#শ্রাবণের_এক_সন্ধ্যায়
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_আঠারো
কতটা নিষ্ঠুর, জঘন্য মানুষ হলে মেয়ের বয়সী একটা মেয়ে’কে এভাবে খু/ন করতে পারে? ভাবতে পারলো না তারিন। ভেঙে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। অসহায়, করুন কন্ঠে প্রশ্ন করলো,,,
“কেনো আমার বোনটাকে মে-রে ফেললেন ? কি ক্ষতি করেছিলো? ”
তারিনের প্রশ্নের জবাবে এইবার রায়হান দেওয়ান আতৎনাদ করে উঠলো,,
“আমাকে প্লিজ এখান থেকে নামাও। আমি সহ্য করতে পারছি না। দম আটকে আসচ্ছে। শরীর অবশ্য হয়ে যাচ্ছে। প্লিজ এখান থেকে নামিয়ে দাও আমাকে। আমি সব বলছি।”
তারিন শুনলো না। ধমক দিয়ে বললো,,
“আর একবার আতৎনাদ করলে। তোর অবস্থা এর থেকেও ভয়ংকর হবে।”
তারিনের ধমকে তাজওয়ার সহ কেঁপে উঠলো। রায়হানের অবস্থা দেখে ও নিজেই শিউরে উঠছে। বরফের মধ্যে দাড়িয়ে থাকা কতটা ভয়াবহ। তা ভাবতেই ওর নিজের শরীর কেঁপে উঠছে। আবার তারিনকেও কিছু বলতে পারছে না। ওমর তারিনের কাঁধে হাত রাখলো। শান্ত কন্ঠে বললো,,
“ও’কে এইভাবে রাখলে ও এমনিতেই মরে যাবে। তার চেয়ে বরং…..। ”
শেষ করতে পারলো না কথাটা। তার আগেই তারিন ভয়ংকর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাঁকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। রায়হান দেওয়ানের পায়ের দিকে তাঁকাতেই দেখলো পা গুলো ঠান্ডায় সাদা হয়ে যেতে শুরু করেছে। আর সে বার বার আতৎনাদ করে উঠছে। তা দেখেও তারিনের মধ্যে কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা গেলো না। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে গিয়ে রায়হান দেওয়ানের সামনে বসলো। চুল গুলো দুই হাতে খোঁপা করে নিতে নিতে বললো,,
“বরফ না আগুন? কোনটা ব্যাটার হবে তুই বল?”
তারিনের কথায় রায়হান দেওয়ান পূর্নরায় আতঙ্কিত হলো। সেদিনের দূর্বল মেয়েটা আজ এতটা কঠিন হয়ে গেছে ভাবতে পারলো না। তার চোখ থেকে পানি পড়ছে টুপটাপ। তাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না তারিন। নিজেই আবার বললো,,
“দেখ তুই শুধুশুধু কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করছিস৷ যত সময় নষ্ট করবি তত তোর শাস্তি ভয়ংকর থেকে ভয়ংকর হতে শুরু করবে।”
অসহায় হয়ে পড়লো রায়হান দেওয়ান। বেঁচে থাকার লড়াই শুরু হলো তার। সহ্যশক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করলো। থেমে থেমে পূর্নরায় বলতে লাগলো,,
“আমি রাহাকে খু/ন করেছি। সেটা আমি আর ওই সার্ভেন্ট ছাড়া কেউ জানতো না। কিন্তু তামজিদ কি করে সব খুঁজে পেয়ে গেলো জানিনা। সেদিন রাতেই তামজিদ আমাকে হুম’কি দিচ্ছিলো। বার বার সব প্রমান গুলো সবাইকে দেখিয়ে দেওয়ার কথা বলছিলো। তাই বাধ্য হয়ে নিজেকে বাঁচানোর জন্য ও’কে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম। ছাদ থেকে চলে আসার সময়েই তারিনকে দেখতে পেলাম। কিন্তু ও আমাকে দেখতে পায়নি কারন ছাদে অন্ধকার ছিলো। তখনি মাথায় আসলো এক ঢিলে দুই পাখি মা-রার। ছোট মেয়েকে হারিয়ে এমনিতেই সালমান দূর্বল হয়ে গেছে। এখন বড় মেয়েকে খু/নের দায়ে জেলে ঢুকাতে পারলে ও’কে সম্পূর্ণ দূর্বল করে দেওয়া যাবে। নিচে নেমে এসে সবাইকে বুঝালাম, আমি দেখেছি তারিন তামজিদ’কে ধাক্কা মে’রেছে। তারপরের টুকু তোমার জানা।”
আবারো থামলো সে। তারিনের চোখের কোনে জল টলমল করছে। মনে পড়ে গেলো সেই বিষাক্ত অতীত। সবাইকে হারানোর আতৎনাদ। এবার ও নিজেকে সামলে নিলো। কন্ঠস্বররোধ হয়ে আসচ্ছে ওর। শুধু প্রশ্নবিদ্ধ চোখ তাঁকালো রায়হান দেওয়ানের দিকে। রায়হান দেওয়ান কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই দরজার সামনে থেকে পরিচিত কন্ঠস্বর কানে এলো তারিনের….
“তার পরের টুকু তারিনের জানা থাকলেও আমার জানা ছিলো না। জানা ছিলো না আপনার এই সুন্দর মুখশ্রীর আড়ালে লুঁকিয়ে থাকা পশুতুল্য চেহারা।”
তারিন দরজার দিকে তাঁকালো। থমকে গেলো শাহানাজ বেগমকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে। মা যদি অপরাধ ও করে তাহলে মা’কে হয়তো কোনোদিন ঘৃনা করা যায় না। তেমনি তারিন ও পারেনি মা’কে আজো ঘৃনা করতে। শুধু মায়ের উপর রয়েছে অনেক অভিমান, অভিযোগ। উঠে দাড়ালো তারিন। অবাক নয়নে তাঁকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। শাহানাজ বেগম রুদ্ররূপ ধারন করে এগিয়ে এলো রায়হান দেওয়ানের দিকে। তার সম্মুখে গিয়ে দাড়ালো। অপেক্ষা করলো না। পর পর কয়েকটা থাপ্প’ড় বসিয়ে দিলো। থা’প্প’ড় দিয়েও ক্ষান্ত হলো না। চুলগুলো শক্ত করে টেনে ধরে বলতে লাগলো,,
“কি ক্ষতি করেছিলো আমার মেয়ে তোর। কেনো মে-রে ফেললি তুই? কেনো? তোকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। আর তুই আমার মেয়েকে কেড়ে নিলি।”
বলে আরো একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দিলো। তারিন শুধু স্তব্ধ হয়ে দেখছে। তাজওয়ার ও শান্ত। ওমর গিয়ে এইবার শাহানাজ বেগম’কে টেনে এনে দাড় করালো। শান্ত করার জন্য বললো,,
“আন্টি শান্ত হন প্লিজ। উনার করা পাপের শাস্তি উনি পাবে। আপনি এখন শান্ত হন। নয়তো আপনার শরীর খারাপ হবে।”
ওমরের কথাশুনে শাহানাজ বেগম কান্না চেপে রাখতে পারলেন না। হুহু করে কেঁদে উঠলো। সামনে থাকা চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,,,
“আপনাকে এই লোকটা’কে বিশ্বাস করেছিলাম। আমার স্বামীর জায়গা দিয়েছিলাম। এর কথা বিশ্বাস করে আমার নিজের মেয়ের সাথে কতশত দুর্ব্যবহার করেছি। যে কিনা আমার মেয়ে’কে আমার থেকে কেড়ে নিলো। আমি তাকেই সঙ্গী করলাম। ছিঃ আমার তো ম-রে যাওয়া উচিত। এমন মায়ের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। কোনো অধিকার নেই। একটা খু-নীর সাথে সংসার পেতে ছিলাম।”
বলে কাঁদতে লাগলেন। তারিন হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেছিলো। দূর্বল হয়ে পড়ার আগেই আবার কঠিনতম রুপ ধারন করলো। তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,,,
“খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা মিসেস শাহানাজ বেগম। অনেক কষ্ট হচ্ছে। এইটুকু শুনেই এত কষ্ট হচ্ছে। খেলা তো এখনো অনেক বাকি। অনেক কিছু শোনার আছে আপনার। আজ আপনি বুঝতে পারবেন আপনি পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মা।”
কথাগুলোর মধ্যে স্পষ্ট রাগ ভেসে উঠলো তারিনের। তারিন শাহানাজ বেগমকে কোনো শব্দ করতে না দিয়ে রায়হান দেওয়ানের দিকে আবারো প্রশ্ন ছুড়ে মা’রলো,,
“বাকিটুকু বলার জন্য কি আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে হবে মিস্টার রায়হান দেওয়ান?”
তারিনের কথাটা উনি বুঝলো। সময় না নিয়ে পূর্নরায় বলতে লাগলো,,
“তারিনকে যখন জহির বাসায় ফিরিয়ে আনলো। তখন নতুন প্লেন করেছিলাম। সালমানের কানে প্রতিদিন তারিন আর তাজওয়ারের নামে বি-ষ ঢেলেছিলাম। সালমানকে বুঝিয়েছিলাম তামজিদের জন্য রাহাকে হারিয়েছে। এখন তাজওয়ারের জন্য তারিন’কে হারাবে। সাথে এটাও বুঝিয়েছিলাম জহির ওর টাকা-পয়সা হাতানোর ধান্দায় ছেলেকে ব্যবহার করছে। যেহেতু সালমান আগে থেকেই জহিরকে খুব একটা পছন্দ করতো না। তাই আমার ও বেশি বেগ পেতে হলো না। তাজওয়ারের প্রতি ওর মনটাকে বিষিয়ে দিতে। সেদিন আমার কথামতোই সালমান জহির’কে হসপিটালে গিয়ে হুমকি দিয়ে আসে। আর আমি এই সুযোগের ব্যবহার করেই……”
এইবার তারিন তার মুখের কথা টেনে নিয়ে বললো,,
“আর আপনি এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তাজওয়ারের এক্সিডেন্ট’টা করিয়ে সব দোষ বাবা’র উপর চাপিয়ে দিলেন। কি ঠিক বললাম তো?”
তারিনের কথার প্রতিউওরে রায়হান আর কথা বললো না। তারিন শব্দ করে নিশ্বাস ছাড়লো। দাতে দাত চেপে বলে উঠলো,,,
“এত কিছুর পরেও কেনো আমার বাবা’কে মে’রে ফেললেন?”
তারিনের প্রশ্ন শুনে শাহানাজ বেগম আতঁকে উঠে দাড়িয়ে পড়লো। অবাকের শেষ সীমানায় পা রাখলো। তারিনের দিকে তাঁকিয়ে রইলো প্রশ্নের উওরের জন্য। রায়হান দেওয়ান উওর দিলো না। রাগে তারিনের মাথা ফে’টে যাচ্ছিলো। কোনায় একটা টেবিলে ব্লে/ড, ছু/ড়ি এমনকি রিভ-লবার রাখা ছিলো। তারিন রেগে গিয়ে ছু/ড়ি’টা তুলে নিয়ে ছু’ড়ে মা-রলো রায়হান দেওয়ানের দিকে। ছু/ড়ি’টা গিয়ে সোজা রায়হান দেওয়ানের হাটুর একটু উপর ঘ্যাঁচ করে গেঁথে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার করে আতৎনাদ করে উঠলো। শাহানাজ বেগম ভয় চোখ বন্ধ করে নিলো। আর তাজওয়ার অবাক চোখে তাঁকিয়ে তারিনকে দেখছে। দেখছে একটা মেয়ে কতটা ভয়ংকর হতে পারে? সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেলে একটা মানুষ কতটা শক্ত হতে পারে? রায়হান দেওয়ান চিৎকার করে উঠতেই তারিন গিয়ে সোজা উনার মুখে ধরলো দুই হাত। চোখ রাঙিয়ে বললো,,
“চুপ। একদম কোনো শব্দ না। আর একবার শব্দ করলে এই ছু/ড়িটা দেখছিস এটা তোর মুখের ভেতরে গেঁথে যাবে। সো, নো সাউন্ড। শুধু আমার প্রশ্নের উওর দেওয়ার জন্য মুখ খুলবি। ওকে।”
তারিনের কথায় রায়হান দেওয়ান ভয়ে মাথা নাড়ায়। যন্ত্রনায় সে অর্ধেক ম-রে যাচ্ছে। পায়ের নিচের বরফ প্রায় অর্ধেক গলে গিয়েছে। পা দুটো এই মুহূতে সাদা হয়ে আছে। কেমন যেনো রক্ত শূন্য লাগছে। এভাবে কিছুক্ষন চললে সে হয়তো সাদা ধবধবে রক্ত শূন্য মানবে পরিনত হবে। কোনো মতেই যে আজ তার বাঁচা হবে না। সে বুঝে গেছে। যন্ত্রনা আর ঠান্ডায় পা দুটো অবশ হয়ে আসলো৷ দাড়িয়ে থাকতে পারলো না আর। হাটু ভেঙে বসতে গিয়েও পারলো না। কারন হাত দুটো দুই সাইডে এমন শক্ত করে বাঁধা যে বসার কোনো সুযোগ নেই। বসতেও হাতে টান লেগে মনে হচ্ছে হাতটা ভেঙে গেছে। নয়তো ছিড়ে চলে আসবে। এই যন্ত্রনা মৃ-ত্যু যন্ত্রনার থেকে কম নয়৷ মুখ দিয়ে শব্দই বের হচ্ছে না। মুখ খুললেই শুধু যন্ত্রনার আতৎনাদ বের হচ্ছে……
#চলবে
[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। যদি কোনো প্রশ্ন থাকে করতে পারেন। গল্পটা শেষের দিকে]