#শেষ_বিকেলের_মায়া (২২)
অতীত
ফারিহাকে এয়ারপোর্টে পৌছে দিয়ে বাড়ি ফিরল রিহান। ছেলেকে দেখতে পেয়ে রুনা প্রায় ছুটে এলেন।
“রিহান, কোথায় ছিলে তুমি? ফারিহা কোথায়?”
“চলে গেছে মম।”
“চলে গেছে মানে?”
“সিঙ্গাপুর গিয়েছে,মায়ের কাছে।”
“মানে? কি বলছো এসব?”
রিহান কথা না বলে গায়ে থাকা ব্লেজার খুলে ফেলল। রুনা ছেলেকে চিনতে পারছেন না। সে ভোর বেলাতেই স্বামীকে খবর দিয়েছেন। বেশ কিছু সময় পর ভদ্রলোক ও বাড়িতে প্রবেশ করলেন। রুনার শরীর কাঁপছে।
“দেখ,রিহান কি বলছে এসব।”
ইরফান ছেলের কাছে এলেন। রিহান চুপ করে আছে।
“রিহান, কি হয়েছে বেটা? তুমি এমন করে আছ কেন?”
রিহান কিছুই বলছে না। রুনা কেঁদে চলেছেন।
“আমরা প্রতারিত হয়েছি। তোমার ছেলে বলল ফারিহা নাকি সিঙ্গাপুর গিয়েছে,তার মায়ের কাছে।”
স্ত্রীর মুখের বাক্যটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো ভদ্রলোকের। ছেলের দিকে দৃষ্টি ফেললেন তিনি।
“ড্যাড,আমি ফারিহাকে নয় কিয়াকে ভালোবাসি। যার সাথে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক।”
কথা গুলো ব্যক্ত হতেই ধা ক্কা লাগল ইরফানের বুকে। একে একে সমস্তটা ব্যক্ত হলো। কিয়া মেয়েটির র হ স্য তখনো বুঝল না কেউ। রিহান নিজের মাথার চুল গুলো টেনে ধরে বলল,”আমি কানাডা যাচ্ছি। সন্ধ্যায় ফ্লাইট।”
তারপরের ঘটনা গুলো খুব দ্রুত ঘটল। কিয়াকে না জানিয়েই কানাডায় গেল রিহান। সেখানে গিয়ে যা দেখল তা ওর প্রেমিক সত্ত্বাকে নাড়িয়ে তুলল। সফেদ রঙা বিছানায় উন্মুক্ত তার প্রেমিকা। আর দে হে মেতে থাকা আরেকটি পুরুষ। সবটা তখন রিহানকে দুমড়ে মুচড়ে ভে ঙে দিল। পুরুষটি বিদেশী এবং কিয়া যে অফিসে কর্মরত সে অফিসের বস। নিজের ভেতর লালন করা সমস্ত ভালোবাসা তখন আ ক্রো শে পরিণত হয়েছে। রিহান সজোরে থা প্প ড় বসিয়ে দেয়। ছিটকে প ড়ে কিয়া।
“কথা বলিস না প্লিজ। আর কিছু দেখতে চাই না।”
কিয়ার দু চোখে জল। সে দ্রুত চাদর টেনে নেয়। আকুতি করে। রিহানের পা জড়িয়ে বসে।
“মাফ কর, মাফ কর আমায়। রিহান আমি তোমায় ভালোবাসি। সত্যিই ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। রিহান, মাফ কর প্লিজ।”
আ র্ত নাদে কিয়ার শরীর কাঁপছে। ওর বুক চিরে বের হচ্ছে হাহাকার। চোখের সামনে ভালোবাসা হারিয়ে ফেলাটা সে সহ্য করতে পারছে না। রিহান তাকে ক্ষমা করে নি। এমন দৃশ্য দেখার পর সত্যিই ক্ষমা করতে পারে নি। অথচ মেয়েটাকে নিজের জীবন দিয়ে ভালোবাসে ও।
তারপরের দিন গুলো আরো বেশি দুঃখের হলো। কিয়ার থেকে প্রতারিত হয়ে রিহান যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলল। কষ্ট লুকাতে এমন কোনো নে শা নেই যা সে গ্রহণ করল না। অথচ তার ভেতরের আ র্ত নাদ গুলো কমল না। কিয়া সহস্রবার এল। কত ঘটনা বলার প্রয়াস করল। তবে রিহান বুঝল না। শুনল না। কিয়ার প্রতি তার ভালোবাসাটা যেমন অসীম,ঠিক তেমনি শক্তপোক্ত অবস্থান গড়ে নিয়েছে ঘৃ ণা। যে প্রেমিকাকে বধূ করতে চেয়েছিল সে, সেই প্রেমিকাকে দেখলে এখন বে শ্যা শব্দটি মাথায় আসে। তাল বিজনেসে ধস নামতে থাকে। দিনের পর দিন নিজেকে নেশায় জড়িত করে রিহান। ছেলের এই অবস্থা জানতে পেরে কানাডায় ছুটে আসেন ইরফান আর রুনা। একদিন কিয়ার বস লর্ড কে প্রচন্ড আ ঘা ত করল রিহান। এই নিয়ে ঝামেলা ও হলো। তারপরের ঘটনা আরো করুণ হলো। একা পেয়ে লর্ডের দলের লোক রিহানকে প্রচন্ড মা’রধর করল। কিয়া সেটা দেখতে পেল। কয়েকদিনেই মেয়েটার শারীরিক সৌন্দর্য নেমে এসেছে। রিহানের অবস্থা ভালো দেখাচ্ছে না। মেয়েটি আ র্ত নাদ করছে।
“রিহান, রিহান, চোখ খুলে রাখো প্লিজ। চোখ খুলে রাখো।”
তার আ’র্তনা’দে এক মুহূর্তের জন্য রিহানের বুকে সুখ নামালেও পর মুহূর্ত বি ষে র মতো লাগে। সে সজোরে আ ঘা ত করে সরিয়ে দেয় কিয়া কে। মেয়েটি পড়ে গিয়েও উঠে দাঁড়ায়। র ক্তা ক্ত রিহানের পিছু পিছু আসে। তার দু চোখে কান্না। ও শুধু বলে,’তুমি প্লিজ হসপিটালে যাও। প্লিজ হসপিটালে যাও।’ শত অপমান, আ ঘা তের পর ও কিয়া বার বার ফিরে আসে তবে রিহান তাকে তুলে নেয় না। বাসি ফুলের মত ছুড়ে ফেলে দেয়। আর কিয়া ভুগতে থাকে ম র ণ য ন্ত্রণা য়। যে য ন্ত্র ণা তার প্রাপ্য ছিল। হয়ত নিজ দোষে কিংবা পরিস্থিতির দৌলতে আজ তার এই অবস্থান। অথচ সম্পর্কের শুরুতে গল্পটা এমন হওয়ার কথা ছিল না।
রিহান বিগড়ে যেতে থাকে। আর কিয়া হতে থাকে প্রত্যাখিত। এক সন্ধ্যায় রিহানের নাগাল পায় কিয়া। সে প্রায় পায়ে পড়ে যায়। শক্ত করে জড়িয়ে রাখে।
“রিহান, আমাকে ক্ষমা কর, ক্ষমা কর। প্লিজ কথাটা শোনো।”
মাথা গরম থাকায় মেয়েটিকে লা থি দিয়ে সরিয়ে দেয় রিহান। প্রচন্ড আর্তনাদ করে ওঠে মেয়েটি। রিহানের বুক ভে ঙে যাচ্ছে। তবু সে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিয়া পুনরায় উঠে আসে। তাকে ছন্নছাড়া লাগছে। রিহানের দু হাত মুঠোয় নেয়।
“তোমায় ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। বিশ্বাস কর,তোমার জন্য,তোমাকে পাওয়ার জন্য এমনটা করেছি। ট্রাস্ট মি, ট্রাস্ট মি। প্লিজ ট্রাস্ট মি।”
তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠে রিহানের চোখে মুখে। কিয়া বলে,”বাবার সাথে মায়ের বিচ্ছেদের পর, মা পুনরায় বিয়ে করলেন। সৎ বাবার নিকট কত ভাবে অবহেলিত হয়েছি। কত ধরনের
অ ত্যা চা রের মুখোমুখি হয়েছি। কখনো কখনো তিনি তো বাজে স্পর্শ ও করতেন। টাকা পয়সার কষ্ট ছিল ভীষণ। এইচ এচ সির পর হুট করেই সুযোগ এল কানাডায় পড়ার। এখানে এসে ভালো দিন দেখতে শুরু করি। তোমার সাথে পরিচয় হলো। একটা ভালো দিনের অপেক্ষা করছিলাম। অথচ ভালো দিন আমার ভাগ্যে ছিল না। তোমার সাথে সম্পর্কের কথা কোনো ভাবে আমার সৎ বাবা জেনে গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে ভয় দেখাতে শুরু করলেন। নিজের অবস্থান সম্পর্কে তোমায় মিথ্যে বলেছিলাম। তাই ভয়টা আমার আরো বেশি।”
কিয়া একটু থামল। রিহান চুপচাপ শুনছে। কিয়া চোখের পানি টুকু মুছে নিল। তবে পুনরায় ভেসে গেল মুখশ্রী। কান্না কি আটকে থাকে?
“এর থেকেও বড়ো কথা আমি আমার মায়ের অ বৈ ধ সন্তান ছিলাম।”
এ কথা বলে কিয়া কেমন করে ওঠল। রিহানের বুকের ভেতরটা হু হু করছে। কেন যেন সে আগলে নিল মেয়েটিকে। কিয়া পুনরায় বলল,”আমার সৎ বাবা আমায় ভয় দেখাতে শুরু করেছিলেন। তার অনেক টাকা চাই। সে টাকা যদি না দেই,তবে তিনি আমার পরিচয় জানিয়ে দিবেন। পরিচয়হীনতায় ভুগছিলাম আমি। লর্ড এর আগেও আমায় নানান প্রস্তাব দিয়েছে। আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। তবে সময়ের স্রোতে আমি বাধ্য হই। সময়ে অসময়ে তোমার থেকে টাকা চাইতে হতো আমায়। সেটা ভালো লাগছিল না। কেমন যেন ছোট মনে হতো। টাকার প্রতি লোভ ছিল না এ কথা বলব না। লোভ ছিল,হয়ত সবার ই থাকে। তবে তোমার প্রতি ভালোবাসাটা মিথ্যে নয় রিহান। আমি লর্ডের সাথে ইন্টিমেট হওয়ার পর থেকে ও আমায় টাকা দিতে থাকে। অনেক টাকা আমার সৎ বাবাকে দেওয়ার পর, তার চাহিদা আরো বাড়তে থাকে। আমাকে পুনরায় লর্ড এর কাছে যেতে হয়। আমি কুল পাচ্ছিলাম না। কেমন করে তোমার কাছে ফিরব বুঝতে পারছিলাম না। আমার দু চোখে অন্ধকার। শরীরের প্রতি ঘৃ ণা। একবার বাংলাদেশে ফিরে তাকে অনেক অনেক টাকা দিয়ে আসি। চুক্তি করিয়ে নিই। ফিরে এসে ভেবেছিলাম তোমার কাছে ফিরে যাব। তবে লর্ড তখন ছাড়বে না। তার ডিমান্ড তখনো ফুরোয় নি। নিজেকে তখন ভো গ্য বস্তু মনে হতে লাগল। আমি আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতাম। তবে কোথাও নিজেকে খুঁজে পেতাম না। যাকে দেখতাম, সে একজন নোংরা মানুষ।”
এ কথা বলেই কান্নায় ভেসে যেতে লাগল কিয়ার দুটি চোখ। রিহানের বুকের ভেতর তখন কি চলছে তা বলার মতো নয়। সে ভালোবাসার টানে ক্ষমা করে দিল। দুদিন ভালোই চলল। সব তখন ঠিক ঠাক হতে যাচ্ছিল। রিহান খুব দ্রুত বিয়ের আয়োজন ও করবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু লর্ড তাদের সুখের মাঝে আ গু ন হয়ে জ্বলে ওঠল। তার আর কিয়ার ইন্টিমেটের মুহূর্ত গুলো পাঠাতে লাগল। যা রিহানের সহ্য হচ্ছিল না। তারপর থেকে যতবার কিয়াকে আগলে নিতে গিয়েছে ঠিক ততবার ই ভেসে উঠেছে সে দৃশ্য। মেয়েটির প্রতি ঘৃ ণা যেন কমছিলই না। এক পর্যায়ে রিহান আরো পাগলামি করতে লাগল। কিয়া সামনে এলে তাকে আ ঘা ত করতে লাগল। মেয়েটির প্রতি এত ঘৃ ণা হচ্ছিল যে নিজেকে শেষ করার চেষ্টাও চালাল। কিয়ার ভালোবাসা সত্যি ছিল। তবে সে ভুল পদ্ধতিতে ভালোবেসেছে। তাই রিহান কে হারাতে হলো। এক সন্ধ্যায় কিয়া হারিয়ে যায়। চিরদিনের জন্য সে হারিয়ে যায়। সেই সময়টায় মেয়েটি বুঝে গিয়েছিল নিজের জীবনের সবটুকু হারিয়ে ফেলেছে। এ জীবনে আর কিছু পাওয়ার কিংবা হারানোর নেই। অমূল্য জীবনের মূল্য খসিয়ে সত্যিই সে হারিয়ে যায়,চিরতরে। যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব।
চলবে……
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি