#শ্রাবণের_ধারা ~(৮ম পর্ব)~
#লেখনীতে_ওয়াসেকা_তাবাসসুম
~দুই পা পিছিয়ে গেলাম। তূর্য তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চলেছে। কি করবো মাথা কাজ করছে না। তূর্যকে পাশ কাটিয়ে এক দৌড়ে বাসায় চলে গেলাম। বাসায় এসেই দেখি বাবার সাথে একজন ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে আছে। আমি যেতেই দুজনে আমার দিকে ঘুরে তাকালেন।
— আরেহ ধারা কেমন আছো মা?
— তৌফিক আংকেল আপনি?
— চমকে দিলাম না কি?
— না মানে আপনি তো বিদেশে ছিলেন না?
— ছিলাম তো কিন্তু আর থাকতে পারলাম কোথায়।
— ঠিক বুঝলাম না?
— ব্যাপার না খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে।
মি.তৌফিক রহমান উনি বাবার বেশ পরিচিত একজন মানুষ। বাবার সাথে ব্যবসায়িক সূত্রে পরিচয় আর তারপরে তাদের বন্ধুত্ব। তৌফিক আংকেলকে অনেক আগের থেকেই চিনি তবে উনি বেশিরভাগ সময়ে বিদেশেই থাকেন। ওনাকে চিনলেও ওনার পরিবারের সাথে কখনো আমার দেখা হয়নি। আম্মুর কাছে শুনেছি ওনার স্ত্রী না কি অনেক আগেই মা*রা গেছেন। ওনার একটা ছেলে আছে, প্রায় আমার বয়সী তবে তার সাথে কখনো দেখা হয়নি আমার।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাবার আদেশে ঘরে চলে এলাম। ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম তারপর বিছানায় বসে ভাবা শুরু করলাম, তূর্য কি চলে গিয়েছে? না কি এখনো উপরেই আছে? কিন্তু বিল্ডিং এর মধ্যে ঢুকলো কিভাবে এটাই তো বুঝতে পারছি না আমি। আর তূর্য তখন কি বললো? আমাকে নিজের করে নিতে এসেছে এর মানে কি? মাথা কাজ করছে না একদম। কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
তূর্যর এভাবে বাড়ির ভিতরে চলে আসাটা স্বাভাবিক না। তূর্য যে নিজের ইচ্ছা পূরণে অনেক দূর যেতে পারে আমি জানি তবে কি এখানে সেই কাজেই এসে? ও কি কোনোভাবে আম্মু আর বাবার সাথে কথা বলার চিন্তায় আছে? কি করতে চাচ্ছে তূর্য!
এতোক্ষণে আম্মু ডাক দিলে উঠে আবার ড্রয়িং রুমে চলে গেলাম। সবাই বসে আছে আর বেশ হাসিখুশি প্রত্যেকে তবে এর কারণ বুঝতে পারছি না। আমি যাওয়াতে বাবা আমাকে বসতে বললো। আমি চুপচাপ আম্মুর পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। এর মধ্যেই তৌফিক আংকেল বলা শুরু করলেন,
— আমার ছেলেটা যে কোথায় গেল এখনো আসছে না কেন কিছুই বুঝতে পারছি না।
— একটা ফোন দেন ওকে।
— ফোন তো দিলাম ভাই। ফোনটাও ধরছে না কিছু না।
মানে তৌফিক আংকেলের ছেলে ও এসেছে? হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি দরজা খুলতে যাবো তখন আমাকে থামিয়ে দিয়ে আম্মু দরজা খুলতে চলে গেল। আমি চুপচাপ বসেই রইলাম ঠিক সেই সময়ে এক পরিচিত কন্ঠ কানে এলো,
— চলে এসেছি বাবা।
ঘুরে তাকাতেই চোখ দুটো আকাশে উঠে গেল। এটা তো তূর্য!! শেষমেষ বাসা মধ্যে ঢুকে পড়লো ছেলেটা? এখন কি করবো আমি? এসব হচ্ছেটা কি! তূর্য সুন্দর মতো ঘরে ঢুকলো আর সোজা তৌফিক আংকেলের পাশে গিয়ে বসে পড়লো আর আমি আবারও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তূর্য আমার দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিল। তৌফিক আংকেল বলে উঠলেন,
— যাক শেষমেষ এলি তুই? তোর সাথে দেখা করার জন্য তোর আংকেল আর আন্টি কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে জানিস তুই?
— সরি বাবা। আসতে আসতেই একটু দেরি হয়ে গেল।
— আহা ওইসব ব্যাপার না। এতো দিন পর ছেলেকে দেখতে পেলাম এটাই কতো। (বাবা)
— এটা ঠিক বলেছো। আমি দেখেছিলাম তখন তো কত ছোট আর আজকে কত বড় হয়ে গেছে। (মা)
— ধারা তুমি তো ওকে চিনতে পারোনি মনে হয় তাই না? ও আমার ছেলের তূর্য। (তৌফিক)
— ধারা কিভাবে চিনবে? ওদের তো কোনোদিন দেখাই হয়নি। (বাবা)
— সেটাই তো। আমি তূর্যকে সেই কবে দেখেছি আমার নিজের ঠিক মতো খেয়াল নেই আর ধারা তো কোনোদিন দেখাই নাই। (মা)
— আমি কি বলছি ধারা। তুই আর তূর্য নিজের মধ্যে একটু কথা বলে নে। আমরা বড়রা এখানে কথা বলবো। তুই তূর্যকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যা। (বাবা)
বাবার কথা শুনে নিঃশ্বাস ব’ন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। এখন কি করবো? আমি তো কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। এর মধ্যেই তাড়া দিয়ে বললেন,
— কি হলো ধারা? তূর্যকে নিয়ে যাও।
— আংকেল আমার মনে হয় নতুন নতুন দেখা তো তাই মনে একটু অ’স্বস্তি বোধ হচ্ছে ওর। (তূর্য)
— হ্যা তা ঠিক। নতুন নতুন দেখা হয়েছে একটু অ’স্বস্তি হতেই পারে। (বাবা)
— ধারা তুই তূর্য নিয়ে যা। তোরা একান্তে কথা বল গিয়ে। এখানে বসে থাকিস না আর। (মা)
তূর্য সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো তারপর আর কি আমিও উঠে পড়লাম। সোজা ঘরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম, তূর্য আমার পিছন পিছন হাঁটছে। ওর এক একটা পায়ের ধাপ আমার শরীরে ক’ম্প’ন সৃষ্টি করছে। ভয়ে পা স্তব্ধ হয়ে আসছে। শেষমেষ ঘরে এসে ঘুরে দাঁড়ালাম। তূর্যর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছি। তূর্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— বারান্দায় চলো।
— কেন? যা বলার এখানে বলবে।
— ধারা এক কথা বারবার বলবো না আমি।
— তোমার কি মনে হয় আমি তোমার কোথায় ভয় পাই?
— সেটা তো আমার থেকে ভালো তুমি জানো।
আর কিছু না বলে সোজা বারান্দায় গিয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। তূর্য আর থেকে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে গেল। আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,
— এখন তোমার আর কিছুই করার নেই।
— কি বলতে চাচ্ছো তুমি?
— তোমাকে এখন আমার হতেই হবে।
— তোমার কি মনে হয়? তুমি যাই বলবে তাই হবে? কখনোই না। তোমার এই আশা পূরণ হবে না।
— ধারা তুমি কি জানো তোমার বাবা আর আমার বাবা অনেক আগেই আমাদের বিয়ে ঠিক করে রেখেছে?
— কিহ? আমাকে তো কখনো এই ব্যাপারে কিছুই বলেনি। তুমি সবটা আগের থেকেই জানতে? তুমি কি আমার এই পরিচয় জানতে?
— হ্যা। তোমার এই পরিচয়টা আমি অনেক আগের থেকেই জানতাম।
— তাহলে বলো নাই কেন তুমি তৌফিক আংকেলের ছেলে?
— এমন পরিস্থিতি কখনোই আসেনি। আমরা কখনো আমাদের পরিবার নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করেছি? একটু মনে করে দেখো তো।
মনে করতে লাগলাম আর তখনই খেয়াল হলো যে আসলেই এমন পরিস্থিতি কখনোই আসেনি। আমরা আমাদের পরিবার নিয়ে তেমন একটা আলোচনা করিনি কোনদিন। যদিও তূর্য বলেছিল ওর বাবা বেশিরভাগ সময় বিদেশেই থাকেন আর ওর মায়ের বিষয়টাও বলেছিল। এরপর আমি আর তেমন কিছু জানতে আগ্রহ প্রকাশ করিনি। তূর্যও এই ব্যাপারে আর কিছু বলেনি। যেহেতু তৌফিক আংকেলের ছেলের সাথে আগে দেখা হয়নি তাই তূর্যকে চেনার কোনো সুযোগই ছিল না।
— ধারা একটা কথা বলবো?
— কি বলবে বলো।
— আমাকে বিয়ে করবে?
— এতো কিছুর পরেও এইটা জিজ্ঞেস করতে ল’জ্জা করছে না তোমার?
— আমি জানি আমি ভুল করেছি। তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছো আর আমি সেটাকে ভেঙ্গে দিয়েছে। একবার নয়, দুইবার। কিন্তু আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি ধারা।
— আমাকে ভালোবাসার কথা বলছো? আমাকে যদি ভালোই বাসতে তবে আরেক নারীর কাছে কেন গিয়েছিলে?
— আমি আমাদের বিয়ের কথাটা অনেক আগে থেকেই জানতাম। আমি জানতাম যে আজ না হয় কাল তুমি আমার হবেই। এজন্যই এতো কিছু ভাবিনি এই বিশ্বাস, সততা এগুলো নিয়ে চিনতাই করিনি কখনো।
— বাহ্ খুব সুন্দর কথা বলেছো। শুধুমাত্র সবটা আগে থেকে জানতে বলে তুমি এতো কিছু নিয়ে ভাবো নাই? তোমার কাছে বিশ্বাসের কোনো মূল্য নেই তাই না?
— আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমার বিশ্বাস বারবার ভেঙেছি জানি তখন বুঝে উঠতে পারিনি তবে এখন বুঝতে পেরেছি।
— তুমি অন্তত “বিশ্বাস” শব্দটা উচ্চারণ করো না। তোমার মুখে এই শব্দটা খুব হাস্যকর শুনায়।
— তাহলে কি তুমি আমাকে বিয়ে করবে না?
— আবার জিজ্ঞেস করছো?
— আমাদের বিয়ের বিষয়টা আগেই জানতাম এইজন্যই তোমাকে জানতে তোমার জীবনে এসেছিলাম আমি। তোমাকে জানতে পেরে তোমার প্রতি আগ্ৰহ জেগেছে আমার তোমাকে পাওয়ার ইচ্ছা জেগেছে আমার মনে।
— তুমি আমার জীবনটা ধ্বং’স করে দিয়ে গেছো তূর্য। এতো কিছুর পরে আবার তোমাকে সুযোগ দিব না আমি।
— ঠিক আছে তাহলে কি আর করার।
— তাহলে?
— তাহলে আর কি তুমি আমাকে মানা করলেও নিজের মা-বাবাকে মানা করতে পারবে?
— (নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কোনো উত্তর দিলাম না)
— কিছু বলছো না যে? দেখো ধারা আমি তোমার সাথে শান্ত হয়ে কথা বলছি। এজন্য না যে পাশের ঘরে আমাদের গার্ডিয়ান বসে আছে। আমি চেয়েছিলাম এই বিষয়ে তোমার সাথে ভালোমতো কথা বলতে।
— তুমি ঠিক কি চাইছো?
— আমার কি চাওয়ার থাকতে পারে?
— তাহলে তুমি এই বিয়েতে না বলে দাও, আমিও তাই করবো।
— তোমার কি মনে হয় আমি আসলেই এমন করবো? এতো সাধনার পর পাওয়া জিনিস এতো সহজে কিভাবে ছেড়ে দেই?
— তুমি এমন করতে পারো না তূর্য।
— আমাকে কেন বলছো? বিয়ে কি আমি ঠিক করেছি?
— তাহলে বিয়েতে মানা করে দিচ্ছো না কেন?
— বিয়েটা হবেই বুঝলে? এখানে তোমার, আমার কিছুই করার নেই বুঝলে।
— তুমি চাইলেই বিয়েটা আটকাতে পারবে আমি জানি।
— আমার তোমাকে লাগবে বুঝতে পেরেছো?
— তূর্য প্লিজ…
— আমার হাতে কিছুই নেই। আমাদের বিয়েটা বড়রা ঠিক করেছে। তাই তুমিও কিছু করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।
আর কিছু বলার মতো ক্ষমতা নেই আমার। তূর্যর পাশ দিয়ে হেঁটে ঘরে এসে বসে পড়লাম। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি। তূর্য একটু এগিয়ে এসে বারান্দার দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে গেল।
আমার মাথা কাজ করছে না একদম। এতো সহজে সবটা শেষ হয়ে যেতে পারে না। আমাকে কিছু একটা করতে হবে যেভাবেই হোক! তূর্য ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো। আমার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে আমার মুখের সামনে কিছু চুল কানের পিছনে গুজে দিয়ে বলতে লাগলো,
— আর কিছুই করার নেই আমার ভালোবাসা। তোমাকে আমার কাছে আসতেই হবে। তুমি না চাইলেও তোমাকে আমার কাছে আসতে হবে কারণ পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই। আবার খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে আমার ভালোবাসা।
এরপরেই তূর্য ঘরের থেকে চলে গেল। আমার চোখের অশ্রুর বাঁধ ভেঙে গেল। চোখ থেকে অশ্রু গুলো ঝরে পরতে লাগলো। আসলেই কি আর কিছুই করার নেই?সব শেষ হয়ে গেল?
চলবে……………………^-^