#শেষ_বিকেলের_মায়া (২১)
তখন প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। ফারিহা রান্না বসিয়েছে। ওমন সময়ে উপস্থিত হলো আদীব। তার মুখশ্রীতে কালো মেঘ এসে জমেছে। ফারিহা অবাক হয় নি। আদীব প্রায় চিল্লিয়ে উঠল। ভয়ে তার বুক কাঁপছিল।
“তুমি কল কেন রিসিভ করছিলে না? জানো কত ভয়ে ছিলাম। অফিস থেকে ফিরে দেখি তুমি নেই। কতটা টেনশন হচ্ছিল।”
“বসুন, আসছি।”
“বসতে আসি নি ফারিহা।”
“আপনি বসুন।”
অবাকের সহিত তাকিয়ে রইল আদীব। সেই সাথে হৃদয়ে জমল ভয়। ফারিহা যতক্ষণ রান্না ঘরে ছিল ও সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। রিহান নিচে এসেছিল। তখন দেখতে পেল আদীবকে। ছেলেটা এখন বেশ নাম কড়া বিজনেসম্যান। মাত্র কিছুদিনেই বেশ নাম কামিয়েছে। টাকার অভাব নেই। দুজন দুজনকে দেখলেও কথা বলল না। ফারিহা স্যুপের বাটি নামিয়ে টেবিলে রাখল।
“রিহান স্যার,আপনি খেয়ে নিন।”
আদীব চুপ করে দেখল সব। ফারিহা হাত মুখ ধুঁয়ে এসে বলল,”আদীব, আপনাকে চা দিব?”
আদীব কথা বলল না। রিহান ডাইনিং এ বসলেও খাবার খাচ্ছে না। পুনরায় খেতে বলল সে।
“ঠান্ডা কিছু খাবেন?”
ধৈর্য হারিয়ে ফেলল আদীব। ওর ভেতরটা অগ্নি শিখায় দগ্ধ হচ্ছে। কাছে এগিয়ে এল। তারপর সোজা বাহুতে হাত রেখে বলল,”বাসায় চলো। মা অপেক্ষা করছেন। কাল বাসায় মেহমান আসবেন। তোমায় না দেখলে কথা হবে।”
ফারিহা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল,”আমি তো ফিরছি না।”
অদ্ভুত শোনাল বাক্যটি। আদীবের সমস্ত শরীরে কম্পন ধরেছে। চোখ হয়েছে লাল।
“বাসায় চলো প্লিজ।”
“আমি ফিরছি না আদীব।”
“আমাদের বিয়ে ফারিহা। তুমি সেসব ভুলে যাচ্ছ কেন?”
“বিয়েটা হওয়ার নয়।”
“এমন করে বোলো না প্লিজ। খালা কিন্তু খুব করে চেয়েছিলেন।”
“মা এখন আর নেই। তাছাড়া আমার মতামতের বিরোধীতা তিনি করতেন না।”
আদীব যেন অর্ধ পাগল হয়ে যাচ্ছে। ওর মাথা কাজ করছে না।
“ফারিহা, প্লিজ আসো। পায়ে ধরি তোমার।”
মেয়েটি নড়ল না। যেন অনুভূতি হারিয়ে গেছে।
“এভাবে আমায় ছোট করবেন না আদীব। আমি আগেও বলেছিলাম আমাদের সম্পর্কটা আগাবে না।”
“ফারিহা! প্লিজ, এমন কোরো না।”
ফারিহা নিরুত্তর। রিহান ওদের কথার মাঝে কিছু বলছে না। আদীবের ভেতরটা হাহাকারে ভরে ওঠল। হুট করেই ফারিহার দু চোখে কান্না মিশে গেল।
“মায়ের দোহাই দিবেন না প্লিজ। আমি আমার অতীত কে স্মরণ করতে চাই না। ওনি যেখানে আছেন ভালো আছেন। আপনি প্লিজ চলে যান।”
হাত জোড় করে কথা গুলো বলল ফারিহা। আদীব চলে যাওয়ার পূর্বে ছলছল নয়নে তাকাল। মেয়েটা সর্বদাই তার জন্য বড়ো নি ষ্ঠু র। কখনো বুঝল না তার ভালোবাসাটা।
স্যুপ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। ফারিহা পুনরায় গরম করে এনে দিল। রিহান বলল,”আদীব ভালো ছেলে। টাকা পয়সার অভাব নেই। ওর সাথে সুখী হতে পারতে।”
ফারিহা উত্তর দিল না। আপন মনে কাজ করতে লাগল। পরদিন দেখা গেল সমস্ত কাগজ পত্র নিয়ে বসেছে রিহান। হাতে ক্যাশের ও অভাব নেই। এত টাকা এ জীবনে দেখে নি ফারিহা। রিহান খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে।
“এসব নিয়ে কেন বসেছেন?”
“সব হিসেব করছি।”
“তাই বলে এভাবে?”
“এগুলো হিসেব করাটা প্রয়োজন।”
“আপনার খাবার।”
“রেখে দাও।”
ফারিহা খাবার গুলো রেখে নিচে এল। এসে দেখল বাড়ির বাইরে একদল মানুষের ভীড়। সে পুনরায় ছুটে এল রিহানের ঘরে।
“রিহান স্যার, বাইরে এত মানুষ কেন?”
“ওরা এসে গেছে?”
রিহান কাদের কথা বলল ফারিহা বুঝল না। ওর হৃদয়ে কম্পন ধরেছে।
“একটু সাহায্য করবে?”
নীরবে কাছে এল ফারিহা। রিহান তাকে নানান হিসেব ধরিয়ে দিচ্ছে। ফারিহা কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘন্টা খানেকের মধ্যে সব তৈরি হয়ে গেল। ক্যাশ চেক মিলিয়ে বস্তার মতো স্তুপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্তটা নিয়ে বাইরে এল রিহান। মানুষ গুলোর হাতে নগদ অর্থ আর চেক ধরিয়ে দিল। সবটা মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। রিহান সবাইকে বিদায় করে আরাম করে সোফায় বসল।
“এত টাকা কেন দিলেন ওনাদের?”
“সবার চাকরি গিয়েছে। ক্ষতিপূরণ দিলাম।”
“এর জন্য এত পরিমাণে?”
রিহান কথা বলল না। বাবার সমস্ত অর্থ সম্পদ বিলিয়ে দিল সে। থাকার মধ্যে রাখল শুধু এই বাড়ি আর একটা গাড়ি। ফারিহা কিছু বলল না। শুধু হতাশার নিশ্বাস ফেলল। দুপুরের দিকে রিহান ফারিহাকে ডেকে নিল। তারপর বলল,”আমার অর্থ সম্পদ কিছুই নেই ফারিহা। তোমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত কোরো না। আদীবের কাছে ফিরে যাও।”
“আমি যাব না রিহান স্যার।”
“জেদ কোরো না।”
“জেদ করছি না। আমি শুধু প্রাপ্যটা চাচ্ছি।”
“এটা কেমন প্রাপ্য নিচ্ছ বলো তো?”
“আমাদের কন্ট্রাক শেষ হতে আরো কিছু সময় বাকি রিহান স্যার। এই সময়টুকু শুধু আপনিই নন, আমিও অধিকার খাটাতে পারি।”
রিহান হতাশ হয়ে চেয়ে রইল। মেয়েটা কোন সুখের আশায় থাকতে চাচ্ছে আসলেই বুঝল না। সন্ধ্যায় চা বানিয়ে নিল ফারিহা। রিহান তখন বারান্দায় বসে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা চাঁদের পানে তাকিয়ে।
“চা।”
“থ্যাংক ইউ।”
ফারিহা চা কাপে চুমুক বসিয়ে কিছু সময় চুপ থাকল। তারপর নিজ আগ্রহ গলিয়ে বলল,”আন্টি আঙ্কেল কীভাবে মা রা গেলেন রিহান স্যার?”
রিহানের বুক চিরে দীঘল শ্বাস নামে। বলে,”কার এক্সিডেন্ট।”
ফারিহা মৌন হয়ে যায়। কি থেকে কি হয়ে গেল। ঠিক তার পর ই কিয়ার কথা স্মরণ হয়। তবে প্রশ্ন করার সাহস হয় না। রিহান কেমন করে যেন সবটা বুঝে ফেলল। নিজের বুকের ভেতরের সবটুকু মায়া ফেলে দিয়ে বলল,”পৃথিবীর সব থেকে নিষ্ঠুর হলো ভালোবাসা। যেই ভালোবাসা তোমায় বাঁচতে ও দিবে না ম র তেও দিবে না। দিবে শুধু একরাশ যন্ত্রণা।”
আদীবের ভেতরটা শেষ হয়ে গেল। সত্যি সে শেষ হয়ে গেল। ফারিহা,তার ভালোবাসা তাকে প্রত্যাখ্যান করল। এত অর্থ সম্পদ ও রাখতে পারল না মেয়েটিকে। ওর খুব রাগ হলো। রাগ থেকে সমস্ত কিছু ভা ঙ তে শুরু করেছে। মরজিনা ছেলের আচরণে ভরকে গেলেন। চিল্লাচিল্লি করলেন।
“বাবা, এমন করিস না। এমন করিস না। আমি ফারিহার কাছে যাব। হাতে পায়ে ধরব। তুই শান্ত হ বাবা।”
শান্ত হলো না আদীব। তার শান্ত সত্ত্বা কোথাও একটা হারিয়ে গেছে। অজস্র যন্ত্রণায় ভরে উঠেছে দুটি নয়ন।
“কেন এমন হলো মা? কেন এমন হলো। আমি ম রে যাচ্ছি মা। ম রে যাচ্ছি। কেউ নেই আমার। কেউ নেই।”
মরজিনা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।
“এমন করিস না বাবা। তুই ছাড়া কে আছে আমার? আমার জন্য বেঁচে থাক তুই। আমার জন্য বাঁচতে হবে তোকে।”
আদীব অঝোরে কাঁদতে লাগল। কাঁদল সমস্ত রাত। তখন প্রায় ভোর হতে শুরু করেছে। মায়ের কোলে শুয়ে ছিল আদীব। সবে তন্দ্রা লেগেছে মরজিনার। মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে এল। সেই সুর মনোযোগ দিয়ে শুনল আদীব। তারপর ওঠে গিয়ে নামাজ পড়ে নিল। নামাজ শেষে এসে দেখল মরজিনাও নামাজে বসেছেন। অঝোরে কেঁদে চলেছেন। আকাশের মালিকের কাছে প্রার্থনা করছেন ছেলেটা স্বাভাবিক হোক। ভালো থাকুক। শেষ রাতে দুঃখিনী মায়ের ওমন আর্তনাদ আদীবকে নাড়িয়ে দিল। বুকের ভেতর চিন চিন অনুভূতি জাগল। একটু পূর্বেও সে ভেবেছিল রেল লাইনে মাথা গুজে দিবে। অথচ এখন তার মন বলছে তোকে বাঁচতে হবে। তোর মায়ের জন্য তোকে বাঁচতে হবে। আর সত্যিই সেদিন বেঁচে গেল আদীব। মমতা ময়ী মায়ের মুখশ্রী তাকে বাঁচিয়ে দিল। দিল নতুন আশা। নতুন আলো। এক নতুন মায়া।
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি