#শেষ_চৈত্র [০৬]
নিজের পূর্ব বিয়ের প্রসঙ্গটা সামনে এলেই অমিত রেগে যায়। এই যেমন এখন তার আগুনচোখ দেখে মনে হচ্ছে মূহুর্তেই আমাকে ভস্ম করে দিবে। তবুও সত্য স্বীকার করবেনা!
আচ্ছা উনি পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলতেও তো পারে তাইনা? শুধু শুধু খারাপ আচরণ করতে থাকে কেন? কেন উনি এতটা অস্বাভাবিক?
তবে আজকের এই ঘটনার পরে কীভাবে অমিত সুমনাকে অস্বীকার করবে,জানিনা।
শুধু আমাকে একটা বিষয় খুব ভাবাচ্ছে, সেটা হলো উনি কি কখনো সুমনা নামক মহিলার উপর নিজের এমন খারাপ আচরণ দেখায়নি? তবুও এখানে আসার মতো দুঃসাহস করলো কি করে? সুমনা এসেই বা অমিতের সামনে দাঁড়াবে কীভাবে? সেই পরিমাণ সাহস কোথায় পাবে সে? অমিতই বা কেন ওই বিয়ের নাম শুনলে রেগে যায়?
এদিকে অমিত আমার মুখে সুমনার আসার কথা শুনে রাগের শেষ চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়েছে, সাথে সাথে রুমে এসে খপ করে নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে বললো,
‘ এতো সাহস তোমার? আমার মোবাইলের কল রিসিভ করো!
আমি মুখ ঘুরিয়ে উনার দিকে ফিরে বললাম,
‘ হুম করছি তো?! কইছি দুজন একলগে মিলমিশে এক স্বামীর সংসার করুম! একদম বইনের লাহান গলায় গলায় ভাব লইয়া চলুম।
আমার শুনে অমিতের নাক রাগে ফুলে উঠলো। চোখের সাদা অংশ অদ্ভুতরকম লাল হয়ে গেছে সাথে সাথে। উনি নিজের হাতে থাকাটা মোবাইলটা তীব্র রাগের সাথে মেঝেতে শক্তভাবে নিক্ষেপ করলো। এটা সাথে সাথে ভেঙে গুড়ো হলো। তারপর ড্রেসিংয়ের উপর থেকে মাটির টবটা তুলে আয়নায় জোরসে ছুড়ে মারলো।
আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম, ভেতরটা ভয়ংকরভাবে কেঁপে ওঠলো। তবে যা ভেবেছিলাম তা হয়নি। আয়নার মাঝ বরাবর ফেটে গেলেও ভেঙে পড়েনি! কিন্তু উনি এটা কি করে বসলো? একটাবার কি ভাবা উচিত ছিল না আয়নাটা তার নয়! নিজের মোবাইল ভাঙছে ভালো কথা, আরেকজনের জিনিস কেন ভাঙবে?
আমার সারা শরীর কম্পনে বেগতিক হয়ে উঠছে। আর উনি এটা ভেঙেও বিছানায় বসে রাগে ফুঁসছে। পারলে হয়তো আমাকেই ছুড়ে মারতো। কিন্তু সেই জেদটা অন্যভাবে দেখিয়েছে। আমি চোখের পানি মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। এখানে থাকলে আরো কি কি জানি ভেঙে ফেলে! তাই তাড়াতাড়ি এই বাড়ি ছাড়তে হবে। আম্মার রুমের দিকে গেলাম।
আম্মার কাছে গিয়ে কান্না আড়াল করার চেষ্টায় বললাম,
‘ আম্মা আমরা যামুগা এহন। আর ওই রুমের আয়নাডা ভাইঙা গেছে। ভুল কইরা আমার হাত ছিটকা ফুলের ভারী টবটা যে ওটা আয়নাত ধাক্কা খায়ছিলো। তাই অনেকটা ফাইটা গেছে। মন খারাপ কইরোনা এইডার লাইজ্ঞা, আয়নাডা আব্বারে বইলা বদলাইয়া ফেইল্লো।
আম্মা আমার চোখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। আমি বুঝতে পারছিলাম অজুহাতটা আম্মার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নি। হবেই বা কি করে? টব ছিঁটকে আয়নায় পড়ে কিভাবে? আমি গুছিয়ে মিথ্যাটাও বলতে পারিনা। তবে আম্মা কোনো প্রকার শব্দ করলোনা। উনিও তো জানে কেমন মানুষের কাছে মেয়েকে তুলে দিয়েছেন! মুখ ভার করে বললো,
‘ আইচ্ছা যা। সাবধানে চলিস। বুইঝা থাহিস।
আমি গিয়ে ব্যাগ হাতে তুলে নিলাম। অমিতও বড় ব্যাগটা হাতে নিলো। তারপর দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আম্মা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, আম্মাকে অমিত বলে বের হয়নি। তবুও আম্মা নিজে থেকে বললো,
‘ বাজান মাইয়াডা ছোটো তো, অন্যায় করলে বুঝাইয়েন। ভালা থাইকেন,আবার তাড়াতাড়ি আইয়েন।
অমিত আম্মার দিকে ফিরে শুধু মাথা নাড়লো একটু। এরপর আমাকে ফেলেই সামনে হাঁটতে লাগলো। আব্বা ক্ষেতের কাজে গেছে ভালোই হয়েছে, নাহলে আম্মার সাথে আব্বাও আমার যাত্রাকালে আবার আমার বরের রুক্ষ ব্যবহারটা দেখতো।
‘
উনার সাথে একদম কথা বলবোনা বলে সিদ্ধান্ত নিলাম! শুধুমাত্র ফোন রিসিভ করায় আমার গরীব বাবার কেনা আয়নাটা ভেঙে দিলো? নিজের মোবাইলটাও ভেঙে ফেললো? সেটা বাদ দিলাম,কিন্তু এতটুকু সেন্স ছিল না? কতো কষ্টের টাকায় বাবা এটা আমাদের জন্য কিনেছিলো! যখন ঘরে ফিরে দেখবে, না জানি বাবার বুকটা কি ভয়ংকরভাবে জ্বলে উঠবে। সামান্য আয়নার জন্য না হোক,আমার কথা ভেবে হলেও যন্ত্রণা অনূভব করবেন।
এদিকে বাড়িতে গিয়েই চিৎকার করে অমিত বললো,
‘ আম্মা বাইরে আসো। রফিক কিছু বলছে তোমারে?
আমার শাশুড়ী অবাক চোখে বললো,
‘ নাতো কিতা কইবো?
অমিত ব্যাগটা নিচে ধপাস করে ফেলে দিয়ে বললো,
‘ ডেকে আনো রফিককে। ফোনের ওপাশে কে কথা বলে সেটা না শুনেই কেন তড়তড়ি করে সব কথা বলে, সেটার শিক্ষা দিতে চাই! আনো ওরে যাও। যাওওও আম্মা!
আমার শাশুড়ী অমিতের ধমকে আড় চোখে তাকাতে তাকাতে রফিকদের ঘরের দিকে যেতে থাকলো। আমি বিরবির করে উচ্চারণ করলাম,
‘ সত্য কি গোপন রাখন যায়?
অমিত আমার দিকে তাকিয়ে জোরে কিছু বলতে গিয়েও কেন জানি থেমে গেলো! সরাসরি আমার উপর রাগ দেখায় না। এখনো দেখায়নি। শুধু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব মিটিয়ে নেয়। আচ্ছা আমি উনার কাছে কি এমন বাধ্যতার? সরাসরি কিছু বলে না কেন? এমন চরিত্রের মানুষ এইটুকু বিরক্তিকর ভালো মানুষী ধরে রেখে আর কি করবে?।
অন্যদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা নিচু করে রফিক এসে দাঁড়ালো। অমিত নিজের কোমরে হাত দিয়ে বললো,
‘ কি সমস্যা তোর হা?
রফিক মাথা তুলে বললো,
‘ আমার পেছনে দেখুন!
অমিত তাকালো, সাথে আমিও পেছনে তাকালাম। দেখলাম আঁটসাঁট পোশাকে আবৃত একজন সুন্দরী মহিলা হনহন করে এগিয়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু আমার শাশুড়ী বাঁধা দিচ্ছে। কিন্তু তার সাথে পেরে উঠছেনা।
অমিত চোখ নিচু করলো।
হয়তো কি বলবে ভাবতেছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে। অসম্ভব সুন্দর মেয়েটা,সেই কি তাহলে সুমনা? মেয়েটা আমার কাছাকাছি এসেই বললো,
‘ এই মুখ খোল তুই, আমি দেখতে চাই তুই কেমন সুন্দর! যার জন্য অমিত আমার শেষ কথাটাও শুনলোনা!
বলেই আমার হিজাব টেনে খুলে ফেললো।
এটা দেখে অমিত চোখ তুলে এক পা এগিয়ে বললো,
‘ যা কথা বলার আমার সাথে বলুন, আমার স্ত্রীর দিকে হাত বাড়ালে আপনাকে আমি এখানেই পুঁতে ফেলবো!
সুমনা হাসির তোড়ে বললো,
‘ জিডি করে আসছি। আমার কিছু হলেই তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠী জেলে পঁচে মরবে।
অমিত আরেক পা এগিয়ে বললো,
‘ আপনার কোনো প্রকার ভয় আমাকে আগেও কাবু করতে পারেনি, এখনো পারবেনা! ফিরে যান ভালোই ভালোই।
আমি অবাক হয়ে দেখছি অমিতের বদল রূপ। কতো সুন্দর করে বুঝিয়ে কথা বলছে! তাও আপনি সম্বোধনে!
কিন্তু মেয়েটা হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো,
‘ এই মেয়েকে কেন বিয়ে করলে? তোমার হাঁটুর সমান একটা মেয়ে! কিসে কম ছিলাম আমি?
ওকে তো পিষে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
বলেই সুমনা আমার দিকে হাত বাড়াতে চাইলো। কিন্তু তার আগেই অমিত সুমনার হাত ধরে ফেললো। আর তার রাগটাকে কোনো রকম দাঁত খিঁচিয়ে আটকানোর চেষ্টায় বললো,
‘ সুমনা ম্যাম! আপনি কেন ভুলে যান ওটা কোনো বিয়ে ছিল না। শুধুই একটা চুক্তিতে সাক্ষর ছিল। আপনিও তো মানেননি সেই বিয়ে। তাহলে পরবর্তীতে কেন অধিকার চান? এখন আমার বিয়ের পরেই কেন আসলেন? যেখানে আপনার কোনো স্থান নেই! সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছি না আমি? আপনি থাকছেন না কেন? আর আমার স্ত্রীকে দ্বিতীয়বার তুই বলার সাহস করবেন না। তাকে আমি ভালোবাসি! তাই তাকে কোনোভাবে আঘাত করলে আপনাকে আমার আসল রূপটা দেখাবো, যা আপনি ছাড়া সবাই দেখেছে!
আমি হাঁ করে শুধু শুনছি। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।
চলবে……
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার