#শ্রেয়সী
#পর্ব_১০
#লেখনীতে_নাদিয়া_সিনহা
জানালার পাশে বসে চায়ের কাপের উষ্ণ ধোঁয়ায় আমার অন্তরালের বিষাক্ত অনুভূতি গুলো ভাসিয়ে দিচ্ছি। বাড়ি এসেছি প্রায় চার দিন হতে চললো। নিজ বাড়ির মতো সুখ বোধ হয় কোথাও নেই। হোস্টেল জীবনটাও খুব কষ্টদায়ক। নিজের খেয়াল খুশি মত থাকা যায় না। বাড়িতে যত দিন যাচ্ছে মন ততো বসে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে যেতেও ইচ্ছে করছে না। আবার না গিয়েও থাকতে পারছি না। বক্ষস্থলের ফাঁকা অনুভূতিটাও বারংবার পীড়া দিচ্ছে। এ কদিনে সেই বক্র হাসি যুবকের মুখশ্রী বারবার অক্ষি সম্মুখে আবিষ্কার করেছি। বেশ বোধগাম্য অন্তস্থল তীব্র ঝড়ের কবলে পরেছে। জানি নিষিদ্ধ অনুভূতির প্রতি ধাবিত হচ্ছি। তবে মন কি আর মস্তিষ্কের কথা মানে? একদমই মানে না। তাই তো আমার অবাধ্য মন নিষিদ্ধ অনুভূতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে অবাক হয়েছি কারণটা অনাকাঙ্ক্ষিত অপরিচিত এক নম্বর থেকে বারংবার কেউ কল দিয়ে যেতো৷ তনুফ ভাইয়া আমাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছে কাউকে ফোন নম্বর না দিতে এবং অপরিচিত কোনো নম্বর থেকে কল এলে না ধরতে। আমিও তার কথা মত কাউকে নম্বর দেইনি এবং অপরিচিত নম্বর থেকে আসা কলও ধরিনি। তবে আমার অবাধ্য মন শুধু আনচান আনচান করতো। অপরিচিত সেই নম্বর ধরার জন্য। তবে ধরিনি। আমার ভাবনার মাঝে তনুফ ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করে। ভাইয়া কে দেখে আমি চকমকে যাই। আচমকা আগমনে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রই। ভাইয়া আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলে,
-“শ্রেয়ু তোকে আজ হলে যেতে হবে। তোমাদের কলেজ কর্তৃপক্ষ নবীন ছাত্রদের নিয়ে একটি প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছে। তার জন্য যেতে হবে। রেডি হয়ে নে।”
-“কিন্তু ভাইয়া আমার তো আরও কদিন পর যাওয়ার কথা তাহলে আজই কেনো?”
-“আমি বলেছি প্রিন্সিপাল কে। লাভ বিশেষ হয়নি। তুই রেডি হয়ে নে। আমি রোদ্দুকে নিয়ে আসি।”
ভাইয়া চলে যায় রোদ্দুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমি হতভম্ব হয়ে বসে আছি। আজই চলে যাব। কষ্ট হচ্ছে। আমি দ্রুত মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়াই। মা ঘরে নেই ভাবি বললো ছাদে। ওখানে গিয়েও মা কে পেলাম না। তারপর রান্না ঘরে এসে দেখি মা রান্না করছে পাশে শান ভাইয়া গল্প করছে। আমাকে দেখে শান ভাইয়া বলে,
-“কিরে বুচি? অকর্মার ঢেঁকির আগমন আমাদের রান্না ঘরে কি করে? রান্না বান্না তো পারিস না। এখানে এসেছিস মানে সব ভেস্তে দিবি।”
-“চুপ করো তো। সব সময় মজা ভাল্লাগে না ভাইয়া। আম্মু তনুফ ভাইয়া বলেছে তোমাকে? আজ কেই আমাকে ঢাকা নিয়ে যাবে।”
শান্ত কন্ঠে মা বলে,
-“হ্যাঁ বলেছে। তুই রেডি হয়েছিস?”
-“আম্মু আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি প্লিজ ভাইয়া কে বলো আমাকে তুমি যেতে দিবে না।”
-“পড়াশোনা করো তুমি শশুর বাড়ি নয় যে না গেলে সমস্যা হবে না। কদিন পর বন্ধ দিবে কলেজে তখন এসে থেকো।”
শান ভাইয়া বলে,
-“আরে মা বুঝো না? তোমার মেয়ে আর পড়াশোনা করতে চায় না। যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে দেও। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আমি ভাইয়া কে মুখ ভেঞ্চি কেটে বলি,
-“তোমার যে বিয়ে করতে মন চাইছে সেটা বলো। আম্মু দেখো গিয়ে তোমার ছেলে আবার কোনো মেয়ে কে কথা দিয়ে এসেছে কি না বিয়ের জন্য।”
-“বুচির বাচ্চি। তুই পেকে গেছিস। তোকে যদি বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় না করি আমিও শান রাহমানী নই।”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ! আমাকে বিয়ে দিলে তোমার রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যাবে তো তাই বলছো বিয়ে দিতে।”
-“মা এই বুচিকে বলো আমার চোখের সামনে থেকে দূর হতে না হয় একটা ছোট খাটো যুদ্ধ বাধিয়ে দিব আমি।”
মা হাতে খুন্তি নিয়ে শান ভাইয়া কে ঠাস করে ঘাত বসিয়ে দেয়। আচমা আক্রমণে শান ভাইয়া অপ্রস্তুত হয়ে পরে। আমি উচ্চস্বরে খিলখিল করে হেসে দেই। আমার হাসি দেখে মা আমার দিকে এগিয়ে এসে ঠাস করে আমার হাতে আঘাত করে দেয়। আমিও আচমকা আক্রমণে চিৎকার দিয়ে উঠি। মা আমাদের থেকে দিগুণ চিৎকার করে বলে,
-“ফা’জি’লে’র হাড্ডি। কিছু বলি না বলে মাথায় উঠে বসেছিস তোরা। আমাকে শান্তি দিস না। তোরা দুজন আমার বাড়ি থেকে দূর হো যা। আমার চোখের সামনে থেকে যা৷ না হয় খু’ন হয়ে যাবি তোরা।”
মায়ের আচমকা রেগে যাওয়ার দরুন আমি আর শান ভাইয়া ভয়ে দৌড়ে চলে আসি। দৌড়ে আসার দরুন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে আমি চেয়ারে বসে পরি। ভাইয়া আমার মাথায় জোরে একটা চ’ড় মেরে বলে,
-“বুচি শান্তি দিবি না আমাকে। তোর জন্মের সময় বুঝে গেছিলাম তোর জন্মই হয়েছে আমাকে অশান্তিতে রাখার জন্য।”
-“এ্যাহ আমার জন্ম তোমাকে অশান্তি দিতে হয়নি। তোমার জন্ম হয়েছে মা কে অশান্তি দিতে। শুনেছি আমি তনুফ ভাইয়ার কাছে তুমি মা কে অনেক জ্বালাতে।”
-“তোর থেকে কমই করেছি। তুই আমার থেকে তিনগুণ।”
-“শুকরিয়া করো আল্লাহর কাছে। আমার মত এত ভদ্র, সভ্য বোন দিয়েছে তোমাকে। না হয় এত দিনে পগারপার হয়ে যেতে।”
-“হ্যাট তোর মত বোন আমার লাগবে না। তোকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিব। ভুঁড়িওয়ালা টাক্কু দাদুর সাথে।”
-“আমার বিয়ের কথা চিন্তা না করে নিজেরটা করো। বয়স তো কম হয়নি। বুড়ো হয়ে যাচ্ছো দিন দিন। দেখো দেখো তোমার দাঁড়িতে পাকা পাকা চুলও আছে।”
আমার কথায় ভাইয়া দ্রুত নিজের ফোন বের করে মুখশ্রীর সম্মুখে নিয়ে গভীর দৃষ্টিতে নিজেকে পরখ করে নেয়। আমি মিটমিট করে হেসেই যাচ্ছি। হাসি খুব কষ্টে চাপিয়ে রেখেছি। আগাগোড়া খুটিনাটি পরখ করে আমার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে বলে,
-“কোথায়? আমি তো একটাও পাকা চুল পেলাম না।”
আমি এবার উচ্চস্বরে হেসে দেই। শান ভাইয়া বেশ বুঝতে পারছে আমি তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যা বলেছি। আমি হাসি চাপিয় বলি,
-“ভাইয়া তুমি তো দেখছি অনেক বোকা। তোমাকে কে বিয়ে করবে? ”
দাঁতে দাঁত চেপে শান ভাইয়া তেড়ে এসে বলে,
-“বুচি তুই দাঁড়া। তোর খবর যদি আজ না করেছি আমিও শান রাহমানী না।”
আমাকে আর পায় কে। দৌড়ে দাদাভাইয়ের পিছনে লুকিয়ে পরি। দাদাভাই আমাকে দেখে দুহাতে আগলে নিয়ে শান ভাইয়ার দিকে তাকায়। শান ভাইয়া দাদাভাই কে অনেক সম্মান করে তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে যায়। দাদাভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“কি হয়েছে? এভাবে দৌড়াদৌড়ি করছো কেনো?”
শান ভাইয়া বলে,
-“না ভাইয়া এমনি মজা করছিলাম৷”
দাদাভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“শ্রেয়ু তুই আজ চলে যাবি না? যা গিয়ে রেডি হয়ে নে।”
-“দাদাভাই আমি যাব না। প্লিজ আর দুটো দিন থাকি প্লিজ ম্যানেজ করে নেও।”
-“তোর কি মনে হয় তনুফ ম্যানেজ করার চেষ্টা করেনি? ম্যানেজ হয়নি বলেই পাঠিয়ে দিচ্ছি। মন খারাপ করে না বাচ্চা খুব জলদি নিয়ে আসব আবার।”
আমি মন খারাপ করে ঘরে চলে আসি। আমার পিছু পিছু শান ভাইয়াও আসে। বিছানায় বসে পা দুটো বিছানার উপর তুলে আমাকে বলে,
-“আহারে বুচি ভাইয়া কে বলে দিতি হোস্টেল নয় আমার শশুর বাড়ি চাই। তাহলেই হয়।”
-“তুমি আমার বিছানায় পা রেখে কেনো বসেছো। আগে পা নামাও। নামাও বলছি।”
-“আমার পায়ের স্পর্শ তোর বিছানায় পরেছে এটা তোর সৌভাগ্য। তোর বিছানা আমার পদার্পণে বিশুদ্ধ হয়ে গেছে। গর্ব কর।”
-“আমাী বিশুদ্ধ লাগবে না তুমি যাও এখান থেকে আমি রেডি হবো।”
-“তার আগে আমার টাকা দে।”
-“কিসের টাকা?”
-“এখন জানিস না কিসের টাকা? এত গুলো প্রানির খাবার আনলাম সে গুলোর টাকা দিবি।”
-“প্রানী কাকে বলো? আনি কি বিড়াল কুকুর পুশি নাকি? আর আমি তো বলিনি আনতে।”
-“না আনলে তো আমাকে আর আস্ত রাখতি না। এখন বেশি কথা না বলে টাকা সব সুদেআসলে শোধ কর।”
-“যাও তো ভাল্লাগছে না আমার এসব।”
-“টাকার কথা উঠেছে তাই তোর ভাল্লাগছে না। তাই না?”
-“টাকা তোমাকে দিব না তা জানো। তাও কেনো মেয়েদের ঘ্যান ঘ্যান করছো?”
আমাদের ঝগড়ার মাঝেই রোদ্দু ঘরে প্রবেস করে।হাহুতাশ করতে করতে বলে,
-“শ্রেয়ুরে আমি যেতে চাই না। আমি যাব না। তুইও যাস না। আমরা এখানেই থেকে যাব। আমি আর ওই বজ্জাত সিনিয়রের হাতে রেগ হতে চাই না।”
-“এই খরা। তোর প্যানপ্যানানি এখনও গেলো না?”
-“শান ভাইয়া গো তুমি জানো না কি কষ্টে আমরা দিন অতিবাহিত করছি।”
-“তোরা যে কি চিজ তা আমি জানি। তোরা নিশ্চয়ই কাউকে কিছু বলেছিস। নয় আগে ঝামেলা পাকিয়েছিস। না হয় কেউ এমনি এমনি রেগ করবে না। তোদের পিছনে লাগবে না।”
-“দেখলি শ্রেয়ু। বলেছিলাম পৃথিবীর সব ছেলে গুলোই অ’স’ভ্য হয়, ই’ত’র হয়, ব’জ্জা’ত হয়।”
-“কি বললি খরা। তোরও দেখছি সাহস বেড়েছে। তোকে কিন্তু মে’রে ফেলব আমি।”
-“এই তোমাদের লজ্জা করে না মেয়েদের সাথে ঝগড়া করতে? আর এত ঝগড়া শিখেছো কোথায়?”
-“চুপ কর বে’য়া’দ’ব। তোর লজ্জা করে না বড় ভাইয়ের সাথে তর্ক করতে?”
-“তোমার না করলে আমার কেনো করবে?”
-“রোদ্দু শান ভাইয়া চুপ করবে প্লিজ? তোমরা দুজন আমার ঘর থেকে বের হও যাও।”
বলতে বলতে দুজন কে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেই ঘর থেকে। মনটা এমনি বিষিয়ে আছে তার উপর এদের ঝগড়ায় মাথাটাও ধরেছে বেশ। দরজা বন্ধ করে ব্যাগ গুছাতে মনোযোগ দিলাম। আমার চিত্তই আমার প্রতিপক্ষ। এই তো কদিন আগে হল থেকে আসার সময় মনটা কেমন বিষাদময় ঠেক ছিলো। আর আজ চলে যাব আজও একই অনুভূতি অনুভব হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস টেনে ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে নিলাম।
নিচে এসে দেখি বাড়ির সবাই উপস্থিত আছেন। বাবা গম্ভীর হয়ে বসে আছে। মায়ের মনটাও ভালো নেই। সবার সাথে বসে টুকটাক কথা বলে বেরিয়ে পরি। আমাদের সাথে শান ভাইয়া আর তনুফ ভাইয়াও এসেছে।
সন্তানের থেকে দূরে থাকার মতো পীড়াদায়ক বোধ হয় আর কিছু কোনো বাবা-মায়ের কাছে নেই। আমারও কষ্ট হচ্ছে খুব। তবুও জীবন তো কষ্টের মাঝে আবদ্ধ থাকে না। শতশত কষ্টের ভীড়েও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে চলতে হয় আগাম পথে।
~চলবে….