#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_১২
#মেহরিন_রিম
এলোমেলো চুল, গাল ভর্তি দাড়ি, চোখে যেন হাজারো ক্লান্তিরা এসে ভিড় জমিয়েছে। অপূর্ব কে এমন বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখে বুকের ভেতর মোচড় নিয়ে উঠলো হিমির। কেন আবারো এই মানুষটার সামনে আসতে হলো তাকে! সবটা তো মেনেই নিয়েছিল হিমি, তবে কেন সেই চিরপরিচিত মুখ তাকে আবারো দেখতে হচ্ছে? তাও আবার এই অবস্থায়।
নিজের অজান্তেই চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পরলো হিমির। অপূর্ব এখনো তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিজের ধ্যান কাটতেই চোখ সরিয়ে নেয় হিমি, হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় সে। তবে স্থান ত্যাগ করার পূর্বেই অপূর্ব তার সামনে এসে দাঁড়ায়। অনুরোধ এর সুরে বলে,
_এভাবে চলে যেওনা হিমি। আমার যে তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে।
_কিন্তু আমার তোমার থেকে আর কিছু শোনার নেই অপু। আমায় যেতে দাও।
_হিমি প্লিজ, শুধু ৫ মিনিট। আমি জানি তুমি আমার উপর অনেক রেগে আছো, তবুও বলছি শুধু একটা বার আমার কথাটা শোন। তারপর তোমাকে আমি আর কখনো আটকাবো না।
অপূর্বের কথায় যেন কিছুটা মায়া হলো হিমির, আবারো চেয়ারে গিয়ে বসলো সে। অপূর্ব তার পাশ থেকে আরেকটা চেয়ার টেনে হিমির পাশে বসে পড়লো। হিমির দিকে তাকিয়ে সামান্য ক্লান্ত হাসি দিয়ে বললো,
_তুমি আবারো হাটতে পারছো, এটা দেখে যে আমার কতটা ভালো লাগছে আমি বলে বোঝাতে পারবো না হিমি।
হিমি নিজেকে সামলে সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
_তোমার জরুরি কিছু বলার থাকলে বলো,নাহলে আমাকে যেতে দাও।
_আমার জন্য এখন একটুও সময় নেই তোমার কাছে হিমি?
অপূর্বের অসহায় কণ্ঠে বলা কথায় যেন কষ্টটা আরো বেড়ে গেলো হিমির। তবুও চোখ বন্ধ করে কড়া গলায় বললো,
_না নেই।
অপূর্ব কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলো,
_সেদিন তুমি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর আমি তোমার সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম হিমি,তবে মায়ের ইমোশনাল ব্লাকমেইল এর কারণে আমি যেতে পারিনি। তুমি তো যানো মা ছাড়া আমার নিজের বলতে এই পৃথিবীতে তেমন কেউই নেই। মাকে হারানোর ভয়ে আমি তোমার সঙ্গে চেয়েও যোগাযোগ করতে পারিনি। তার দুদিন পরে জমিজমার কিছু কাজে আমাকে গ্রামে যেতে হয়। পরবর্তীতে জানতে পারি,মা বাড়ির আশেপাশের সবাইকে বলেছে যে আমি বিয়ে করতে গ্রামে যাচ্ছি।
হিমি অবাক চোখে তাকালো অপূর্বের দিকে। এর মানে তার ধারণা ঠিক ছিল,অপূর্ব বিয়ে করতে যায়নি!
অপূর্ব আবারো বলতে লাগলো,
_বিশ্বাস করো হিমি, আমি যেই মুহূর্তে এই কথাটা জানতে পারি আমি তোমার কাছে চলে আসতে চেয়েছিলাম। মায়ের কথাও শুনিনি আমি, তবে যেই মুহূর্তে আমি বাড়ি থেকে বের হতে যাবো তখনই মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরে। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর জানতে পারি, মা ব্রেইন স্টোক করেছে।
কিছুটা থামলো অপূর্ব। তারপর হিমির দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো,
_আমার না নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আমার জন্যই মায়ের এই অবস্থা হয়েছে। আমি তোমাকে অনেকবার কথাটা জানাতে চেয়েছি হিমি, তবে মনে হচ্ছিল মা যদি আমার উপর রাগ করে আমায় ছেড়ে চলে যায়! এই ভয়ে আমি তোমাকে কিচ্ছু জানাতে পারিনি হিমি। ভেবেছিলাম, মা একবার সুস্থ হয়ে যাক। তারপর আমি মাকে আবার বোঝাবো। কিন্তু সেটা হয়তো আমার ভাগ্যেই ছিলনা।
অপূর্ব চুপ করে রইলো, চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। পাথর এর ন্যায় বসে ধরা গলায় বললো,
_মাকে বাঁচাতে পারলাম না জানো তো।
বড়বড় চোখ করে অপূর্বের দিকে তাকালো হিমি, তার চোখ থেকেও অবাধ্য অশ্রুধারা গড়িয়ে পরলো। অপূর্বের সাথে এতকিছু হয়ে গেছে,কথাটা বিশ্বাস করতেই গায়ে কাটা দিচ্ছে তার।
অপূর্ব একইভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
_যার জন্য আমি তোমার থেকে দূরে সরে গেলাম, সেই মানুষটাই আমায় ছেড়ে চলে গেলো হিমি। আমায় একদম একা করে দিলো।
অপূর্ব এবার হিমির দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল চোখে বলল,
_তুমি ছাড়া আমার আর আপন বলতে কেউ থাকলো না হিমি, কেউ না। আমার যে তোমাকে এখন ভীষণভাবে প্রয়োজন হিমি।
হিমি কিছু বলতে পারছে না, সব কথাগুলো যেন কোথাও গিয়ে আটকে যাচ্ছে। অপূর্ব এবার হিমির হাতটা ধরে বললো,
_আমায় ফিরিয়ে দিওনা হিমি। তোমায় ছাড়া যে বেচে থাকার ইচ্ছেটাও হারিয়ে ফেলছি আমি। তুমি বললে আমি এখনি তোমাকে বিয়ে করতে পারি।
অপূর্ব যে এভাবে হুট করে হিমির হাত ধরে বসবে সেটা সে ভাবতেও পারেনি। অপূর্বকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হিমির চোখ পড়ে সামনের দিকে। অর্নব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হিমির হাতের দিকে,চোখদুটো লাল হয়ে আছে তার। অর্নব কে এভাবে দেখে ভয় পেয়ে যায় হিমি, এক ঝটকায় অপূর্বের হাতটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। অপূর্ব ও উঠে দাঁড়িয়ে হিমির দৃষ্টি অনুসরণ করে অর্নবের দিকে তাকায়।
অর্নব সবেমাত্রই গাড়ি পার্ক করে এসেছে। তাই তাদের আগের কথাগুলো কিছুই শুনতে পায়নি সে। শুধু শুনতে পেরেছে বিয়ের কথাটা,তার উপর অপূর্বকে এভাবে হিমির হাত ধরতে দেখে রাগটা মাথায় উঠে যায় তার।
অর্নব রাগী চোখে অপূর্বের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ওর কাছে এগিয়ে যায়। অর্নবের অবস্থাটা বুঝতে পেরে হিমি তাকে বলে,
_অ অর্নব আপনি ভুল ভাবছেন,আমার কথাটা..
কিছুই শুনলো না অর্নব। অপূর্বের কাছে এগিয়ে বলতে লাগলো,
_কেন এসেছিস তুই? হিমিকে আমার থেকে নিতে?
অপূর্ব কিছু বুঝতে না পেরে হিমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
_হিমি,উনি কে? তোমার কোনো আত্মীয়?
হিমি কিছু বলার আগেই অর্নব অপূর্বের শার্টের কলার ধরে বলে,
_তুই একবার ওকে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছিস, আবারো একই কাজ করতে এসেছিস তাইনা? পারবিনা। আমার আর হিমির মাঝে তুই আর আসতে পারবিনা।
হিমি এক হাত দিয়ে অর্নবকে ছাড়িয়ে বলে,
_অর্নব,কি করছেন আপনি? রাস্তার মাঝে এভাবে সিনক্রিয়েট করবেন না,আমি আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলবো।
অপূর্ব আবারো অবাক চোখে হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
_উনি কে হিমি?
হিমি অপূর্বের দিকে তাকালো, তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। হিমি একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো,
_উ উনি আমার হাসবেন্ড।
মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়লো অপূর্বের। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো হিমির দিকে। জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোট ভিজিয়ে বললো,
_হ হিমি, আমি জানি তুমি আমার উপর অভিমান করে আছো। হ্যা সেটা স্বাভাবিক, তার জন্য তুমি আমাকে যেই শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেবো। তবে এভাবে আমার সঙ্গে মজা করোনা প্লিজ।
_আমি মজা করছিনা অপু।
_না না তুমি মজা করছো আ আমি জানি। প্লিজ হিমি, এভাবে শাস্তি দিওনা আমাকে। নিঃশ্বাস আটকে যায় আমার।
কথাটা বলে অপূর্ব হিমির দিকে এগোতে নিলেই অর্নব তাকে আটকে দেয়। এবার দুহাত দিয়ে তার কলার টেনে ধরে বলে,
_ কেন? কেন মজা করবে ও তোর সাথে? ও বলছে আমি ওর হাসবেন্ড,তারপর ও তুই ওর দিকে এগোতে যাচ্ছিস। এত্ত সাহস তোর!
অপূর্বের কানে এর কোনো কথাই যাচ্ছে না। সে শুধু একদৃষ্টিতে হিমির দিকে তাকিয়ে বলছে,
_তুমি তো জানো হিমি,আ আমি তোমাকে ভালোবাসি। আই লাভ ইউ আ লট হিমি। আর তুমিও তো আমাকে ভালোবাসো,আই নো দ্যাট।
অর্নব এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না। অপূর্বের ঘাড়ে জোরে ধাক্কা দিতেই সে পড়ে যায় নিচে। অর্নব অপূর্বের দিকে এগোতে যাবে তার আগেই তার গালে সজোরে ঠাস করে চড় মা*র*ল হিমি। ঘটনার আকষ্মিকতায় অর্নব অবাক হয়ে তাকায় হিমির দিকে। হিমি অর্নবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
_স্টপ ইট অর্নব! পাগল হয়ে গেছেন আপনি? আমি আপনার থেকে এটা আশা করিনি।
কথাটা বলে আর এক মুহূর্ত ও সেখানে দাড়ালো না হিমি। ক্রাচ টা নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে অটোতে বসে স্থান ত্যাগ করলো সে। অর্নব রাগী দৃষ্টিতে একবার অপূর্বের দিকে তাকিয়ে বললো,
_তোকে তো আমি দেখে নেবো।
কথাটা বলেই সেখান থেকে চলে গেলো অর্নব। তবে এতকিছুর মাঝেও পাথর এর ন্যায় একইভাবে পড়ে আছে অপূর্ব। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো যেন কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে তার। আশেপাশের কোনোকিছুই তার কানে যাচ্ছে না। মনের মাঝে শুধু একটা কথাই ঘুড়ছে,
_তুমি এটা করতে পারোনা হিমি,ইউ কান্ট ডু দ্যাট…
#চলবে
[আজকের পর্বটা লিখতে গিয়ে নিজেই খানিকটা ইমোশনাল হয়ে পরেছিলাম।
তবে যাই হোক, আপনাদের মন্তব্যের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী পর্ব আসবে। আপনাদের ভালো আগ্রহ পেলে রাতে বোনাস পার্ট দেওয়ার চেষ্টা করবো। তাই নিজেদের মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না। ]