#শ্রাবণের_ধারা ~(৯ম পর্ব)~
#লেখনীতে_ওয়াসেকা_তাবাসসুম ~
~চোখ থেকে অশ্রু গুলো ঝরে পরতে লাগলো। আসলেই কি আর কিছুই করার নেই?সব শেষ হয়ে গেল? না এতো সহজে সব শেষ হতে পারে না। আমি জানি তূর্য আমাকে ভয় দেখানোর জন্যই ওইভাবে বলেছে। অন্তত বাবার সাথে কথা বলে দেখতে হবে আমাকে।
কিছুক্ষণ বাদে আম্মুর ডাকে উঠে চোখ দুটো মুছে নিলাম, যেভাবেই হোক এই বিয়ে ভেঙে দিতে হবে এই প্রত্যাশায় এগিয়ে গেলাম। ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি তূর্য আর আংকেল চলে গিয়েছে। বাবা আমাকে দেখে বসতে বললেন, আমিও চুপচাপ সোফায় বসে পড়লাম। এরপর শান্ত গলায় বাবা বলা শুরু করলেন,
— ধারা একটা কথা তোকে বলবো বলবো করে বলাই হয়নি আসলে আমি……
— “আমি বিয়ে করবো না” বাবার কথা শেষ না হতেই আমার মুখের থেকে এই বাক্য উচ্চস্বরে বেরিয়ে এলো। বাবা আর আম্মু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এদিকে আমি চোখ দুটো বন্ধ করে মাথা নিচু করে বসে আছি।
— বিয়ে? তোমাকে এই ব্যাপারে কে বললো? (বাবা)
— আমার মনে হয় তূর্য বলেছে। তাই না ধারা? (মা)
— আসলে.. বাবা আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না।
— ধারা আমি ভেবেছিলাম এই বিষয়ে ধীরে সুস্থে তোমার সাথে আলোচনা করবো। কিন্তু তূর্য তোমাকে আগেই এই ব্যাপারে বলে দিল। (বাবা)
— ভালোই তো হয়েছে। একদিন তো বলতেই হতো আজকেই জেনে গেছে। (মা)
— তোমরা আমাকে একটাবার জিজ্ঞেস তো করতে পারতে? আমি বিয়ে করতে চাই কি চাই না একটাবারও জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলে না কেউ?
— তোমাকে এখনই কেউ বিয়ে দিচ্ছে না ধারা। হ্যা এইটা সত্যি যে আমি আর তৌফিক ভাই মিলে অনেক আগেই তোমাদের বিয়ে ঠিক করে রেখেছি কিন্তু বিয়েটা পরেই হবে এই নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আর তো কয়েকটা মাস তারপর নাহয় তোমাদের কাবিন করিয়ে দিব। তুমিও এরমধ্যে ইন্ডিপেন্ডেন্ট হয়ে যাবে। (বাবা)
— আমরা জানি মা তুমি এখনই বিয়ে করতে চাস না। তোকে এখন বিয়ে করতে হবে না। দরকার পরলে তুই যখন বলবি তখনই বিয়ের কথা উঠবে। (মা)
— না মানে বিষয়টা এমন না। তূর্য তো আমার মতোই স্টুডেন্ট। তূর্য তো কিছুই করে না তাহলে ওকে কিভাবে বিয়ে করবো?
— কি? কি বললি তুই? তূর্য কিছু করে না তাই ওকে বিয়ে করবি না? এই কথা কি তুই বললি? (মা)
দুজনেই চোখ বড় বড় আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে কেবল মনে হলো আমি একটু আগে কি বললাম। যেই আমি প্রথম থেকেই বলে এসেছি যে নিজের পায়ে দাঁড়াবো, নিজের খরচ নিজেই বহন করবো। বিয়ের আগে হোক আর পরে হোক যখন থেকেই নিজে কিছু করবো তখন থেকেই নিজের খরচ নিজেই চালাবো। সেই আমার কাছ থেকে এমন কথা কেউই আশা করবে না। অজুহাত দিতে গিয়ে নিজের কথায় নিজেই ফেঁ’সে যাচ্ছি।
— কি ভাবছিস? তুই আসলেই আমাকে অবাক করে দিলি রে। এই কথা যে আমার মেয়ে বলবে এইটা তো ভাবতেই পারিনি। (বাবা)
— আসলে আমি ওইভাবে বলিনি।
— আচ্ছা বলেছিস যখন তাহলে উত্তরটাও দেই। দেখ তূর্য সামনে ওর বাবার ব্যবসা দেখবে এইটা জানা কথা তাই এই বিষয়ে চিনতে করতে হবে না তোর। আসলে আমি ভেবেছিলাম কাবিনটা করিয়ে রাখলে এইদিক দিয়ে হালাল থাকা গেল। সংসার না হয় পরে করিস এতে আমার সমস্যা নেই। (বাবা)
এখন যে কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার সমস্যা যে তূর্যকে নিয়ে এইটা এখন কিভাবে বুঝাবো? আমি তো তূর্যকে বিয়ে করতে চাই না। এইটা যদি আরো আগে হতো তখন আমার আপত্তি থাকতো না কিন্তু এখন না। এতো কিছুর পরে তূর্যকে বিয়ে করা সম্ভব না আমার পক্ষে। আমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বাবা বললো,
— কিছু তো বল মা। বিয়েটা করবি তো? আমি জানি তুই আমার সিদ্ধান্তের উপর না করবি না।
— বাবা আমার বিয়ে করা নিয়ে সমস্যা নেই কিন্তু আমি তূর্যকে বিয়ে করতে পারবো না।
— তোর সমস্যা তূর্যকে নিয়ে? ওকে তো চিনিসও না ঠিক মতো তাহলে?
— হ্যা হ্যা ওইটাই সমস্যা। মানে যাকে চিনিই না তাকে বিয়ে করবো কিভাবে বলো?
— হ্যা তো চিনে নে। ওর সাথে কথা বল, দেখা কর। (মা)
— মা তুমি বুঝতে পারছো না।
— বুঝায় বললে তো বুঝবে তাই না? তুই যে কি বলছিস আমিই তো বুঝতে পারছি না। (বাবা)
— আমি বিয়েটা করবো না শেষ, আর কিছু না।
— এতো তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত দিচ্ছিস কেন? তুই কি কাউকে পছন্দ করিস? যার কারণে বিয়েটা করতে চাচ্ছিস না? (বাবা)
— তুই তো আমাকেও কখনো কিছু বলিসনি। কেউ কি আছে আগের থেকে? (মা)
— “এখন তোমাদের কি বুঝাবো সেটা নিজেই বুঝতে পারছি না।” মনে মনে বলতে লাগলাম। কি যে বলে এই বিয়েটা আটকাবো আসলেই মাথায় আসছে না।
— ধারা? উত্তর দিচ্ছিস না কেন? তুই কাউকে পছন্দ করিস? (বাবা)
— বাবা আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত না। এটাই কারণ অন্য কিছু না। আমি এখনও বিয়ের বিষয়ে কিছু ভাবিনি।
— ঠিক আছে। তোমাকে এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি আমি। এরপরে তোমার সিদ্ধান্ত জানবো। সেটা ‘হ্যা’ হোক আর ‘না’ হোক তখনই শুনবো। (বাবা)
— আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাবে না। আমি যদি এক সপ্তাহ পরেও না বলি তোমাদেরকে তা মেনে নিতে হবে।
— ঠিক আছে দেখা যাবে। তবে একটা কথা মাথায় রেখো তোমাদের বিয়েটা কিন্তু অনেক আগের থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম আমি। এই বিষয়ে তৌফিক ভাইয়ের সাথে কথা প্রায় ঠিকঠাক হয়েই আছে। কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমার দিকটাও ভেবে দেখো ধারা। (বাবা)
সেখান থেকে উঠে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বসে পড়লাম। রাতে আর বাইরে যাইনি, খেতে দেখেছিল কিন্তু খাবো না বলে দিয়েছি। বাবার বলা শেষ কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে খালি। মনে হচ্ছে বিয়ের জন্য সরাসরি চাপ না দিলেও কথার মাঝে একটা ঠিকই ছিল। তবে বিয়েটা ভেঙে দেয়ার একটা সুযোগ আছে। তূর্য ইচ্ছা করেই ওইভাবে বলেছে যাতে আমি ভয় পেয়ে আর চেষ্টাই না করি। ওর লাভ হলো না আমাকে ওইসব বলে কারণ সুযোগ যখন আছে এই বিয়ে ভেঙে ছাড়বো।
——————–
শান্ত মনে ক্যাম্পাসের এক গাছতলায় বসে আছি। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে আছে, পাখিগুলোর মনে হচ্ছে মন খারাপ। তাদের মনেও নেই কিচিরমিচির করার ইচ্ছা। খেয়াল করলাম একটা পাখি একা গাছের একটা ডালে বসে আছে। খুব বিষন্ন দেখাচ্ছে পাখিটাকে, ওর হয় তো আমার মতোই মন ভালো নেই।
এখানে আসতে আসতেই জিনিয়াকে ফোন দিয়ে বলে দিয়েছি চলে আসতে, ওকে এই বিষয়ে সবটা জানাতে হবে। আজকে তূর্য ভার্সিটিতে এসেছে না কি বুঝতে পারছি না। যদিও ওকে একবারো দেখেনি তারপরেও ওর থেকে দূরে দূরে থাকা ভালো। এই বিয়েকে ওযুহাত বানিয়ে যা খুশি করতে পারে তূর্য।
— ধারা? কি রে এখানে ডাকলি কেন?
— ওহ্ এসেছিস তুই।
— হ্যা কিন্তু কি হয়েছে?
— তোকে এর মধ্যে কিছুই বলতে পারিনি রে। গতকাল বাসায় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। তৌফিক আংকেলের কথা খেয়াল আছে তোর? একবার যে বলেছিলাম?
— ওই যে বিদেশে থাকেন যিনি?
— হ্যা ওনার কথাই বলছি। তূর্য তৌফিক আংকেলের ছেলে।
— কিহ!!!!?????
— হ্যা। গতকাল ওরা আমাদের বাসায় এসেছিল।
— তূর্য ওনার ছেলের আর তুই এইটা আজকে বলছিস আমাকে?
— আমি আগে জানলে তো বলতাম। আমিও গতকাল জানতে পেরেছি কিন্তু জানিস তূর্য সব আগের থেকেই জানতো।
— মানে সব জেনে শুনে এতো দিন এই নাটক চালালো?
— সবটা সাজানো। আমাদের দুই পরিবার আমাদের বিয়ে পর্যন্ত ঠিক করে রেখেছে জানিস? এটাও তূর্য আগের থেকেই জানতো।
— এই ছেলে তো সেই লেভেলের এক্টিং পারে দেখছি। এতো গুলো দিনে বুঝতে পর্যন্ত দেইনি কিছু।
— আমিও অবাক হয়ে যাচ্ছি। যদিও ওর পরিবারের ব্যাপারে আমিও এতো কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তূর্য যতটুকু বলেছে ওইটুকুই। তৌফিক আংকেলের ছেলের সাথে আমার কখনো দেখাই হয়নি তাই ওইটা যে তূর্য এইটা বুঝতে পারার সুযোগও ছিল না।
— এখন কি করবি বিয়ের ব্যাপারে?
— চিন্তা ভাবনার জন্য বাবা এক সপ্তাহ সময় দিয়েছে। এক সপ্তাহ পরে সিদ্ধান্ত শুনবে। গতকাল তূর্য বলেছে এই বিয়ে না কি আটকাতে পারব না, এই বিয়ে করতেই হবে।
— ইচ্ছা করেই তোকে উল্টা পাল্টা বুঝিয়েছে। তুই ভালো মতো বুঝিয়ে বল আংকেল আর আন্টিকে তাহলেই হবে দেখিস।
— আশা করি। এখন চল ক্লাসে যাই।
— চল যাই।
দুজনেই উঠে পড়লাম গাছতলা থেকে তারপর হাঁটা শুরু করলাম ক্লাসরুমের উদ্দেশ্য। আমি আর জিনিয়া কথা বলতে বলতে যাচ্ছি। ভাবলাম এদিকে যখন এসেইছি একটু ঘুরে যাই। অন্যদিক দিয়ে ঘুরে যেতে গিয়ে মনে হলো সেদিকে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। জিনিয়াকে থামিয়ে দিয়ে আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা করলাম। একি? সাজিদ স্যার এখানে কি করছেন? মনে হচ্ছে কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন তবে সবার আড়ালে এসে কেন?
— এই ধারা স্যার এখানে কি করছে বল তো।
— আমি কিভাবে জানবো? আমিও তো তোর সাথেই আসলাম।
— কিন্তু উনি এভাবে লুকিয়ে কথা বলছেন কেন? উনি তো ক্যাম্পাসের ভিতরেও কথা বলতে পারেন।
— হয় তো এমন কোনো কথা আছে যা সবার সামনে বলতে চাচ্ছেন না। এখন চুপ কর শুনতে দে।
স্যার আশেপাশে দেখে নিলেন তখনই আমরা দেয়ালের পিছনে লুকিয়ে পড়লাম আবার উনি ফিরে তাকাতেই আমরা একটু এগিয়ে গেলাম। স্যার ফোনে কথা বলা শুরু করলেন,
— হ্যালো? হ্যা কি হয়েছে?….. আরেহ এতো সহজ না কি? ওরা চাইলেই আমাকে ধরতে পারবে? আর এখানে সন্দেহজনক তেমন কেউ নেই। একটা ছেলে ওইদিন একটু অদ্ভুত আচরণ করেছে কিন্তু ওই ছেলে কিছু করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। বাচ্চা মানুষ!…. হ্যা হ্যা বুঝতে পেরেছি আমাকে এতো শিখাতে হবে না। আহা বুঝতে পেরেছি এখন যেতে হবে আমাকে এত সময় নেই। ফোন রাখছি।
এরপরেই স্যার ফোনটা কেটে দিলেন। আবার চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে নিলেন। আমরা আবার আড়ালে লুকিয়ে গেলাম। স্যারও চলে গেলেন সেখান থেকে। আমি আর জিনিয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছি এখানে ঠিক কি হলো। স্যারও বা কার সাথে কথা বলছিলেন?
— কিছু বুঝলি ধারা?
— কিছুই তো বুঝতে পারছি না। স্যার কার সাথে কথা বলছিলেন এটাও তো জানতে পারবো না।
— কিছু একটা ঝামেলা আছে বুঝলি। ওনার কথা বার্তা সুবিধার মনে হলো না আমার কাছে।
— সে তো আমার কাছেও মনে হয়নি। এখান থেকে চল আগে কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে।
———————
একটা বইয়ের দরকারে লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে কারো আওয়াজে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আশেপাশে তেমন কেউ নেই তবে খেয়াল করলাম পাশের একটা খালি ক্লাসরুম থেকে কথার শব্দ শুনা যাচ্ছে,
— কালকেই?
— হ্যা কালকেই কারণ আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। সময়ের কাজ সময়ে শেষ করা ভালো বুঝলি?
— হ্যা সেটা ঠিক আছে কিন্তু বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে না?
— দেখ আমি কি করছি ভালো মতোই জানি, তুমি রেডি থাক কালকের জন্য।
চলবে…………………………^-^