#শ্রেয়সী
#পর্ব_২৫
#লেখনীতে_নাদিয়া_সিনহা
সব সময় মনে করতাম আমার জীবনের সবচেয়ে জ’ঘ’ন্য সময় ছিলো আরাবী থেকে দূরে থাকার দুটো মাস। কিন্তু কখনও ভাবিনি এর থেকে ভয়ংকর সময় আসবে আমার জীবনে। দীর্ঘ এগারো মাস পর ডায়েরি টায় লিখতে বসেছি। এই এগারোটা মাস আমার জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম সময়। পেয়েছি অপূর্ণতা, দিয়েছি বিসর্জন নিজেকে, হারিয়েছি প্রিয় মানুষটাকে। এগারো মাসের তিনটা মাস ছিলো আমার জন্য ভয়ংকরী জা’হা’ন্না’ম থেকে কম নয়। সেই তিনটা মাসে যত অ’ত্যা’চা’র করা যায় সব অ’ত্যা’চা’র করা হয়েছে আমাকে। কেঁদেছি, ছটফট করেছি, চিৎকার করে অনুরোধ করেছি, সব কথা মেনে নিয়েছি তবুও আমার রক্ষা হয়নি। জা’নো’য়া’রে’র মত ছি’ড়ে’খুঁ’ড়ে খেয়েছে আমার সর্বাঙ্গ। মুখশ্রীতে রয়েছে অংশ ছোপ ছোপ দাগ। নিজেকে আয়না দেখাও বন্ধ করে দিয়েছি। ঘৃণা হয় নিজের প্রতি৷ এমনটা না হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো?
বিয়ের দিন আমাকে শাহীর ভাইয়া ফোন করে বলেছেন আরাবী বাইক এ্যাক্সিডেন্ট করেছে। বাঁচবে কি না সন্দেহ। আমাকে দেখতে চাইছে। আরাবীর শেষ ইচ্ছে আমাকে দেখার। শাহীর ভাইয়ার কথা শুনতেই আমার পুরো পৃথিবী চক্কর দিয়ে উঠে। আরাবী কিছু হলে বাঁচব না আমি। দিকবিদিক না ভেবেই কলেজ ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পরি বাসা থেকে। এত এত মেহমান, এত সাজসজ্জা সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে বেরিয়ে পরি বাড়ি থেকে। বাড়ির ভেতরে কেউ নেই তাই পেছনের গেট দিয়ে চলে আসি। গেট দিয়ে বের হতেই দেখে শাহীর ভাইয়া বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে তাড়া দিয়ে বলে,
-“তাড়াতাড়ি বাইকে উঠে বসো। না হয় দেরি হয়ে যাবে। আরাবীর শেষ ইচ্ছা….”
আমি আর না ভেবে উঠে পরি বাইকে। আমার অস্বস্তি হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত। তবে যত দ্রুত সম্ভব আরাবী কাছে পৌঁছাতে হবে৷ শাহীর ভাইয়া বেশ দ্রুতই বাইক চালাছেন। কিয়ৎ পর একটা বিল্ডিং এর সামনে বাইক দাঁড় কায়। আমি বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে আছি। বিশাল আলিসান বিল্ডিং। আমি শাহীর ভাই কে জিজ্ঞেস করি,
-“ভাইয়া এখানে কেনো নিয়ে এলেন?”
-“ভেতরে চলো। ওখানেই আরাবী কে রাখা।”
-“কিন্তু হসপিটালে না নিয়ে গিয়ে এখানে কেনো রেখেছেন?”
শাহীর ভাইয়া পেছনে মুড়ে আমার পানে তাকায়। বাঁকা হেসে বলে,
-“হসপিটালে তো আর তোমার খাতিরদারি হবে না। তাই না?”
কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ পেছন থেকে মুখে রুমাল চেপে ধরে। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসছে৷ নিজের ভার রাখতে না পেরে ঢলে পরি ফ্লোরে কিন্তু এবারও অনুভব করলাম কেউ এসে আমার মাথা ধরেছে। তবে কে? জানা নেই।
চোখ খুলতেই নিজেকে একটা অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করি। পুরো রুমের কোথাও আলো নেই। আমার হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছে। হাত-পা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। তবে লাভ বিশেষ হচ্ছে না। ভয়ে চিৎকার করে ডাকি ‘কেউ আছে?’
আমি অনবরত চিৎকার করে বলছি বাঁচাতে, ছেড়ে দিতে। আর আরাবী কে খুঁজছি। আমার চিৎকার দেয়ালে বারি খেয়ে আমার কানেই আসছে। হঠাৎ কেউ রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। অন্ধকার হওয়ায় তার মুখশ্রী ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না। আগন্তুক আমার দিকে তাকিয়ে রুমের সব আলো জ্বালিয়ে দেয়। আচমকা এত আলো চোখের পরতেই আমার চোখের পাতা গুটিয়ে যায়। কিয়ৎ পর আস্তে আস্তে চোখ খুলে সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সম্মুখে তাকাতেই আমার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে। আমি যা দেখছি তা কি সত্যি নাকি কল্পনা। নিজের চোখ কে বিশ্বাস করা দ্বায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এসে বাঁকা হেসে বলে,
-“হেই বেইব হা’উ আ’র ইউ ফিলিং না’উ?”
আমি তাকিয়ে আছি ওয়ালিদে পানে। মস্তিষ্ক উদ্ভট হচ্ছে নানা প্রশ্নের তবে উত্তর নেই। ওয়ালিদ আমার দিকে এগিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলে,
-“আমাকে দেখে খুশী হওনি?”
ঘৃণায় আমি মুখ ঘুরিয়ে নেই। এই লোকটা কে দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। একে দেখার চেয়ে ম’রে যাওয়াই শ্রেয়। ওয়ালিদ একদম আমার মুখশ্রীর কাছাকাছি এসেছে। তার উষ্ণ নিশ্বাস আমার উপরে বিচরণ করছে। সর্বাঙ্গ গুলিয়ে আসছে। ওয়ালিদ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“খুশী হবে নাই বা কেনো? তোমার হবু স্বামী বলে কথা।”
আমি আর সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে বলে উঠি,
-“আমার কাছে আসবেন না একদম। দূরে যান বলছি।”
-“দূরে যাওয়ার জন্য তো কাছে আসিনি। এখন তুমি চাইলেও দূরে ঢেলে দিতে পারবে না।”
-“কেনো করছেন এসব? কি ক্ষতি করেছি আপনার?”
-“আরে তোমার মাথায় তো দেখি বেশ বুদ্ধি। ধরেও নিলে অকারণে কিছু করছি না। আই লাইক ইট।”
-“একদম কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবেন না সত্যিটা বলুন।”
ওয়ালিদ উঠে দাঁড়ায়। আমার পানে তাকিয়ে আছে রক্ত চক্ষু নিয়ে। বলে,
-“তুমি খুব বুদ্ধিমতি তা আমি শুরু থেকেই টের পেয়েছি। তোমার বাবা প্রতিবার ইলেকশনে জয়ী হয়। আমাদের রাজনীতির প্রতিটা লোক এবং জনগন তোমার বাবাকে প্রধান মন্ত্রী রূপে দেখে। আমার বাবা ইলেকশন লড়েও হেরে যায় প্রতিবার শুধু মাত্র তোমার বাবার জন্য। কিন্তু এখন আর জিতবে না। কেনো জানো? কারণ তার মেয়ে বিয়ের দিন পালিয়ে গেছে তার আশিকের সঙ্গে।”
ওয়ালিদ সজোরে হাসছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। আমার জানা ছিলো না ওয়ালিদও রাজনীতি করে। বাবাও রাজনীতি করে। কিন্তু কখনও সেই প্রভাব আমাদের ভাইদের উপর পরতে দেননি। কিন্তু আজ ওয়ালিদ তা করে দেখালো। ওয়ালিদ আমার সামনে এসে বলে,
-“জানো আরাবীর কিছুই হয়নি। তোমাকে ওই ফোনটা আমিই করিয়েছিলাম যেনো তুমি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসো। আর একটা কথা আরাবীও গিয়েছিলো তোমাকে আনতে তবে আফসোস ওর যাওয়ার আগেই তুমি পালিয়ে গেছো।”
মানুষ এতটা জ’ঘ’ন্য কি করে হতে পারে? নিজের স্বার্থের জন্য আমার জীবন আমার পরিবারের মান সম্মান সব কিছু নষ্ট করে দিলো। আমি ওয়ালিদের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করি,
-“এসব করে আপনি কি পেলে? কেনো এভাবে আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন।”
-“আমার জীবন সুন্দর করতে তোমার জীবন নষ্ট করে দিলাম। তুমি পালিয়ে গেছো বলে সবাই তোমার বাবা কে ধিক্কার জানাচ্ছে। আমার পরিবারের সামনে অপমানিত হয়েছে। আর তোমার দাদাভাই তাকেও তো পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। কারণ সে অস্ত্র পাচার করে। কয়েমাস পরই ইলেকশন আর তোমার বাবা নমিনেশন নিবেন না। কারণটা তো বুঝতেই পারছো তীব্র অপরাধবোধ থেকে সরে যাবে রাজনীতি থেকে। আর এমপি হবো আমি।”
ওয়ালিদ অদ্ভুত হাসি হাসছে। পাঁচ বছরের একটা ক্ষণস্থায়ী পদের জন্য মানুষ এতটা নিচে কি করে নামলো৷ আমার পুরো পরিবার ধ্বংস করে দিলো। এখন তো আমি বাবার কাছে গেলেও বিশ্বাস করবে না। করলেও আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসবে না। আর দাদাভাই তার কি হবে? দাদাভাইকে ছাড়াবে কে? আমার চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পরছে। এমনটা কেনো হলো আমার পরিবারের সাথে। আমার সুখী পরিবার ধ্বংস হয়ে গেলো। আমি ওয়ালিদের দিকে ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকাই। চিৎকার করে বলি,
-“তুই যদি বাবা কে বলতি তুই এমপি হতে চাস তাহলে আমার বাবা নিজে তোকে ইলেকশনে দাঁড় করাতো। তোকে ভিক্ষা দিয়ে দিতো। কিন্তু তুই এটা কি করলি? আমার পুরো পরিবার নষ্ট করে দিলি। কেনো? কেনো করলি এসব?”
-“আরে আরে বেব আস্তে। এইটুকু শুনেই রেগে গেলে আরও তো বাকি আছে৷ জানো আরাবী বাবাকে তোমার সম্পর্কে কে বলেছে? জানো না তাই না? আমি বলেছি। কি বলেছি জানো?”
ওয়ালিদ প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু না বলায় সে বলে,
-“তুমি একটা ক্যারেক্টারলেস মেয়ে। আমাকেও ফাঁসিয়ে ছিলে এখন আমার থেকে ভালো ছেলে পেলে তাই আমাকে ভুলে গেলে। আরাবীর বাবাও আমার সব কথা মেনে নিলেন। আর তোমার বাবাকে ফোন করে অপমান করলেন। তারপর তোমার বাবা আমার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করলেন। আর তুমি কি না বিয়ে থেকে পালিয়ে এলে। ভে’রি বেড।”
-“ছিঃ।”
ঘৃণায় মুখ ফিরে নেই। ওয়ালিদ উচ্চস্বরে হেসে বলে,
-“ছিঃ বলছো কেনো? আমার স্পর্শ গায়ে লাগলে কি করবে?”
ওয়ালিদ আমার কাছে এগিয়ে আসছে। আমি চিৎকার করছি। পেছনে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আর না আছে বাঁচানোর মতো কেউ। ওয়ালিদ আমার ঘাড়ে, গলায় আর ওষ্ঠদ্বয় বিচরণ করছে তার হাত। ঘৃণায় সে অংশ কে’টে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আমার চিৎকারে ওয়ালিদ রেগে আমার গলায় শক্ত করে চেপে ধরে। আমার শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। ওয়ালিদ আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
-“যত কম ছটফট করবি ততোই শাস্তি কম পাবি।”
আমি কাশতে কাশতে বলি,
–“আমাকে এভাবে আটকে রাখছিস কেনো? মেরে ফেল।”
-“তোকে এত সহজে মারব না। দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ শাস্তি মৃত্যু। মরে গেলে বেঁচে যাবি। কিন্তু আমি তোকে মরতে দিব না৷ বাঁচিয়ে রেখে জা’হা’ন্না’ম দেখি দিব।”
ওয়ালিদ শক্ত করে আমার কাঁধ চেপে ধরে। আমি ছুটার জন্য ছটফট করতে থাকি। তবে কিছুতেই পারছি না। ওয়ালিদের হাতের স্পর্শ আস্তে আস্তে গভীর থেকে গভীরতায় রূপ নিতে থাকে। আমার পৃষ্ঠদেশে ওয়ালিদ তার নোংরা হাত বুলাচ্ছে। ঘৃণায় আমার সমগ্র শরীর রি রি করছে। বাঁধা হাত দিয়েই সজোরে ধাক্কাছি ওয়ালিদ কে তবে তার শক্তির কাছে আমার এইটুকুনি জোর কিছুই না। তবুও নিজেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টাও করেছি।
তবে পারিনি। সর্বস্ব হারানোর মতো যন্ত্রণা ভয়ংকর হয়। আর তা আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। ওয়ালিদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছি। শারীরিক, মানসিক সব অ’ত্যা’চা’র করা হয় আমার উপর। কখনও গরম লোহা গায়ে চেপে রাখা তো কখনও দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকা। এতটাই নি’র্যা’ত’ন করা হয় যে আমি একটা সময় মানসিক রুগীতে পরিনতি হই। যাকেই দেখতাম ভয়ে চিৎকার করে উঠতাম। তিনটা মাস আমি সূর্য আলো তো দূর সোডিয়ামের আলোও দেখিনি। একটা অন্ধকার ঘরে বন্দী করে রেখেছিলো। শুধু ওয়ালিদই নয় তার সাথে পোষা ন’র’পি’শা’চে’রাও অ’ত্যা’চা’র করেছে আমার উপর। সে দিন গুলো আজও চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে আমার আত্মা কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। ভুল তো ছিলো না আমার তবে কেনো এত বড় শাস্তি পেতে হলো আমাকে। এই তিনমাস আমি দেয়ালে দাগ কে’টে হিসেব কষেছি শুধু। আরাবী আসবে আমাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু ভুলেই গেছিলাম বাস্তবে কখনও কেউ কাউকে বাঁচাতে আসে না। কেউ কারো পাশে থাকে না। সে যতই ভালোবাসুক। দিন শেষে সবাই একা।
~চলবে……