শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব ৯

0
1571

#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_৯

সে রাতে স্মরণের সিংহভাগ প্রহরই কাটলো আমার ঘরে। অবশ্য রাত গভীর হওয়ার পথে সে চেষ্টা করেছিলো ছোঁয়াকে নিয়ে তার ঘরে যাওয়ার। কিন্তু সে চেষ্টা নিতান্তই ব্যার্থ হয়। ছোঁয়া গাঢ় জেদ নিয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে বলেছিল সে যাবে না। আমিও আশ্বাস দিয়ে বললাম

— আমার অসুবিধা হচ্ছে না। ও থাক।

স্মরণ আর কিছু বলেনি। অনেকটা সময় মেয়ের যত্ন নেয়। ক্ষণে ক্ষণে কপাল স্পর্শ করে জ্বর অনুভব করে। এরমাঝে ছোঁয়া একবার বমি করলো। এতে করে স্মরণের চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ প্রগাঢ় হয়ে গেলো। আমি তেমন কিছুই করতে পারলাম না। ছেঁকা খাওয়া হাত পা নিয়ে শুধু বিছানায় বসে দেখে গেলাম। তারপর হঠাৎ গুটিসুটি হয়ে বিছানায় শুয়ে পরার পর হাতের তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতে করতে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম। অজান্তেই ঘুম। সেই ঘুমের পর চোখ মেলেছি ভোর ছয়টায়। পাশে ছোঁয়া শুয়ে ছিলো। তার ওপাশে দৃষ্টি রেখে দেখেছিলাম চেয়ারটা শূন্য। স্মরণ কখন এঘর ছেড়েছে তা আমার অজানা।

দিনটা শুরু হলো আমার টুকটাক কর্মব্যস্ততা নিয়ে। হাতের আঙ্গুল আর ডান পায়ের বা দিকটা ফুলে ফেঁপে উঠেছে সাধ্য মতো। লম্বাটে তাদের আকার। রান্নাঘরে যাওয়ার পূর্বে কিছুসময় তাদের পরখ করলাম। যতদূর মনে পরে জীবনে তৃতীয় বারের মতো ফোসকা পরলো হাতে। একবার খুব ছোট বেলাতে মোমবাতি নিয়ে খেলার কালে আর একবার ছোট বাবা কে চা বানিয়ে দেওয়ার কালে। কিশোরী তখন আমি প্রথম চা বানাতে যাই। চাচি আম্মার হুকুম পেয়ে। খুব একটা রান্নার অভ্যাস আমার নেই। যদিও উঠতি বয়সে মা-বাবা ছাড়া জীবন যাপন তবুও কাজ কর্মের অত্যাচার ছিলো না আমার ওপর। শুধু ছিলো টাকা আর জিনিসের অভাব। কিছু শখ পূরণ না হওয়ার দুঃখ। কিছু আল্লাদ চেপে রাখার কষ্ট। শহরে বেড়ে উঠলেও মা বাবার মতো করে আর কেউ খুব যত্নে রাখেনি। একটা মাত্র মামা তো তার বাসা থেকে দূরই করে দিলো। পরিশেষে ছোট বাবা নিজে দায়িত্ব নিলেন। এর বিপরীতে চাচি আম্মা ক্ষুব্ধ হয়ে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিল। ছোট বাবার সাথে তার কথার বিরতি হয়েছিল টানা দু’দিনের।

.
রান্নার কাজ করার ইচ্ছে পোষণ করলেও খালা বাঁধা দিলেন। আমি খুব বেশি জোরাজুরি করার সাহস করে উঠতে পারলাম না। অসুস্থতাকে বড্ড ভয় পাই। যেমন কাকে নিষ্কর্মা আমি। তেমনই ভয়ে ভীতু। মা বলতো আমি নাকি ননির পুতুল। সামান্য কিছুতেও অসামান্য রকমের রুগী হয়ে যাই। নিতে গেলাম বাবার খোঁজ। উনি হুইল চেয়ারে বসে বন্ধ চোখে ছিলেন। আমি যেতেই চোখের পল্লবদ্বয় উন্মুক্ত করে বললেন হঠাৎ

— অনেক দিন হলো এভাবে বসে বসে। হাঁটার ইচ্ছে করে খেয়া।

মনটা আকুপাকু করে উঠলো আমার। বাবার নিকটে গিয়ে বললাম

— দেড় মাস তো হয়ে গেছে বাবা। আপনি একটু চেষ্টা করুন। হাটাতে পারবেন ইনশাআল্লাহ। এমন অবস্থা থেকে কিন্তু অনেকেই বেরিয়ে আসতে পারে।

— বলছিস?

আমা মাথা দুলিয়ে সাহস দিতে চাইলাম। স্মরণ আর আমার বিয়ের আনুমানিক বিশ দিন আগে বাবার স্ট্রোক হয়েছিল। অতঃপর বাম পা প্যারাইসিস রোগী তিনি।

— ফিজিওথেরাপি দেওয়া শুরু করবেন বাবা?

— হ্যা। দেখি কি হয়।

— আল্লাহ ভরসা।

বাবা আমার প্রতিত্তোরে নীরব হাসি দিলেন।

— অঙ্কনের সাথে কথা বলে ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে যেতে হবে।

বাবা আরো কিছু এমন কথা বললেন। আমি শুনে গেলাম। বাবা হঠাৎ আবেগ প্রবণ হয়ে মায়ের একটা ছবি দেখালেন আমাকে। প্রথমে ছোট একটা বাক্স খুলতে বললেন আমাকে৷ তার মাঝে যত্নে রাখা একটা ছবি। ভীষণ রূপসী একজন নারী সম্মোহনী দৃষ্টিতে যেন তাকিয়ে আছে ক্যামেরার পানে। চেয়ারে বসে ঈষৎ ঝুঁকে এসে থুতনিতে হাত রেখেছেন। নাক, চোখ, কপাল, ভ্রু স্পষ্ট বলে দেয় তিনি স্মরণের জন্মদাত্রী জননী। অনেকটা মায়েরই মতো দেখতে হয়েছে স্মরণ।

— বাবা ছোঁয়ার মা দেখতে কেমন ছিল?

বুকে অস্তিত্ব চেপে রেখে কোতুহলটা প্রকাশ করেই বসলাম আজ। স্মরণের পিছু নেওয়ার পর দিন হতেই এই কৌতুহল মনে ওত পেতে আছে।

— কে অথৈ? অথৈয়ের ছবি তো আমার কাছে নেই। স্মরণ সব ছবি সরিয়ে ফেলেছে।

— ওনাদের বিয়ে কি আপনাদের জানাজানিতে হয়েছে?

— না। স্মরণ পালিয়ে বিয়ে করেছে। অথৈয়ের সাথে ওর খালাতো ভাইয়ের বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল। ওইদিন কাবিন করে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু স্মরণ পালিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। অথৈয়ের মা বাবা মেনে নেয়নি বিয়ে। এমনকি ছোঁয়া জন্ম নেওয়ার পরও না। শেষ মুহূর্তে যখন মেনে নিলো তখন…. অথৈ…

বাবা স্তব্ধ হলেন। মলিন হয়ে উঠলো তার চোখ মুখ। আমি আমার বুকে আফসোসের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম। তার কিছুসময় পর খুঁজে পেলাম এক ঝাঁক প্রশ্ন। বাবাকে প্রশ্ন করার ইচ্ছে হলো, ‘কে বা কারা অথৈকে মে*রে*ছে? সত্যিই কি অথৈ খু*ন হয়েছে?’
প্রশ্নগুলো মনে উদয় হলেও বলা হলো না। শুধু শেষ বারের জন্য বললাম

— উনি কতদিন আগে মারা গেছে?

বাবা বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন

— তিন মাস হবে।

আমি আঁতকে উঠলাম। খুবই নিকটবর্তী সময়। ছোঁয়া কিভাবে তার ছোট হৃদয় সামলে রেখেছিল?

.
.
আমি বলি বেলা যেন বড্ড কৃপণ। একটুও হেরফের করে না হিসাবের। কিন্তু দুঃখ গুলো? বড্ড বেশিই মায়া দেখায়। তাই তো থেকে যেতে চায় আরো বেশি। আমার বাম হাতের ফোসকা ঠিক হওয়ার পথে। পয়ের ফোসকা কমজুরির হওয়ায় সেও নিলীন হওয়ার পথ খুঁজছে। মাঝ থেকে আমার মায়ায় পরেছে ডান হাতের ফোসকাটা। সে যেন যেতেই চায় না আমাকে ছেড়া। দিন কাটলো তিনটা। সে এখনো আগেরই মতো তরতাজা। খাওয়া দাওয়া চালাচ্ছি চামচের সহায়তায়। ছোঁয়ার অবস্থা বেশ ভালো। সে জ্বর কাটিয়ে এখন ফুরফুরে। স্কুলে যাওয়া শুরু করলো আজ থেকে। এরমাঝে একদিন অঙ্কন এসেছিল। আমার হাতের পরিস্থিতি দেখে সে যেন একটু বেশিই আফসোসে পরেছে। নতুন আরেকটা মলম দিয়েছে। কিছু নিয়ম কানুন বারংবার বলে মুখস্থ করিয়ে দিয়ে গেছে। বাবার চিকিৎসা নিয়েও আলাপ করে গেছে। আবার দু’দিন পর তার আসার কথা।

— ছোঁয়া, জলদি। দেরি হয়ে যাচ্ছে বাবা। আমি অফিস যাবো তো।

খাওয়ার টেবিলে স্মরণের তাড়া। ছোঁয়া তার বাবার কথাতে যেন একটু বিরক্ত হলো। বলল

— ইশ বাবা! এতো জলদি খাওয়া যায়? আমার ক্লাস তো আজ ন’টা থেকে। মাত্র আটটা। তুমি চলে যাও। আমি মায়ের সাথে যাবো।

মুখে মাংসের টুকরো ছিলো। ছোঁয়ার উক্তিতে আচমকা অবাকে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হলাম। আড় চোখে স্মরণের পানে তাকাতেই আকস্মিক চোখাচোখি। আমি দ্রুত চোখ নামিয়ে অস্তিত্বে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছি। ছোঁয়া হঠাৎ মা বলায় খাবার টেবিলে বাবাও যেন খানিকটা অবাক। স্মরণ তাৎক্ষণিক কোনো কথা যেন মুখে আনতে পারলো না। বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেলে গম্ভীর কন্ঠে বলল

— ড্রাইভার কে রেখে গেলাম। সময় মতো স্কুলে পৌঁছে যেও।

বলেই সে দ্রুত পায়ে চলতে শুরু করলো। আমি নব ভাবনার জন্ম দিলাম। তাকে নিয়ে একবার মন্তব্য করলাম, হয়তো মেয়ের সুবিধার জন্য এমন করে নির্বাকে ছেড়ে দিলো। নয়তো সে পরিস্থিতি মেনে নিচ্ছে। মেনে নিচ্ছে কথাটা মনের মাঝে আবেগের ঢেউ তুলল। সে।কি সত্যিই মেনে নিচ্ছে? মনটা কিছু সময়ের জন্য আশার আলো দেখলেও হঠাৎ করে সে আলো নিভে গেলো।পরবর্তী ভাবনার দরুন। মেনে নিলেও কি আমি থেকে যাবো? ভালো তো বাসবে না। শুধু হয়তো স্বার্থের জন্য রেখে দেবে। মেয়ের জন্য। কিন্তু স্বার্থ দিয়ে যে সম্পর্কের আয়ু বাড়ানো যায় না একথা কি সে ভাববে না?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here