শৈবলিনী পর্ব ৩৪

0
685

#শৈবলিনী—-৩৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★আট মাস পর,
“সময়”,বড়োই অদ্ভুত জিনিস সময়।এই নিরবধি বয়ে চলা সময়, একেক জনের জীবনে একেক ভাবে চলে। এই সময়,কারোর জীবনে হয় আনন্দের, সুখের, সাফলতার। কারোর জীবনে হয় দুঃখ,কষ্ট আর বিষন্নতার। কারোর জীবনে এনে দেয় সফলতার চাবিকাঠি আবার কারোর জীবনে নিয়ে আসে ব্যর্থতার দূর্দশা। সময়,কাউকে এনে দেয় নতুন আলোর সন্ধান আবার কাউকে ঠেলে আধারের গভীরতায়। কেউ সময়ের মূল্য বুঝে তার সাথে চলার চেষ্টা করে আবার কেউ নিজের জীবনের চাওয়া-পাওয়া আশা-নিরাশা ভালো-মন্দ সব সময়ের ওপর ছেড়ে দেয়। কারোর আবার সময়ের কাছে কিছু চাওয়ারই থাকে না, সময় তাকে কী দিলো না দিলো তার ধার ধারে না, সে নিজের মতো করেই চলে। এমনিতেতো কারোর জন্য থেমে থাকে না সময়। সে যতোই কেউ কান্নাকাটি করে নিজের জান দিয়ে দিক তবুও সময় শোনে না কারোর মিনতি। কঠোর হয়ে নিরন্তর ছুটে চলে সময়। তবে কখনো কখনো এই সময়ই আবার কারোর জন্য থমকে যায়। ঘড়ির কাঁটা এক জায়গাতেই আঁটকে যায়। চেয়েও পারেনা সময়কে এগিয়ে নিতে। জীবন থেমে থাকে ওই সময়ইটাতে।

আদিত্যর ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। তার সময় আঁটকে আছে আট মাস পূর্বের ওই রাতে। যেদিন ওই নিঠুর রমনী ওকে জীবন্ত লা,শে পরিণত করে চলে গিয়েছিল।হৃদয়টাকে মৃ,ত করে এই নির্জীব শরীরটাকে ফেলে গেছে। সেদিনের সেই কালো রাত থেকে আজও আলোর দেখা পায়নি সে। বেঁচে থাকাটা কেবলই দায়ভার তার। নিঃশ্বাস গুলোও বোঝা হয়ে গেছে তার। কিন্তু চাইলেও এই নিঃশ্বাসের বোঝা একেবারে বন্ধ করতে পারছেনা আদিত্য।এটাই যে নূরের দেওয়া শাস্তি। তার শাস্তি ভোগ না করে কীভাবে পালাতে পারে ও। বেঁচে থাকার মতো ভয়াবহ যে শাস্তি নূর দিয়েছে তা ভোগ না করে কীভাবে চলে যাবে।
সাতাশ বসন্ত পেরিয়ে আসা এই জীবনে আদিত্যর হঠাৎই সবকিছু মিথ্যে মনে হচ্ছে। সব জানা অজানা জ্ঞান আজ নিজের ওপরই উপহাস করছে। এই পর্যায়ে এসে জীবনের হিসাব খাতায় কেবলই শূন্য মিলছে। সম্পর্ক, বন্ধন মায়া,মমতা এসব শুধুই মিথ্যে জাল।আসলে সব হলো স্বার্থের খেলা। যতক্ষণ স্বার্থ ঠিক আছে ততক্ষণই সব ঠিক আছে। স্বার্থে আঘাত পড়লেই তখন মিথ্যে জালও ছিঁড়ে যায়। পৃথিবীর বাস্তব রুপ দেখা যায় তখন। এই স্বার্থময় পৃথিবীতে নিজেকে বড়োই বেমানান মনে হয় এখন আদিত্যর।

দশ তালা বিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের ছাঁদের রেলিঙের ওপর বসে এক হাতে ম,দে,র বোতল আরেক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে আছে আদিত্য। একবার অ্যা,ল,কো,হ,ল গিলছে তো আরেকবার নিকোটিন টানছে। ভেতরের জ্বলনকে বাইরের অগ্নি দ্বারা নিভানোর বৃথা চেষ্টা করছে। কারণ সে অগ্নি নেভার পরিবর্তে আরও জ্বলে উঠে পুড়িয়ে দিচ্ছে আদিত্যকে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ টান দিয়ে রেলিঙ থেকে ছাঁদের ফ্লোরে এনে ফেললো। আদিত্য হকচকিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো, আবির। আদিত্যকে নিচে নামিয়ে হাঁটুর ওপর হাত ঠেকিয়ে রিতীমত হাঁপাচ্ছে সে। আসার সময় নিচ থেকে আদিত্যকে এভাবে রেলিঙের ওপর বসে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে যায় আবির। তাই প্রাণপণে দৌড়ে আসে সে। আদিত্যর মনমানসিকতা এখন স্বাভাবিক নেই। এই অবস্থায় যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে ও। সোটরই ভয় হচ্ছিল ওর। তাই দৌড়ে এসে ওকে নামিয়েছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে একটু ঠিক করে আবির ক্ষেপে গিয়ে আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
–শালা, হা,রা,মি রেলিঙের ওপর কি কোনো মুভির শুটিং করছিলি? জানোস এক্ষুনি আমার কোটি টাকা দামের পরানডা লাফ দিয়া বারাই যাইতো। তোর দেবদাস গিরির চক্করে আমার ইন্না-লিল্লাহ হয়ে যেত এক্ষুনি। বিষয় টা শুধু আমার মরার না। আমি মরে গেলে এই লাখো নারীর কল্যাণ কে করতো? নারীদের এই মহা সর্বনাশের জন্য দায়ী থাকতি তুই।

আদিত্য মাতালের মতো হেঁসে বলল,
–“মৃ,ত্যু”!মৃ,ত্যু,কে লোক শুধু শুধুই বদনাম করেছে। আসল যন্ত্রণাতো শালী এই জীবন দেয়।

–দেখ এমনিতেই মাথা গরম হয়ে আছে। তারওপর তোর ঠ্যাং, মাথা ছাড়া কথা বলে আমার মগজের আলু ভাজা করিসনা।
আবির আদিত্যর পাশে গিয়ে বসলো। আদিত্যর হাত থেকে ম,দে,র বোতলটা হাতে নিয়ে বলল,
–শালা, সকাল সকাল হয়রানি করালি। এমন দৌড় অলিম্পিকে দিলে দেশের জন্য আজ গোল্ড মেডেল কনফার্ম ছিলো। গলাও শুকিয়ে গেছে। দে, গলা ভেজাই।

আদিত্য ছাদের রেলিঙের দেয়ালের সাথে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,
–তা সকাল সকাল কে টপকাতে বললো তোকে? নিশ্চয় উনি তাইনা?

উনি বলতে যে আদিত্য ওর মায়ের কথা বলছে তা জানে আবির। আবির বলল,
–নাহ,রেহনুমা আন্টি পাঠায়নি। আসলে কাল একটা নিউজ দেখলাম। ভাবলাম তুই দেখেছিস কিনা…

–হুম দেখেছি। তবে আমি অবাক হয়নি। এমনটা হবে আমি জানতাম। নূর ওর গাড়ি বানানোর কাজে সফল হয়েছে। সেই নিউজ দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বড়ো বড়ো কোম্পানি নূরের সাথে কোলাবোরেশান করতে চাচ্ছি। এই সবকিছুই জানি আমি। এটাতো হওয়ারই ছিলো। নূরের এই সফলতা ও ডিজার্ভ করে।

–আর তুই? তোর কী? তুই কী এসব ডিজার্ভ করিস? যে তোকে ভালোবাসেনা। তোকে চায়না।তার জন্য কেন নিজে সন্ন্যাসী হয়ে জীবন কাটাচ্ছিস। এইযে নিজের পরিবার ছেড়ে একা এই ফ্লাটে এসে পড়ে আছিস। বেঁচে থাকার নামে শুধু নিঃশ্বাসটাই নিচ্ছিস। এসব কী তুই ডিজার্ভ করিস?

–ভুল বলছিস তুই আবির। ও ভালোবাসে আমাকে। অনেক ভালোবাসে। আমি এতটাও অন্ধ না যে,ওর চোখের ভাষা পড়তে ভুল করবো। ওই চোখে আমি নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছিলাম। আমি এসব ডিজার্ভ করি, কি করি না তা জানা নেই। তবে যাতনা শুধু একটাই, ও যেতে যেতে মিথ্যে বলে গেল আমাকে। আর সেটাই বেশি অসহনীয় পীড়া দেয় আমাকে। বুকের ভেতর সর্বক্ষণ দাবানল জ্বলছে আমার।

দুঃখজনক এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আবির। প্রাণপ্রিয় বন্ধুর এমন বেহাল দশা আর দেখতে পারে না ও। নিজের ওপরই রাগ হয় ওর। এসব ভালোবাসা টালোবাসার চক্করে ওকে পড়তে দেওয়াই উচিত হয়নি। তখনই যদি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে এসব থেকে বের করে আনতো তাহলে হয়তো আজ ওর এই দশা হতোনা। ওতো জানে, ভালোবাসা জিনিসটাই দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্য অনুভূতি। যা কখনো কাউকে সুখী করেনা। ভালোবাসা শুধু গ্লানী আর দূর্দশাই এনে দিতে পারে। ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না ভালোবাসা। আই জাস্ট হেট লাভ।
আবির আদিত্যর হাত ধরে ওকে উঠাতে উঠাতে বলল,
–হয়েছে, তোর দেবদাস কথন শেষ হলে ভেতরে চল। সকাল সকাল খালি পেটে অ্যা,ল,কো,হ,ল খেয়ে নিলাম। এখন তাড়াতাড়ি নাস্তা করি চল। নাহলে আজ বাথরুম সংসার শুরু করতে হবে।
বলেই আবির আদিত্যকে টেনে নিয়ে গেল ভেতরে।

আদিত্য সেদিনের পর থেকেই একা ওর কেনা এই ফ্ল্যাটে থাকে। মায়ের ওই কাজের পর থেকে পরিবারের উপর তার কেমন বিতৃষ্ণা এসে গেছে। তাইতো একাই এখানে পড়ে থাকে। দিনরাত ম,দে,র নেশা আর ধোঁয়ার নেশায় নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। নূরের দেওয়া কষ্ট থেকে এভাবেই বাঁচার উপায় খোঁজে সে। যদিও তা খুব একটা কাজে দেয়না। বুকের যন্ত্রণা থেকে একবিন্দুও মুক্তি পায়না সে। আজ আট টা মাস সে হৃদয় ছাড়াই বেঁচে আছে। এই দেহটাকেও হয়তো এতদিন দাফন করার ব্যবস্থা করে দিতো আদিত্য। শুধু নূরের দেওয়া শাস্তি ভোগ করার জন্যই সে বেঁচে আছে। তার অপরাধের শাস্তিযে তাকে মরতেও দেয়না।নূরকে দেওয়া ওয়াদা অনুযায়ী সেদিনের পর আর নূরের সামনে যায়নি আদিত্য। তবে নূরের সব খবরই তার জানা থাকে। নূর ওকে তার সামনে যেতে মানা করেছে। তবে নূরের কথা জানতে তো আর কেউ ঢেকাতে পারবেনা ওকে। সেই দিনের পর একমাসের মাথায়ই নূরের ফাইনাল এক্সাম শুরু হয়ে যায়।তারপরে আর নূর ভার্সিটিতে আসে না। আদিত্যও তাই আর সেখানে শুটিং করতে যায়না। আদিত্যর কোনো কিছুই আর করতে ইচ্ছে করে না। পারলে তো এসব মুভির শুটিং টুটিং সব ছেড়ে দিতো সে। কিন্তু অনেক গুলো মুভির কন্ট্রাক্ট সাইন করে রেখেছিল সে। তাই না চাইতেও শুটিং এ যেতে হয় ওকে।যদিও ও না গেলে কোনো কনট্রাক্ট ওর কিছুই করতে পারবেনা। তবু্ও নিজের জন্য কারোর ক্ষতি চায়না আদিত্য। যেহেতু কথা দিয়েছিল তাই মন না চাইলেও কাজে যায় আদিত্য। তবে সে ভেবে নিয়েছে পেন্ডিং কাজগুলো শেষ হলে আর কোনো মুভি টুভি করবেনা । এখান দূরে কোথাও চলে যাবে। আদিত্যর কাছে নূরের সব আপডেট থাকে। নূর অনেক ভালো রেজাল্টে পাশ করেছে। এবং নিজের স্বপ্নও পূরণ করেছে সে। তার সেই গাড়ি উদ্ভাবন করতে পেরেছে। প্রত্যেক টা নিউজ মাধ্যমে এখন তারই আলোড়ন শুধু। নূরের সফলতায় আদিত্যও খুশি। “নাহোক সে আমার, তবুও তার জীবন হোক খুশির সমাহার।”
__

আদ্র অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। বাবার বিজনেস জয়েন করেছে সে। এই কয়মাসে নিজেকে অনেক টাই শুধরে নিয়েছে। দায়িত্ববান একজন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। অতীতের ভুলগুলোকে তো আর ঠিক করা যাবে না। তবে সামনের জীবনে যাতে আর কোনো ভুল না হয় সেই প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে সে। যদিও তার এই প্রচেষ্টা কতদূর ফলপ্রসু হয়েছে তা জানা নেই। অমালিয়া এখনো তাকে মাফ করেনি। আজও তার অন্যায়ের শাস্তি দিয়ে যাচ্ছে অমালিয়া ওকে। যদিও আদ্রর কাছে এসব এখন আর শাস্তি মনে হয়না। ওই রাগী, জিদ্দি মেয়েটার ক্রোধের সম্মুখীন হতে হতে কখন যে ওই নারীতে মন হেরে বসে আছে তা বুঝতেও পারেনি। এখনতো তার দেওয়া শাস্তিও মজাদার লাগে আদ্রর কাছে। এখনতো কেবল একটাই চাওয়া, কবে অমালিয়া ওকে মাফ করে দিবে। আর ওকে স্বামী হিসেবে নিজের জীবনে জায়গা দিবে।

ভাবনার মাঝেই হঠাৎ মুখের ওপর প্রচন্ড বেগে টাওয়াল এসে লাগলো। আদ্র খুব একটা অবাক হলোনা। এটাযে ওর বউ নামক আগুনের গোলার কাজ তা ভালো করেই জানে সে। আদ্র মুখের উপর থেকে তোয়ালেটা নামিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো অমালিয়া যথারীতি অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্র মুচকি হেঁসে বলল,
–মনে হচ্ছে স্বামীকে তোয়ালে দেওয়ার রীত এর ব্যাপারে তোমাকে কেউ ভুল তথ্য দিয়েছে। প্রথমত তোয়ালে গোসলের সময় দিতে হয়। আর দ্বিতীয়ত এভাবে গুগলির মতো ছুঁড়ে দিতে হয়না। ওয়াশরুমের দরজায় গিয়ে একটু লাজুক, মোহনীয় ভঙ্গিতে স্বামীর হাতে নিয়ে দিতে হয়। আর স্বামী তোয়ালের বদলে পুরো বউটাকেই ভেতরে নিয়ে নেয়।এটা হলো তোয়ালে আদান প্রদানের আসল প্রটোকল।

আদ্রর হেয়ালি পূর্ণ কথা অমালিয়ার রাগের আগুনে আরও ঘী-এর কাজ করলো। সে ফুঁসে উঠে বলল,
–নোংরা মনের মানুষের মাথায় সবসময় শুধু নোংরা চিন্তাই চলে। তোমার মতো জঘন্য মানুষের কাছ থেকে আর আশাই কী করা যায়। তোমাকে কতবার বলেছি গোসল করে নিজের তোয়ালে ওয়াশরুমে ফেলে রাখবেনা। তোমার তোয়ালে দেখলেও আমার ঘেন্না হয়।

আদ্রর মুখে আঁধার নেমে এলো। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। মেয়েটা তাকে বিষাক্ত কাটার ঘাঁ দেওয়ার একটা সুযোগও ছাড়েনা।ওই ঘটনা কিছুতেই ভুলতে দেয়না। বারবার সেই একই জায়গায় নিয়ে থামিয়ে দেয় সব। কী আর করার, এসব ওরই কর্মের ফল। ও যে অপরাধ করেছে তার তুলনায় তো এসব কিছুই না। হয়তো সারাজীবনই এর শাস্তি ভোগ করতে হবে ওকে। আদ্র কাটার আঘাত হজম করে নিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–আচ্ছা সরি,আর হবেনা। তুমি প্লিজ রাগ করোনা। তুমি গিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নাও। সমস্যা নেই আমি টেবিলে থাকবোনা। আমি এখুনি বেরিয়ে যাচ্ছি। তুমি প্লিজ না খেয়ে থেকোনা।

আদ্র ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রাগে দুঃখে বিছানায় গিয়ে ঠাস করে বসে পড়লো অমালিয়া। গত আটমাস হলো আদ্রর সাথে কঠিন থেকে কঠিনতম ব্যবহার করছে সে। ও এতো এতো বাজে কথা শোনায় আদ্রকে। তবুও ওর মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়না সে। উল্টো সে আরও ওর সবসময় কেয়ার করে। আর এই জিনিসটাই অমালিয়ার রাগ বাড়িয়ে দেয়। লোকটা এমন কেন করে? এতো খারাপ ব্যবহারেও কেন তার কষ্ট লাগেনা? একতরফা ভাবে বাজে ব্যবহার করতে করতে কেমন যেন হয়রান হয়ে গেছে অমালিয়া। সেতো চায় ওই লোকটাকে অশান্তিতে দেখতে। দূর্দশায় দেখতে চায় তাকে। কিন্তু তা হয়না কেন? আমি কী এখানেও অপারগ হয়ে গেলাম। উল্টো ওই লোকের যত্নসুলভ আচরণ দেখলে কোথাও না কোথাও নিজেরই কেমন খারাপ লাগা কাজ করে। যারজন্য নিজের ওপরই চরম রাগ হয় অমালিয়ার। যে আমার সাথে এতবড় অন্যায় কাজ করলো,যারজন্য আপু আমাকে পর করে দিলো। সেদিনের পর আপু আর কথা বলেনা আমার সাথে। দেখা হলেও পাশ কেটে এড়িয়ে চলে যায়। আর যার কারণে এসব হলো আজ তার প্রতিই নাচাইতেও কেমন মায়া কাজ করে। এটা ভাবতেই নিজের ওপরই ঘৃণা হয় অমালিয়ার।

আদ্র নিচে আসতেই দেখলো ওর মা সোফায় বসে টিভির দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে। টিভিতে আদিত্যর সিনেমা চলছে। ছেলেকে দেখেই তিনি কাঁদছেন বুঝতে পারলো আদ্র। এগিয়ে গিয়ে বসলো মায়ের পাশে। মায়ের চোখের পানি মুছে বলল,
–এভাবে কাঁদলে কী ভাইয়া ফিরে আসবে মা?

রেহনুমা ব্যাথিত কন্ঠে বললেন,
–তাহলে কী করলে ফিরে আসবে বলনা? মায়ের জন্য কি ওর একটুও মায়া হয়না? একবারও কী আমাদের কথা মনে হয়না ওর? আজ আট টা মাস হলো বাড়ি ছেড়ে গেছে।তারপর একদিনের জন্যও এলোনা দেখা করতে। ফোন করলেও ধরে না।মা নাহয় একটু ভুল করেছিল।নাহয় ছেলের জন্য একটু স্বার্থপর হয়েছিল। তাই বলে তার এতবড় শাস্তি দিবে ও?

আদ্র অপরাধী সুরে বলল,
–তোমার কোনো দোষ নেই মা। সব দোষ আমার। আমার একটা ভুলের জন্য আজ সবার জীবন উলোটপালোট হয়ে গেল। ভাইয়া আর নূরের মাঝে দূরত্বও হয়েছে হলো আমার কারণে। আমার অপরাধের শাস্তি আজ ভাইয়া পাচ্ছে। এরজন্য নিজেকে আমি কখনো মাফ করতে পারবোনা। এমন হবে জানলে আমি পুলিশের কাছেই আত্মসমর্পণ করে দিতাম। লিয়া ঠিকই বলে, আমি আসলেই একটা জঘন্য মানুষ।
__

নূরের জীবনে এই কয়মাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ভালো নাম্বারের সাথে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে গেছে তার। আর সে তার স্বপ্নও পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। তার সেই গাড়ি সে তৈরি করতে পেরেছে। দেশের বড়ো এক কোম্পানি তার সাথে কোলাবোরেশান করেছে।আরও বেশি করে গাড়ি তৈরি করে মার্কেটে আনার জন্য ইনভেস্ট করছে। দেখতে গেলেতো তার জীবনে এখন সফলতার বহর এসেছে। সুখী হওয়ার সময় এসেছে। তবুও এতকিছুর পরও দিনশেষে সে শূন্যতায় ডুবে যায়।সেদিনের পর থেকে নূর নিজেকে আরও শক্ত করে নিয়েছে। অনুভূতিহীন পাথরে তৈরি করেছে নিজেকে। কাজের মাঝে নিমজ্জিত করে দিয়েছে নিজেকে। যার ফলস্বরূপ পেয়েছে আজকের সফলতা।ওর সংঘর্ষ সফল হয়েছে আজ। উপরে উপরে দেখতে গেলে সে এখন সর্বসুখী। তবে কেউ জানে না তার ভেতরের সত্তাটা আজও বিষন্নতার নিচে গুমরে মরছে। না চাইতেও আদিত্যর শূন্যতা ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় ওকে। চেয়েও পারেনা ওই বেঈমান লোকটাকে ভুলতে। কেন যেন মনে হয় এতকিছুর পরও তাকে এখনো ঘৃণা করতে পারেনি ও। আর এই মনোভাবের জন্য নিজের ওপরই চরম রাগ হয় নূরের। একটা মানুষ ওকে এতটা কীভাবে বশ করতে পারে? দূরে গিয়েও কীভাবে এতো প্রভাব ফেলতে পারে? তবুও নিজেকে আর ওই দূর্বলতায় গলতে দিবেনা। ফেলে আসা ওই গলিতে আর যাবেনা সে।

ইনভেস্টরস দের সাথে মিটিংয়ে এসেছে নূর। এস এস কোম্পানির সিইও সোহান সোহরাব এসে নূরের সাথে হাত মিলিয়ে মুচকি হেঁসে বলল,
–গুড মর্নিং মিস নূর।

নূর সৌজন্যমূলক হেঁসে বলল
–গুড মর্নিং। ক্যান উই স্টার্ট?

–ইয়া শিওর।

সোহান চেয়ারে বসলো। নূর ওর ল্যাপটপ থেকে প্রজেক্টরে সব ডিটেইলস দেখাতে লাগলো। সোহান প্রজেক্টরে দেখছে কম,নূরের দিকেই বেশি চোখ যাচ্ছে তার। নূরের মতো এমন রুপে, গুণে, প্রতিভা, সাহসিকতায় পরিপূর্ণ নারীকে সে এর আগে কখনো দেখেনি। মেয়েটার মাঝে একটা বিশেষ আকর্ষণ আছে। না চাইতেও আকর্ষিত করে। নূরের প্রেজেন্টেশন শেষে সোহানসহ মিটিং রুমের সবাই হাতে তালি দিয়ে প্রশংসা জ্ঞাপন করলো নূরকে। সোহান বলে উঠলো,
–তো সবতো ঠিক ঠাক আছে। তাহলে এখন প্রোডাক্টের প্রমোশনের জন্য একটা কমার্শিয়াল অ্যাড তৈরি করা জরুরি। এই ব্যাপারে কোনো সাজেশন আছে আপনার?

অ্যাডের কথা আসতেই নূরের হঠাৎ আদিত্যর কথা মনে পড়ে গেল। সেই খেয়াল ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে নূর বলে উঠলো,
–সেটা আপনারা যা ভালো বোঝেন, করেন। আপনাকে তো আগেই বলেছি এসব ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবোনা৷

–হ্যাঁ বলেছিলেন,আর তাই আপনাকে আর পেরেশান না করে আমি নিজেই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি। অ্যাড শুটের জন্য মডেলও সিলেক্ট হয়ে গেছে। আজই শুরু হবে কাজ। এখুনি হয়তো চলে আসবেন উনি?

–উনি? কে উনি?

সোহান নাম বলতে যাবে ঠিক তখনই দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
–আরে ওইতো চলে এসেছেন উনি।

নূর দরজার দিকে তাকাতেই থমকে গেল সে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here