#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrunNesa Ripa
#পর্বঃ২১
হঠাৎই বিন্দুর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম চোখেই তাকালো সামনের মানুষটার দিকে। শিশির একদম নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। বিন্দু আস্তে করে শিশিরের হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করলো। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে! এত কষ্ট হচ্ছে যে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আজ এভাবে শিহাবের বাহুডোরে তো থাকার কথা ছিল না তার তাহলে বিধাতা কেন এমন করলো? কেন এই অবেলায় শিহাবকে তার থেকে কেড়ে নিলো। মাঝে মাঝে আল্লাহকে এ নিয়ে কত প্রশ্ন করে নামাজের পাটিতে বসে কিন্তু এসব প্রশ্নের কোনো উত্তরই মিলে না। কয়টা বাজে বিন্দু যানে না। সবাই এমন তাড়া দিচ্ছিলো আসার সময় ফোনটাও নেওয়া হয়নি৷ বিন্দু শিশিরকে অনেকবার ডাকলো কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বিন্দুর সেবা করতে করতে অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে। বিন্দু কোনো উপায় না দেখেই শিশির কাঁধে হাত দিয়ে হালকা ধাক্কা দিতেই ঘুম ভাঙলো শিশিরের। বিচলিত হয়ে উঠে বসলো। বিন্দুর দিকে তাকিয়ে বললো,
–আবারও কষ্ট হচ্ছে? ”
–নাহ্। দেখুন তো কয়টা বাজে। সেহরী খাওয়ার টাইম হয়েছে মনে হয়।”
শিশির পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে দেখলো তিনটা বাজে। আর ঘুমানো চলবে না। সবাইকে জাগিয়ে দিলো শিশির। মেহমানরা রাতেই চলে গিয়েছে। আবার কেউ কেউ থেকেও গেছে। সবাই একসাথে বসে সেহরী খেল। কিন্তু বিন্দু তেমন কিছুই খেতে পারলো না। যা খেয়েছে তাও বমি করে ফেলে দিয়েছে।
–এভাবে রোজা রাখবা কী করে? কিছুই তো পেটে নেই।”
–আমি পারবো৷”
–ঘোড়ার ডিম পারবা। রোজা রাখা লাগবে না”
–উঁহু আমি রাখবোই।”
শিশিরও আর বেশি জোর করতে পারলো না। কারণ পূর্ণ বয়স্ক কেউ স্ব-ইচ্ছায় রোজা রাখতে চাইলে যে তাকে মানা করবে তারও পাপ হবে। অন্যদিকে আযান দিতেও আর বেশি সময় নেই। শিশির তাড়াতাড়ি একটা কলা আর দুধ দিয়ে ভাত মাখিয়ে নিয়ে রুমে ডুকলো।
–চুপচাপ কোনো কথা না বলে খেয়ে নাও।”
–উফ এত জোড় করছেন কেন?”
–ইচ্ছে তাই। ”
বিন্দুকে আর কোনো সুযোগ না দিয়েই এক চামচ ভাত বিন্দুর মুখের সামনে ধরলো। অনিচ্ছা স্বত্বেও ভাতগুলো খেয়ে নিলো। এরপর দু’জনে নামাজ আদায় করে শুয়ে পরলো। আগের মতোই এক হাত বরাবর ফাঁকা করে দু’জনে শুয়ে আছে।
–বিন্দু। ”
–হু।”
–এমন না খেলে হবে না। এই সময় বেশি বেশি খেতে হয় না হলে তো আমাদের বাচ্চাটা একদম পুষ্টি পাবে না। রোগা-পাতলা হবে।”
শিশিরের কথা শুনেই বিন্দু শিশিরের মুখের দিকে তাকালো। বিন্দুর এভাবে তাকানো দেখে শিশিরও তাকালো। চোখের ঈশারায় বিন্দুকে প্রশ্ন করলো,
–কী হয়েছে?”
বিন্দু মাথা নাড়িয়ে কিছু না বললো। বিন্দু ভেবে পাচ্ছে না শিশির এত সহজে কী করে অন্যের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা বলছে.। বিন্দুর কেমন যেন রহস্যময় মনে হয় শিশিরকে। আজকালকার দিনেও কী এমন ছেলে আছে যে একটা প্রেগন্যান্ট মেয়েকে বিয়ে করবে? কেউই করবে না। তাহলে শিশির কেন করলো? এর মধ্যে কী কোনো রহস্য আছে? নাকি সব বিন্দুদের সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার কু-মতলব। হতেই পারে এমনটা৷ আজকাল পত্রিকায় -টিভি চ্যানেলে এসব অহরহ ঘটে। এই ছেলেকে একদম বিশ্বাস করা যায় না। নিশ্চয়ই কোনো কু-মতলবে এই বিয়েটা করেছে। এখন বিন্দুর রাগ হচ্ছে বাবা-মায়ের প্রতি আর কোনো ছেলে পেল না তারা এর সাথেই ধরে-বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিলো। অবশ্য তাদেরই বা দোষ কিসের? এই পরিস্থিতিতে তাদেরও তো মাথা ঠিক নেই। শিশিরের ডাকে চিন্তায় ছেদ পরলো বিন্দুর।
–হু। ”
–কী এত ভাবছো হ্যাঁ? সে কখন থেকে ডাকছি।”
–কিছু না।”
শিশির হঠাৎই বিন্দুকে জড়িয়ে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে বিন্দু শিশিরকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো।
–কী হয়েছে? এভাবে উঠে বসেছো কেন?”
–আমার ভাল্লাগছেনা। ”
কথাটা বলতে গিয়ে যে বিন্দুর গলা কাঁপছিল সেটা শিশির ঠিকই টের পেল। আর শিশির ইচ্ছে করেই কাজটা করেছে৷ কারণ বিন্দু সারাক্ষণ মন খারাপ থাকুক এই পরিস্থিতিতে এটা শিশির চায় না৷ যে করেই হোক শিশিরকে বিন্দুর কাছাকাছি আসতেই হবে। সমস্ত অতীত ভুলিয়ে দিয়ে একটা নতুন জীবন বিন্দুকে ফিরিয়ে দেওয়াই হচ্ছে শিশিরের একমাত্র লক্ষ্য। অনেক তো কষ্ট পেয়ছে বিন্দু শিশির চায় না আর বিন্দু কোনোভাবে কষ্ট পাক। শিশির উঠে বসে বিন্দুর কাঁধে মাথা রাখলো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরতেই বিন্দুর শিরা-উপশিরা কেঁপে উঠলো। হাতের মুঠো শক্ত করে চোখ বন্ধ করে রেখে অশান্ত গলায় বললো,
–উফ রোজার মধ্যে কী শুরু করলেন?”
শিশির হালকা হেসে বললো,
–প্রেম শুরু করেছি।”
বিন্দু শিশিরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
–রোজার সময় এসব ঠিক না। ঘুমিয়ে পরুন।” শিশির হেসে শুয়ে পরলো। বিন্দু তখনো বসে আছে দেখে শিশির একটানে বিন্দুকে শুয়ে দিলো। তারপর আবার নিজের বাহুতে বন্দী করে নিলো৷ কেন যেন শিশিরের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারছে না বিন্দু। কিন্তু কেন পারছে না? তার তো উচিত শিশিরকে কড়া কড়া কয়েক কথা শুনিয়ে দেওয়া। এমন জোরজবরদস্তিই বা শিশির কেন করবে? জানে না বিন্দু অন্য কাউকে ভালোবাসে যেখানে শিশিরের কোনো অস্তিত্বই নেই!
সকালে আটটায় শিশিরের ক্লাস আর রিদিরও আটটায় প্রাইভেট। শিশিরের স্কুলে যাওয়ার পথেই রিদির টিচারের বাসা। তাই শিয়ির সবসময় রিদিকে নিজের সাথে নিয়ে যায়।শিশির রেডি হয়ে রিদিকে ডাকতেই রিদি রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো।
–ভাইয়া আজ না গেলে হয় না?”
–না হয় না। আগে পড়ালেখা পরে বাকি সব।”
রিদি আর কোনো কথা না বলে ভাইয়ের সাথে রেডি হয়ে বেরিয়ে পরলো। তখনো সবাই ঘুমিয়ে আছে। শিশির বাইক চালাতে চালাতে বললো,
–রিদি কিছু কথা বলি তোকে।”
–বল?”
–বিন্দু তো এখন এ বাড়িতে নতুন। হয়তো কাজ-টাজও তেমন করতে পারবে না। বা মাঝে মাঝে লেট করে ঘুম থেকে উঠতে পারে(কারণ প্রেগন্যান্সিরর সময় স্বাস্থ্য সবসময়ই খারাপ থাকে) এসব নিয়ে হয়তো মা দু’য়েক কথা শুনাতে চাইবে। তুই মাকে একটু বুঝিয়ে নিস কেমন? আমি বলতে গেলে মা হয়তো ভাববে আমি বউয়ের সাপোর্ট করছি।”
–আরেহ চিন্তা করো না। আমি আছি না? আমি মাকে বুঝিয়ে বলবো। আর ভাবিরই বা এমন কী বয়স আমার বয়সীই তো। মা বুঝবে চিন্তা করো না।”
–হুম।”
এরপর শিশির রিদিকে টিউশনির জায়গায় নামিয়ে দিয়ে স্কুলে চলে গেল। রিদি মনে মনে ভাবছে তার ভাইটা বউকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। ভেবেই আনমনে হেসে ফেললো। আচ্ছা তার বরটাও কী তাকে এভাবে ভালোবাসবে? ভাবির মত কী এমন সৌভাগ্য তার কাপালেও জুটবে?”
সকাল আটটা বাজতেই ঘুম ভেঙে গেল বিন্দুর। পাশ ফিরেই দেখলো শিশির নেই৷ নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো কামিজটা অনেকখানি উপরে উঠে পেটের এক অংশ দেখে যাচ্ছে। নিজে নিজেই ভিষণ লজ্জা পেল। ভাগ্যিস শিশির নেই তাহলে আরও বেশি লজ্জায় পরতে হতো। বিছানা ছেড়ে উঠে সকাল সকালই গোসলটা সেরে নিলো। রাতে আবার সাজেদা বেগম ফোন করে বলেছে নতুন কয়েকদিন নাকি শ্বশুরবাড়ি শাড়ি পরতে হয় এ নিয়েও নাকি অনেকে কথা শুনায় আত্মীয়রা। কিন্তু বিন্দু ভেবে পায় না এটাও কী কথা শোনানোর মতো কোনো বড় কারণ! কিন্তু কী আর কার অনিচ্ছা স্বত্বেও একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। শাওয়ার শেষে শাড়ি পরে রুমে আসলো। এখনো কী এই ফুল-টুল থাকবে? নাকি এগুলো ফেলে দিয়ে বিছানাটা ঝেড়ে-ঝুড়ে রাখবে। ভাবনার মাঝেই দরজায় কেউ নক করলো। বিন্দু দরজা খুলতেই দেখলো শিরিনা বেগম।
–যাক ভালোই করেছো শাড়িটা পরেছো। না হলে আমিই বলতাম। চলো কয়েকজন এসেছে তোমাকে দেখবে। আর শোনো কানের গলার গয়নাগুলো কোথায়?”
–বিছানায় রেখেছি মা।”
–এসব এভাবে ছড়িয়ে রেখো না। এখনি পরে নাও। কতজন আসবে দেখতে।”
বিন্দু গয়নাগুলো পরে নিলো। এরপর শাশুড়িকে অনুসরণ করে রুম থেকে বের হলো। চার-পাঁচজন মহিলাকে দেখে বিন্দু সালাম দিলো।
–শিরিনা আফা আপনের ছেলের পছন্দ আছে বলতে হয়৷ কই পাইলো এই মাইয়্যা আমরা খুঁজতে গেলেই পাই না। আমার ভাই শিহাবের জন্য কত করে একটা মেয়ে খুঁজলাম কিন্তু পাইলামই না।”
কথাটা শুনেই বিন্দু হকচকিয়ে মহিলার দিকে তাকালো পরক্ষণেই মাথা নামিয়ে নিলো। শিহাব নামের তো আরও কেউ থাকতেই পারে। কিন্তু বিন্দু যে শিহাব নামে শুধু তার শিহাবকেই চিনে। বউ দেখা শেষে সবাই চলে যেতে শিরিনা বেগম পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে -ফিরিয়ে দেখালেন বিন্দুকে। এক তলার একটা সুন্দর বাড়ি। বিন্দুর বাড়িটা ভিষণ পছন্দ হয়েছে। শিরিনা বেগম ছাঁদেও নিয়ে গেছেন। ছাঁদে কত রকমের ফুল দেখেই অণ্যরকম ভালো লাগলো বিন্দুর কাছে।
–জানো বউমা এগুলো সব রিদি আর শিশিরের কাজ। দুইটায় ফুল পছন্দ করে। শিশিরের কাজ ফুল গাছে এনে দেওয়া। আর বিন্দুর কাজ এগুলোর পরিচর্যা করা। দিনের বেশিরভাগ সময় বিন্দু এগুলোতেই ব্যয় করে। শিরিনা বেগমের সাথে ঘুরে-ফিরে কথা বলতে বেশ ভালোই লাগছে বিন্দুর। অনেকদিন পর যেন একটু প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে পারছে। এতদিন দমটা যেন বন্ধ হয়ে ছিল।
শিশিরকে বিয়ের পরেরদিন স্কুলে দেখে সবাই ঠাট্টা-মশকরা শুরু করে দিয়েছে। শিশিরও তাদের সাথে সমানে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে। তাদের স্কুলের এক সমবয়সী টিচার বললেন,
–কী শিশির সাহেব সব ঠিক আছে তো?”
শিশির হেসে জাবাব দিলো,
–বেঠিক থাকবে কেন?”
–এই যে আপনি বিয়ের পরেরদিনই স্কুলে ক্লাস করতে চলে এসেছেন। আমি তো নিম্নে দশদিন ছুটি কাটাতাম।”
–ভাই আমার পোড়া কপাল রমজান মাসতো তাই বইয়ের থেকে দূরে থাকাই ভালো।”
শিশিরের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে ফেললো। ক্লাস শেষে বাড়ির পথে আসতে গিয়েও বাইক ঘুরিয়ে নিলো শিশির একটাবার শিহাবদের বাড়িতে যাওয়া দরকার। সেখানকার কী অবস্থা আর তো জানা হয়নি। শিশির শিহাবদের বাসায় গিয়ে কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দিলেন সাহেলা বেগম।”
–আসসালামু আলাইকুম। ”
–ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো? ”
–আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”
–আল্লাহ ভালো রাখছে।
এরপর শিশিরকে ঘরে ভেতর নিয়ে এসে বসালেন সাহেলা বেগম।
–আমি দুঃখিত শিশির। তোমার মা এসেছিল তোমার বিয়ের কথা বলে গেছে। কিন্তু আমর শরীরটা এত খারাপ ছিল যে যেতে পারিনি। কিছু মনে করো না বাবা।”
–না আন্টি কী মনে করবো।”
–আন্টি শিহাবের কী অবস্থা? ওর সাথে কথা হয় আপনার?(শিশির ইচ্ছে করেই জানতে চাইলো সাহেলা বেগম সত্যিটা জানে কি না জানার জন্য)
–আর বলো না। সেই রোজার পহেলা দিকে কথা হয়েছিল। তারপর আর কথা হয়নি ছেলেটার সাথে। তোমার আংকেলকে যখনই বলি শিহাবের সাথে একটু কথা বলবো, তখনই বলে শিহাব ব্যস্ত। এত কী ব্যস্ততা যে একটু পাঁচ মিনিট কথা বলার মতো সময় হয় না ওর৷ খুব মনে পরতাছে ছেলেটাকে। এর মধ্যে একদিন রেগে গেছিলাম তোমার আংকেলের সাথে তখন তোমার আংকেল বললো,
“আমি অসুস্থ তাছাড়া ওনার পার্টনারও নাকি অসুস্থ তাই সব কিছু ওকে একা সামলাতে হচ্ছে ”
আর এসব নিয়েই ওর ব্যস্ততা।”
শিশির সব শুনে চুপ করে রইলো। সত্যটা আর কতদিন আড়াল করে রাখবে শিহাবের বাবা? একদিন তো সব সত্য জানাতেই হবে।
চলবে,,,,,,