শ্রেয়সী পর্ব ১১

0
374

#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ১১

সকালে ঘুম থেকে উঠেই দুই পারা কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করলো বিন্দু। আর নিজের মনকে পড়ায় মনোনিবেশ করাতে পারছে না। বুকটা প্রচণ্ড খালি খালি লাগছে। বারবার প্রিয়জনকে হারানের ভয়টা এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। আজ বাদে কালই শিহাবের ফ্লাইট। দেখতে দেখতে চোখের পলকে কীভাবে যে দিনগুলো চলে গেল বুঝতেই পারলো না বিন্দু। সকাল থেকেই মনভার করে রেখেছে। কাল চলে যাবে প্রিয় মানুষটা। পাঁচটা বছর তাকে সামনা-সামনি দেখতে পারবে না। যদিও এখনকার যুগে ভিডিও কলে কথা বলা যায়। তবুও সামনে বসে কথা বলার মধ্যে একটা আলাদা অনুভূতি রয়েছে। অসম্ভব এক ভালো লাগা কাজ করে। কিন্তু আজ যদি একবার না দেখা করতে পারে তাহলে যে বিন্দু পাগল হয়ে যাবে। ওদিকে সাজেদা বেগমের থেকে আধেও বাড়ির বাহিরে বের হওয়ার পারমিশন পাবে কি না জানা নেই বিন্দুর। মনটাকে নানা রকম বুঝ দিয়ে কোনোরকম স্থির করে এগুলো সাজেদা বেগমের রুমে।

সাজেদা বেগম নামাজের চৌকিতে বসেই কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। কী করে যে মাকে মিথ্যে বলবে ভেবে পাচ্ছে না বিন্দু। একদম মিথ্যে বলার জন্য মন সায় দিচ্ছে না। অন্যদিকে নিজের মনকেও বুঝিয়ে-সুজিয়ে রাখতে অপারগ সে। আস্তে আস্তে পা ফেলে এগিয়ে গেল সাজেদা বেগমের কাছে৷ মৃদু গলায় ডাকলো,
–মা?”
–কিছু বলবি?”
–একটা দরকারে কলেজে যাওয়ার দরকার ছিল।”
–কী দরকার? রোজার-রমজানের দিনে এত জার্নি করে কলেজে যেয়ে কোনো কাজ নেই। যেই গরম পরতাছে পুরা গলা শুকিয়ে যাবে। যা কাজ ঈদের পরে করিস।”
প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে বিন্দুর। এক টুকরো আশার আলো দেখেছিল সেটাও বুঝি দমকা হাওয়া এসে নিভিয়ে দিলো। বিন্দু আরও কোমল কণ্ঠে বললো,
–মা প্লিজ না করো না। একবার যাই। আমার এক ফ্রেন্ড আজ কলেজে থেকে ট্রান্সফার হয়ে ঢাকা চলে যাচ্ছে। আজ না গেলে ওকে আর দেখতে পারবো না।”
সাজেদা বেগম কোরআন তেলাওয়াতের ফাঁকে একবার বিন্দুর দিকে তাকালেন। বিন্দুর আকুতি পূর্ণ চাহনি তিনি আর অগ্রাহ্য করতে পারলেন না।
–যা তাহলে। বেশি লেট করবি না। তাড়াতাড়ি চলে আসবি।”
ঠোঁটের কোণে প্রশস্ত হাসি ফুটিয়ে বললো,
–আমি তাড়াতাড়িই চলে আসবো।”

সেই কখন থেকেই কলেজ ক্যাম্পাসে অপেক্ষা করছে শিহাব৷ এখন রেস্টুরেন্টে গিয়ে মিট করাটা মোটেও শোভনীয় নয়। যে কেউই বাজে টিচ করতে দু’বার ভাববে না। তার চেয়ে কলেজে মিট করাটাই বেটার। আর এমনিতেও এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র শিহাব সেই হিসেবে আলাদা একটা পাওয়ারও আছে তার। কলেজের অনেকের সাথেই বেশ ভালো জানাশুনা রয়েছে। বিন্দু অটো থেকে নামতেই দেখলো শিহাব কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনে কথা বলতে বলতে কলেজের একটা নিরিবিলি জায়গায় চলে গেল। যেখানে কেউই নেই ওদের বিরক্ত করার মতো।
–শিহাব তুমি আন্টিকে আরও একটু যদি ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে। এখনও সময় আছে।”
–তোমার কী মনে হয় আমি বলিনি? মাকে অনেক করে বলেছি কিন্তু মা কিছুতেই চাইছে না এখন বিয়েটা হোক। ”
–তুমি বলেছিলে, তুমি একজনকে ভালোবাসো?”
–হ্যাঁ, তোমার কথা বলেছি। কিন্তু মা কিছুতেই রাজী হলো না। বললো যা হওয়ার একেবারে তুই বিদেশ থেকে আসলেই হবে।”

শিহাবের থেকে আজ কিছুতেই দূরে যেতে মন চাইছে না বিন্দুর। ওদিকে সাজেদা বেগমও বারবার ফোনে কল করে যাচ্ছেন। শিহাবের থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বে শিহাবকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে ছিল বিন্দু।

বাড়িতে আসতেই কয়েক দফা কথা শুনিয়ে দিলেন সাজেদা বেগম। এতবার ফোন করার পরেও কেন ও ফোন রিসিভ করলো না এজন্য। এমনিতেই মনটা প্রচন্ড খারাপ তার ওপর মায়ের বকুনি খেয়ে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল বিন্দুর। সহ্য করতে না পেরে রুমি গিয়ে দরজা লক করে কাঁদতে লাগলো।

প্রিন্সিপাল স্যারের ওপর প্রচণ্ড মেজাজ গরম হচ্ছে শিশিরের। আজ মাসের তের তারিখ অথচ গত মাসের স্যালারী এখনো দেয়নি। রোজার বাজারও তেমন করা হয়নি। হাত-খরচাও তো লাগে। বাড়তি তো আর তেমন কোনো ইনকাম নেই। কাজের বেলার নিজেরটা ষোলো আনাই বুঝেন তিনি। কাজ করিয়ে নেওয়ার বেলার বিন্দু পরিমাণও ক্লান্তি নেই ওনার। সেই কখন থেকে বসে আছে অথচ এখনো বেতনের টাকাটা দেওয়ার নামই নিচ্ছে না। একে তো রোজা তার ওপর প্রচন্ড গরম। এই মুহূর্তে যেন আগুনের কুন্ডলীর মধ্যে বসে আছে শিশির। পুরো শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। কপালের জমে থাকা ঘাম একটু বাদে বাদেই টিস্যু দিয়ে মুছছে।

শিহাব বাড়িতে গিয়েই ফোন করলো বিন্দুর নাম্বারে। কান্নাভেজা কণ্ঠে ফোন রিসিভ করলো বিন্দু।
–এই পাগলী কাঁদছো কেন?”
–এমনি।”
–এমনিতেও কাঁদবে না বলে দিলাম।”
–শিহাব আমি আর পারছি না। তোমার এই দূরত্ব আমার ভেতরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। যন্ত্রণায় ছটফট করে কাটাচ্ছি আমি। আমি মনে হয় মরেই যাব তোমাকে ছাড়া।”
শিহাব স্তব্ধ হয়ে আছে। বিন্দুর এমন পাগলামোগুলো শিহাবকেও দুর্বল করে দিচ্ছে।
–বিন্দু নিজেকে সামলাও। এমন পাগলামো করো না। আমি সেখানে গিয়ে প্রতিদিন তোমার সাথে কথা বলবো। যাতে তোমার না মনে হয় যে আমি খুব দূরে আছি। ”
–সত্যিই বলবে তো?”
–হু। আর একদম কাঁদবে না। তুমি এভাবে কাঁদলে আমি নিজেকে কী করে সামলাবো একবারও ভেবে দেখেছো? তোমার এমন কান্না দেখলে আমার ভেতরটায় কী হয় সেটা আমি তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না।”
বিন্দু একটু ম্লান হেসে বললো,
–আচ্ছা আর কাঁদবো না। আর প্রতিদিন তুমি আমাকে কল করবে। যদি একদিনও লেট হয় তাহলে তোমার একদিন কী আমার একদিন।”
–আচ্ছা। বিন্দু মেম যা বলবে তাই হবে।”

শিশির একগাদা বাজার নিয়ে বাড়িতে পা রাখতেই গলা ফাটিয়ে ডাকতে লাগলো রিদিকে। রিদি দৌড়ে গিয়ে শিশিরের হাত থেকে কিছু বাজারের ব্যাগ নিয়ে নিলো। শিশির আর রিদি সব বাজার নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। শিরিনা বেগম সবেমাত্র কোরআন তেলাওয়াত সেরে পা রাখলেন রান্নাঘরে। শিশির মুখে প্রশস্ত হাসি দিয়ে বললো,
–দেখ মা আজ কতবড় একটা ইলিশ মাছ এনেছি। রিদি ব্যাগ থেকে মাছটা বের করে দেখাতো মাকে?”
রিদি মাছটা দেখাতেই চোখদুটো ছানাবড়া শিরিনা বেগমের। অনেক বড় একটা ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে শিশির৷ ওর বাবাও কখনো এত বড় মাছ কিনেনি। সেদিন কথায় কথায় শিরিনা বেগম বড় মাছের কথা রিদির কাছে বলেছিলেন যে ওনার খুব খেতে ইচ্ছে করছে। সে কথাই হয়তো শিশির কিভাবে যেন শুনেছে। সত্যিই এই ছেলেটা পরেও বটে। কম করে হলেও মাছটার দাম এই বাজারে হাজার টাকার উপরে হবে। শিরিনা বেগমকে চুপ থাকতে দেখে শিশির বললো,
–কী মা, কেমন হয়েছে মাছটা?”
–কী দরকার ছিল এত বড় মাছ কেনার?”
–অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে হচ্ছিল বড় মাছ খাওয়ার কিন্তু বেতনই পাচ্ছিলাম না আজ পেলাম তাই কিনে নিয়ে এলাম।”
এটা যে শিশির মিথ্যা বলছে সেটা বুঝতে খুব সময় লাগলো না শিরিনা বেগমের।
–কিভাবে রান্না করবো বল?”
–তোমার যেভাবে ভালো লাগে ঠিক সেইভাবে রান্না করবা।”
–তোর খেতে মন চেয়েছে আর রান্না করবো আমার মতো এটা কথা হলো?”
–আরেহ তোমার হাতের রান্না খেয়েই তো বুঝেছি রান্নার স্বাদ সম্পর্কে। আর তোমার হাতের সব রান্নাই অমৃত। কী বল রিদি?”
–হ্যাঁ ভাইয়া একদম। মা তুমি তোমার মতোই রান্না করো।”
দুই ভাই-বোনের এই লুকোচুরি খেলা সবটাই বুঝতে পারলেন শিরিনা বেগম। সাথে মনে মনে গর্ববোধ করতে লাগলেন। সত্যিই দুইটা সোনার টুকরো পেয়েছিন তিনি। যা সবার ভাগ্যে জোটে না।

শিহাব আজ বাদে কাল চলে যাবে আজ ছেলের প্রিয় রান্না নিয়ে খুব ব্যস্ত সাহেলা বেগম। অন্যদিকে মনটাও ভিষণ খারাপ। বাড়িটাও একদম ফাঁকা হয়ে যাবে। খালি দু’জন মানুষ এত বড় বাড়িতে থাকবে। কী করে নিজের মনটাকে বোঝাবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। যেদিন থেকে শুনেছেন শিহাব চলে যাবে সেদিন থেকে আড়ালে চোখের জল ফেলছেন সাহেলা বেগম৷ শিহাবের বাবাকেও এত করে বুঝালেন অথচ তাতেও কোনো কিছু হলো না। শিহাবের বাবা খুব শিঘ্রই শিহাবকে বিদেশ যাওয়ার জন্য বলেছেন। কিন্তু কেন এত তাড়াতাড়ি যেতে বললেন সেটাই জানালেন না ওনাকে। সব মিলিয়ে একদম ভালো নেই সাহেলা বেগম। প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছেন তিনি।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here