শ্রেয়সী অন্তীম পর্ব

0
758

#শ্রেয়সী
#অন্তীম_পর্ব
#লেখনীতে_নাদিয়া_সিনহা

আকস্মিক পেছন থেকে কেউ ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয় আদ্রিশী। পেছন মুড়তেই শোহা শেখের কঠিন দৃষ্টি সম্মুখীন হতে হয় তাকে। শোহা শেখ একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে অপর পাশের ব্যক্তিকে বলে,
-“আমি পরে ফোন করছি। রাখি!”

অতঃপর আদ্রিশীর পানে তাকিয়ে কঠোর কন্ঠে শোধায়,
-“ফোন রিসিভ করেছো কেনো?”

আদ্রিশী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। ফোনের অপর পাশের ব্যক্তির কথাগুলো তার সমগ্র মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে। কি বলেছিলো সেই মহিলা? শ্রেয়ু? শ্রেয়ু তো শ্রেয়সী। আর আরাবী কে? আরাবী মা’রা যায়নি? শ্রেয়সীও মা’রা যায়নি। দুজনই বেঁচে আছে। তাহলে? কিন্তু আরাবী আর আদ্রিশীর কি সম্পর্ক? ওনি আদ্রিশীর কথা কেনো জিজ্ঞেস করলেন? সকল প্রশ্নের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে আদ্রিশীর ছোট মাথা। আদ্রিশী স্থির দৃষ্টিতে মায়ের পানে তাকিয়ে বলে,
-“মা তুমি শ্রেয়সী?”

আদ্রিশীর এহেন প্রশ্নে শোহা শেখ চমকে পিছনে ফিরে আদ্রিশীর পানে বিষ্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। বেশ অপ্রস্তুতও হয়ে পরেন। নিজের বিষ্ময়তা দমিয়ে আদ্রিশীকে বলেন,
-“আমি শ্রেয়সী হতে যাব কেনো? কি আজেবাজে কথা বলছো? আর এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেও আদ্রি।”

-“আমি আরাবী শাহনেওয়াজের মেয়ে তাই না মা?”

-“তুমি আদনান শেখের মেয়ে ভুলে যেও না।”

-“তাহলে আমার নাম আদ্রিশী শাহনেওয়াজ কেনো? আদ্রিশী শেখ নয় কেনো?”

আদ্রিশীর কথায় থমকে যায় শোহা শেখ। আদ্রিশী এগিয়ে এসে শোহা শেখকে বলে,
-“লুকাবে না মা। তুমিই শ্রেয়সী। মিথ্যা বলবে না। আর বললেও আমি বিশ্বাস করব না।”

-“কি লুকাবো তোমার কাছে? মিথ্যাই বা কেনো বলব?”

-“মা তুমি কিন্তু কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছো।”

-“কথা আমি ঘুরাচ্ছি না তুমি প্যাচাচ্ছো।”

-“ওকে ফাইন। আর কিছু বলতে হবে না বোঝাতেও হবে না। তুমি শ্রেয়সী আর বাবাই আরাবী তা আমি বুঝে গেছি। কিন্তু এত লুকোচুরি করছো কেনো? তাই কেবল অজানা।”

-“তেমন কিছুই না। তুমি ভুল ভাবছো।”

-“তাই না? আমি ভুল ভাবছি তো? তাহলে আমাকে ছুঁয়ে সত্যি বলো।”

শোহা শেখ চোখ রাঙ্গিয়ে বলেন,
-“আজগুবি কাজকর্ম না করলে চলছে না তোমার আদ্রি?”

-“মা প্লিজ বলো।”

শোহা শেখ রেগে চলে যাওয়ার জন্য পেছনে ফিরতেই আদ্রিশী উচ্চস্বরে বলে,
-“তুমি যদি আজ সত্যিটা না বলো তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব মা। হারিয়ে যাব আমি।”

মেয়ের কথা শুনে থমকে যায় শোহা শেখ। অক্ষিদ্বয় টলমল করে উঠছে তার। মস্তিষ্কে কড়া নাড়ে পুরোনো স্মৃতির। তার মেয়ে এই এক সত্যি জেনে চলে গেছে। আরেক মেয়ে সত্যি না জানায় চলে যেতে চায়। পেছনে ফিরে আদ্রিশীর পানে তাকিয়ে বলেন,
-“শ্রেয়সী-আরাবী গল্পটা তো তোমার জানা। আর কি সত্যি জানতে চাও?”

আদ্রিশীর চোখে মুখ উচ্ছ্বসিতায় খেলছে। দ্রুত মায়ের সম্মুখে ঝুঁকে এসে বলে,
-“তোমার কি হয়েছিলো? বিদেশে কেনো চলে এলে? আর নাম কেনো পাল্টে নিয়েছো?”

-“শ্রেয়সী থেকে শোহা হয়ে উঠার গল্পটা অত সহজ ছিলো না আদ্রি। কিশোরী বয়সে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা সম্মুখীন হয়েছিলাম আমি। ভয়ংকর সব স্মৃতি গুলো শ্রেয়সী কে তাড়া করতো। তা শ্রেয়সীর মেনে নিতে কষ্ট হতো। কষ্ট গুলো বক্ষস্থলে চাপা পরতে পরতে একটা সময় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হই। হসপিটালে নিজেকে দ্বিতীয় বার জীবিত দেখে অবাক হয়েছি বেশ। জ্ঞান ফিরার কিয়ৎ পর আগমন ঘটে আরাবীর। আরাবী কে দেখে আমি বড়সড় শক খাই৷ কেননা আরাবী কেবল আমার স্বপ্নেই বিচরণ করতো বাস্তবে নয়৷ আরাবীর কোলে আনুশী ছিলো। আরাবী এসে আমার পাশে বসে অঝোরে চোখের জল ফেলে। জীবনে প্রথম কোনো ছেলেকে কাঁদতে দেখেছি। তাও নিজের প্রিয় পুরুষকে।”

থমকে যায় শ্রেয়সী। কন্ঠ ভারি হয়ে আসছে তার। ওষ্ঠদ্বয় চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আদ্রিশীর পানে তাকিয়ে ভাবছেন তার মেয়েটা বড্ড ছোট এত সব কথা তার মাথায় যাবে তো? বলাটা ঠিক হচ্ছে তো? এই ভয়ংকরী জ’ঘ’ন্য অতীতটা মানতে পারবে তো? শ্রেয়সী নিরুপায়। তার মেয়ে সব কিছু জানতে চায়। শ্রেয়সী কে চুপ করে থাকতে দেখে কম্পিত গলায় আদ্রিশী বলে,
-“তারপর কি হয়েছে মা?”

নাক টেনে শ্বাস নিয়ে পুনরায় বলা শুরু করে শ্রেয়সী,
-“হসপিটাল থেকে বাড়ি আসার পরই আরাবী বিয়ের জন্য পাগলামি শুরু করে। তনুফ ভাইয়া আরাবীর উন্মাদনায় বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। অতঃপর বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হই৷ বিয়ে কয়েক মাস পর আরাবী জানায় আমরা আর দেশে থাকব না। আরাবী চায় না আমাদের মেয়ের উপর অতীতের কোনো আঁচ আসুক তাই দ্রুত বিদেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর আনুশী কে নিয়ে আমরা বিদেশে চলে আসি। আনুশীর যখন চার বছর বয়স তখন তুমি আসো আমাদের জীবনের নতুন খুশী হয়ে। আমি এবং আরাবী দুজন চাইতাম না যে তোমরা দুই বোন কখনও জানো তোমাদের বাবা আলাদা ব্যক্তি। কঠিন হলেও সত্য। তাই আমরা পরিচয় বদলে ফেলি। বাঁচার অধিকার আমাদেরও আছে। সব সময় চাইতাম সুস্থ ভাবে বাঁচতে তাই নিজের অস্তিত্ব মিটিয়ে নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু কে জানতো সেটাও আমাদের জীবনে ক্ষণস্থায়ী হবে।”

চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পরছে শ্রেয়সীর। আদ্রিশী তার মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। সেও কাঁদছে। তার বাবা-মা জীবনে এতটা কষ্ট সহ্য করেছে। তবুও তাদের জন্য বাঁচতে শিখেছে। বেঁচে আছে। হাজারো নি’ষ্ঠু’র’তা থেকে তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। আদ্রিশী শ্রেয়সী কে জিজ্ঞেস করে,
-“আমাদের জীবনে তো আর কোনো দুঃখ নেই মা। তাহলে এত কষ্ট কেনো?”

-“আছে আদ্রি। আনুশী আমাদের কাছে নেই। আমার মেয়েটা এই ভয়ংকর সত্যি জেনে চলে গেছে আমাদের ছেড়ে।”

বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিশী শ্রেয়সীর পানে। সশব্দে কেঁদেছে শ্রেয়সী। আদ্রিশী শ্রেয়সীর চোখে জল মুছে জিজ্ঞেস করে,
-“আপু নেই মানে? কোথায় গেছে?”

-“আনুশী কোনো ভাবে সত্যি জেনে ছিলো। সত্যি জানতেই দৌড়ে আরাবী কে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো ‘তুমি আমার বাবা। আর কেউ না। আমি শুধু তোমার মেয়ে। আমার বাবা তুমিই বলে দাও।’ আনুশীর কথায় আরাবী ওকে শক্ত করে জড়িয়ে বলেছিলো ‘আনুশীর বাবা একজনই আর সে আরাবী।’ তবুও আমার মেয়েটা শান্ত হয়নি। খুব কেঁদেছে সেদিন। তারপর আমার চঞ্চল মেয়েটা একদম চুপসে যায়। কথা বলা বন্ধ করে দেয়। হাসতে যেনো ভুলে যায়। আনুশীর এমন পরিবর্তনে। আমরা বেশ চিন্তিত ছিলাম কিন্তু কখনও ভাবিনি আনুশী বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে।”

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিশী। আদ্রিশীর এখনও মনে আছে আনুশীর পনেরো তম জন্মদিনের কথা। তার বাবা-মা আর বোন সেদিন বেশ আনন্দে কাটিয়েছে। ভীষণ আনন্দ করেছে। আনুশী আদ্রিশী কে সবচেয়ে বেশি ভালো বাসতো। জন্মদিনের প্রথম কেকটাও আগে তার বোন কে খাইয়েছে। আদ্রিশীর চোখের জল বাঁধ মানছে না। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পরছে। আদ্রিশী নিজেকে সামলে শ্রেয়সী কে জিজ্ঞেস করে,
-“তুমি কিভাবে নিশ্চিত আপু বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে?”

টলমলে দৃষ্টিতে আদ্রিশীর পানে তাকিয়ে শ্রেয়সী তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
-“আমার এখনও মনে আছে। সেদিন আনুশীর স্কুলে প্রোগ্রাম ছিলো। আনুশী প্রোগ্রামের জন্য অন্য একটা স্কুলে গিয়েছিলো। আমিও ছিলাম। ফাংশন শেষে সবাই মেকআপ রুমে চলে যায়। আমি আনুশী কে খুঁজতে সেদিকে যাই৷ মেকআপ রুমে আনুশী ছিলো না তবে ওর ব্যাগের উপর একটা চিরকুট রাখা ছিলো। চিরকুটে লেখা ছিলো ‘আমাকে খুঁজো না মা। এই বি’দ’ঘু’টে জ’ঘ’ন্য সত্যি নিয়ে আমি বাঁচতে পারছি না। জানো তো মানুষ হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু যে নিজ ইচ্ছায় হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই খুঁজো না।’ সেদিনের পর আর আমার মেয়ে কে খুঁজে পাইনি।”

শব্দ করে কাঁদছে শ্রেয়সী। আদ্রিশী স্তব্ধ, নিস্তেজ হয়ে দাঁড়িয়ে। সে এতদিন জানতো তার বোন হোস্টেলে। অথচ সে নেই। চলে গেছে সেই কবেই। আদ্রিশীর আজ খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে। মনটাও বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শ্রেয়সী কে শান্তনা দেওয়া মতোও ভাষাও আদ্রিশীর কাছে নেই৷ সে কি করে মানবে এত কিছু? তার বাবা-মা সারাটা জীবন কেবল ভয়ে ভয়ে বেঁচে এসেছে। শ্রেয়সী আকস্মিক আদ্রিশী কে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“আমার আর হারানোর ক্ষমতা নেই আদ্রি। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না কখনও। আমি এবার সত্যি সত্যি ম’রে যাব।”

আদ্রিশীও শ্রেয়সী কে জড়িয়ে ধরে আছে৷ আদ্রিশী আজ যেনো কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সে এসবের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। আদ্রিশী মানতে নারাজ তার বোন নেই। হারিয়ে গেছে। এই সত্যি নিয়ে বাঁচা বড় দ্বায় হয়ে দাঁড়াবে তার কাছে। প্রতি নিশ্বাস কেবল বিষাক্ত শ্বাসে পূর্ণ হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস নামক আশ্বাসও আজ নিঃশেষে পরিনত হলো।
_____________________

বাড়ি ফিরে থমথমে পরিবেশ দেখে ভড়কে যায় আরাবী। আজ কে বাড়িটা একটু বেশিই নির্জন বলে বোধ হচ্ছে। কেমন থমথমে নিস্তব্ধ, নির্জন পরিবেশ চারদিকে। প্রতিদিন বাড়ি ফিরতেই সবার আগে আদ্রিশী দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করে তার জন্য কি এনেছে। তারপর শুরু হয় আদ্রিশীর সারা দিনে গল্প। কি কি করেছে? মা-মেয়ে কি বানিয়েছে সে সব কিছু। কিন্তু আজ তার উল্টো। খানিক চিন্তিত হয়ে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা দেয় আরাবী। কক্ষের সদর দরজার সম্মুখে পৌঁছাতেই দেখে শ্রেয়সী সোফায় বসে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। আর আদ্রিশী ফ্লোরে বসে শ্রেয়সীর হাঁটুতে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। আরাবী ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে নিঃশব্দে এগিয়ে যায় সেদিকে। অতঃপর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। একপলক শ্রেয়সী পানে তাকিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়।

ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে বেলকনিতে চলে যায় আরাবী। যতই চেষ্টা করুক পুরোনো অতীতটা তাকে তাড়া করে বেড়ায় তীব্র ভাবে। যতই পালাতে ইচ্ছে করুক ততোই সম্মুখে পদার্পণ করে। পুরোনো অতীতটা প্রায় ভুলে গেছিলো আরাবী-শ্রেয়সী। কিন্তু ভুলতে গিয়ে তা তীব্র আঘাত বয়ে হানে তাদের জীবনে। সে আঘাতটা ছিলো আনুশী। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর থেকে শ্রেয়সী-আরাবীর অন্তরালে জখমটা গভীর ভাবে দা’গ কে’টে দেয়। এমন কোনো মুহূর্ত নেই যে মুহুর্তে আনুশীর কথা মনে পরেনি আরাবীর। প্রতি মুহূর্ত কাটে তার গরলতায়। আজও আকাশের পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরাবী। আনুশী আকাশ দেখতে ভীষণ ভালোবাসতো। বিশেষ করে তার বাবার সাথে। আরাবী অফিস থেকে আসতেই আনুশী জেদ ধরতো বাবা মায়ের সাথে ছাদে বসে আকাশের তারা গুনবে। তারা গুনতে গুনতে খিলখিল করে হেসে উঠতো। ছোট আনু তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,”আচ্ছা বাবা আমিও কি স্টার হয়ে যাব? তখন তুমি কি আমাকে দেখবে?” মেয়ের এহেন কথায় আরাবীও হাসতো। তবে আজ তার কাছে মনে হচ্ছে তার মেয়ে সত্যি স্টার হয়ে গেছে। কিন্তু এই স্টারের একটাই তফাত অনুভব করা যায় ছোঁয়া যায় না, দেখাও যায় না। আরাবী চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস টেনে বলে,
-“না ঘুমিয়ে রাত জেগে আছো কেনো?”

-“তুমি না দেখে কি করে বুঝলে আমি দাঁড়িয়ে আছি?”

আরাবী মৃদু হেসে বলে,
-“বাবা হয়ে মেয়ের উপস্থিতি টের পাব না? তাহলে তো বাবা হওয়াটাই বৃথা।”

ছোট নিশ্বাস ছেড়ে খানিক এগিয়ে এসে আদ্রিশী বলে,
-“আপুর কথা মনে পরছে?”

-“একজন বাবা হয়ে মেয়ে কে তো ভুলে যাওয়া যায় না। মানুষ ভুলে গেলে কেবল মনে করে। আমি ভুলিনি তাই মনে করার কথাও না।”

-“তার মানে আপুর কথাই ভাবছো?”

আর কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি আরাবীর কাছ থেকে। আদ্রিশী এগিয়ে গিয়ে আরাবী ডান বাহু আঁকড়ে ধরে দাঁড়ায়। আরাবী এক পলক মেয়ের পানে দৃষ্টি আবদ্ধ করতেই চমকে যায়। এলোমেলো চুল, অক্ষিদ্বয় লাল হয়ে ফুলে আছে, ঔষ্ঠদ্বয় কেঁপে কেঁপে উঠছে বি’ধ’স্ত দেখাচ্ছে। আরাবী বাম হাতটা আদ্রিশীর মাথায় বুলিয়ে বলে,
-“এলোমেলো দেখাচ্ছে কেনো আমার মেয়েটাকে?”

-“জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে বাবা। আর কি’ই বা ঠিক থাকবে?”

ওষ্ঠদ্বয় বক্রাকৃতি করে হেসে আরাবী বলে,
-“জেনে গেছো সব?”

কান্না চেপে রাখার বৃথা চেষ্টা করে আদ্রিশী মাথা নাড়ায়। আরাবী ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে আকাশের পানে দৃষ্টি আবদ্ধ করে বলে,
-“তুমিও এবার ভুল বুঝে বাবা-মা কে ছেড়ে চলে যাবে তাই না?”

করুন কন্ঠে আদ্রিশী বলে,
-“কখনও না বাবা। আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাব না। আর প্রমিস আমি আপুকেও ফিরিয়ে আনব।”

মেয়ের কথায় আরাবী শব্দ করে হেসে বলে,
-“আমার মেয়েটাকে কত খুঁজেছি। পেলাম কই? আনুশী ঠিকি বলে, যে নিজ ইচ্ছায় হারায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।”

আদ্রিশী আরাবীর হাতটা খামচে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
-“বাবা আমার ভীষণ ভয় করছে। দুনিয়াটা বড্ড নি’ষ্ঠু’র। আপুর কোনো ক্ষতি হয়নি তো আবার?”

চমকে আদ্রিশীর পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরাবী। এমন নয় এই ভয়টা আগে কখনও আরাবীর হয়নি। প্রতিটা মুহুর্তে সে এই ভয়ের সম্মুখীন হয়েছে। তবুও সামলে নিয়েছে নিজেকে। আদ্রিশীর চোখে জল টপটপ করে গড়িয়ে পরছে। আরাবী ওষ্ঠদ্বয় চেপে আবারও সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্থীর হয়ে বলে,
-“আমার মন বলে আনুশী যেখানেই আছে ভালো আছে।”

-“ভালো আছে কিভাবে বলতে পারো? আমাদের ছাড়া ভালো থাকবে কি করে?”

-“ভালো আছে বলেছি আদ্রি। ভালো আছে মানে সুস্থ আছে। কিন্তু খুশি নয়। আমার মেয়েটা বড্ড দুঃখে আছে।”

-“আপু কে কি আর খুঁজব না?”

খানিকক্ষণ সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস টেনে আরাবী বলে,
-“না।”

আদ্রিশী উত্তেজিত হয়ে বলে,
-“কেনো বাবা?”

-“ভাগ্যে বিশ্বাস করো তো? যদি ভাগ্যে লেখা থাকে তবে একবার না একবার জীবনের কোনো না কোনো মোড়ে দেখা হবে। অপেক্ষায় আছি।”

-“আপুর প্রতি তোমার অনেক অভিমান জমেছে তাই না বাবা?”

আরাবী আবারও চুপ করে আছে। আদ্রিশী এবার আর বাবার কাছে উত্তরের আসা না করে সম্মুখে দৃষ্টি আবদ্ধ করে। কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই শ্রেয়। আদ্রিশী জানে তার বাবা মিথ্যা বলেছে। যতই বলুন আনুশী কে খুঁজবে না কিন্তু ঠিকি খুঁজে বেড়ায়। আদ্রিশী কাঁধে কারো হাতের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে পেছনে তাকায়। শ্রেয়সী দাঁড়িয়ে আছে। মৃদু হেসে এগিয়ে এসে আদ্রিশীর পাশে দাঁড়ায় শ্রেয়সী। শ্রেয়সীর দৃষ্টিও আকাশ পানে। খানিকক্ষণ মৌনতা বাদে নীরবতা ভেঙ্গে শ্রেয়সী বলে,
-“আঠারো তম বয়স পূর্ণ হলো আমার মেয়ের। শুভ জন্মদিন মা যেখানেই থাকো।”

চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পরছে শ্রেয়সীর। আদ্রিশীর মনের অবস্থা বেহাল। পাথরের ন্যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আরাবী। আদ্রিশী তার মা-বাবা কে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। শ্রেয়সী-আরাবী সযত্নে আগলে নেয় আদ্রিশী কে। আদ্রিশীর চোখের জল বাঁধহীন গড়িয়ে পরছে। বেশ খানিক পর আদ্রিশী আরাবী-শ্রেয়সী কে ছেড়ে দিয়ে বলে,
-“তোমরা একটু অপেক্ষা করে আমি একটা জিনিস নিয়ে আসছি।”

আদ্রিশী ঘর থেকে বের হওয়ার পর শ্রেয়সী আরাবী কে বলে,
-“আদ্রি কে মিথ্যা বললে কেনো?”

-“কি মিথ্যা বলেছি?”

-“আনু কে আর খুঁজবে না?”

-“খুঁজব। মৃ’ত্যু’র আগ পর্যন্ত। দরকার হলে আমি পৃথিবী এফোঁড়ওফোঁড় করে খুঁজব। শেষ বার হলেও চোখের দেখা দেখে যেতে চাই আমার মেয়েটা কে।”

-“আদ্রি কে কেনো মিথ্যা বললে?”

তাচ্ছিল্য হেসে আরাবী বলে,
-“তাহলে কি বলতাম? খুঁজব? অতঃপর প্রতিটা মুহূর্ত সে প্রহর গুনবে। কখন তার বাবা তার বোন কে এনে দিবে। আর আমি এক আকাশ পরিমান নিরাশতা নিয়ে তাকে বলতাম খুঁজে পাইনি আমি আনুকে। তারপর আমার মেয়েটা হতাশ হয়ে আস্তে আস্তে ভেঙ্গে পরতো।”

-“প্রতিটা বছর আনু কে খুঁজতে আমি দেশে যাই। রোদ্দু কে নিয়ে কোথায় কোথায় না খুঁজেছি। দিন শেষে হতাশ হয়ে ঘরে ফিরেছি। জীবনে কি বড্ড বেশি পা’প করে ফেললাম আরাবী? যে আমার নতুন জীবনের অধ্যায় হারিয়ে গেলো।”

আরাবী আলতো করে জড়িয়ে ধরে শ্রেয়সীকে। নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে শ্রেয়সীর৷ আরাবী চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে। নিঃশব্দে চোখে জল মুখে নেয় সে। দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করে আদ্রিশী। আদ্রিশীর উপস্থিতিতে পেয়ে আরাবী শ্রেয়সী কে ছেড়ে দূরে দাঁড়ায়। আদ্রিশীর হাতে বড় পোস্টারের কাগজের মতো কিছু একটা। আরাবী ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
-“এটা কি এনেছো আদ্রি?”

মেকি হেসে আদ্রিশী বলে,
-“আপুর জন্য বার্থডে গিফট বানিয়েছিলাম। জানো বাবা এটা আমি নিজে বানিয়েছি। ইনেসাও হেল্প করেছে একটু।”

জোরপূর্বক হেসে এগিয়ে এসে শ্রেয়সী বলে,
-“তা দেখাও কি গিফট বানিয়েছো।”

আদ্রিশী উচ্ছসিত হয়ে পেপারটা মেলে ধরে সম্মুখে। পেপারের পানে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে শ্রেয়সী। জল রঙ্গের পেইন্টিং করা পেইন্ট। পেইন্টিনে আরাবী, শ্রেয়সী, আনুশী আর আদ্রিশীর হাসোজ্জল প্রতিচ্ছবি। সেখানে লেখা “ফ্রম মাই সুইট সিস্টার, হ্যাপ বার্থডে’ এন্ড আই মিস ইউ অনেক অনেক।”
শ্রেয়সী পেইন্টিং এ থাকা আনুশীর ছবির উপর হাত বুলাচ্ছে। আদ্রিশী ওষ্ঠদ্বয় চেপে বলে,
-“ভেবেছিলাম আপু তার আঠারো তম জন্মদিন বাড়িতে সেলিব্রেট করবে। সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আমি পেইন্টিং টা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু যার জন্য সারপ্রাইজ রেডি করলাম সেই নেই। উল্টো আমি শক খেয়ে গেলাম।”

আরাবী-শ্রেয়সী এগিয়ে এসে আদ্রিশীকে জড়িয়ে ধরে। শ্রেয়সী আদ্রিশীকে বলে,
-“আনু আদ্রি আমার কাছে এক। আনু নেই তো কি হয়েছে? আদ্রি আছে। আদ্রি আনুর হয়ে বার্থডে সেলিব্রেট করবে।”

আনুশীর জন্মদিনটা আদ্রিশী নিয়ে কাটিয়ে দেয় আরাবী-শ্রেয়সী। জীবনে পরিপূর্ণতা পেয়েও অপূর্ণ রয়ে গেলো। আনুশী নামক অপূর্ণতায় ভুগতে হবে আজীবন। শ্রেয়সী ভেবে নিয়েছে তার জীবনে সুখ অলক্ষুণে। কিছু মানুষের সুখী না হওয়াই শ্রেয়। আর তা শ্রেয়সী। আরাবী নিজেকে ব্যর্থ বাবা বলে মনে করে। সে আগলে রাখতে পারেনি। আনুশী তাকে প্রথম বাবা বলে ডেকেছিলো। বাবা ডাকের মতো অনুভূতি এর আগে কখনও আরাবী অনুভব করেনি। দিন শেষে আনুশীর মুখশ্রী পরখ করতেই আরাবী সারা দিনে ক্লান্তির অবসান ঘুচিয়ে যেতো। আর আজ সেই আনুশী কে খুঁজে খুঁজে ক্লান্তিরাও ক্লান্ত হয় না।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছাদের এক কোনে বসে আছে আরাবী-শ্রেয়সী। আরাবী এক হাতে শ্রেয়সী কোমর জড়িয়ে আছে। শ্রেয়সী আরাবীর কন্ধে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরছে। শ্রেয়সীর চোখের জলে আরাবী কাঁধের শার্টের অংশ ভিজে একাকার। আরাবী অস্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের পানে। আকাশে আজ তারা নেই। মেঘাচ্ছন্ন অম্বর! চোখ বন্ধ করে নেয় আরাবী। সময়টা যদি পেছনে পারিয়ে দেওয়া যেতো। তবে আজকের সময়টা ভিন্ন হতো। আরাবী আড় চোখে শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সব সময় সত্য কে মেনে নিতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।”

শ্বাট টেনে অক্ষিদ্বয় আবদ্ধ রেখে মৃদুস্বরে শ্রেয়সী জিজ্ঞেস করে,
-“কোন সত্যিটা মেনে নিব না?”

-“যে সত্যটা তুমি মেনে নিতে অক্ষম।”

-“তবে বলব আনুশী! দুঃস্বপ্নের ন্যায় হারিয়ে গেলো মেয়েটা।”

-“সুস্বপ্ন ন্যায় ফিরেও পেতে পারো।”

-“চার বছর কম সময় নয় আরাবী।”

-“অপেক্ষা পৃথিবীর শুদ্ধতম অনুভূতি। অপেক্ষার মাঝে স্বার্থপরতা উৎপীড়নতা হয় না। ধৈর্য্যের আরেক নাম অপেক্ষা। আমি আমার মেয়ের জন্য সারা জীবন অপেক্ষার প্রহর গুনবো।”

ওষ্ঠ চেপে মৃদু হেসে শ্রেয়সী বলে,
-“তুমি পাশে আছো বলে সকল অপেক্ষা এক নিমেষে কাটিয় দেওয়া ক্ষমতা বেঁচে আছে।”

আকাশের দিকে তাকিয়ে আরাবী বলে,
-“শ্রেয়সী আছে বলেই অপেক্ষারা এত সুমিষ্ট হয়।”

~সমাপ্ত….

[শেষের দিকে এসে গুলিয়ে ফেলেছি পুরো গল্পটাই। গল্পের সৌন্দর্য শেষ পর্বে তা ঠিক করে লেখতি পারলাম না। খাপছাড়া হয়ে গেছে। তার জন্য আমি সত্যি দুঃখিত। ভুল গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল]

সবাই অনেক অনেক ধন্যবাদ🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here