#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৮।
সাদরাজের স্থির, নিমিষ দৃষ্টি রিতাতে আবদ্ধ। রিতার চক্ষু জোড়া অস্থির। হাতে মৃদু কম্পন। সাদরাজ নিরব, নিস্তব্ধ। এই ছোট্ট, সুন্দর কথাটাও তার মস্তিষ্কে ঠাই পাচ্ছে না। সে হতভম্ব। কী বলবে এখন? খুশি হবে? খুব খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরবে রিতাকে? সাদরাজ ভাবছে। সাদরাজের এমন ঠান্ডা রূপ দেখে রিতা কেন যেন ভয় পাচ্ছে। আচ্ছা, সাদরাজ মেনে নিবে তো? আর যদি মেনে না নেয়, তখন?
রিতা জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজায়। খানিক সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি খুশি হোননি, সাদরাজ?’
সাদরাজ আগের মতোই। অনুভূতি যেন সব হারিয়ে গিয়েছে। সে কীভাবে প্রতিক্রিয়া করবে, সেটাও সে বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ চুপ থাকে সে। ভাবে। রিতা ভয় নিয়ে চেয়ে থাকে। সময়ের সাথে সেই ভয় বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে গিয়ে সাদরাজের নিরবতা ভাঙে। সে ঠোঁট নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এটা সত্যি?’
রিতা চট করে উপর নিচে মাথা নাড়ায়। সাদরাজ এদিক ওদিক তাকায়। তার এই অস্থিরতা রিতাকে আরো ঘাবড়ে তুলছে। সাদরাজ ঢোক গিলে। ঠোঁট কাঁপছে তার। কিছু বলতে চাইছে। বলতে পারছে না। রিতা তখন সাদরাজের দু হাত আগলে ধরে। আবারও জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি খুশি হোননি?’
সাদরাজের চোখ হঠাৎ টলমল করে উঠে। কম্পিত সুরে বলে,
‘আমি তো ভালো বাবা হতে পারব না, রিতা। আমি ঐ শাহাদাত আহমেদের মতোই হব, ভীষণ খারাপ বাবা।’
রিতার ব্যথিত হয়। নরম গলায় বলে,
‘কে বলেছে, আপনি খারাপ বাবা হবেন? আপনি ভীষণ ভালো বাবা হবেন। আপনার বাবা ভালো হতে পারেনি তো কী হয়েছে? আপনি হবেন। পৃথিবীর সবথেকে ভালো বাবা।’
সাদরাজ ঠোঁট কামড়ে নিজের চোখের পানি ধরে রাখে। তার মনে ভয়। যদি সেও তার বাবার মতো খারাপ বাবা হয়? যদিও সেও তার সন্তানের সাথে এমন অন্যায় করে, তখন?
সাদরাজ উদ্বিগ্ন গলায় বলে,
‘আমার ভয় হয়, রিতা। যদি আমিও আমার স্বার্থের কথা ভেবে আমার সন্তানের সাথে অন্যায় করে বসি? আমার নিজের উপর আমার ভরসা নেই। আমি আমার সন্তানদের কষ্ট দিতে পারব না।’
রিতা সাদরাজের হাত জোড়া শক্ত করে ধরে। ভরসা দিয়ে বলে,
‘তেমন কিছুই হবে না। আমি বলছি তো, আপনি বেস্ট বাবা হবেন। কেন ভয় পাচ্ছেন? আপনি ভালো মানুষ। আপনি আপনার বাবার মতো স্বার্থপর না। প্লিজ সাদরাজ, মেনে নিন।’
সাদরাজ রিতাকে টেনে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। সাদরাজের লম্বা, চওড়া বুকে তুমুল ভাবে হয়ে চলা স্পন্দনের শব্দগুলো সে শুনতে পারছে। বুকের উপর হাত দিয়ে চেপে ধরে। মিহি সুরে বলে,
‘শান্ত হোন, সাদরাজ। আপনার হৃদপিন্ড এবার বেরিয়ে আসবে তো।’
কিন্তু, বললেই কি আর শান্ত হওয়া যায়? সাদরাজ শান্ত হতে পারছে না। এত বড়ো একটা খবর পাওয়ার পর কী করে শান্ত হবে সে? ভয়, আনন্দ, চিন্তা, অস্থিরতা সবকিছু একসাথে চেপে ধরেছে তাকে। যেই সম্পর্কটা এত অগোছালো, সেই সম্পর্কের পরিণতি এত সুন্দর হবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। রিতাকে অনেকক্ষণ বুকে চেপে রাখে। রিতাও খুব মনোযোগ দিয়ে সাদরাজের বুকের ভেতরের ঢিপঢিপ শব্দগুলো শুনে। যেন সেগুলো কোনো যন্ত্রের সুর।
রিতার মুখ তুলে সাদরাজ তার কপালে আলতো করে চুমু খায়। এই প্রথম সাদরাজের স্পর্শে ভীষণ রকম লজ্জা পায় সে। চোখ বুজে নেয়। সাদরাজ মাথা তুলে চেয়ে মুচকি হাসে। রিতার ঠোঁটে আঙ্গুল ছোঁয়ে বলে,
‘নিজের সবটুকু দিয়ে আমি তোমাকে আর আমাদের সন্তানকে আগলে রাখব, রিতা। কখনো এইটুকু কষ্টও পেতে দিব না, প্রমিস।’
রিতা চোখ মেলে তাকায়। সাদরাজে চোখে চোখ রাখে। মনে তখন সে দারুণ কিছু একটা করে ফেলার ফন্দি আটে। সাদরাজ বুঝে উঠে না। এর আগেই সে সাদরাজের আঙ্গুল সরিয়ে তার ওষ্ঠপল্লবে ভালোবাসা ছোঁয়ায়। সাদরাজ শিউরে উঠে। মেয়েটা কী ভয়নাক কাজ করে ফেলেছে।
রিতা চট কর পেছনে চলে যায়। সাদরাজ হাত দিয়ে ঠোঁট ধরে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রিতার লজ্জায় যেন মরমর অবস্থা। সে মাথা নুইয়ে কোনোরকমে বলল,
‘নিচে মেহুল আর ভাইয়া অপেক্ষা করছেন, মিষ্টি খাওয়ার জন্য। চলুন।’
বলেই ছুট লাগাল দরজার বাইরে। সাদরাজ যেভাবে ড্যাবড্যাব চেয়ে ছিল, আজ ঐ চাউনিতেই সে মৃত্যু অবধারিত ছিল।
রিতা নিচে আসতেই মেহুল তার কাছে ছুটে আসে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কিরে, ভাইয়া কী বলেছেন?’
রিতা হাসে। বলে,
‘খুশিতে বোধ হয় কথাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শোনার পর স্তব্ধ হয়ে এক ঘন্টা চেয়েছিল।’
সোফা থেকে তখন রাবীর হেসে বলে,
‘তা তো হবেই। আমার ছোট্ট হৃদয়ের বন্ধু, এত বড়ো একটা খবরের দখল সে কীভাবে সামলাবে বলো?’
সাদরাজ পেছন পেছনেই নামে। রিতার দিকে একপলক চেয়ে রাবীরের পাশে সোফায় গিয়ে বসে। রাবীর হেসে বলে,
‘কিরে শালা, আমার পরে বিয়ে করে আগে বাপ হয়ে যাচ্ছিস। ব্যাপারটা মোটেও ঠিক হয়নি কিন্তু।’
সাদরাজ তখন শব্দ করে হাসে। বলে,
‘তোর মতো এত দিন, মাস ঠিক করে সব করতে গেলে, কিছুই হবে না। আমাদের মতো হুট হাট সব ঘটিয়ে ফেলবি, তাহলেই দেখবি, আর কোনো ঝামেলা নেই।’
রাবীর কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মেহুল চোখ মুখ কুঁচকে বলে উঠে,
‘হ্যাঁ, সেটাই। উনার তো সব কিছুতেই পারফেক্ট সময় লাগে।’
সাদরাজ আর রিতা তার কথা শোনে হেসে উঠে। রাবীর কপাল কুঁচকায়। একটা মিষ্টি তুলে সাদরাজের মুখে পুরে দিয়ে বলে,
‘নে, না হেসে মিষ্টি খা।’
সাদরাজ কোনো রকমে মিষ্টি চিবিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এই মিষ্টি কে এনেছে? আমি তো মিষ্টি অর্ডার দিয়েছি।’
‘এটা আমরা এনেছি। আপাতত এখন আমাদেরটা দিয়েই মিষ্টি মুখ কর।’
রাবীর উত্তরে বলে। মেহুলও তখন একটা মিষ্টি এনে রিতার মুখে দেয়। রিতা অল্প খেয়ে মেহুলকেও খাইয়ে দেয়। তারপর সবাই বসে গল্প জুড়ে। এর মাঝে সাদরাজের অর্ডার করা মিষ্টিও চলে আসে। তখন আরেকদফা মিষ্টি খাওয়া দাওয়া হয়।
____________
রাতে রিতা অনেকবার বলেছে, খেয়ে আসার জন্য। তবে মেহুল আর রাবীর রাজি হয়নি। এই সময় রিতাকে আর এত দখল দেওয়ার দরকার নেই। বাড়ি ফেরার পথে মেহুলের মন খারাপ। আজ প্রথম সেহরি। কাল থেকেই রোযা শুরু। বাড়িতে সব আয়োজন শেষ। তবে সেসব নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। চিন্তা তার অন্য জায়গায়। বিয়ের পরই শাশুড়ি মায়ের কথায় তার গান গাওয়া বন্ধ হয়েছে। সোজা ভাষায় বলে দিয়েছিলেন, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার করতে। এসব গান ফান নিয়ে যেন আর না ভাবে। প্রথমে খুব কষ্ট হলেও পরে সে মানিয়ে নিল। এখন আবার বাচ্চার প্রতিও আগ্রহ জন্মাল তার। তবে রাবীর কেন এখন এমন করছে? ওর যেন বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ’ই নেই। রিতার বাড়িতে সাদরাজও দু একবার তাকে এই নিয়ে বলেছিল, তবে সে সেখানেও ব্যাপারটা উপেক্ষা করেছে। কেন? রাবীর কি ইচ্ছে করেই এসব করছে, নাকি মেহুলের কথা চিন্তা করে? যেখানে মেহুল চাইছে, সেখানে এত ভাবার কী আছে? এই প্রশ্নটা মেহুল এখন সরাসরি রাবীরকে করতেও পারছে না। জড়তা কাজ করছে ভীষণ। রাবীর ভীষণ বিচক্ষণ মানুষ, সেটা মেহুল জানে। রাবীর যা করে ভেবে চিন্তে করে, ঠান্ডা মাথায় করে। তবে সব ব্যাপারে এত ভাবার কোনো মানে হয়? বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হবে, স্বাভাবিক। এটা নিয়ে এত ভাবার কী আছে, আশ্চর্য!
মেহুলের মনের কথা রাবীর কিছু হলেও আন্দাজ করতে পারছে। কিন্তু সেও যে নিরুপায়। মেহুলকে সে কোনোভাবেই কষ্ট পেতে দেখতে পারবে না। যদিও সত্য বেশিদিন চেপে রাখা যায় না। কিন্তু, তাও এখনই না জানুক। আরো সময় পরে জানুক। জানলেই তো মেহুল থমকে যাবে, ভীষণ কষ্টে মুচড়ে উঠবে সে। রাবীর যে তাকে এখনই এত কষ্ট দিতে চাইছে না। এই কথাটা সে এখন কী করে মেহুলকে বোঝাবে?
চলবে…