#শৈবলিনী—৪০
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★নির্বিকার স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে নূর। মস্তিষ্ক আপাতত অজ্ঞান হয়ে আছে। বর্তমানে সে আদিত্যর ঘরে অবস্থান করছে।মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কি থেকে হয়ে গেল তা এখনো বুঝতে পারছে না সে। তখন ওইভাবে ঘটনাচক্রে বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ ওদের ছেড়ে দেয়। মিডিয়াও তাদের প্রশ্নের জবাব পেয়ে সেটাকে ঘরে ঘরে পৌছানোর কাজে লেগে পরে।মুহুর্তের মাঝেই রমরমা খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। যা আদিত্য আর নূরের পরিবার পর্যন্তও যেতে সময় লাগেনা। সবাই জেনে যায় এই বিয়ের ঘটনা।তবে কাহিনির শেষ এখানেই হয়না। ধারাবাহিকের আরও কিছু পর্ব যে তখনও বাকি ছিলো।ওসব ঘটনার পর নূর পুলিশ স্টেশন থেকে আদিত্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা নিজের বাড়ি ফিরে আসে।আদিত্য আটকানোর চেষ্টা করলেও তা উপেক্ষা করে চলে আসে সে। বাড়ি আসতেই শুরু হয় সবার প্রশ্নের বেড়াজাল। নূর কোনোরকমে তাদের সবকিছু বুঝিয়ে বলে। ইভান বিষয় টা একটু ঠান্ডা ভাবে নিলেও লতিকা বেগম এসব জেনে মোটেও শান্তি পাচ্ছেন না। এক মেয়েকে নিয়ে এমনিতেই এতকিছু হয়ে গেল। এখন আবার এই মেয়েটার ভবিষ্যৎ কি হবে সেই চিন্তায় বুক ভারী হয়ে আসছে তাঁর ।
কাহিনির তবুও শেষ হয়না। এতে আরও মশলা, পাঁচফোড়ন মেশাতে নূরের বাড়িতে হাজির হয়, নূরের সদ্য বিবাহিত স্বামী জনাব, আদিত্য। সে এসেই তার বউকে নিজের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জোর দাবি জানায়৷এতে নূরের শতভাগ অমত থাকলেও তার এই সিদ্ধান্তের পাশে আর কাউকেই পেলনা সে। মা, ভাই এননকি পিচ্চি মিছরিটাও ওই আদিত্যর সাপোর্টার হয়ে গেল। তবুও অনঢ় রইলো নূর। সে কোনোমতেই আদিত্যর সাথে যাবে না। যেখানে সে এই নাটকীয় বিয়েটাকেই মানে না,সেখানে উনার বউ হয়ে উনার বাড়িতে গিয়ে থাকাতো প্রশ্নই আসেনা। কদাপি নহে। কিন্তু নূর তার সিদ্ধান্তে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারলোনা। কারণ টা ছিলো তার মা। নূরের মা ওর হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলে,
“নূর মা, দেখ যেভাবেই হোক বিয়েটাতো হয়েই গেছে। আদিত্য এখন তোর স্বামী। তোরা এখন স্বামী স্ত্রী। তুই মান আর না মান,সত্যিকে এড়াতে পারবিনা। আল্লাহর আদেশেই সব হয়। যার ভাগ্যে যে থাকে, কোনো না কোনোভাবে তার সাথে মিল হয়েই যায়।স্বামী স্ত্রীর বন্ধন, পবিত্র বন্ধন। এটা কোনো খেলার জিনিস নয় যে, মন চাইলে খেললাম, না মন চাইলে না খেললাম। বিয়ে যখন হয়েই গেছে, এটাকে নিজের ভাগ্য মেনে নে। ছেলেটা খারাপ না। ওর চোখে আমি সততা দেখেছি। তুই হয়তো অমালিয়ার বিষয় টার কারণে আমাদের সবার মতো আদিত্যর ওপরও রেগে আছিস। তাই তুই রাগের বশে কোনোকিছু বুঝতে পারছিস না। কিন্তু আমার চোখ ভুল দেখেনি। ছেলেটার মন পরিষ্কার আছে। ভালো রাখবে তোকে। ওকে আরেকটা সুযোগ দিয়ে দেখ।”
মায়ের কথায় নূর মনে মনে তাচ্ছিল্যকর হাসে। মন পরিষ্কার! হাঁহ, মা তো আর জানেনা ওই লোকের আসল চেহারা। জানলে আর তাকে ভালোর ট্যাগ দিতে পারতোনা। কিন্তু ওসব কথা মাকে বলাও যাবে না। নূর তার মাকে অনেক ভাবে মানা করতে চায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর পেরে ওঠেনা সে। যখন তার মা এসব বুঝাতে বুঝাতে এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন নূর আর শক্ত থাকতে পারে না। মায়ের অবস্থা দেখে হার মেনে রাজি হতে বাধ্য হয় সে। আর যাইহোক মায়ের কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কখনে মাফ করতে পারবেনা সে। বাবার পর এখন মাকেও হারানোর ক্ষমতা নেই তার মাঝে। তাইতো মায়ের কথায় রাজি হয়ে আদিত্যর সাথে যেতে রাজি হয় সে।
আদিত্যর খুশি আর দেখে কে। সে তো পারলে পুরো পৃথিবীতে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তার খুশির বয়ান করে। খুশির পরিমাণ এতটাই বেশি হয় যে, সে নূরকে ওদের বাড়ির সবার সামনেই পাঁজা কোলে তুলে নেয়। সেই যে কোলে তুলে নেয়, একেবারে ওর বাড়ি পর্যন্ত ওইভাবেই নিয়ে আসে। নূর কতবার করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু আদিত্যর সাথে কিছুতেই পেরে ওঠেনা। নূরকে কোলে নিয়েই নিজের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে আদিত্য। লিভিং রুমে বসা পরিবারের সবার সামনে নূরকে কোলে নিয়ে বাসায় ঢুকে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,
–আরে কে কোথায় আছ? দেখ তোমাদের বাড়ির বউ নিয়ে এসেছি। তাড়াতাড়ি ওয়েলকাম করো।
আদিত্যর পরিবারতো হতবাক হয়ে যায় আদিত্যর আচমকা এমন কান্ডে। খবরে তারা আগেই জেনে গিয়েছিল। তাই আর বেশি অবাকের সময়কাল বৃদ্ধি করে না। সবার সামনে এভাবে কোলে নিয়ে আসায় নূর চরম অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আদিত্যকে ছাড়িয়ে ঝট করে নিচে নেমে দাঁড়ায় সে। আদিত্যর ওপর রাগের পাহাড় জমছে তার। কত্তবড় নির্লজ্জ লোক! পরিবারের সবাই অবাকের পর্ব কোনোরকমে সমাপ্ত করে এগিয়ে এলো ওদের সামনে। বিস্ময় ছাপিয়ে এবার সবার চোখেমুখে আনন্দের ঝলক দেখা গেল। প্রথমত আজ এতদিন পর বাড়ির ছেলে, বনবাস শেষ করে বাড়িতে ফিরে এসেছে। তারওপর বাড়ির বউও নিয়ে এসেছে। যেভাবেই হোকনা কেন, এই বিয়েটাই হয়তো আদিত্যকে আবারও হাসিখুশি জীবনে ফিরিয়ে আনবে। এটা ভেবেই সকলে খুশি। সবচেয়ে বেশি আনন্দে নেচে উঠলো আহানা। সে খুশিতে হৈ হৈ করে আদিত্যর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,
–ওয়াও ভাইয়া! আম সোওওওও হ্যাপি। আজ তুমি ফাইনালি একটা কাজের কাজ করেছ। আমার ভাবি নিয়ে এসেছ। ইয়েএএএএ…
আহানা নূরকে ফট করে জড়িয়ে ধরে বলল,
–ওয়েলকাম ভাবি। আমি তোমার কিউট ননদ, আহানা। সবাই আন্নি বলে ডাকে।
নূর কিছু না বলে শুধু জোরপূর্বক কিঞ্চিৎ ঠোঁট দুটো প্রসারিত করলো। এইমুহূর্তে এসব তার কাছে চরম অস্বস্তিকর লাগছে। আদিত্যর মা বাবাও এগিয়ে এলো। নূর একবার রেহনুমার দিকে তাকালো। এই মহিলা তাকে কতো কথা শুনিয়ে ছিলো। নাজানি আজ কী তান্ডব করে। কিন্তু নূরের ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দিয়ে রেহনুমা নিজের গলার স্বর্ণের চেনটা খুলে নূরকে পরিয়ে দিতে দিতে প্রসন্নচিত্তে বলল,
–খালি হাতে নতুন বউকে কীভাবে বরন করি? আদিটা আগে জানালে বড়ো করে নাহয় কিছু করতাম। যাইহোক নতুন বউ ঘরে এসেছে এরচেয়ে বড়ো সৌভাগ্যের বিষয় আর কিছুই না। অন্যসবতো পরেও করা যাবে।
রেহনুমার আচরণে নূর অবাকের শির্ষে। উনি কি সেই মহিলাই, যে তাকে সেদিন ওসব কথা বলেছিল? নাকি উনার মাঝে স্প্লিট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার আছে? এই পরিবারের সবাই কি এমন দুমুখো? এদের মাঝে কীভাবে নিজেকে এডজাস্ট করাবে নূর? মস্তিষ্ক পুরো জমে যাচ্ছে তার। আদিত্যর বাবাও আদিত্য আর নূরের মাথায় একসাথে স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন,
–তুই যে বৌমাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে এসেছিস এতেই আমি অনেক খুশি। এতদিন পর বাড়িটা যেন বাড়ি মনে হচ্ছে। নাহলে তোকে ছাড়াতো বাড়িটা শোকাচ্ছন্ন হয়ে ছিলো।
আদিত্যর বাবার কথায় নূরের ভ্রু কুঁচকে এলো। এতদিন পর বাড়ি ফিরে এলো মানে কি? উনি কি বাড়িতে ছিলেন না এতদিন? যাকগে যেখানে খুশি সেখানে, আমার কি! ওদের থেকে কিছুটা দূরে আদ্র আর অমালিয়াও দাঁড়িয়ে ছিলো। তবে আদিত্য আর নূরের সামনে আসার সাহস পেলনা ওরা। ওরা জানে, আদিত্য বা নূর কেউই ওদের দেখে খুশি হবেনা। তাই ওরা দূরেই থাকলো। এতদিন পর দুজন মিলতে চলেছে। এখন তাদের সামনে গিয়ে পূরণ ক্ষত জাগ্রত করতে চায়না তারা।
রেহনুমা আহানার উদ্দেশ্যে বলল,
–আন্নি,তোর ভাবিকে আদির রুমে নিয়ে যা। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে, টায়ার্ড হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়। রুমে নিয়ে গিয়ে আরাম করতে দে। আর আপাতত তোর কিছু কাপড়চোপড় নূরকে দিস, চেঞ্জ করে নিবে। আমি কালই নূরের সব দরকারি জিনিসপত্র কিনে এনে দিবো।
এই পর্যায়ে এসে মুখ খুলল নূর। রেহনুমার উদ্দেশ্যে বলল,
–জি তার কোনো দরকার নেই। আমি নিজের প্রয়োজন নিজেই মেটাতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমার যা লাগবে আমি নিজেই ব্যবস্থা করে নিবো। আমার জন্য কারোর উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই।
রেহনুমা পরিস্থিতির গম্ভীরতা ঠাহর করতে পারলেন। বর্তমানে নূরের মনোভাব বুঝতে পারছেন তিনি। তাই আর কথা না বাড়িয়ে আহানাকে বললেন নূরকে নিয়ে যেতে। আহানা নূরকে নিয়ে এলো আদিত্যর রুমে। তখন থেকে রুমেই অবস্থান করছে নূর। সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে তার কাছে। কি থেকে কি হয়ে গেল, এখন সামনেই বা সবকিছু কীভাবে চলবে সেসব ভাবনায় অশান্ত হয়ে যাচ্ছে নূর। যে লোকটা তার সাথে এতো বড়ো ধোঁকা করলো, সেই লোকের সাথে কীভাবে এই সম্পর্ক মেনে চলবে সে? মাথার ভেতর যেন স্নায়ুযুদ্ধ চলছে নূরের। মন চাচ্ছে এক ছুটে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। কিন্তু চাইলেই যে সব সম্ভব না। জীবন টা হঠাৎ কেমন সাকার্সের খেল হয়ে গেল। নূর রুম জুড়ে পায়চারি করছে আর অশান্ত মনে এটা ওটা ভাবছে। হঠাৎ চোখ গেল ওর দেয়ালে টানিয়ে রাখা আদিত্যর বিশাল ছবিটাতে। গিটার কাঁধে নিয়ে স্টাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে অমায়িক হাসি। হাসিতো থাকবেই, বদ লোকযে একটা। বদ লোক, নিশ্চয় কোনো বদ চিন্তা করেই হাসছে। নূরের ভাবনার মাঝেই দরজা খোলার শব্দে হকচকিয়ে সেদিকে তাকালো সে। আদিত্য ভেতরে ঢুকলো। আদিত্যকে দেখে হঠাৎ বুকের মাঝে হালকা কম্পন হলো নূরের। মনে হচ্ছে গলা শুঁকিয়ে আসছে ওর। হাত পায়ের ভেতর নিশপিশ শুরু হলো।
আদিত্য নূরের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেললো। একটুও এদিক ওদিক নড়চড় হলোনা নজর। ঠোঁটে তার দুষ্টুমিপূর্ণ হাসি। নূরের দিকে তাকিয়ে থেকেই দুই হাত পেছনে নিয়ে দরজা আটকে দিলো। দরজা আটকানোর খট শব্দে নূরের বুকের ভেতর আরও একবার কেঁপে উঠল। নূর নিজের নার্ভাসনেস ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে আমতাআমতা স্বরে বলল,
–এই এই,আপনি দরজা কেন বন্ধ করলেন? দেখুন আপনি যদি ভেবে থাকেন আমরা একই রুমে থাকবো আর আপনি আমার সাথে যা খুশি তাই করতে পারবেন তাহলে সেই চিন্তা ভুলে যান। আমি এই বিয়ে মানি না। আর না আপনার মতো বেঈমান লোককে আমি আমার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবো। সো স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম মি।
নূরের হুমকিপূর্ণ কথা আদিত্যর উপর কোনো প্রভাব ফেলল বলে মনে হলোনা। সে একই ভঙ্গিতে দুষ্টু হাসির রেখা ঠোঁটে ঝুলিয়ে ধীর ধীরে সামনে অগ্রসর হলো। এগুতে এগুতে সে নিজের শার্টের বোতামগুলো এক এক করে করে খুলতে লাগলো। যা দেখে নূর আরও ভড়কে গেল। চোখ কপালে উঠে যাওয়ার অবস্থা। আদিত্যকে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে সে অপ্রস্তুত ভাবে পেছাতে লাগলো। পেছাতে পেছাতে কন্ঠে রাগী ভাব আনার চেষ্টা করে বলল,
–শা শার্ট কেন খুলছেন আপনি? দেখুন ভালো হবে না কিন্তু বলে দিলাম। আমি কিন্তু ভয় পাওয়ার মতো মেয়ে নই। একদম উল্টো পাল্টা কিছু করার চেষ্টা করবেন না। নাহলে কিন্তু আপনার জন্য মোটেও ভালো হবে না।
আদিত্য নূরের হুমকির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না একইভাবে এগিয়ে যেতে লাগলো নূরের দিকে।নূর পেছাতে পেছাতে আবারও বলতে লাগলো,
— থামুন, ওখানেই থামুন বলছি। আর একপাও এগুবেন না। নাহলে…..
পেছাতে পেছাতে এইপর্যায়ে নূর কাবার্ডের সাথে ঠেকে গেল। পেছনে আর যাওয়ার যায়গা পেলনা সে। এতক্ষণে আদিত্যও নূরের একেবারে কাছে চলে এলো।আর শার্টের বোতামও ততক্ষণে সবগুলো খোলা শেষ। এবার শার্টটাকেও শরীর থেকে আলাদা করে ফেলল। ঠোঁটে তার এখনো সেই দুষ্টুমি ভরা হাসি বিদ্যমান। সেই হাসিটা আরও বিস্তৃত করে আদিত্য নূরের দুইপাশ দিয়ে কাবার্ডে হাত ঠেকিয়ে নূরকে দুই হাতের মাঝে আটকে দিলো। নূরের চোখের দিকে নেশালো চোখে তাকিয়ে মাথাটা ধীরে ধীরে নূরের মুখের দিকে ঝুকালো। নূর চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো।উপরে উপরে যতই বাহাদূরি দেখানোর চেষ্টা করছে, ভেতরে ভেতরে গলা শুঁকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে তার। বরাবরের মতোই এই লোকটার সান্নিধ্য তাকে শক্তিহীন, বোধহীন করে দেয়। চেয়েও শক্তি যোগার করে এই লোকটাকে প্রতিহত করতে পারে না। আদিত্য ধীরে ধীরে নূরের চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে নূরের কানের দিকে ঝুঁকে মাদকতা জড়ানো কন্ঠে ফিসফিস করে বলল,
–নাহলে? নাহলে কী করবে শুনি? টেল মি না, নূরসোনা?
নূর কী উত্তর দিবে! আদিত্যর এতো কাছে আসায় এমনিতেই তার সব এলোমেলো হয়ে গেছে। কাঁধে আদিত্যর তপ্ত নিঃশ্বাস অনুভব হতেই এবার যেন নিঃশ্বাসটাও অবরোধ করে বসলো। হঠাৎই যেন বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের ঘাটতি উপলব্ধি করলো নূর। পর্যাপ্ত নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা সে। একি জ্বালা! এখন কী তাহলে নিঃশ্বাস আঁটকে মরে যাবে সে! লোকটা তাহলে ওকে এভাবে মেরে ফেলার ফন্দি আঁটছে! নূরের আকাশপাতাল ভাবনার মাঝেই আদিত্য খট করে কাবার্ডের পাল্লা খুলে নিজের জন্য টিশার্ট আর ট্রাউজার বের করলো। কাবার্ড খোলার শব্দে চোখ খুলে তাকালো নূর। আদিত্য কাপড়চোপড় হাতে নিয়ে মুখের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন করে হঠাৎই দুনিয়ার সবচেয়ে ভোলাভালা ব্যক্তি প্রমাণ করার চেষ্টা করে বলে উঠলো,
–শার্ট না খুললে ফ্রেশ কীভাবে হবো? কিন্তু তুমি কী ভাবছিলে? আমি তোমার সাথে…… ইশশ কি সব ভাবো তুমি! মাথায় শুধু এসবই চলে তোমার তাইনা? নটি গার্ল! মানলাম আমরা স্বামী-স্ত্রী,তাই বলে সোজা মেইন সীনে চলে যাবে? আমার বুঝি লজ্জা করে না! আমি কী তোমার মতো নির্লজ্জ নাকি?এসব ভাবতেও লজ্জায় মরে যাই আমি। আগে আমার লজ্জা কমুক, তারপর সব হবে।
বলেই কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে রওয়ানা হয় আদিত্য। রাগে নূরের র,ক্ত,ক,না ফেটে যাচ্ছে। কত্তবড় বদ লোক। রেগে গিয়ে নূর ক্যাবিনেটের ওপর থাকা পারফিউমের বোতল টা উঠিয়ে পেছন থেকে আদিত্যর দিকে ছুঁড়ে মারলো। তবে আদিত্য নিজের শরীরে লাগার আগেই ঝট করে সেটা ধরে ফেলল। ধরে নিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
–উই মা! এতো রাগ! কেন? বাসর আরম্ভ করিনি বলে? বললাম তো আমার লজ্জা করে। এখন কি বেচারা মাছুম বর লজ্জাও পেতে পারবেনা? আচ্ছা ঠিক আছে, করো তুমি যা করতে চাও। বাঁধা দেবোনা তোমাকে। তুমি তোমার বউয়ের অধিকার নিয়ে নাও৷ আমি নাহয় লজ্জায় মরি মরি করেই নিজেকে তোমার কাছে সমর্পণ করে দেবো। ♬ আমার গায়ে যতো দুঃখ সয়,বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা চায়….
আদিত্যর এসব ফালতু কথা নূরের রাগকে আরও হাজার গুণ বাড়িয়ে দিলো। রাগে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হওয়ার উপক্রম তার৷ প্রচন্ড রেগে নূর আদিত্যর দিকে তেড়ে যেতে যেতে বলল,
–ইউউউউউউ….
অবস্থা বেগতিক দেখে আদিত্য দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দিয়ে হো হো করে হেঁসে উঠল। আর নূর রাগে কটমট করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো আদিত্য। নূর খাটের একপাশে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আদিত্য নূরকে আর নাড়লো না।এমনিতেই ক্ষেপে আছে। দেখা যাবে শেষমেশ প্রথম রাতেই শহিদ হয়ে যেতে হবে। তাই চুপচাপ বিছানায় একপাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। তবে নূর পড়ে গেল চরম দ্বিধায়। সে কোথায় ঘুমাবে? একই বিছানায় উনার সাথে শোয়াতো ইম্পসিবল। কিন্তু তাছাড়া আর কোথায় শোবে?সারারাত এভাবে বসেতো আর থাকা যাবে না।
নূরকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আদিত্য বলে উঠলো,
–এখন কী টিভি সিরিয়ালের সেই বিখ্যাত সীনটা করার ইচ্ছে জেগেছে নাকি? এক বিছানায় শুতে পারবোনা, সোফায় গিয়ে শুবে এন অল? নাকি তোমার নিজের উপর বিশ্বাস নেই? আমার মতো এমন হ্যান্ডসাম, হট পুরুষের কাছে শুয়ে তুমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবেনা সেই ভয় করছ?
নূর দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
–একদম বাজে কথা বলবেন না। আমি আপনাকে আগেই বলেছি আমি আপনার সাথে এক রুমে থাকতে পারবোনা।
–হ্যাঁ, সেটাইতো বলছি। আমাকে চোখের সামনে দেখে তুমি তোমার কামনা আঁটকে রাখতে পারবেনা। তাইতো একসাথে থাকতে চাওনা। জানি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবেনা তুমি। হামলে পড়বে আমার ওপর।
–আর একটাও বাজে কথা বললে কিন্তু খবর আছে আপনার। নূরের এতো খারাপ দিনও আসেনি যে আপনার মতো থার্ড ক্লাস নায়ককে দেখে নিয়ন্ত্রণ হারাবে।
–হাঁহ,এসব কথার কথা। নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় না থাকলে আমার পাশে বিছানায় ঘুমিয়ে দেখাও। জানি পারবেনা। সেই সাহসই নেই তোমার। কারণ তুমি কন্ট্রোল করতে পারবেনা।
নূর চোয়াল শক্ত ঠাস করে আদিত্যর পাশে বিছানায় শুয়ে পড়ে বলল,
–এইযে নেন শুয়েছি। এখন দেখি কে নিয়ন্ত্রণহীন হয়। খবরদার আপনার হাত যেন আমার সীমানায়ও না আসে।
আদিত্য মনে মনে হাসলো। রাগী মেয়েগুলো মাঝে মাঝে খুব বোকা হয়ে যায়।নূরের উপর সবসময় এই ট্রিক টা কাজে লাগে। সারাদিনের অশান্তি আর ক্লান্তির কারণে ঘন্টাখানিকের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেল নূর। আদিত্য বালিশে কনুই ঠেকিয়ে, হাতের উপর মাথা রেখে মায়াময় চোখে তাকিয়ে নূরের ঘুমন্ত মুখের দিকে। এই দিনটার জন্য আদিত্য কতদিন ধরে অপেক্ষা করছিলো। আজ ফাইনলি সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত এসেছে। নূর আজ ওর বউ। ওর ঘর নূরের আলোর মতোই আলোকিত ওর পাশে শুয়ে আছে। আর কি চাই আদিত্যর। হ্যাঁ, নূরকে এভাবে পেতে ওকে একটু অযাচিত পন্থাও অবলম্বন করতে হয়েছে। কিন্তু এছাড়া যে আর কোনো উপায় ছিলোনা। নূরকে অন্য কারোর হয়ে যাওয়া কীভাবে দেখতে পারতো সে? তাইতো নূরকে একেবারেই নিজের করে নিয়েছে। এখন আর নূরকে হারানোর ভয় নেই। যত খুশি রাগ করুক তবুও আমার চোখের সামনে থাকুুক। ওর সব রাগ, অভিমান,ঘৃণা সইতে পারবো। তবে অন্য কারোর হতে দেখতে পারবোনা। কখনো না। তুমি শুধু আমার নূর। আমার শৈবলিনী।
চলবে……