#শেষ_বিকেলের_মায়া (৭)
ফারিহা মায়ের দিকে তাকিয়ে বড়ো অধৈর্য হয়ে পড়ল। আজ দু বার র ক্ত বমি হয়েছে তার। সে কান্না করতে করতে এল মরজিনা খালার কাছে। ভদ্র মহিলা রান্নায় ব্যস্ত ছিলেন। আদীব এসে দেখল কাঁদছে ফারিহা।
“কি হয়েছে? কাঁদছ কেন?”
“আদীব ভাইয়া। মা আজ দু বার র ক্ত বমি করেছে।”
“আগে জানাও নি কেন? হায় আল্লাহ। মা নিচে আসো তো।”
মরজিনার জন্য অপেক্ষা না করেই নিচে ছুটে এল আদীব। মেঝে তে র ক্তে র বন্যা হয়ে গেছে। খাটের উপর অর্ধ মৃ ত ফাহিমা। আদীব কাছে এসে ডাকল।
“খালা, খালা কথা বলুন খালা।”
ভদ্রমহিলা কথা বলতে পারলেন না। দরজার কাছ থেকেই আর্তনাদ করে উঠল ফারিহা।
“মা, মা গো কি হলো তোমার। ও মা, মা গো।”
তীব্র যন্ত্রণায় ফারিহা যেন জ্ঞান হারাবে। আদীব কি বলবে বুঝতে পারছে না। মরজিনা এসে দাঁড়িয়েছে।
“হায় আল্লাহ। এখনি হসপিটালে নিতে হবে। আদীব গাড়ি আন।”
আদীব অ্যাম্বুলেন্সে কল করল। ফারিহা আজ ভীষণ ভে ঙে পড়েছে। মায়ের এমন করুণ দশা ও আর নিতে পারছে না। কিছু সময় পর অ্যাম্বুলেন্স এল। ফাহিমাকে কোলে তুলে নিল আদীব। তারপর বড়ো রাস্তায় নিয়ে এল। ফারিহা পেছন পেছন আসছে। কোথায় তার ওড়না কোথায় তার জামাকাপড়। ভীষণ অগোছালো সব। ফাহিমাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে আদীব বলল,”শান্ত হও। খালা ঠিক হয়ে যাবে।”
মেয়েটি পারল না শান্ত হতে। আজকের মতো ভয়াবহ অবস্থা এর আগে হয় নি। নিজের মায়ের মৃ ত্যু র প্রহর গুনছে যেন। গাড়িতে স্থির হয়ে বসে রইল ফারিহা। তাকে জড়িয়ে রেখেছে মরজিনা। আদীবের বুকের ভেতরটা ভারী ঠেকল। ফারিহার প্রতি তার বিশেষ মায়া রয়েছে। মেয়েটির কষ্টে ভীষণ রকমের কষ্ট হয় তার।
হসপিটালের আরেক নাম টাকা। টাকা ছাড়া চিকিৎসা সম্ভব না। ফারিহার কাছে যা ছিল তা দিয়ে এডমিট করানো হলো। তবে আরো টাকার প্রয়োজন। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার রিহানকে কল করেছে। তবে কল রিসিভ হয় নি। রিক্ত হয়ে এল মেয়েটির দুটি চোখ। চার পাশে কেবল আর্তনাদ। প্রায় ঘন্টা খানেক চেষ্টার পর রিহান কল রিসিভ করল।
“হোয়াটস ইউর প্রবলেম ফারিহা? দেখছ কল রিসিভ করছি না। তারপর ও কল করে যাচ্ছ।”
রিহান প্রচন্ড রেগে আছে। সে কিয়ার সাথে কথা বলছিল। এই নাটকটা করার ইচ্ছে নেই তার। কিন্তু কিয়া যেন পুরোই বদলে যাচ্ছে। নিজের ক্যারিয়ারে কথা তুলছে। অথচ বিষয়টা যদি জানানো হত তবে নিশ্চয়ই ওর পরিবার মেনে নিত। তবে কিয়া নারাজ। সে এই বিষয়টা জানাতে চায় না। কল রাখতে যাবে ওমন সময় ফারিহার কান্না ভেসে এল। নরম হলো রিহান। সে ভাবল তার কথায় বোধহয় মেয়েটি কষ্ট পেয়েছে।
“সরি। আমার আসলে রিয়েক্ট করা ঠিক হয় নি। বল কিসের জন্য এতবার কল করলে।”
“রিহান স্যার। আমার মা….”
“হ্যাঁ। বল তারপর?”
“আমার মা বোধহয় আর বাঁচবে না। রিহান স্যার আমার মা হারিয়ে যাচ্ছে। আমি পারছি না বাঁচাতে।”
“ফারিহা। শান্ত হও। বলো কোথায় আছ?”
ফারিহা কেমন করে ঠিকানা টা বলল জানা নেই। কথা শেষেই মা মা আর্তনাদ করে উঠল। এতটা ব্যগ্র হলো যে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল তখুনি।
দুটো দিন ফারিহার পাগলামি চলল। সে কি করছে বলছে জানে না। শুধু মাত্র মায়ের জন্য তার এত চিন্তা। আশ্চর্যজনক ভাবে রিহান নিজেও হসপিটালে অবস্থান করছে দুদিন। কেন কোন দায় বদ্ধতা থেকে করল জানা নেই। বাসা থেকে কয়েকবার কল এসেছে। প্রতিবার ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছে সে। আদীব সকালের নাস্তা নিয়ে এসেছে। রিহান সম্পর্কে তার ধারণা নেই। সে স্বাভাবিক ভাবেই খাবার অফার করল। সেটা নাকোচ করে দিল গম্ভীর পুরুষটি। তার স্ট্যাটাস আসলে এখানে না সেটা খুব ভালোই বুঝল আদীব। এতে অবশ্য তার কিছু হলো না। সে বরং হেসে বলল,”আশে পাশে ভালো রেস্টুরেন্ট বলতে যেটা চিনি সেটা থেকেই খাবার এনেছি। আপনি সম্ভবত এখান থেকেই গতদিন ডিনার করেছিলেন।”
রিহানের ধ্যান ফিরল। সে পুরোপুরি নজর দিল আদীবের দিকে। দুজনের বয়স সমান ই হবে।
“কি বললেন?”
“আপনি এই রেস্টুরেন্টের খাবার ই খেয়েছেন গত রাতে। আশা করি অসুবিধা হবে না।”
চমৎকার বাক্য দুটি শেষ করেই চলে গেল আদীব। পড়ে রইল খাবারে প্যাকেটটা। কিছু লজ্জা, অপমান নাকি অস্বস্তি সেটা জানে না রিহান। শুধু মনে হলো ছেলেটা বড়ো বুঝে শুনে জবাব দিয়েছে। রিহানের বুকের ভেতর থেকে নিশ্বাস পড়ল। সে মানুষ কে মানুষ হিসেবেই দেখে। এমন না টাকা পয়সা কম থাকা মানুষ গুলোকে সে ঘৃণা করে। তবে চলন বলনের ভিন্নতাও অস্বীকার করার মতো না। সে যে পরিবেশে বড়ো হয়েছে সে পরিবেশ থেকে সহজেই যে কারো সাথে মেশা যায় না। আদীব খাবার সাজাচ্ছে। খানিক টা শান্ত হয়েছে ফারিহা। শুনেছে মা সুস্থ এখন। এই জন্যেই কী না স্থির সে।
“খালা ঠিক আছে। এবার তো খাবার খাও।”
ফারিহা কথা বলছে না। ভদ্র বাচ্চাটির মতো চুপ করে আছে। কিছুটা এগিয়ে এল আদীব।
“ফারিহা, কি হলো?”
“হুম?”
“হা করো।”
ফারিহা হা করতেই যাচ্ছিল। ওমন সময় দেখা গেল রিহানকে। হাতে ফোন। সেখানেই ব্যস্ত।
“রিহান স্যার।”
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আদীব। রিহান থমকে দাঁড়িয়ে। ফারিহা বেড থেকে নামতে চাচ্ছে। রিহান হাত নাড়িয়ে নিষেধ করল।
“রিহান স্যার। আপনি, আপনি কখন এসেছেন?”
বড়ো হাসি পেল রিহানের। দুদিন ধরে হসপিটাল পড়ে আছে সে। তবে বিষয়টা না ঘাটিয়ে বলল,”সত্তর হাজার টাকা পেমেন্ট করে দিয়েছি। বিকেলে ডিসচার্জ দিয়ে দিবে।”
কথা শেষে ন্যানো সেকেন্ড ও দাঁড়াল না রিহান। ফারিহা কথা বলতে পারল না। শুধু দেখল গম্ভীর মুখশ্রীর পুরুষটি এগিয়ে চলেছে।
ফাহিমাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় হুট করেই প্রশ্নটা করে ফেলল আদীব।
“লোকটা কে ফারিহা?”
ফারিহা ভীত নয়নে তাকায়। ফাহিমা একটু বিস্মিত হয়ে বলল,”কোন লোক?”
“যে সকল খরচ দিল খালা।”
ফারিহা চট করেই বলে উঠল।
“আমার স্যার। আমি ওনার অফিসে জব করি।”
“এত গুলো টাকা…”
“আমি আসলে লোন নিয়েছি আদীব ভাইয়া। স্যার খুব ভালো মানুষ।”
“ও। সহসা এমন ভাবে কাউ কে টাকা দিতে তো দেখি নি।”
“ওনি ভালো মানুষ।”
“ভালো হলেই ভালো।”
“হুম।”
অস্বস্তির মধ্যে পড়ল ফারিহা। সামনেটা অনিশ্চিত। কে জানে কি হবে। সে ভেবে কুল পায় না। আসলেই কি ঠিক হচ্ছে সব? মায়ের জান বাঁচাবে নাকি নিজের মান বাঁচাবে? এই দ্বিধার বিপরীতে সত্যিই কোনো উত্তর নেই। যা আছে তা হাহাকার। এক দুঃখিনী মেয়ের আর্তনাদ। যে নিজের মায়ের জীবনের বিপরীতে কলঙ্কিত করছে নিজের সবটুকু।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
|