#শৈবলিনী—-৫১
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★ফার্মহাউসের বেলকনির ডিভানে বসে নিচে তাকিয়ে আছে নূর। সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে এখানে বসেছে সে। নিচে গেলে আবার সবগুলো খোঁচানো শুরু করবে সেই ভয়েই আর নিচে নামেনি।রাতে যেভাবে আদিত্য ওকে নিয়ে আসলো তারপর ওদের সামনে যাওয়া মানে মজার পাত্র হওয়া। এখান থেকেই সে সবার কার্যক্রম দেখছে। সকাল সকাল আদ্র আর আবির সুইমিং পুলে নেমেছে। দুজন মজা করছে পুলে। জিদান বেচারা পানিতে নামতে ভয় পায়।তাই শুধু পা ভিজিয়ে বসে আছে। নূর বসে বসে ওদের কান্ড দেখছে। তখনই আদিত্য এলো রুমে। হাতে ধোঁয়া উঠানো দুটো কাপ।একটা চায়ের কাপ আরেকটা নিজের জন্য কফির কাপ। সেটা নিয়ে এসে নূরের পাশে বসলো।চায়ের কাপটা নূরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–দিস ইস ফর মাই বিউটিফুল ওয়াইফ।
নূর মুচকি হেঁসে চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল,
–তুমি কেন বানাতে গেলে আমি নিজেই বানিয়ে নিতাম।
–আরে খেয়েই দেখোনা। এমন চা জীবনেও খাওনি। দ্য গ্রেট আদিত্যর হাতের চা সবার ভাগ্যে জোটে না।
–শুকরিয়া মিঃ নায়ক।
আদিত্য বলে উঠলো,
–কিন্তু আমি তো আর নায়ক থাববো না নূর।
নূর ভ্রু কুঁচকে বলল,
–মানে?
–মানে আমি চলচ্চিত্র জগৎ ছেড়ে দিচ্ছি। পেন্ডিং মুভিগুলোর কাজ শেষ। এরপর আর কোনো মুভি বা চলচ্চিত্র জগতের কোনোকিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবোনা আর।
নূর মলিন সুরে বলল,
–এসব কি আমার জন্য করছ? দেখ এসবের দরকার নেই। সময়ের সাথে আমিও একসময় এসবে অভ্যস্ত হয়ে যাবো। তাই প্লিজ, আমার জন্য নিজের ক্যারিয়ার, নিজের ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিও না।
আদিত্য এক হাত নূরের গালে রেখে মায়াবী কন্ঠে বলল,
–উহুম, তুমি এমন কোনো জিনিসে অভ্যস্ত হবে না যা তোমার মনকে পীড়া দিবে।তোমাকে আগেই বলেছি তোমার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে আর কিছুই না। আর হ্যাঁ, আমি মোটেও এইজন্য কোনো আপসোস করছিনা। ফিল্ম জগতে আসাটা নেহাতই শখের বসে হয়েছিল আমার। ভাগ্যবশত সফলতাও পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই হয়তো এটাকেই প্রফেশন করে নিয়েছিলাম। কিন্তু এটাই যে আমার স্বপ্ন বা জীবনের এইম ছিলো এমন কিছু না। তাই এটা ছাড়তেও আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। আমার জীবনে সবার আগে এবং সবকিছুর উর্ধ্বে শুধু তুমি। তোমার খুশিই আমার কাছে সর্বোপরি। বাকিসব ম্যাটার করে না। দরকার হলে রাস্তায় ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করবো। তোমার কি সমস্যা হবে সবজিওয়ালার বউ হতে?
নূর আদিত্যর বুকে মাথা রেখে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
–শুধু সবজিওয়ালা কেন,তুমি যে প্রফেশনেই থাকো না কেন, তোমার বউ হতে পেরে নিজেকে সবসময়ই দুনিয়ার সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী মনে করবো।আমি সবসময় তোমার পাশে থাকবো। আমরা দুজন মিলেই সবজি বিক্রি করবো। আর হ্যাঁ, তুমি সিনেমার নায়ক থাকো বা না থাকো, তুমি আমার জীবনের সত্যিকারের নায়ক। তাই আমার জন্য তুমি সবসময়ই মিঃ নায়ক থাকবে।
আদিত্য প্রাপ্তির হাসি দিয়ে এক হাতে নূরকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় চুমু খেল। দুজন মনের নানান কথপোকথনের মাধ্যমে নিজেদের চা, কফি শেষ করলো তারা। আদিত্য কাপ দুটো পাশে রেখে নূরের কোলে মাথা রেখে পরম আরামে শুয়ে পড়লো। নূরও প্রণয়সূলভ হেঁসে আদিত্যর লম্বা সিল্কি চুলগুলোতে বিলি কেটে দিতে লাগলো। আদিত্য নূরের অন্য হাতটা নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে নূরের মুখপানে তাকিয়ে রইলো। আদিত্যর স্থির দৃষ্টির সামনে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছেনা নূর। লাজুক হেঁসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে। কখনো আবার নিচে তাকিয়ে সবার কার্যক্রম দেখছে। আবিরকে দেখে হঠাৎ কিছু একটা ভেবে নূর আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
–একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
আদিত্য আবেশিত কন্ঠে বলল,
–হাজার টা বলোনারে প্রাণপাখি।
–আচ্ছা আবির ভাইয়ার বিষয় টা একটু খুলে বলবে? উনার ব্যাপারটা না আমার কাছে কেমন যেন অদ্ভুত লাগে। মনে হয় উনি যেমন দেখাতে চাচ্ছেন বাস্তবিক তেমনটা না। অনেক টা রহস্যময় চরিত্র মনে হয় আমার কাছে।
আদিত্য ফোঁৎ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
–হুম,তুমি ঠিকই ধরেছ। ও বাকি সবার থেকে একেবারেই আলাদা। বাইরের জগতের জন্য এক রুপ। আর ভেতরে নিজের জন্য অন্য রুপ। বাইরে ও একটা হাসি-খুশি মজার ব্যাক্তি আর চরিত্রহীন একটা রুপ ধারণ করে থাকে। তবে আসল আবিরটা আলাদা। যার ভেতরে অনেক হাহাকার আর বিষাদের পাহাড়। একটা কথা জানলে তুমি অবাক হবে। আবির কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো মেয়ের সাথে ই,ন্টি,মে,ট হয়নি। হি ইজ পিওর ভার্জিন। কিন্তু ও দুনিয়ার সামনে এমন ইমেজ বানিয়েছে যে সবাই ভাবে ও রোজ কোনো না কোনো মেয়ে নিয়ে রাত কাটায়। ও কেন এমন ইমেজ তৈরি করতে চায় তা ওই জানে। জানো,নিউইয়র্ক থাকতে ও একদম এমন ছিলোনা। কোনো মেয়ের সাথে কখনো এক কাপ কফিও খায়নি। কিন্তু দেশে ফেরার পর থেকে ওর কি হলো কে জানে। এমন একটা ইমেজ বানানো শুরু করে দিলো ও। যেন সবার সামনে নিজেকে খারাপ দেখাতে চাইছে ও। কিংবা কোনো এক স্পেসিফিক ব্যাক্তির সামনে নিজেকে খারাপ দেখাতে চাইছে।
নূর বলে উঠলো,
–আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সেই ব্যাক্তিটা কে তাও তুমি জানো। যেখানে আবিরের সবকিছু তুমি জানো সেখানে এটা জনোনা তা নিশ্চয় না।
আদিত্য স্মিথ হেঁসে বলল,
–হুম,আমার বউটা দেখছি সেই বুদ্ধিমতি। সব ধরে ফেলে। হ্যাঁ আমি জানি সে কে। আর তোমার কথায় বুঝতে পারছি তুমিও জানো সে কে।যদিও আমি যে জানি, সেটা আবির জানে না। ও ভাবে শুধু ওই আমার সবকিছু বুঝে যায়।কিন্তু আমিও ওর নড় নক্ষত্র বুঝে যাই।সেই ছোটোবেলা থেকে যে ওর মনে শুধু আহানাই বাস করে তা আমি বুঝি। হ্যাঁ আহানার সামনেই ও নিজেকে খারাপ প্রমাণ করার জন্যই এসব করে। যাতে আহানা ওকে ঘৃণা করে। কারণ ওর মতে ঘৃণাই নাকি বেস্ট অনুভূতি। আর আহানার কাছ থেকে ও এটাই পেতে চায়।
–কিন্তু এমন কেন চান উনি? এটা কি ধরনের লজিক? ঘৃণা কারোর চাহিদা কীভাবে হতে পারে? ঘৃণা কি কখনো সুখ দিতে পারে?
–আসলে এসবের জন্য ওর বিষাদময় অতীত দায়ী। ওর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন ওর মা ওকে আর ওর বাবাকে ছেড়ে অন্য একটা লোকের সাথে চলে যায়। আর আবিরের বাবা বিষয় টাকে খুবই বাজেভাবে হ্যান্ডেল করে। তিনি নিজের কষ্ট আর ইগো স্যাটিসফাই করতে অন্য নারীদের সান্নিধ্যে ডুবে যান৷ মাঝখান থেকে হয়ে যায় বোঝমাত্র। যে বোঝ আঙ্কেল কাজের বুয়ার হাতে সপে দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেন। আর কাজের বুয়ার কাছে একটা বাচ্চা কিভাবে বড়ো হয় তা ভাবাও কষ্টদায়ক। আবিরকে এই সব সহ্য করে বড়ো হতে হয়। মা বাবা থাকতেও এতিমের থেকেও কষ্টদায়ক জীবন ভোগ করতে হয় ওকে। আর এসব ওর মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ভালোবাসার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জন্মে যায় ওর। ও ভাবে ভালোবাসা খারাপ জিনিস। ভালোবাসা শুধু কষ্ট আর ধ্বংস ছাড়া কিছুই দিতে পারে না। তাই ও ঘৃণাকেই আপন করে নিয়েছে। ওর ঘৃণাই নাকি সবচেয়ে লয়াল মনে হয়। এ কারণেই ও এমন করে।
–তো তুমি আবির ভাইয়াকে বুঝাও না কেন? তাকে বোঝানো দরকার সে ভুল ধারণা পোষণ করছে। তার মা বাবার সাথে এমন হয়েছে দেখে যে ভালোবাসাই খারাপ এটাতো ভুল ধারণা।
–তোমার কি মনে হয়, আমি চেষ্টা করিনি! আরে ও কিছু বুঝতে চাইলে তো। ও যা ধারণা নিয়ে বসে আছে ওটাই ওর কাছে সত্যি মনে করে। আর রইলো আন্নির কথা। তো এই বিষয়ে না কখনো কথা বলেছে আর না আমি। আসলে এই ব্যাপারে কথা বলাটা দুজনের জন্যই খুবই আনকম্ফোর্টেবল। আমি জানি ওর মতো একটা ছেলে আমার বোনের জন্য আমি নিজেও হয়তো খুঁজে পাবোনা। কিন্তু ওদের মাঝে আমি কীভাবে কিছু বলতে পারি? বন্ধুর সাথে ছোটবোনের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলাটা খুবই অস্বস্তিকর বিষয়। এটাতো ওদের নিজেদেরই মেটাতে হবে। এখানে আমার কিছু করার নেই।
–হুম,ঠিকই বলেছ। দেখা যাক ওরা নিজেদের মাঝে সব ঠিক করতে পারে কিনা।
এতক্ষণ আদিত্য আর নূরের সব কথাই শুনছিল আহানা। নূরকে ডাকতে এসেছিল সে। দরজা খোলা দেখে ভেতরে চলে আসে। বেলকনি থেকে ওদের কন্ঠ শুনতে পেয়ে ডাকতেই যাবে ঠিক তখনই ওদের আবিরের সম্পর্কে কথা বলতে শুনে থমকে যায় সে। আবিরের ব্যাপারে সবকিছু জানতে পেরে স্তব্ধ হয়ে যায় সে। লোকটার ভেতরে এতো বিষাদ জমে আছে অথচ কখনো বুঝতেই পারলোনা ও! বাকি সবার মতো আমিও শুধু বাইরের রুপটাই দেখলাম। যাকে সেই ছোট্ট বেলা থেকে মনের ঘরে বসিয়ে রেখেছি তার আসল রুপটা কখনো বুঝতেই পারলাম না আমি! বুঝতে পারলাম না তারও মন জুড়ে শুধু আমিই আছি! তাহলে কেমন ভালোবাসলাম আমি! আবিরের সব জানতে পেরে আহানা খুশি হবে না দুঃখ পাবে বুঝতে পারছে না। তবে হঠাৎ কান্না পাচ্ছে তার। ভীষণ কান্না। কিছু খুশির আর কিছু অনুশোচনার কান্না। আহানা দ্রুত বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। এখন অনেক কাঁদতে হবে তাকে। তবেই হয়তো একটু হালকা হতে পারবে সে।
আহানা চলে যেতেই নিরব হাসলো নূর। আহানাকে দেখতে পেয়েছিল সে। তাইতো কথা তুলেছিল। এখন আহানা সব জেনে গেছে। বাকিটা এখন সেই সামলে নিতে পারবে।
একটু পরেই সবাই ফার্মহাউস থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় যার যার গন্তব্য স্থলে।
___
মাঝখানে একদিন পার হয়ে গেছে। সবাই যার যার রেগুলার জীবনে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। আদিত্য সবজি বেচার খেয়াল আপাতত স্থগিত রেখে ফ্যামিলি বিজনেস জয়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কিন্তু আগে কিছুদিন সে ছুটি কাটাবে। বউয়ের সাথে মনমতো সময় কাটাবে। তারপর জয়েন করবে। এতে অবশ্য তার বাবা অনেক খুশি। ব্যাস এবার এই বাবলুর থেকে মুক্তি পেলে তার থেকে সুখী ব্যক্তি বোধহয় আর কেউ হতোনা।
ঘুমের মাঝেই অনেকক্ষন ধরে বুকের উপর ভারী কিছু অনুভব হচ্ছে আবিরের। মোড়ামুড়ি করে শেষমেশ চোখ খুলতে বাধ্য হলো সে। কপাল কুঁচকে ধীরে ধীরে চোখ দুটো মেলে তাকালো সে। তাকাতেই এক জোরা কাজল রাঙা ডাগর আঁখির সম্মুখীন হলো। যে আঁখি যুগল ওর পানেই তাকিয়ে আছে। কিছুটা হতভম্ব হয়ে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো আবির। তার মনে হচ্ছে সে বোধহয় এখনো স্বপ্ন দেখছে। হ্যাঁ স্বপ্নই হবে। নাহলে বাস্তবে কি আহানা এভাবে ওর বুকের উপর হাত ভাজ করে তার উপর থুঁতনি ঠেকিয়ে ওর দিকে এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকব! আবিরের এভাবে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকা দেখে আহানা ভ্রু জোড়া নাচিয়ে বলল,
–কি হলো মিস্টার, ঘুম ভাঙেনি এখনো? নাকি আমাকে দেখে এতো ভালো লাগছে যে তাকিয়েই আছেন? আজকে অনেক সুন্দর লাগছে আমাকে তাইনা?
আহানার কথায় বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল আবিরের। তারমানে আন্নি সত্যি সত্যিই এখানে! এটা বোধগম্য হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো আবির। হাঁপানি রুগীর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে লাগলো সে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলো আহানা শাড়ী পড়েছে। আবির হাঁপাতে হাঁপাতে বিস্ময়ের সপ্তম আসমানে উঠে বলল,
–ত ত তুই এখানে, এই বেশে কি করছিস? আর এসব কি করছিলি তুই? আবুলের মরা নানির ভুত চাপছে নাকি তোর ঘাড়ে।তাই বুঝি এমন আলট্রা মডেল পেত্নী সেজে সকাল সকাল হার্ট অ্যাটাক দেওয়ার ধান্দা খুঁজছিস!
আবিরের কথায় আহানা রেশমী চুড়ি পরা হাতটা মুখের ওপর রেখে খিলখিল করে হেঁসে দিয়ে হেয়ালি কন্ঠে বলল,
–আবির ভাই,আপনিও না! কত্তো ফানি কথা বলেন।
আবিরের ভ্রু কুঁচকে ভর্তা হয়ে যাওয়ার উপক্রম।সে অতি বিস্মিত কন্ঠে বলল,
–ফানি! আমার কথা তোর কাছে ফানি লাগছে! এখনতো আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর তোকে ভূতে ধরেছে। যা গিয়ে জিদানের মটকা বাবার কাছে গিয়া চিকিৎসা করা।
আবিরের কথায় আহানা আবারও হালকা হাসলো। তারপর আবিরের চোখের দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। আহানার কাছে আসা দেখে আবির থতমত খেয়ে গেল। ফিচেল গলায় বলল,
–এ এই কি করছিস তুই? খবরদার কাছে আসবিনা! দূরে যা, দূরে যা বলছি। শুহ, শু..
বলতে বলতে পেছন দিকে হেলে গেল আবির।আহানা একসময় একেবারে আবিরের মুখের কাছে ঝুঁকে গেল। আবিরের গলা শুঁকিয়ে আসছে। শুঁকনো ঢোক গিললো সে। আহানা আবিরের একেবারে মুখোমুখি এসে কিছুটা আবেদনময়ী কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
–আমার ভূত কোনো মটকা বাবা নামাতে পারবেনা। এটা শুধু আপনিই পারবেন। আপনিই আমার একমাত্র ওঝা। দিন না ওঝা সাহেব, কোনো মন্ত্র ছুঁড়ে। প্রেমের কাটা যে বিঁধেছে হৃদয়ে, তা দিন না বের করে।
আবিরের নিঃশ্বাস আঁটকে গেছে। কুলকুল করে ঘামছে মুখমণ্ডল। আহানার ভাবসাব তার ঠিক লাগছে না। এই দৃষ্টি তার অচেনা। এই দৃষ্টিতে সে ঘৃণার বদলে অন্যকিছু দেখতে পাচ্ছে। যা সে মোটেও চায়না৷ আবির এবার ধমকের সুরে বলল,
–চুপ কর বেয়াদব। কি আবোলতাবোল বলছিস! খবরদার আমার সাথে এসব কথা বলবিনা। তোর না বয়ফ্রেন্ড আছে? তাকে গিয়ে শোনা তোর এইসব আবুল মার্কা কথা।
আহানা সোজা হয়ে বসে বলল,
–ওটাতো কাল্পনিক বয়ফ্রেন্ড ছিলো। বাস্তবে থাকলে না শোনাবো।
–মানে?
–মানে ওসব আমি মিথ্যে বলেছিলাম। আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।
–হ্যাঁ তো না থাকলে গিয়ে একটা বানিয়ে নে। আমার মাথা খাচ্ছিস কেন সকাল সকাল? যা ফুট এখান থেকে। পুরো সকালটাই বর্বাদ করে দিলো।
বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে চলে যেতে নিলো আবির। কিন্তু যেতে দিলোনা আহানা। পেছন থেকে হাত টেনে ধরে বলে উঠলো,
–আর কতো পালাবেন? কতো হাত ঝাড়বেন নিজের অনুভূতি থেকে? আর কতো বাঁচবেন আমার ভালোবাসা থেকে?
থমকে গেল আবির। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। সে ঘুরে এসে আহানার দুই বাহু চেপে ধরে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–কীসের ভালোবাসার কথা বলছিস তুই হ্যাঁ? আর তুই এভাবে কেন দেখছিস আমাকে? তোর চোখে ঘৃণা কেন নেই আজ?
আহানা আবিরের চোখে চোখ রেখে ব্যাকুল কন্ঠে বলল,
–কারণ ভালোবাসি আপনাকে? আজ থেকে না সেই ছোট্ট বেলা থেকে। যখন জানতামও না ভালোবাসা কি। তখন থেকে ভালোবাসি আপনাকে। তাহলে চোখে ভালোবাসা ছাড়া আর কি পাবেন?
–জাস্ট শাট আপ। তোর সাহস কি করে হলো আমাকে ভালোবাসার? তুই শুধু আমাকে ঘৃণা করবি। আমাকে ভালোবাসার অধিকার নেই তোর। আমি দেবোনা সেই অনুমতি।
–ভালোবাসতে অনুমতি লাগে না। ভালোবাসা কোনো কাজ নয় যার জন্য পারমিশনের দরকার হয়। ভালোতো আমি বেসেই ফেলেছি। এখন আমার হাতে কিছু নেই। এখন হয় আমাকে ভালোবাসা দিয়ে সুখী করবেন। নাহয় আপনার মরমে পুড়তে পুড়তে একসময় শেষ হয়ে যাবো।
আবির অধৈর্য কন্ঠে বলল,
–আন্নি,আন্নি কি হয়েছে তোর হ্যাঁ? তুই আগেই তো ভালো ছিলি। কত সুন্দর একটা ঘৃণার অনুভূতি ছিলো আমার প্রতি। তুই কেন পরছিস এই ভালোবাসার মোহে। ভালোবাসা খুবই খারাপ জিনিস। তোকে কখনো ভালো রাখবেনা। ধ্বংস করে দিবে তোকে। এসব মিথ্যে মোহে পড়িস না। শেষ হয়ে যাবি।
আহানা অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে বলল,
–আপনি ভুল বুঝছেন আবির ভাই। মানছি আপনি জীবনে যা সয়েছেন, আপনার মা বাবার কর্মে হয়তো আপনার ভালোবাসার প্রতি বিদ্বেষ এসে গেছে। তাই বলে শুধু তাদের জন্য আপনি পুরো ভালোবাসা টাকেই খারাপ কীভাবে বলতে পারেন। ভালোবাসা এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। ভালোবাসা ছাড়া পৃথিবী চলে না। ঘৃণা কখনো একটা মানুষকে সুখ দিতে পারে না। ঘৃণা সর্বদা শুধু দূর্বিষহ পরিণতি এনে দেয়। ঘৃণার সম্পর্ক কখনো সুখদায়ক হয়না।আপনার মা বাবার কাজে এটা বোঝা যায় যে তাদের ভালোবাসা সত্যি কারের ভালোবাসা ছিলো না।তাই এতো ঠুনকো হয়ে ছিন্ন হয়ে গেছে তাদের সম্পর্ক। কারণ সত্যিকারের ভালোবাসায় কখনো ফাটল ধরে না। ভাইয়া ভাবিকেই দেখুন। এতো ঝড় ঝাপটার পরেও ঠিকই তাদের ভালোবাসা মঞ্জিল পেয়েছে। কারণ তারা সত্যিকারের ভালোবেসেছে। সত্যি ভালোবাসা মানুষকে অনাবিল সুখ এনে দেয়। প্লিজ একবার ভালোবাসার উপর ভরসা করে দেখুন না। দেখবেন কতো সুখী হন আপনি।
–বুল শিট! এসব সব সস্তা আবেগী কথা। ভালোবাসা কখনো কাউকে সুখী করেনা। আমি ঘৃণাতে বিশ্বাস করি। তুই শুধু আমাকে ঘৃণা করবি আমাকে। আমাদের ঘৃণার সম্পর্ক ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক হবে না। বুঝেছিস?
আহানা এবার গলার স্বর পালটে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
–আচ্ছা ঠিক আছে। করবো আপনাকে ঘৃণা। আমাদের ঘৃণার সম্পর্ক হবে। কিন্তু কোনো সম্পর্কই একপাক্ষিক হয়না। তাতে দুই পক্ষেরই সমান অবদান থাকতে হয়। তো আমি নাহয় আপনাকে ঘৃণা করলাম কিন্তু আপনার কি? আপনি কি আমাকে ঘৃণা করেন? আপনি আমাকে ঘৃণা করবেন না অথচ আমার কাছ থেকে ঘৃণা চান। এটা কেমন কথা? সম্পর্ক তো ইকুয়াল হওয়া চাই তাইনা? তো বলুন করেন ঘৃণা আমাকে?
এই পর্যায়ে আবির থতমত খেয়ে গেল। অপ্রস্তুত কন্ঠে আমতাআমতা করে বলল,
–অ অবশ্যই, আমিও তোকে ঘৃণা করি। প্রচুর ঘৃণা।
আহানা দুই হাত ভাজ করে বলল,
–আচ্ছা? কই, আমিতো দেখতে পাইনা?
–ঘৃণা কি ঘাঁ পচরা নাকি যে দেখা যাবে? বললাম তো ঘৃণা করি। অনেক ঘৃণা।
–কে বলেছে দেখা যায় না। অবশ্যই দেখা যায়। ভালোবাসা যেমন বোঝা যায়, তেমন ঘৃণাও বোঝা যায়। আর আপনার চোখে আমি একবিন্দুও ঘৃণা দেখতে পাচ্ছিনা। তারমানে আপনিও আমাকে ভালোবাসেন।
–হোয়াট রাবিশ! ভালোবাসা আর আমি? যা গিয়ে চোখের ডাক্তার দেখা। চোখে ছানি পড়েছে তোর।
আহানা এগিয়ে গিয়ে দুই হাতে আবিরের গলা জড়িয়ে ধরে মোহময় হেঁসে বলল,
–ছানি আমার না আপনার মনে পড়েছে। তাইতো মিথ্যের চাদরে সত্যকে ঢাকতে চাচ্ছেন। তবে লাভ হবে না। এখন হয় আপনি আমাকে ঘৃণা করবেন নাহয় নিজের ভালোবাসা মেনে নিবেন। তাছাড়া আমিও ছাড়ছিনা আপনার পিছু।
আবির আহানার হাত ছাড়িয়ে রাগ দেখানোর চেষ্টা করে বলল,
–তুই,তুই না অনেক পঁচা হয়ে গেছিস। একেবারে অসহ্য টাইপের পঁচা। এই তুই যাতো এখান থেকে। সকাল সকাল মাথা নষ্ট করে দিয়েছিস আমার। যা এখান থেকে। আর খবরদার এই বাড়িতে আর আসবিনা।
বলেই আবির আহানার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে দরজার বাইরে বের করে দিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। আহানা দরজায় চাপড়ে বলল,
–বললেই হলো নাকি? এটা কি আপনার বাড়ি। এটা আঙ্কেলের বাড়ি। আমি কোথাও যাচ্ছি না। দেখি কতক্ষণ পালাতে পারেন আপনি।
চলবে….