#শৈবলিনী—২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★”ইফ ইউ থিংক অ্যা’ম ব্যাড, দেন ইউ আর রং। কজ অ্যাম ওয়ার্স্ট ফর ইউ। আমার জঘন্যতম রুপ দেখতে ভালো লাগে না তোদের? তোরা হয়তো ভুলে গিয়েছিলি সম্রাটের চরিত্র ইজ নট ফুলের মতো পবিত্র। একটা কথা মনে রাখবি। সম্রাট কাউকে হুমকি দেয়না। ত্রাশ সৃষ্টি করার জন্য সম্রাটের নামই যথেষ্ট। মাইন্ড ইট”
টিভির স্ক্রিনে সুপারস্টার আদিত্যর ডায়লগ ডিলেভারী দেখে দুই আঙুল মুখে পুরে শিস বাজিয়ে উঠলো অমালিয়া। উত্তেজনায় মাতন হয়ে ছোটবোনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–দেখেছিস চিনি, আদিত্য কেমন ফাটিয়ে দিলো! হায় কী দিলা মাই হিরো। আদিত্যর সব মুভি গুলোই একেবারে সুপার ডুপার বাম্পার হিট। এই মুভি টা তো আমার সবচেয়ে ফেবারিট। কী হ্যান্ডসাম, কী এটিটিউট। হায়,,,
মিছরি মুখের মাঝে গপাগপ পপকর্ণ ঢুকাচ্ছিলো আর চোখ দুটো মার্বেল আকার করে টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলো। অমালিয়ার কথায় সে সহমত পোষণ করার উদ্দেশ্যেই তার দিকে ফিরে তাকালো। তবে অমলিয়ার পেছনে দরজা দিয়ে ভেতরে অগ্রসর হওয়া ব্যক্তিকে দেখে তার মনোভাব মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়ে গেল। গালের মাঝে ফুলে থাকা পপকর্ণ গুলোও আর চাবানোর সাহস পেলনা। তড়িঘড়ি করে কোলের উপরে রাখা বালতি আকারের পপকর্ণের বোলটা উঠিয়ে টি টেবিলের নিচে রেখে দিলো। গালের পপকর্ণ কোনরকমে গলার নিচে ফ্ল্যাস করে দিলো। ভীতিগ্রস্ত অবস্থায় কোনরকমে নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে নির্দোষ প্রমাণ করার কাজে লেগে পড়লো।কন্ঠে মিছে রাগ এনে অমালিয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–কী বলছ এসব আপু! একেতো বড়ো আপুর কথা না মেনে বসে বসে টিভি দেখছ। আবার আমার মতো ছোট অবুঝ মেয়েকে এসব বলছ। লজ্জা করে না তোমার?
মিছরির এই পরিবর্তিত রুপান্তরে অমালিয়ার কপাল কুঁচকে এলো। মিছরির পানে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
–ওই চিনির বাচ্চা, তোর আবার কী হলো? পপকর্ণের সাথে নিজের মগজও গিলে খেয়ে ফেলেছিস নাকি? তুই নিজেই তো..
অমালিয়ার মুখের কথা কেঁড়ে নিয়ে মিছরি সেটার মোড় ঘুড়িয়ে দিয়ে বলল,
–আমি কী হ্যাঁ? আমিতো ঘরে বসে পড়ছিলাম। তুমিই তো আমাকে ডেকে এনে টিভি দেখতে বসিয়ে দিলে। নিজেতো পড়াশোনা করোই না। আবার আমাকেউ পড়তে দাওনা।
কথা বলার মাঝেই মিছরি চোখের ইশারায় বুঝালো তোর পেছনে জম দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাস এবার অমালিয়ার মুখও হাওয়া বের হওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেল। ও বুঝতে পারছে পেছনে কে আছে। ভয়ে ভয়ে ঘাড়টা পেছনে ফেরালো। ওর পেছনেই নূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অমালিয়া শুকনো ঢোক গিলে বলল,
–আ আপু তু তুমি! ওই আসলে হয়েছে কী, এই মাত্রই একটু বসেছিলাম।
নূর চোখ তুলে একবার টিভির পর্দায় তাকালো। ব্লাক প্যান্ট আর ব্লাক শার্ট পরিহিত এক পুরুষ দাম্ভিকতার সহিত স্লো মোশনে এগিয়ে আসছে। শার্টের বোতাম নামমাত্র নিচের একটা শুধু লাগানো আছে। বাতাসে বুকের শার্ট সরে গিয়ে সম্মুখভাগ উন্মুক্ত হয়ে আছে। দুই ঠোঁটের মাঝে সিগারেট চাপানো আছে স্বযত্নে। সামনে যেই আসছে তাকে মুহুর্তের মাঝে এক হাতে জমিনে কপোকাত করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে মানুষ না, শরীরের ওপরে পড়া মাছি তাড়াচ্ছে সে। পুরুষ টাকে চিনতে বেশি সময় লাগলো না নূরের। এটা যে গ্যারেজের সেই লোকটাই। আর চিনতে পেরেই মেজাজ যেন আরও একধাপ বিগড়ে গেল। নূর এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে টিভির সুইচ টা বন্ধ করে দিলো। বোনদের দিকে নজর ঘুরিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলো,
–তোদের কতবার বলেছি না এসব ফালতু মুভি টুভি একদম দেখবি না? এসব ফ্যান্টাসি মুভি দেখে মাথার আই-কিউ যা আছে তাও বৃন্দাবনে যাবে। এসব হিরোরা শুধু ছবিতেই হিরোইজম দেখাতে পারে । বাস্তবে এরাও বাকি সবার মতোই সুবিধাবাদী। খবরদার আর কখনো যদি এসব ফালতু জিনিস দেখেছিস তো। টিভি একেবারে ভেঙে ভাংঙাচুরা ওয়ালার কাছে বিক্রি করে দিবো। পড়াশোনা নেই তোদের? পড়াশোনা বাদ দিয়ে টিভি দেখা হচ্ছে? একজনের সামনে এইচএসসি পরীক্ষা আর আরেকজনের পিএসসি। অথচ দেখ কী সুন্দর আয়েশ করে টিভি দেখছেন উনারা।
মিছরি ইনোসেন্ট ভাব ধরে বলল,
–আপু আমার সব পড়া শেষ।
–তাই? ঠিক আছে যা বই নিয়ে আয় দেখবো কত মহাভারত উদ্ধার করেছিস তুই। কী হলো যা!
মিছরি ভয়ে দিলো এক ভোঁ দৌড়। নূর এবার অমালিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
–তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন লিয়া? তুই কোন জাহাজ আবিস্কার করেছিস দেখা। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে চেক করছি তোর পড়ার কী অবস্থা।
অমালিয়াও মিনমিনিয়ে চলে গেল ওখান থেকে। মনে মনে তার আদিত্যর মুভিটা না শেষ করার শোক যাচ্ছে না। এই আপুটাও না, একটু বেশিই করে। একটু দেখলে কী হয়? নিজে তো রসকষহীন কাঠখোট্টা হয়ে থাকে। আমাদেরও তাই বানাতে চায়।
রান্নাঘরে চুলোয় তরকারি নাড়ছে লতিকা বেগম। তাড়াহুড়ো করে রান্নাটা শেষ করতে চাচ্ছে। বড়ো মেয়েটা সারাদিন পর বাড়িতে আসলে ওর সামনে গরম গরম ভাত তরকারি রাখতে পারলে শান্তি লাগে তাঁর। সারাদিন দৌড়া দৌড়ি করে মেয়েটা ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াই করে না। তাইতো বাসায় আসলে তার সামনে খাবার দিতে দেরী করতে চায়না উনি। সামনে বসে মেয়েটাকে পেটপুরে খেতে দেখলে শান্তি লাগে তাঁর। হাঁটুর ব্যাথাটা আজ একটু বেশিই পীড়া দিচ্ছে তাঁকে।তাইতো রান্না করতে দেরি হয়ে গেছে আজ। ঔষধ শেষ হয়ে গেছে। সেটা বলেনি কাউকে। কী করবে,মেয়েটার ওপর আর কতো বোঝা চাপিয়ে দিবে! এমনিতেই সংসারের সব দায়িত্ব ওর ওপর। আর কতোই বা বলা যায় ওকে।
রান্না শেষে টেবিলে খাবার পরিবেশন করে ডাকলো সবাইকে। একে একে এলো সবাই। নূর টেবিলে চোখ বুলিয়ে উৎসাহ নিয়ে বলল,
–ওয়াও মা, টাকি মাছ ভর্তা! মাই ফেবারিট। আজতো জম্পেশ খাওয়া হবে।
–হ্যারে মা,তোর জন্যই করেছি।
–ইউ আর দ্যা বেস্ট, মা।
মিছরি মিছে আক্ষেপের সুরে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ, আপুই তো সব। আমরা তো তালপুকুরের ভেসে থাকা শেওলা। আমাদের তো কোনো ভেলুই নেই।
অমালিয়াও মিছরির সুরে সুর মিলিয়ে বলল,
–হ্যারে চিনি, এই প্রথম একখান সঠিক কথা বলছিস। এখানে আমাদের কেউ নেই। চল এই স্বার্থপর দুনিয়া ছেড়ে আমরা বনবাসে চলে যাই।
নূর মাছ ভর্তা মুখে পুরে দায়সারা ভাবে বলল,
–যাক ভালোই হলো। তোরা নিজেরাই তোদের আসল ঠিকানা খুঁজে পেলি। আমার আগেই মন হয়েছিল এসব লেজ কাটা বাঁদর গুলো আমার বোন হতেই পারে না। এখন যা, জঙ্গলে গিয়ে তোদের আসল আপনজনের সাথে সুখে জীবনযাপন কর। আমার দোয়া রইলো।
মিছরি আর অমালিয়া একসাথে বলে উঠলো।
–আপুউউউউ..
হেসে দিলো নূর। মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
–মা ইভান কোথায়? বাসায় ফেরেনি ও?
–না এখনো আসেনি। কলেজের পর নতুন একটা টিউশন ধরেছে নাকি। তাই হয়তো আসতে সময় লাগছে।
–টিউশন? ওকে টিউশন কে নিতে বলেছে? টাকার দরকার হলে আমিতো আছি। এতো টিউশন করালে ও নিজের পড়াশোনায় সময় দিবে কখন?
তখনই ইভান পেছন থেকে আসতে আসতে বলল,
–চিন্তা করোনা আপু। আমি নিজের পড়াশোনার কোন ক্ষতি হতে দিবোনা। আর শুধু শুধু বসে থাকার বদলে দুই একটা টিউশন করলে সময়ও কাটে। তাছাড়া তুমিতো একা একাই সব সামলাচ্ছ। তাই অন্তত নিজের হাত খরচের ব্যবস্থা নিজে করতেই পারি।
–ঠিক আছে। তবে পড়ালেখার ক্ষতি করে কিছু করার দরকার নেই। আমিতো আছিই।
–সেটা আমি জানি আপু। তুমি কোন চিন্তা করোনা।
খাবার খেতে খেতে অমালিয়া বলে উঠলো।
–আপু আমাদের কলেজ থেকে পিকনিকে যাচ্ছে সবাই। আমিও যেতে চাই। আমাকে টাকা দাওনা।
–কত টাকা?
–পাঁচ হাজার।
ইভান বলে উঠলো।
–এতো টাকা দিয়ে পিকনিকে যেতে হবে কি জন্য? দরকার নেই যাওয়ার।
অমালিয়া আকুতিভরা কন্ঠে বলল,
–প্লিজ আপু,সবাই যাবে। আমি না গেলে সবার সামনে ইমব্যারেস হতে হবে। সবাই ভাববে আমি টাকার জন্য যাইনি। সবাই হাসাহাসি করবে আমাকে নিয়ে। প্লিজ আপু।
নূর একটু চিন্তায় পড়ে গেল। কিছু টাকা জমিয়ে ছিলো নিজের একটা কাজের জন্য। এখন লিয়াকে টাকা দিলে ওর আর সেই কাজটা করা হবে না। থাক, নিজের কাজটা নাহয় পরে করা যাবে। ওকে এখন না দিলে মনঃক্ষুণ্ন হবে ওর। তাই জোরপূর্বক হেসে বলল,
–আচ্ছা ঠিক আছে। সকালে নিয়ে যাস আমার কাছ থেকে।
–সত্যিই! থ্যাংক ইউ আপু।
খাওয়া শেষে নূর ওর মায়ের সামনে ঔষধের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
–এইযে মা তোমার ঔষধ। নিশ্চয় আজ শেষ হয়ে গেছে তাইনা? আর প্রতিবারের মতো এবারও তুমি আমাকে বলোনি। এটা কিন্তু ঠিক না মা।
লতিকা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,
–আর কতো করবি মা। সংসারের সব ঝামেলা তো তোর ওপরেই। আর কতো বোঝা বাড়াবো তোর? আমাদের সবার বোঝা টানতে টানতে তুই নিজের জীবনের কথাই ভুলে গেছিস।
–এভাবে কেন বলছ মা! আজ যদি আমার জায়গায় তোমার বড়ো ছেলে থাকতো তাহলে কী তাকে দায়িত্ব নিতে হতোনা?তখন কী তাকে এভাবে বলতে তুমি? তাহলে আমি কি এমন আহামরি কাজ করলাম? নাকি বাকিদের মতো তুমিও ছেলে মেয়ের মধ্যে পার্থক্য দেখ?
–না না নূর, কখনোই না। আমার কাছে ছেলে মেয়ে সবই একসমান।
–তাহলে এসব কথা আর বলবেনা। আর পুরনো সিনেমার মায়েদের মতো অযথা চোখের পানি ফেলবেনাতো। ভালো লাগে না আমার একদম।
লতিকা চোখের পানি মুছে জোরপূর্বক হেসে দেখালো মেয়েকে। নূর মুচকি হেঁসে বলল,
–এইতো আমার সুন্দরী মা।আমার আলাভোলা বাবাকে এই হাসি দেখিয়েই পাগল করিছিলে তাইনা?
–তবেড়ে পাঁজি মেয়ে দাঁড়া দেখাচ্ছে মজা।
নূর হেঁসে উঠে দৌড় লাগালো নিজের রুমের দিকে। মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল লতিকা। মেয়েটা যে তাঁর মন ভালো করার জন্যই এমন করেছে তা ভালোই জানেন তিনি। মেয়েটার জন্য বড্ড চিন্তা হয় তার। আগে কতো উচ্ছল প্রাণবন্ত ছিলো মেয়টা। হঠাৎ করেই যেন সব থমকে গেল। নূরের বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে সবকিছু বদলে গেল। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়লো এই মেয়েটার ওপর। দায়িত্ব পালন করতে নূর ওর বাবার রেখে যাওয়া গ্যারেজ নিজেই চালাতে লাগলো। এতসব দায়িত্ব পালন করতে করতে মেয়েটা নিজের জীবনের কথাই ভুলে গেছে।কেমন বেরঙ হয়ে গেছে। নিজের ভেতরের নারীসুলভ সবকিছুই কেমন হারিয়ে ফেলছে ও।যে বয়সে মেয়েরা সংসার জীবনের স্বপ্ন দেখে, সেই বয়সে নূরকে এই সংসারের কর্তা হতে হলো। কী হবে মেয়েটার? ওর জীবনে কী নতুন ভোর আসবেনা? কেউ কী আসবেনা ওর জীবনে? যে ওকে নতুন রঙে রাঙিয়ে দিবে?
___
আদিত্য নিজ গৃহে পা রাখতেই প্রথমে নজরে এলো চিন্তিত অবস্থায় পায়চারীকৃত তার মা রেহনুমা বেগমকে।কাজের মেয়ে কম, রেহনুমার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট ছবি হাতে জুস নিয়ে তাঁর পিছে পিছে হাঁটছে। মায়ের এই অস্থিরতা যে তার কারণেই হয়েছে তা ভালো করেই জানে আদিত্য। আজ বাসায় ফিরতে একটু দেরি হওয়ায় মা জননীর নিশ্চয় বিপি হাই হয়ে গেছে। আদিত্য মুচকি হেঁসে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
–রিল্যাক্স মা, আমি এসে গেছি। আর আমি একদম ঠিক আছি।
রেহনুমা পেছনে ফিরে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,
–এতো দেরি হলো কেন আদি? জানো চিন্তায় আমার জান বের হয়ে যাচ্ছিল? তুমি কী জানোনা তোমাকে নিয়ে আমার সবসময় কতো চিন্তা হয়? তোমার কতো শত্রুরা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তারা একবার সুযোগ পেলেই তোমার ক্ষতি করে দিবে। আর ওই জিদান টা কই? আমার সামনে তো খুব ওয়াদা করে যায়।তা এই বুঝি তার নমুনা? কোথায় ও?
রেহনুমা ক্ষিপ্ত চোখে জিদানের দিকে তাকালো। জিদান আহত কন্ঠে বলল,
–হ্যাঁ ম্যাডাম ঠিকই বলেছেন। আমি আসলে স্যারের এসিস্ট্যান্ট হওয়ার যোগ্যই না। যেখানে একটা মেয়ের হাত থেকেই তাঁকে আমি বাঁচাতে পারলাম না। এই জীবন রেখে আর কী লাভ? আপনি বরং এখুনি আমাকে ছাঁদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিন। এই কলঙ্কের বোঝা আমি বয়ে বেড়াতে পারবোনা।
আহানা সোফায় বসে মোবাইল ঘাঁটছিল। তার মায়ের এসব ড্রামায় তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। তার ভাইয়ের প্রতি মায়ের এই শাবানা টাইপ মেলোড্রামা দেখে দেখে ফেডআপ সে। সাথে এই জিদান নামক আইটেম টা আরও সোনায় সোহাগা। যাকে বলে “একেতো নাচুনি বুড়ি,তার ওপর ঢোলের বাড়ি”। কোত্থেকে যে এই আলাদীনের বাতি পেয়েছে কে জানে? দুজন বোধহয় অসকার পাওয়ার আশায় চুড়ান্ত কম্পিটিশনে আছে। অসকার না পেলেও অসকার পরিস্কার করা ত্যানাটা নির্ঘাত ছুঁড়ে মারবে এদের দিকে। তবে হঠাৎ জিদানের মুখে কোনো মেয়ের কথা শুনে আহানার আগ্রহ ফিরলো। সে ফট করে উঠে এসে তীব্র কৌতুহলের সহিত বলল,
–মেয়ে? কীসের মেয়ে?কোন মেয়ে? কোনো হিরোইন নাকি? ওই সামাইরা নাকি? আর কী করেছে সে? শেষমেশ কী ভাইয়ার ইজ্জত ছিনিয়ে নিতে সফল হয়ে গেছে সে? কবে থেকে হিরোইন গুলো ভাইয়াকে ভোগ করার লা,ল,সা,র আগুনে জ্বলছিলো। তবে কী আজ সফল হয়ে সেই কাজে সফল হয়ে গেল ওরা? সব ডিটেইলস এ বলুন না জিদান ভাই।
আদিত্য আহানার কানে মোচড় দিয়ে বলল,
–একটা চড় মেরে মাথার সব ভাইরাস বের করে দিবো। এসব অসভ্য কথাবার্তা কোথাথেকে শিখেছিস তুই হ্যাঁ? বড়ো ভাইয়ের সম্বন্ধে এসব অশালীন কথা বলতে লজ্জা করে না তোর? ইডিয়ট।
আহানা ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বলল,
–আহহ, ভাইয়া লাগছে তো। ছাড়না, সরি আর বলবোনা।
রেহনুমাও ভ্রু কুঁচকে বললেন,
–কোন মেয়ের কথা বলছে জিদান?
–আরে মা, ওসব কিছুই না। তুমিও কার কথা কানে নিচ্ছো। আসলে রাস্তায় হঠাৎ করে গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাই আসতে দেরি হয়ে গেছে। আর কিছুই না। তুমি ছাড়ো তো। জিদান তুমি এখন বাসায় যাও। আর মা খাবার দাও। ক্ষুদায় পেটে ইদুর হাডুডু খেলছে।
জিদান প্রস্থান করলো। আদিত্যর কথায় রেহনুমা পুরোপুরি কনভিন্স হলোনা। তিনি খুবই চতুর। তাঁর চোখ ফাঁকি দেওয়া বড্ড কঠিন কাজ। তবে আপাতত আর বিষয় টাকে ঘাঁটলেন না উনি। ছবিকে দ্রুত ডিনার লাগাতে বললেন।
__
ডিনার শেষে লিভিং রুমের সোফায় এসে বসলো সবাই।আদিত্য মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
–মা, আদ্র কবে ফিরবে টুর থেকে?
–কালতো বলল, আরও দুদিন পর নাকি ফিরবে। তোরা দুই ভাই আমাকে শান্তি দিসনা। একজনের টেনশন কমলে আরেকজনের টা বেড়ে যায়।
–আরে মা টেনশনের কী আছে? বন্ধুদের সাথে টুরেই তো গেছে আদ্র। টুর শেষ হলেই চলে আসবে। তুমি অযথা চিন্তা করোনা নাতো।
আদিত্যর বাবা মাহমুদ সাহেব টিভি অন করে নিউজ দেখছিলেন। পানির পিপাসা অনুভব হওয়ায় তিনি কাজের লোক বাবলুকে ডাকলো। বাবলু যথারীতি তার অভ্যাসগত ভাবেই রোবটের মতো সোজা হয়ে ধীর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল মাহমুদের সামনে। মাহমুদ বললেন,
–বাবলু আমার জন্য একটু পানি আনতো।
বাবলু একইভাবে আবার চলে গেল। একটু পরে এক বালতি পানি নিয়ে ফিরে আসলো। মাহমুদের সামনে ধরে যন্ত্রমানবের ন্যায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সুর টেনে বলল,
–সাব, আপনার পানি।
মাহমুদ অবাক সুরে বললেন,
–কিরে তুই বালতিতে করে পানি নিয়ে আসছিস কেন? আমি কী বালতিতে করে পানি খাবো?
–সাব,আপনি তো বলেন নি পানি খাওয়ার জন্য চান।
–তো কী আমি এখানে গোসল করার জন্য চাইছি পানি?
— তা আমি কী করে বলবো সাব?
মাহমুদ দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
–এই তোর মাথায় গোবর পোরা আছে? স্টুপিট কোথাকার। যা আমার জন্য খাবার পানি নিয়ে আয়।
–কোথাথেকে আনবো স্যার?
— রান্নাঘর থেকে আন।
–কীসে করে আনবো?
–গ্লাসে করে আন।
–ঠান্ডা না গরম?
–ঠান্ডা।
–নরমাল ঠান্ডা না ডিপ ঠান্ডা?
বিরক্তিতে সারা শরীর কিড়মিড় করছে মাহমুদের। এক গ্লাস পানি চেয়ে যেন তিনি জীবনের সবচেয়ে বড়ো অপরাধ করে ফেলেছেন। এতক্ষণে তো মরুভূমির মানুষও পানির সন্ধান পেয়ে যেত। এমন একটা আইটেম কারোর বাসায় থাকলে তার আর শত্রুর দরকার হয়না।সেদিন এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়কে এভাবে জেরা করতে করতে একসময় হার্ট অ্যাটাক দিয়ে ছেড়েছে। সে এখনো আইসিইউতে ভর্তি আছে। নেহাৎ রেহনুমার বাপের বাড়ি থেকে এসেছে। নাহলে এটাকে কবেই কুচিকুচি করে কেটে রাস্তার কুকুর কে পেট পুরে খাইয়ে দিতাম। মাহমুদ ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–লাগবেনা তোর পানি। তুই যা আমার চোখের সামনে থেকে।
বাবলু একইভাবে বলে উঠলো।
–তাহলে এই পানির কী করবো।?
মাহমুদ রাগের বশে বলল,
–আমার মাথায় ঢাল।
অতঃপর বাবলু আজ্ঞাকারী বালকের মতো বালতি উঠিয়ে সব পানি মাহমুদের মাথায় ঢেলে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় মাহমুদ হতভম্ব হয়ে গেল। এতক্ষণ সবাই ঠোঁট টিপে হাসলেও এবার আর হাসির ফোয়ারা থামাতে পারলোনা কেউ। বাঁধ ভাঙা হাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। আর বাবলু আবারও রোবটের মতো হেঁটে চলে গেল। মাহমুদ রেহনুমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
–তুমি ইচ্ছা করে এই পাগলটাকে এনেছ তাইনা? যাতে আমাকে অশান্তি দিতে পারো। কোন জনমের বদলা নিচ্ছো আমার কাছ থেকে?
রেহনুমা তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন।
–তোমার কাছ থেকে কোনোরকম বদলা নেওয়ার জন্য আমি নিজেই পর্যাপ্ত আছি। আমার সারগেত লাগে না। তুমি জানোই ও একটু এমনই। তাহলে ওকে যা বলবে প্রথম বারেই একটু ক্লিয়ার করে বললেই তো হয়।
মাহমুদ রাগ গিলে নিলো । জানে বউয়ের সাথে লাগতে গেলে তারই দূর্গতি হবে।
___
আদিত্য গাড়িত বসে আছে। শুটিংয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে সে।পাশেই জিদান ডাইরি দেখে একের পর এক আদিত্যর আজকের সারাদিনের সিডিউল বলে যাচ্ছে।
–স্যার,আজ আপনার দুটো সিনেমার শুটিং আছে। তারপর আবার বিকেলে *******ভার্সিটিতে একটা ব্রান্ডের বিজ্ঞাপনের শুটিং আছে।
আদিত্য শুধু নিরব দর্শকের মতো শুনে যাচ্ছে। হঠাৎ জিদান বলল,
–স্যার, আজকে তো আপনার গাড়িটা ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা। তো ড্রাইভারকে কী বিকেলে পাঠিয়ে দিবো ওখানে গাড়ি নিতে?
আদিত্য ফট করে বলে উঠলো।
–না আমি যাবো।
জিদান একটু অবাক হয়ে বলল,
–স্যার,এই সামান্য কাজের জন্য আপনি কেন যাবেন?
ফট করে কথাটা বলে আদিত্য নিজেও একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। সত্যিই তো, সে কেন যাবে ওখানে? কেন বললাম আমি এই কথা? কেন মনে হলো এই উছিলায় মেয়েটাকে আরও একবার দেখতে পাবো? কী হবে দেখে? কেনই বা এই অবাঞ্ছিত চাহিদা জাগছে?গতকাল থেকেই ওই একটা মানবীর ভাবনা কেন মাথা থেকে কোনক্রমে যাচ্ছেই না? থেকে থেকেই মনে উঁকি দিচ্ছে ওই একটাই চেহারা। রোজ কতশত মেয়ের সাথে সাক্ষাৎ হয়। কই কখনো তো কারোর ভাবনা এভাবে অস্থির করেনি। এমনকি এতো সুন্দরী হিরোইনদের সাথে রোজ কাজ করে। তাদের কাউকে নিয়েও এমন কিছু কখনোই ঘটেনি। তবে কেন ওই মানবীর এক সাক্ষাতেই স্থির ভাবনা গুলো অবাধ্য হয়ে ছোটাছুটি করছে ? পাশ থেকে জিদানের কথায় ভাবনার যোজনের বিয়োজন ঘটে। জিদান বলে উঠলো।
–স্যার, ওই চরম অভদ্র মেয়েটার সামনে আপনার যাওয়ার কোনো দরকার নেই। কাল আপনাকে চোর বলেছিল। আজ আবার ডাকাত না বলে দেয়। মেয়ে তো নয় যেন কুমিরের সরদারনী। মনে হয় শিকার করার জন্য সবসময় নিজের ধারালো দাঁত গুলো বের করে ধাওয়া করতে আসে।
আদিত্য চোখ জোড়া কটমট করে তাকালো জিদানের পানে। অকারণেই তার রাগ হলো খুব। দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে বললো।
–শাট আপ। গাড়ি নিতে আমিই যাবো। আর এই নিয়ে দ্বিতীয় কোনো কথা যেন আমার কানে না আসে।
ঘাড় ঝাঁকিয়ে সোজা হয়ে বসলো জিদান। ওই মেয়েটার সামনে আবার পড়বে ভাবতেই হাঁটুর নিচে শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে।
__
শুটিং শেষ করে যথা সময়ে গ্যারেজে পৌঁছাল আদিত্য। মনের মাঝে কেমন অদ্ভুত পুলক কাজ করছে। হৃষ্ট মেজাজে গাড়ি থেকে নেমে গ্যারেজে ঢুকলো সে। তবে তার প্রফুল্ল মন মুহুর্তেই বিবর্ণ হয়ে গেল,যখন জানলো নূর গ্যারেজে নেই। পল্টু এসে গাড়ির চাবি দিয়ে গেল। আদিত্য ভাবলো একবার পল্টুর কাছে নূরের কথা জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু চেয়েও পারলোনা বলতে। কী বা বলবে? আর ছেলেটাই বা কী ভাববে ওর ব্যাপারে। দ্বিধাবোধ করে আদিত্য আর কিছু বলতে পারলোনা। চাবি হাত নিয়ে গ্যারেজে রেখে যাওয়া গাড়িটাই স্টার্ট দিয়ে বেড়িয়ে গেল।হুট করেই মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। বিষন্ন মন থেকে একটা কথাই বারবার ধ্বনিত হচ্ছে । তবে কী আর কখনো দেখা হবে না নূরের সাথে? চলতি পথে হঠাৎ দেখা ওই মানবীর সাথে আমার গল্পটা কী এতটুকুই ছিল?
বিষন্ন মনেই ****ভার্সিটিতে এসে পৌঁছাল আদিত্য। এখানে স্পোর্টস সু কোম্পানির একটা অ্যাডশুট আছে। সেই উদ্দেশ্যেই আসা। গাড়ি থেকে নামতেই হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রীর বিশাল ভীড় সুপারস্টার আদিত্যকে দেখার আশায় ছুটে আসতে লাগলো। গার্ডসরা অনেক কষ্টে ভীড় থেকে আদিত্যকে বাচিয়ে নিয়ে গেল। আদিত্য রেডি হওয়ার জন্য মেকআপ রুম কোথায় জানতে চাইলো। একজন স্টাফ হাতের ইশারায় মেকআপ রুম দেখিয়ে দিলো। আদিত্য এগিয়ে গেল সেদিকে। রুমের দরজা খুলে ভেতরে তাকাতেই থ হয়ে গেল সে। এমন কিছু দেখতে পাবে তা ইহকালেও ভাবেনি সে। আদিত্য হতভম্বের হয়ে নির্বিকার দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎই ভেতর থেকে ভূমিকম্প সৃষ্টি করা আর্তচিৎকার করে উঠলো কেউ।
চলবে………