। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না বিন্দু। ঠিক সেই সময় আগমন ঘটলো শিশিরের। রিদিকে মেহেদী নিয়ে খাটের ওপর বসে থাকতে দেখে শিশির বলে উঠলো,
–বিন্দু কোথায়?”
–ব্যালকনির দিকে গেল।”
–মেহেদী পরানো শেষ হয়েছে?”
–আর অল্প বাকি।”
–আর পরানো লাগবে না। এবার তুই গিয়ে পরে নে।”
–ভাইয়া ভাবির হাতে তোর নামের ইংরেজি প্রথম অক্ষর এঁকে দিয়েছি।”
–ওহ্।”
রিদি আর কিছু না বলে চলে গেল। শিশিরের আর বুঝতে বাকি রইলো না। দ্রুত পায়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। বিন্দু অস্থির হয়ে চোখের পানি মোছার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু দু’হাতে মেহেদী থাকার কারণে মুছতে পারছে না। শিশির এগিয়ে গিয়ে বিন্দুকে নিজের দিকে ফেরালো। নিজের হাতে মুছে দিলো বিন্দুর চোখের পানি। কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বিন্দু শিশিরের দিকে। শিশির আলতো করে বিন্দুর নাকটা টেনে দিয়ে বললো,
–এতটা অবাক হওয়ার মতো কিছু হয়নি। এত চোখের জল আসে কোত্থেকে হু? আমি তো চাইলেও কাঁদতে পারি না।”
–আপনি কেন কাঁদবেন? আপনার তো কোনো প্রিয় মানুষ হারিয়ে যায়নি।”
–কিন্তু আমার প্রিয় মানুষটা যে কষ্ট পাচ্ছে সেটাও তো আমি সহ্য করতে পারছি না।”
–আপনার প্রিয় মানুষ আবার কে?”
শিশির একটু হালকা হেসে বললো,
–কেউ না। একটু মায়ের রুমে এসো তো। মায়ের জন্য একটা শাড়ি এনেছি আর একটা তোমার জন্য। দেখো তো কেমন হয়েছে।”
–বিয়েতে তো এত গুলো শাড়ি দিলেন। আবার কী দরকার ছিল।”
–সেগুলো তো ঈদ উপলক্ষ্যে দেইনি। এখন এসো।”

শিশির বিন্দুর জন্য গাঢ় ফিরোজা কালারের মধ্যে কালো সুতার কাজ করা একটা শাড়ি এনেছে। সবারই শাড়িটা ভিষণ পছন্দ হয়েছে। শিরিনা বেগম বিন্দুকে বললো,
–বিন্দু দেখ তো শাড়িটা কেমন হয়েছে?”
–অনেক সুন্দর হয়েছে মা।”
–কালকে এইটা পরবি। খুব মিষ্টি লাগবে তোকে দেখতে। আর এমনিতেও কালকে অনেকজন আসবে দেখতে। কাল একদম অগোছালো থাকবি না৷ একটু সাজুগুজু করবি। বাড়ির মেয়ে-বউরা এলোমেলো থাকলে দেখতেও ভালো লাগে না।”
বিন্দু মাথা নেড়ে সায় দিলো। শিরিনা খুব সহজেই বিন্দুকে আপন করে নিয়েছেন। রিদির মতো বিন্দুকেও তুই করে বলেন। বিন্দুর এই বিষয়গুলো অনেক ভালো লাগে। কত সহজেই সবাই কী সুন্দর তাকে আপন করে নিয়েছে। তবে মাঝে মাঝে বুক ফেটে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সত্যিই তো বিন্দু এসব একদম ডিজার্ভ করে না।
–বিন্দু, বিধু কল করেছে কথা বলো।”(শিশির)
–হ্যালো বিধু।”
–কিরে কেমন আছিস। সবাইকে পেয়ে তো আমাকে ভুলেই গেছিস।”
–আরেহ পাগলী ভুলিনি। মা-বাবা কেমন আছে?”
–কল করলাম আমি আর জিজ্ঞেস করছিস মা -বাবার কথা। বাহ্!বেশ ভালোই। ভালোই আছে তোর মা-বাবা।”
বিধুর পাকাপাকা কথা শুনে বিন্দু হেসে ফেললো।
–তা আমার ঝগড়ুটে বোনটা কেমন আছে?”বলেই মুখ টিপে হাসছে। পাশ থেকে শিশির বলে উঠলো। আমার বোন কিন্তু মোটেও ঝগড়ুটে নয়। এরপর শিশির ফোন নিয়ে বিধুর সাথে ঠাট্টা-মশকরা শুরু করে দিলো।

আজও রাতে শিশির চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিলো। মনে মনে বিন্দুর অনেক প্রশ্ন জমা থাকলেও তার একটাও জিজ্ঞেস করলো না। চুপচাপ নিজের মতো শুয়ে পরলো। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পরলো বিন্দু। শিশির তখনও চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বিন্দু ভেবে পায় না শিশির কেন এভাবে কষ্ট করে ঘুমায়। নাকি শিশিরের ঘেন্না লাগে বিন্দুর পাশে ঘুমাতে? তাহলে প্রথম দুইদিন এভাবে ঘুমিয়েছিল কেন? তখনও তো শিশির সব কিছুই জানতো। এসব ভাবতে ভাবতেই অনেকক্ষণ শিশিরের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কেমন যেন একটা মায়া কাজ করছে বিন্দুর ভেতরে। এভাবে কষ্ট করে ঘুমায় সারাট রাত সত্যিই বিন্দুর খুব খারাপ লাগছে। অন্যদিকে এ নিয়ে যে শিশিরকে প্রশ্ন করবে তাও মন টানছে না। সব মিলিয়ে একটা অস্বস্তিতে আছে বিন্দু। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেল সকাল সকালই গোসল সেরে নতুন শাড়ি পরে বেরিয়ে আসলো। ততক্ষণে শিশরেরও ঘুম ভেঙে গেছে। বিন্দুকে দেখেই বিষম খাওয়ার মতো পরিস্থিতি শিশিরের। ফিরোজা রঙের শাড়িতে বিন্দুকে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে একটা পবিত্র ফুল। কিছুতেই চোখের দৃষ্টি সংবরণ করতে পারছে না শিশির। এক অজনা শক্তি শিশিরকে চুম্বকের মতো টানছে বিন্দুর দিকে। বিন্দু খানিকটা লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে সরে ব্যালকনিতে চলে গেল। টাওয়ালে চুল মুছতে মুছতে নিজেকেই বকা দিতে লাগলো। কী দরকার ছিল সকাল সকালই শাড়িটা পরার! যার কারণে এখন লজ্জায় পরতে হয়েছে৷ শিশিরও বুঝতে পেরে ওয়াশরুমে চলে গেল। সারা দিনের মধ্যে শিশির -বিন্দু কেউই কারো মুখোমুখি হয়নি। একরকম দু’জনেই পালিয়ে পালিয়ে ছিলো দু’জনের থেকে। বিকেল বেলা বিন্দু ছাঁদে উঠেছিল ফুল গাছগুলোতে পানি দিতে। শিশির জানতো না বিন্দুও ছাঁদে আছে। কারো সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল। বিন্দু বেখেয়ালি ভাবে সিঁড়ি দিয়ে নামছে হঠাৎই শিশিরের সাথে ধাক্কা খেয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নিচে পরে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় শিশির পুরো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দু চিৎকার দিয়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। শিশির দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলো। অনেকখানি মাথা ফেটে গেছে। রক্তে শিশিরের টিশার্ট অনেকখানি ভিজে গেছে। শিশির চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে। যদি বেবিটার কিছু হয়ে যায় শিশির কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। অস্থির হয়ে প্যান্টের পকেট থেকে রুমালটা বের করে বিন্দুর মাথাটা বেঁধে দিলো। শিরিনা বেগম এসেই চিৎকার করে বললেন,
–কিভাবে হলো এসব? এই বিন্দু মা চোখ খোল।”
–মা অস্থির হয়ো না। ভাইয়া তুই তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে চল ভাবিকে। মাথায় তো ভালোই আঘাত পেয়েছে।”
–কিন্তু এমন অঘটন ঘটলো কী করে?”
–মা আমি বুঝতে পারিনি৷ ফোনে কথা বলছিলাম তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেছি আর ওমনি বিন্দুর সাথে ধাক্কা লাগে। আর ও টাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে গেছে।”
–এতটা বেখেয়ালি হয়ে কেউ হাঁটে? ইশ এই ঈদের দিনই মেয়েটার কী অবস্থা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি এখন ওরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা। কতখানি রক্ত বের হয়ে গেছে।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here