#শৈবলিনী—৪২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★অনেকক্ষণ ধরে নিচে বসে থেকেও আহানার মুখদর্শন হলোনা আবিরের। নাস্তা শেষ করে তাই ছাঁদের দিকে পা বাড়াল সে। হয়তো আহানাকে ছাঁদেই পাওয়া যায় সেই আশায়। সাথে সি,গা,রে,টে,র নেশাটাও একটু মিটিয়ে নেওয়া যাবে। এবং আশানুযায়ী সুফলও তার ভাগ্যে জুটলো। আহানাকে সত্যি করেই সে ছাঁদে পেয়ে গেল। ছাঁদের রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে কারোর সাথে ফোনে কথা বলছে সে। মুখে এক অমায়িক হাসি লেগে আছে। কিন্তু আবিরের তো আহানার মুখের হাসি চাইনা। আবিরযে বাকি দুটো সাধারণ প্রেমিকের মতো না যে, প্রিয়তমার হাসিতে মোহিত হবে। সেতো ঘৃণার প্রেমিক। ঘৃণাই তার চাহিদা। আহানার চোখে মুখে শুধু সীমাহীন ঘৃণার ছাপ চায় সে। তার মুখ থেকে সেই ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড “ছিহহ” শুনতে চায়। যা সো কল্ড “ভালোবাসি” শব্দটার চেয়ে হাজার গুণ মোহনীয় শোনায়। আহানার মুখ থেকে সেই ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড টা শোনার উদ্দেশ্যে বাঁকা হেঁসে সেদিকে এগিয়ে গেল আবির। আহানার নিকট গিয়ে উস্কানির ইচ্ছেতে বলে উঠলো,
–কিরে, এমন হলুদ দাঁত বের করে কার সাথে এতো কথা বলছিস? তাও আবার ছাঁদে একা একা! ঘটনা কি তাহলে ঘটিয়েই ফেললি? বয়ফ্রেন্ড করেই ফেললি?
বলেই বিদ্রুপের হাসি হাসলো আবির। রাগে, ঘৃণায় আহানার শরীর দপদপ করে জ্বলে উঠলো। এই জঘন্য লোকটার থেকে বাঁচার জন্য সে নিচে না গিয়ে এখানে এসেছে। মাইন্ড ডাইভার্ট করতে একটু বান্ধবীর সাথে কথা বলছিল। কিন্তু তাও শান্তি হলোনা। শেষমেশ চলেই এলো এই অসভ্য লোকটা। কি, চায় কি সে! এসেই তার গা জ্বালানো কথা শুরু করে দিয়েছে। মানুষ এতো খারাপ কীভাবে হয়! রাগের বশে আহানা বলে উঠলো,
–হ্যাঁ আছে বয়ফ্রেন্ড, আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথেই কথা বলছি। হ্যাপি?
আবির ঠোঁটে সি,গা,রে,ট রেখে, লাইটার বের করে মাত্রই আগুন জালিয়েছে, ঠিক তখনই আহানার এমন কথায় হঠাৎ স্থির হয়ে গেল সে। শরীরের সকল ক্রিয়াকার্য যেন হঠাৎই থমকে গেল। কোথাও খচ করে কিছু বিঁধল তার। বোয়ালখালীতে লাইটারের আগুনের ছ্যাঁকা লাগলো আঙ্গুলে। হাত ছিটকে সরাতে গিয়ে লাইটারটা নিচে পড়ে গেল। ঠোঁটে ধরে রাখা সি,গা,রে,ট টা বের করে, চোখের পাতা ক্রমশ পিটপিট করে আহানার দিকে তাকিয়ে বলল,
–হোয়াট ডিড ইউ সে? সে ইট অ্যাগেইন।
আহানা বলে উঠলো,
–চরিত্রের সাথে সাথে এখন কী কানও নষ্ট হয়ে গেল আপনার? আমি বলেছি, আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছি।
আবির কতক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আহানার পানে। তারপর হঠাৎ মুখ ফুলিয়ে বেলুনের হাওয়ার মতো ধীরে ধীরে ফুসস করে করে হাসতে হাসতে একসময় দম ফাটানো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো আবির। হাসতে হাসতে পেট ধরে বাঁকা হয়ে গেল সে। হাসতে হাসতে দম আঁটকে যাওয়ার উপক্রম তার। কতক্ষণ হেঁসে কোনোরকমে বলে উঠলো,
–আন্নি, তুই এক প্রফেশনে টিকে থাকিস না কেন? কখনো যাত্রা দল তো কখনো সার্কাস। এখন কী আবার ভাদাইমার কৌতুক দল জয়েন করেছিস? যাই বলিস তোর এই ফিল্ডে ব্রাইট ফিউচার আছে। কি একটা জোক মারলি! “বয়ফ্রেন্ড”! হোয়াট আ জোক! আমি শেষ কবে এতো হেসেছি মনে নেই। তোর সেন্স অফ হিউমার টু গুড।
আহানা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–ওয়েল, আমিতো আপনার প্রশ্নের সত্যি এবং হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি উত্তরটাই দিয়েছি জাস্ট। এখন আপনি যদি এটাকে জোক্স মনে করে খুশি হন, দেন ইউর উইশ। আই কান্ট হেল্প ইট। আপনি আপনার জোক্স এনজয় করুন। আমি যাই। আপনার জন্য আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। ও রাগ করে আছে। যাই আমি বরং গিয়ে ওর রাগ ভাঙাই।
বলেই আহানা হনহন করে চলে গেল। আবিরের হাসি মুহুর্তেই গায়েব হয়ে গেল। কোথাও যেন আগুন জ্বলে উঠলো তার। ভীষণ জ্বলছে। অস্থির হয়ে সি,গা,রে,ট ধরাতে লাগলো। কিন্তু সেটাও হচ্ছে না।প্রচন্ড অস্থিরতায় সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আবির রাগে সি,গা,রে,ট টা হাতের মাঝে পিষে ফেলে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
–বয়ফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড….
হাতের সি,গা,রে,টের টুকরো গুলো সজোরে ছুঁড়ে মেরে ছোট্ট করে একটা চিৎকার দিলো সে।
____
বিকালের দিকে বাসায় ফিরলো নূর। আদিত্য বাসায় নেই। হয়তো শুটিং থেকে ফেরেনি এখনো। যাক একটু কিছুক্ষণ শান্তিতো পাবে। শান্তিমতো কিছু চিন্তাভাবনা করতে পারবে ও। সামনে কী করবে, না করবে সেটা নিয়েও ভাবতে পারবে। কারণ এইভাবে তো আর সবসময় থাকা সম্ভব না। ওই নাটকীয় বিয়ে মেনে নিয়ে আদিত্যকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করা ওর জন্য সম্ভব না। আদিত্যর দেওয়া ধোঁকা যে সে এখনো ভোলেনি। না কখনো ভুলতে পারবে। তাই এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতহীন সম্পর্কের বাঁধনে আঁটকে থাকা বোকামি। মায়ের কথামতো এখানে আসতে বাধ্য হলেও এখন সামনে কী করবে সেই ব্যাপারে ওকে ভাবতে হবে। যাতে এসব থেকে বের হওয়া যায়। নাহলে ধীরে ধীরে আরও দূর্বল হয়ে পড়বো আমি। তখন আর এই মায়া ছাড়িয়ে যেতে পারবোনা। নূর উঠে আপাতত ফ্রেশ হয়ে নিলো। হঠাৎ দরজায় নক করলো কেউ। নূর আসার অনুমতি দিলে আহানা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। হাতে কফির কাপ নিয়ে নূরের সামনে এসে হাসিমুখে বলল,
–ভাবি, তোমার জন্য গরম গরম কফি। তোমাকে অফিস থেকে আসতে দেখে নিয়ে আসলাম। এই নাও।
নূর মুচকি হেঁসে বলল,
–থ্যাংক ইউ সো মাচ। কিন্তু এর কোনো দরকার ছিল না।আমার কফি খাওয়ার তেমন অভ্যস নেই।
–অভ্যাস নেই তো, করে নাও। কারণ এখন থেকে আমি রোজ তোমার সাথে কফি খাবো। জানো আগে না আমার খুব একা একা লাগতো।গল্প করার কেউ ছিলোনা। কফিটাও একা একা খেতে হতো।হ্যাঁ অমালিয়া ভাবি আছে। কিন্তু সেতো তার রুম থেকে বেশি বেরই হয়না। তেমন কথাও বলেনা কারোর সাথে। কিন্তু এখন তুমি এসে গেছ। এখন অনেক মজা হবে। তোমার সাথে আড্ডা দিবো আমি।
আহানার প্রতি খুব মায়া হলো নূরের। মেয়েটা কতো মিষ্টি আর মায়াবী। অমালিয়া আর মিছরির মতোই ছোটবোন মনে হচ্ছে। এসব ভেবে মন আরও ভার হয়ে গেল নূরের। এদের মায়ায় পড়ে গেলে কী আর ছেড়ে যেতে পারবে?
রাত এগারোটার দিকে বাসায় ফিরলো আদিত্য। শুটিংয়ের অনেক কাজ ছিলো তাই দেরি হয়ে গেছে। যদিও আদিত্যর বেশির ভাগ দিনই অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। তবে এখনযে ওর বউ হয়েছে। যে ওর ঘরে হয়তো অপেক্ষা করছে। তাইতো কাজ শেষ করেই তড়িঘড়ি করে চলে এসেছে আদিত্য। রুমে ঢুকে দেখলো নূর বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। প্রশান্তিময় এক দমকা বাতাসে শীতল হয়ে গেল যেন আদিত্যর মন প্রাণ। সারাদিনের ক্লান্তি ছু মন্তরের মতো গায়েব হয়ে গেল। কী সুন্দর ঘরটাকে নূরের আলোয় আলোকিত করে ওর শয্যায় ঘুমিয়ে আছে আদিত্যর রাজরানী। ফ্যানের বাতাসে কপালের চুলগুলো উড়ছে। কী অপূর্ব অনুভূতি। ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। শুধু এই খুশি টুকুর জন্যে হলেও নূরের সব নারাজি মানতে রাজি আদিত্য। দরজাটা আস্তে করে বন্ধ করে দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল নূরের দিকে। নূরের ঘুম যেন না ভাঙে সেটারই প্রচেষ্টা। নূরের মাথার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো আদিত্য। কিছুক্ষণ মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নূরের মুখপানে। নিজের মুখটা নামিয়ে অধর ছোঁয়াল নূরের কপালে। বিড়বিড় করে বলল,
–ব্যাস,এভাবেই শুধু প্রশান্তির ছায়া হয়ে থাকো আমার পাশে। আর কিছু চাইনা আমি নূর।
নূরের কপালের চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে উঠে গেল আদিত্য। কাবার্ড থেকে কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো শাওয়ার নিতে। আজ শুটিংয়ে এ্যাকশন সীন ছিলো। শরীরে অনেক ধূলাবালি লেগে আছে। তাই শাওয়ার নেওয়া জরুরী। আদিত্য ওয়াশরুমে ঢুকতেই আঁটকে রাখা নিঃশ্বাস টা এবারে ছাড়ল নূর।মাত্রই শুয়েছিল সে, তাই ঘুম তেমন গভীর হয়নি। আদিত্য আসতেই সে বুঝে গিয়েছিল। তবুও মটকা মেরে ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিলো। যাতে আদিত্যর সাথে কোনো কথা বলতে না হয়। কিন্তু আদিত্য যে এভাবে এসে ওকে চুমু দিবে সেটাকি আর জানতো! আদিত্যর ওই ছোঁয়া যে নূরের ভেতর কেমন কম্পন সৃষ্টি করেছিল তা কেবল ওই জানে। তখন থেকেই নিঃশ্বাস আঁটকে গিয়েছিল তার। আজকাল নিঃশ্বাসটাও বেঈমানী করা শুরু করা দিয়েছে। সব ওই লোকের ষড়যন্ত্র। আমার নিঃশ্বাস টাকেও হাত করে নিয়েছে।
নূরের অবান্তর ভাবনা চিন্তার মাঝেই আদিত্য শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে এলো। নূর চোখ হালকা খুলে দেখতে পেল আদিত্য শাওয়ার নিয়ে খালে গায়ে শুধু ট্রাউজার পরে, তোয়ালে দিয়ে মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বের হয়েছে।আয়নার সামনে গিয়ে চুল ঝাড়ছে। এটা দেখে নূর চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। কিন্তু ওইযে বেহায়া বদমাশ চোখের নজর আবারও নূরের রায়কে পুরোপুরি অবমাননা করে আবারও তারা খুলে তাকালো। হালকা করে চোখ খুলে দেখতে লাগলো আদিত্যকে। আদিত্য বডি স্প্রের বোতলটা নিয়ে নিজের ফর্সা উন্মুক্ত বুকের আড়াআড়ি ছিটাচ্ছে। হঠাৎ যেন পরিবেশে তাপ বেড়ে গেল মনে হচ্ছে নূরের। কেমন গরম লাগছে নূরের। নূরের নিঃশ্বাস আবারও অবরোধ করে বসলো। নাহ্, কী হচ্ছে এসব! এই বাসায় আসলেই অক্সিজেনের ঘাটতি আছে। নাহলে ওদের বাড়িতে তো কখনো এমন হয়নি। কিছু একটা করতে হবে। অক্সিজেন লেভেল বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কোনোরকমে নিজের বেহায়া চোখ দুটোকে বন্ধ করে শুয়ে রইলো নূর। আদিত্যও একটু পর ডিনার করে এসে নূরের পাশে শুয়ে পড়লো। নূরের হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লো সে। নূর চোখ মেলে তাকালো এবার। নজর আবদ্ধ হলো আদিত্যর এই ঘুমন্ত মায়াভরা মুখটাতে। কতো মায়া এই মুখে।মনে হচ্ছে কত রাত পর সে এমন শান্তির ঘুম দিচ্ছে। কে বলবে তার মাঝে কোনো ছলচাতুরী আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমারই বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে। মনে হয় আমি হয়তো ভুল বুঝছি। কিন্তু সত্যের থাপ্পড় সজোরে এসে লেগে আমার সেই ধারণা থেকে বের করে আনে। মন চায় এই লোকটার মাঝে নিজেকে আবদ্ধ করে নিতে। সব অনুভূতির দুয়ার খুলে তাকে সাদরে গ্রহণ করতে । কিন্তু মস্তিষ্ক বলে আমি ভুল করছি। সে আবারও ছলনা করছে। মন মস্তিষ্কের এই লড়াইয়ে ক্লান্ত আমি। কোনটা ভুল, কোনটা সঠিক কী করে বুঝবো আমি? কীভাবে এই দোটানা থেকে বের হবো? এই অসহনীয় যন্ত্রণা ভরা অশান্তি থেকে কী কখনোই মুক্তি পাবোনা?
___
পরদিন ছুটির দিন হওয়ায় আদিত্য আর সকাল সকাল ওঠেনি। এমনিতেও কত রাত বাদে আজ শান্তির ঘুম হচ্ছে ওর। তাই একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠলো। আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকালো। পাশে নূরকে দেখতে পেল না। হয়তো উঠে গেছে আগেই। দুই হাত ছড়িয়ে আলসি ভেঙে উঠে বসলো আদিত্য। ঘরের মাঝে চোখ বোলাতেই কিছুটা থতমত খেয়ে গেল সে। তার যতটুকু মনে আছে, সে তো রাতে নিজের ঘরেই শুয়েছিল। তাহলে এই চারাগাছে ঘেরা নার্সারিতে কীভাবে চলে এলো ও? আদিত্য ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো। ঘরের চারিদিকে ছোট ছোট মানিপ্লান্ট এর চারাগাছের ছোট ছোট টব দিয়ে ভরপুর। সকাল সকাল ঘরকে নার্সারি কে বানালো সেটাই ভাবছে আদিত্য। বিষয় টা খতিয়ে দেখার জন্য বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল সে এদিক ওদিক তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। তার ডেকোরেটেড ওয়ালে মাটির দাগ লাগিয়ে কি বেহাল দশা করেছে।দেশের বেস্ট ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দিয়ে ডিজাইন করা দেয়ালের এই অবস্থা দেখে শোকাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে আদিত্য। দ্রুতই অপরাধীকে খুঁজে বের করে এর চরম শাস্তি দিবে সে। হঠাৎ বেলকনি থেকে কোনো কিছুর শব্দ এলো। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেল সেদিকে। বেলকনি যেতেই আরেক দফা হতভম্ব হলো সে। ঘরকে তো তাও নার্সারি মনে হচ্ছিল। কিন্তু বেলকনি তো পুরো আমাজনের জঙ্গল মনে হচ্ছে। লাকি ব্যাম্বু, তালি পাম, এন্থেরিয়া, আমাজন ভাইন সহ আরও কি কি নাম জানা গাছের সমাহারে বেলকনির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দায়। কোনরকমে জঙ্গল পেরিয়ে সামনে যেতেই চোখ কপালে উঠে গেল। কারণ এসবের কর্তা ধর্তা আর কেউ নয় বরং ওর পার্সোনাল ওয়াইফ মিসেস নূর। যে বসে বসে টবে মাটি ভরে গাছ লাগাচ্ছে। দুই হাত মাটিতে মাখামাখি। মুখে আর চুলেও মাটি লেগে আছে। সে মগ্ন হয়ে তার কাজে নিয়জিত। একটু আগে অপরাধীকে শাস্তি দিতে চাচ্ছিল অথচ এখন নূরকে দেখে সে নিজেই প্রতিহত হয়ে গেল। সকাল সকাল নূরকে এভাবে দেখে ভীষণ কিউট লাগছে। যদিও নূরের সব রুপই মনকাড়া। ভালোবাসা জিনিসটাই এমন। ভালোবাসার মানুষকে সব রুপেই মোহনীয় লাগে। কিন্তু সকাল সকাল নূর এই গাছ লাগাও, পরিবেশ বাঁচাও অভিযানে নামলো কেন? নূরের কী গার্ডেনিং করারও শখ আছে নাকি? আদিত্য একটু বিস্মিত কন্ঠে নূরকে জিজ্ঞেস করলো,
–নূর,এসব কি? গার্ডেনিং করার ইচ্ছে হলে নিচে করো। আমাদের এতবড় গার্ডেন রেখে আমার মাছুম ঘরটাকে কেন শহিদ করছ?
নূর আদিত্যর দিকে তাকালো। মাটি লাগা হাতে কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল,
–কেন? রুমে করলে কোনো সমস্যা আছে আপনার? নাকি আপনার কোনো কাজে ব্যাঘাত হবে?
নূরের কথার মর্ম বুঝতে পারলোনা আদিত্য। তাই ফিচেল হেঁসে বলল,
–না না আমার কী হবে! সবই তোমার। যা খুশি তাই করো। চাইলে আমার পেটের উপরও দু চারটা গাছ লাগিয়ে দাও।
নূর নিজের কাজে আবার মনোযোগ দিলো। এবার দেখি কীভাবে অক্সিজেনের ঘাটতি থাকে। নূর রাতেই অনলাইনে এসব গাছ অর্ডার করেছে। এখন সারা ঘরে ভরপুর অক্সিজেন থাকবে। এখন আর নিঃশ্বাস আঁটকে আসবেনা। এই লোকের ষড়যন্ত্র আমি একেবারে উল্টে দিয়েছি। এখন নিশ্চয় হেরে গিয়ে মনে মনে আপসোস করছে যে কার সাথে পাঙ্গা নিতে এসেছিল। দিলামতো তার পরিকল্পনা ভন্ডুল করে। হাঁহ্! আমার সাথে ষড়যন্ত্র! দ্য গ্রেট নূরের সাথে! আমার নিঃশ্বাস বন্ধ রাখার প্লানিং চলছিল। এখন মুখ থুবড়ে পড়লো তো! মনে মনে নিজেকে বিশ্বজয়ী ভেবে গর্ববোধ করছে নূর। কাজ শেষ করে দুই হাত একসাথে বারি দিয়ে হাতের মাটি ঝাড়ল নূর। আদিত্যর দিকে একটা তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি ছুঁড়ে ভেতরে চলে গেল সে। নূরের এই অদ্ভুত আচরণের আগামাথা কিছুই না বুঝে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো আদিত্য। তার বউ কি শেষমেশ পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি! এই সেরেছে। ভালোটাকেই সামলানো যায়না, পাগল নূরকে কীভাবে সামলাবে! আব তেরা কেয়া হোগা আদি!
__
বেলা তখন এগোরাটা। সকালের নাস্তা শেষ করে সবাই লিভিং রুমে বসেই সময় কাটাচ্ছে আপাতত। নূরকেও আহানা জোর করে সোফায় বসিয়ে রেখেছে নিজের পাশে। নূরও ওর আবদার মানা করতে পারেনি। মেয়েটা এতো মিষ্টি করে বলে মানা করার ক্ষমতা হয়না ওর। আদিত্যও পাশের সিঙ্গেল সোফায় বসে কানে ইয়া বড় হেডফোন লাগিয়ে নিজের ছবির কোনো সীন পর্যবেক্ষণ করছে। আদিত্যের বাবা যথারীতি বাবলুর উদ্দেশ্যে বলল,
–এই বাবলু, আমার মাথা ব্যাথা করছে। বাম টা আনতো।
বাবলু যথারীতি রোবটের মতো এগিয়ে এসে বলল,
–কার বাম আনমু স্যার?
–কার বাম আনবি মানে! বাম কি আর জনপ্রতি একটা করে আছে নাকি? পুরো বাড়িতে একটাইতো বাম আছে।
–কি কন স্যার! পুরো বাড়িতে একটা থাকবো ক্যা? সবারই যার যার আলাদা বাম আছে। তাও দুটো করে।
–কী বলিস! তাই নাকি? এতো বাম দিয়ে কী করে সব?
–এইটা তো যার যার প্রতিভার বিষয়। কেউ শুধু নিজের বাম কমোটে বসার কাজেই লাগায়। আবার কেউ নেচে নেচে সেটাকে ফেমাস করে। ওইযে গান দেহেন নাই! ♬ বাম ডিগি ডিগি, বাম বাম….
আদিত্যর বাবা ভড়কে উঠে বলল,
–হোয়াট?এই তুই কোন বামের কথা বলছিস?
–কেন, সবার পেছনে যে বাম থাকে সেটার কথা বলছি।
–আরে ছাগল, আমি মাথা ব্যাথায় লাগানো বাম, মানে মলমের কথা বলছি।
–হ্যাঁ তো মলম বললেই তো পারেন৷ নিজে ভুল বলেন আবার আমাকে বকেন। নিজের দোষ এই গরীবের উপর চাপিয়ে দেন৷
বাবলুর প্রতিভাবান কথপোকথন শুনে আহানা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। নূরও মুখ টিপে হাসছে। যতোই হোক আদিত্যর বাবার সামনে তো জোরে হাসা যায়না। তাই অনেক কষ্টে নিজের হাসি চেপে রাখছে। আদিত্যর বাবা ছেলের বউয়ের সামনে এভাবে লজ্জায় পড়ায় আরও রেগে গেল। রাগ ঝাড়ল তার পাশে বসা রেহনুমার ওপর। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–দেখেছ কতবড় বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে ও দিনদিন! এসব কিছু তোমার কারণে হচ্ছে। তুমি আজই এই আপদটাকে এই বাড়ি থেকে বিদায় করবে। নাহলে…
রেহনুমাও ফুঁসে উঠে বললেন,
–নাহলে? নাহলে কী করবে তুমি? কী করার ক্ষমতা রাখো তুমি? সন্ধ্যা সাতটার পর ঘরের বাইরে পারা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সেই তুমি আমাকে হুমকি দিচ্ছ? এতবড় সাহস তোমার!
দেখতে দেখতেই শুরু হয়ে গেল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নূরের অবশ্য ভেতরে ভেতরে মজাই লাগছে এদের ঝগড়া। কিন্তু এভাবে বড়োদের ঝগড়ার সামনে থাকাটা ঠিক দেখায় না। তাই নূর উঠে চলে যেতে চাইলো। কিন্তু আহানা যেতে দিলোনা। নূরের হাত চেপে ধরে বলল,
–আরে এসব দেখে, যাওয়ার দরকার নেই। এসব ঘন্টায় ঘন্টায় চলতে থাকে। এসব রোজকার রুটিন। ধীরে ধীরে তোমারও অভ্যাস হয়ে যাবে। তাই চিল করো। টিভি দেখ।
আহানা হঠাৎ একটা চ্যানেলে এসে দেখলো আদিত্যর নতুন মুভির প্রমোশনের ফাংশন চলছে। আহানা সেটা দেখে খুশি হয়ে নূরকেও দেখতে বললো। নূর না চাইতেও আহানার মন রাখতে সেও দেখতে লাগলো। প্রথম প্রথম সব স্বাভাবিকই লাগছিলো। কিন্তু হঠাৎই সব খারাপ লাগতে শুরু করলো। যখন মুভির নায়িকা আদিত্যর বাহু জড়িয়ে ধরে মঞ্চে উঠে এলো। নূরের মুখমন্ডলে হঠাৎ কালো ছায়া নেমে এলো। দর্শকদের অনুরোধে আদিত্য সেই নায়িকাকে ধরে নাচতে লাগলো। নূরের হঠাৎ সব অসহ্য লাগতে লাগলো।রেহনুমা আর আদিত্যর বাবার ঝগড়া এতক্ষণ এনজয় করলেও এবার সেটাও বিরক্তিকর লাগছে। নায়িকাটা নানান ভঙ্গিতে আদিত্যর শরীরের সাথে লাগছে। তীব্র ক্রোধে হাত পা নিসপিস করছে নূরের। তখনই সেখানে আদ্র আর অমালিয়াও এলো। তারাও কি যেন নিয়ে নিজেদের মাঝে ধীর কন্ঠে ঝগড়া করছে। যদিও শুধু অমালিয়াই কথা শুনাচ্ছে আদ্রকে। তবুও নূরের যেন এখন সবকিছুই অসহ্য লাগছে। কাজের মেয়ে ছবিটাও টেবিলের ওপর ব্লেন্ডারে কি যেন ব্লেন্ড করছে। সে শব্দও নূরের অসহ্যের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আদ্র আবার আহানার কাছ থেকে রিমোট নিতে চাইলো। কিন্তু আহানা দিবে না। তা নিয়ে দুজনের আরেক লড়াই শুরু হলো। সবকিছু মিলিয়ে নূরের মাঝে যেন ভয়ংকর বিস্ফোরণ জমলো। টিভির পর্দায় আদিত্যর এই দৃশ্য দেখে এখন আশেপাশের এসব আরও সীমাহীন অসহ্য, জ্বলাপূর্ণ লাগতে লাগলো নূরের। বিস্ফোরণ জমতে জমতে এতটাই ভয়ানক হলো যে সেটা ফেটে পড়লো একসময়। নূর ঠাস উঠে দাঁড়াল। তারপর সোজা গিয়ে দাঁড়াল বাবলুর সামনে। কেউ কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই নূর ঠাস করে চড় লাগিয়ে দিলো বাবলুর গালে। মুহুর্তেই থেমে গেল সব কোলাহল। যে যেখানে ছিলো সেখানেই জমে গেল। বাবলু থাপ্পড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে আতঙ্কিত চোখে তাকালো নূরের দিকে। নূর রাগী কন্ঠে বলল,
–তোমাকে কী আনতে বলা হয়েছে?
নূরের এক চড় খেয়েই বাবলুর মগজের বাতি জ্বলে উঠলো। সে দ্রুত গতিতে বলল,
–বাম। স্যার মাথার বাম এনে দিতে বলেছে। এখুনি এনে দিচ্ছি।
আদিত্যর বাবা হা করে হতবাকের মতো তাকিয়ে রইলো। এতবড় চমৎকার কীভাবে হলো সেটাই ভাবছে সে। শুধু এক চড়েই মগজ ঠিক জায়গায় চলে এলো! নূর এবার আদিত্যর মা বাবার দিকে তাকালো। আদিত্যর বাবা ফট করে রেহনুমার হাত ধরে ফিচেল গলায় বলল,
–আরে আদির মা, তুমিতো দেখছি শুধু শুধু রাগ করছ। আমিতো মজা করছিলাম তোমার সাথে। চলনা আমরা দুজন একটু বাইরে থেকে আইসক্রিম খেয়ে আসি।
রেহনুমাও পরিস্থিতি বুঝে স্বামীর সাথে সায় দিয়ে সুড়সুড় করে বেড়িয়ে গেল। নূর এবার আদ্রদের দিকে তাকালো। আদ্র ফিচেল হেঁসে রিমোট টা আহনার হাতে দিয়ে বলল,
–তুইই দেখ। তুই আমার একমাত্র বোন। তোর চাওয়া সর্বোপরি।
অমালিয়াও বোনের মনমেজাজ ঠাহর করতে পেরে আদ্রর হাত ধরে বলল,
–চলনা আমরাও বাইরে থেকে চকলেট খেয়ে আসি।
আদ্রতো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পাওয়ার মতো করে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ চলো এখুনি যাই।
বলেই তারাও কেটে পড়লো। নূর এবার ছবির দিকে তাকালে সেও ভয়ে ভয়ে ব্লেন্ডার নিয়ে রান্নাঘরে দৌড় মারলো। সব শেষে নূর আদিত্যর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজেও হনহন করে উপরে চলে গেল। নূর যেতেই আহানা ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল,
–বাহ্ ভাইয়া কি বউ এনেছ। দুই দিনেই সবাইকে টাইট করে দিয়েছে। বউ তো নয় যেন বিন্নি ধানের খই।
নূরের এতসব এ্যাকশনের কারণ ঠিকই বুঝতে পেরেছে আদিত্য। অন্যসময় হলে নূরের এই জেলাসি দেখে সে খুশি হতো। তবে আজ সে খুশি হতে পারছেনা। কারণ নূরের চোখে সে আজ পীড়ন দেখতে পেয়েছে। ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারোর সাথে দেখে যেমন কষ্ট হয় সেই কষ্ট। আর নূরের চোখে কষ্ট আদিত্যর সহ্য হয়না।নূরের জায়গায় ও ঠিকই আছে। আমি যেমন নূরকে অন্য কারোর সাথে দেখতে চাইনা। তেমনটা নূরেরও তো মন চায়। চিন্তা করোনা নূর। শুধু আর কিছুদিন। পেন্ডিং মুভিগুলো হয়ে গেলে আমিও আর এসব করবোনা। আদিত্য শুধু তোমার হয়ে থাকবে। শুধু আমার শৈবলিনীর।
চলবে……