#শ্রেয়সী
#পর্ব_৩০
#লেখনীতে_নাদিয়া_সিনহা
খাবার টেবিলে বসে নীরবে খাবার খাচ্ছে আদ্রিশী। তার পাশে আদনান শেখও বসে খাবার খাচ্ছে। আদ্রিশী ওষ্ঠদ্বয় উল্টে কাঁদোকাঁদো মুখ করে তাকিয়ে আছে বাবার পানে। আদনান শেখ ভাবলেশহীন খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিচ্ছেন। প্রতিবার খাওয়ার টেবিলে বাবা মেয়ের খুনসুটি হয়। তবে আজ তার ব্যতিক্রম। আদনান শেখ আজ একটু বেশি নীরব। কারণটা আদ্রিশীর অজানা। আদ্রিশী বাবা দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জানার পাশে তাকায়। ছোট একটা বৃক্ষ বেড়ে উঠছে তার পাশে খানি বড় দুটো বৃক্ষ। একটা বৃক্ষ ছাঁয়াতে থাকায় কেমন নিস্তেজ হয়ে হেলে পরেছে। আদ্রিশী এতই মনোযোগ দিয়ে তা দেখছে মনে হচ্ছে যেনো এই বৃক্ষ দিয়ে সে বৈজ্ঞানিক হয়ে যাবে। আদ্রিশী জানার পানে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে বলে,
-“ওয়ালিদের কি হয়েছিলো?”
-“অ/স্ত্র পাচারে ধরা খেয়েছিলো। তারপর সেখানেই বিজিবি ক্রসফায়ারে মে/রে দেয়।”
তড়িৎ গতিতে আদনান শেখের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আদ্রিশী আদনান শেখ নিজের কথা মানে বুঝতেই আদ্রিশীর পানে তাকায়। বৃহৎ আকৃতি চোখ করে আদ্রিশী তার বাবার পানে তাকিয়ে আছে৷ আদ্রিশী চাহনি দেখে আদনান শেখ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে রয়। পরিস্থিতি সমাল দিতে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-“ডিনার ফিনিস। তাড়াতাড়ি ঘুমতে হবে। আদ্রি মা তুমিও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরো।”
আদনান শেখ দুকদম এগোতেই আদ্রিশী বসা থেকে উঠে দৌড়ে আদনান শেখের হাত জড়িয়ে ধরে বলে,
-“ওয়েট ওয়েট কোথায় যাচ্ছো?”
-“কোথায় আবার? ঘুমোতে।”
-“তার আগে বলো তুমি কিভাবে জানো ওয়ালিদকে বিজিবি ক্র’স’ফা’য়া’রে মে’রে ফেলেছে।”
আদনান শেখ কম্পিত গলায় বলে,
-“তা আমি জানব না? ওয়ালিদ তো আমাদের দেশে এমপি।”
-“ওয়ালিদ তাজওয়ার আমাদের দেশে এমপি?”
-“কি শুরু করেছো আদ্রি? ঘুম পাচ্ছে আমার যেতে দাও।”
আদ্রিশী দুকদম পিছিয়ে কোমড়ে হাত চোখ ছোট ছোট করে বলে,
-“হ্যাঁ হ্যাঁ! যাও যাও ঘুমাও। মা নেই বলে আমার সাথে অ’ত্যা’চা’র করছো।”
আদনান শেখ অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ে পানে তাকায়। মেয়ে সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত রেখে বলে,
-“আমার মেয়েটা বড্ড অভিমানী। তোমার মা নেই তো কি হয়েছে আজকে আমি তোমাকে ঘুম পারিয়ে দিব চলো।”
আদ্রিশী খুশীতে লাফিয়ে উঠে। বাবা নিয়ে ঘরে চলে যায় ঘুমাতে। আদনান শেখ মেয়ের এহেন কান্ডে হেসে দেয়। ঘুমানোর আগে কেউ আদ্রিশীর মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে তার ঘুম হয় না। তাই আজ আদনান শেখ তাকে ঘুম পারিয়ে দিবে। আদ্রিশী মাত্র তেরো বছর বয়সী কিশোরী। গ্রিসের একটা স্কুলে মাত্র ক্লাস এইটে পড়ছে। বেশ চঞ্চল প্রকৃতি মেয়ে আদ্রিশী। পড়ার তুলনায় বুদ্ধি তার একটু বেশিই। সব সময় এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি করে। শান্তিতে একটা জায়গায় বসেই না।
আদনান শেখ মেয়ে কে ঘুম পারিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরি রুমে চলে যান। লাইব্রেরিতে গিয়ে ডায়েরিটা নিয়ে টেবিলে বসে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডায়েরির পাতা উল্টায়। আদনান শেখের অক্ষিদ্বয় জলে টইটম্বুর। একে একে ডায়েরির পাতা উল্টে দেখছে আর তাতে হাত বুলাচ্ছে। সযত্নে ডায়েরিটা বন্ধ করে আনমনে বলেন,
-“ভয়ংকর থেকে জ’ঘ’ন্য স্মৃতিগুলো এক সময় ধুলোবালি জমা ডয়েরিতে আবদ্ধ হয়ে কেবল স্মৃতি হয়ে রয়।”
_______________
কোলাহল পূর্ণ এয়ারপোর্টে বসে আছে এক প্রৌঢ় নারী। বেশ অনেক্ক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছে। তবে যাদের আসার কথা। তাদের কোনো খবর নেই। বিরক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে যান তিনি। বাইরে বের হতেই কেউ একজন ছুটে এসে তাকে জাড়িয়ে ধরে। মহিলাটি মুচকি হেসে বলে,
-“মিস করছিলে মা কে?”
-“প্রচুর মিস করছিলাম। জানো বাবা আমাকে রাতে ঘুম পারিয়ে দিয়েছে।”
-“দুষ্টমি করোনি তো বেশি। বাবাকে জ্বালিয়েছো?”
-“একদম না মা। তুমি জানো আমি কত শান্তশিষ্ট ভদ্র বাচ্চা একটা মেয়ে।”
-“জানি আমার আদ্রি গুড গার্ল।”
দুজনই শব্দ করে হেসে দেয়। আদনান শেখের স্ত্রী শোহা শেখ। আর আদ্রিশীর মা। আদ্রিশী তার মাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদনান শেখ দ্রুত এগিয়ে এসে শোহা শেখ কে বলে,
-“আর কত ঘরের বাইরে ঘুরাঘুরি করবে? দয়া ময়া তো একদম নেই। নিজের সুইট হাসবেন্ড কে রেখে এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়াও। বাড়ি চলো জলদি।”
আদনান শেখের কথায় আদ্রিশী এবং শোহা শেখ দুজনই হেসে দেয়। শোহা শেখ হেসে বলেন,
-“মি.হাসবেন্ড আমি তো আপনাকে সাথে নিতে চেয়েছি কিন্তু কার যেনো বিজনেস লাঠেউঠবে তাই তো গেলো না।”
-“হয়েছে এবার বাড়ি চলো। তোমার মেয়ে যা যা করেছে বিচার বৈঠক করতে হবে।”
-“আমার মেয়ের নামে একদম মিথ্যা অপবাদ দিবে না।”
আদনান শেখ আর শোহা শেখ দুজন মেয়ে কে নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দেয়। আদ্রিশী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। সেই দশ বছর আগের সিনে চলে গেছে। আদ্রিশী যখন ছোট ছিলো তখন কি কি করেছে। কিভাবে জ্বালিয়েছে। কে সামলেছে। সব ইতিহাস টেনে আনছে দুজন। শোহা শেখ ঝগড়া করার এক পর্যায় মুখ ফস্কে বলে ফেলে,
-“হ্যাঁ হ্যাঁ! সব তো তুমিই করেছো। সব সময় তো বাইরে বাইরে থেকেছো। আনুশী আর আদ্রিকে আমি একা সামলেছিলাম।”
শোহা শেখের কথায় আদনান শেখের হাসোজ্জল মুখশ্রী মিয়ে যায়। তিনি স্তব্ধ হয়ে চুপসে যান। শোহা শেখ নিজেও চুপ হয়ে যায়। আদ্রিশী বাবা-মায়ের অবস্থা বুঝে বলে,
-“উফ! বাবা-মা আপুর কথা উঠলে তোমরা সব সময় এমন চুপ হয়ে যাও কেনো? এত শোকের কি আছে?”
শোহা শেখ জোরপূর্বক হেসে বলে,
-“কিছু না মা। বাড়ি চলো।”
বাড়ি এসে আদ্রিশী তার মা কে এ কয়েকদিনের সকল ঘটনা খুলে বলে। তার বাবা কি কি করেছে। সে কি করেছে। বাবাকে জ্বালায়নি। গুড গার্ল হয়ে থেকেছে। আদ্রিশীর কথায় তার মা কিয়ৎ পর পর হেসে উঠছে সাথে আদনান শেখও। কারণ তার মেয়ে তার বিপক্ষে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যাও বলছে৷ আদনান শেখ উঠে দাড়িয়ে বলেন,
-“আর যা যা অপবাদ আছে সব দিয়ে দে মা। আমি আসছি।”
-“আরে বাবা কোথায় যাও? এখানেই বসো। তুমি এখান থেকে চলে গেলে তোমার নামে যা যা বলব সব কূটনামি হয়ে যাবে। তুমি থাকলে সেটা হবে না। আর আমার পাপও হবে না।”
আদনান শেখ অবাক দৃষ্টিতে মেয়ের পানে তাকিয়ে আছেন। মনে মনে ভাবছেন কি বিচ্ছু মেয়ে। আবার এটাও ভাবছেন সেও এই বয়সে কম বিচ্ছু ছিলেন না। তার মেয়ে তো তারই মতো হবার কথা। আদনান শেখ মেয়ের মাথায় আলতো মে’রে বলেন,
-“ইঁচড়েপাকা! কাজ আছে আমার। মায়ের সাথে বসে গল্প করো।”
আদনান শেখ একপলক শোহা শেখের পানে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আদ্রিশী পূর্বের ন্যায় নিজের গল্প বলা শুরু করে। আদ্রিশী মা ভক্ত। সারা দিনে কি কি হয়েছে সব এসে মা কে বলে। আর তার মাও চুপচাপ বসে বসে মেয়ের কথা গুলো শোনে। আদ্রিশীকে কেউ প্রেম প্রস্তাব দিলেও তা এসে মাকে বলে দেয়। আর শোহা শেখ নিজের মেয়ে এমন অদ্ভুত কান্ডে হেসে কুটিকুটি হয়। শোহা শেখ মনোযোগ নিয়ে শুনছে মেয়ের কথা গুলো। আদ্রিশী আচমকা উত্তেজিত হয়ে বলে,
-“জানো মা কি হয়েছে?”
খানিক চমকে যায় শোহা শেখ। আচমকা এমন উচ্ছসিত ধ্বনিতে খানিক ভড়কে যায়। নিজেকে সামলে আদ্রিশীর পানে তাকিয়ে বলেন,
-“তুমি না বললে আমি জানব কি করে মা?”
-“ওহ হ্যাঁ! বলছি! শোনো না মা কি হয়েছে। আমি না আমাদের লাইব্রেরি থেকে একটা ডায়েরি পেয়েছি। বেশ পুরোনো মাটির রঙ্গের।”
শোহা শেখ চমকে অক্ষিদ্বয় বৃহৎ আকৃতি করে মেয়ের পানে তাকিয়ে আছেন। আদ্রিশী তার মা শোহা শেখ কে বলে,
-“আচ্ছা মা শ্রেয়সী আর আরাবী কে?”
শোহা শেখ আচমকা মেয়ের পায়ে তাকিয়ে দ্রুত বলেন,
-“যেই হোক তোমাকে তাদের সম্পর্কে একদম জানতে হবে না। আর কখনও লাইব্রেরিতে গিয়ে জিনিসপত্রে হাত দিবে না।”
-“কেনো জানতে হবে না মা? জানো শ্রেয়সী কত কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু পুরোটা কাহিনি ডায়েরিতে নেই। শ্রেয়সী আরাবী কি হয়েছে তা তো লেখা ছিলো না মা। আমি সেটা জানতে চাই।”
-“কার না কার ডায়েরি। কাল্পনিকচরিত্রও হতে পারে। তা নিয়ে এত ভাবছো কেনো?”
-“কাল্পনিক না মা। এটা সত্যি শত ভাগ সত্যি আমি জানি।”
-“আচ্ছা ওদের সম্পর্কে জেনে তুমি কি করবে?”
-“জানি না কিন্তু জানতে চাই। আচ্ছা মা তুমি কি ওদের চিনো?”
শোহা শেখ চোখ রাঙ্গিয়ে মেয়ের পানে তাকিয়ে বলে,
-“মরিচীকা কোনো বিষয়ের উপর এত কিউরিওসিটি রাখা উচিত না আদ্রি। আর আমি শ্রেয়সী-আরাবী কে চিনি না। এই প্রথম নাম শুনলাম।”
আদ্রিশী হতাশ হয়ে বলে,
-“মা ওরা সত্যি আছে। কাল্পনিক না।”
-“হতে পারে। তবে তা আমরা জানি না। আর জেনেই বা কি হবে? ফালতু চিন্তায় মন না দিয়ে ঘুমাতে চলো।”
শোহা শেখ জোর করে আদ্রিশীকে ঘুম পারাতে নিয়ে যায়। আদ্রিশী ঘুমচ্ছে না। কিয়ৎ পর পর শ্রেয়সী-আরাবী কথা মনে করছে আর এটা ওটা বলছে। শোহা শেখ মেয়ে কে বার বার ধমকে চুপ করিয়ে দিচ্ছে। আদ্রিশী মায়ের ধমক খেয়ে চুপ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। শোহা শেখ মেয়ে কে ঘুম পারিয়ে কপালে চুমু দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বিস্তার খোলা আকাশের পানে তাকিয়ে আছে আদনান শেখ। অন্তরালে তার নানা প্রশ্ন ঘুর পাক খাচ্ছে। সব গুলো প্রশ্ন একটা উত্তরে এসে ঠেকছি “এর পর কি হবে?” আজ আর দীর্ঘশ্বাসেও কাজ হচ্ছে না। যত বার শ্বাস টানছে ততোবার অন্তরাল বি’ষি’য়ে উঠছে। সমস্ত হৃদয় গহিনে অজানা এক ভয়ে জর্জরিত হচ্ছে কেবল। আদনান শেখ এতটাই আনমনে ছিলেন যে তার পাশে এসে শোহা শেখ দাঁড়িয়ে তা সে টের পায়নি। শোহা শেখ আদনান শেখের উদ্দেশ্য করে বলেন,
-“কি ভাবছো?”
আদনান শেখ আকাশের পানে তাকিয়ে উত্তর দেন,
-“সত্য কখনও চাপা থাকে না। যতোই চেষ্টা করি তবে একদিন ঠিক বর্তমানে পদার্পণ করে।”
-“উঁহু! সত্য সব সময় সামনেই থাকে কেউ ধরতে পারে আর করো অগোচরে থাকে। কিন্তু বিষাক্ত অতীত লুকিয়ে রাখা যায় না।”
দু’জনই নীরবে দাঁড়িয়ে রয়। রাতের আঁধারে দু’জন কপোত-কপোতী নীরবে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মনে করছে তাদের বিষাক্ত অতীত। যে অতীত শুধু তাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। সুখ পেয়েও আনন্দে বাঁচার স্বাধ গ্রহন করতে পরেনি। নীরবতা ঘুচিয়ে আদনান শেখ বলেন,
-“যে ভয়টা ছিলো তা সত্যি হয়ে গেলো। বিষাক্ত অতীতের জন্য আমার মেয়ে আমার থেকে দূরে চলে গেছে।”
-“কি ভয় পাচ্ছিলে বাবা? আপু চলে গেছে মানে?”
পেছন থেকে আদ্রিশীর কথা শুনে দুজন চমকে পেছন ফিরে তাকায়। শোহা শেখ আদনান শেখের পানে তাকিয়ে আছে। আদনান শেখ চুপ করে তাকিয়ে আছে আদ্রিশীর পানে। হয়তো তার আরেক মেয়েকে হারানোর পালা চলে এসেছে।
~চলবে…..