#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৬।
রাবীর একটুও অবাক হলো না। যদিও এই মুহুর্তে তার অবাক হওয়াটা ভীষণ জরুরি। তবে সে এই জরুরি কাজের প্রতি কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল,
‘হঠাৎ বাচ্চা নেওয়ার প্রসঙ্গ উঠাচ্ছেন যে? আপনার তো এখনো অনার্স শেষ হয়নি।’
মেহুল খানিক নড়ে চড়ে বসে। মাথায় তার কথা সাজানো আছে। এবার সব গুছিয়ে বলতে পারলেই হলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে অতঃপর বলে,
‘শুনুন, আমি আর রিতা খুব আগে থেকেই প্ল্যান করেছিলাম, আমরা একসাথে বেবি নিব। একসাথে না পারি, অন্তত কাছাকাছি সময়ে নিব। যেন আমাদের বাচ্চার বয়সের পার্থক্যটা খুব বেশি না হয়। তাতে লাভ হবে যে, আমাদের যার আগে ছেলে বাচ্চা হবে, তার সাথে আমাদের মেয়ে বাচ্চার বিয়ে দিতে পারব। তাই সেইজন্যই বলছিলাম, এখনই বাচ্চা নিয়ে ফেললে ভালো হয়। আমাদের ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারব।’
মেহুলের এই উদ্ভট যুক্তি শুনে, রাবীর কিছুক্ষণের জন্য কথা হারিয়ে ফেলে। মানে, এমনও কারোর চিন্তাধারা হয়? এই মেয়ের এসব কথাবার্তা শুনলে কেউ বুঝবে, মেয়েটা যে অনার্স পাস করতে চলছে?
রাবীরকে নিরব দেখে মেহুল বিচলিত হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘কী হলো, কিছু বলছেন না কেন?’
রাবীর বড়ো করে নিশ্বাস ছাড়ে। মাঝে মাঝে ভাবে, এত ব্যস্তময় জীবনে এমন একটু আধটু বিনোদনের প্রয়োজন আছে। নয়তো জীবন পানসা হয়ে উঠবে। সে মৃদু হাসে। বলে,
‘তা, দুই বান্ধবী মিলে এখন বাচ্চা নেওয়ার কথা ভাবছেন নাকি? আর রিতাও কি সাদরাজের সাথে এই নিয়ে কথা বলেছেন?’
‘না না। ও এসব নিয়ে কেন কথা বলবে।’
পরে আবার মেহুল ভীষণ লজ্জামাখা স্বরে বলল,
‘ওরা তো কথা না বলেই কাজ সেরে ফেলেছে।’
মেহুলের লজ্জামাখা মুখের দিকে রাবীর অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। মেয়েটা কী বলছে, তা তার বোধগম্যের বাহিরে। সে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়েই থাকে। মেহুল তা দেখে ঠোঁট চেপে হাসে। বলে,
‘কী ব্যাপার, বুঝতে পারছেন না কিছু?’
রাবীর মাথা নাড়ায়। সে বুঝতে পারছে না। মেহুল আবার হাসে। এত হাসির কী আছে, সেটাও রাবীর বুঝতে পারছে না। মেহুল হাসি থামিয়ে পুনরায় লজ্জাভাব ফুটিয়ে তুলে বলে,
‘আপনি খালু হতে যাচ্ছেন, আর আমি খালা।’
এই বলে আবারও হাসে সে। রাবীরের দুই ভ্রু এর মাঝে এবার ভাঁজ পড়ে। সে বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা। অনেক ভেবে সবকিছু মিলিয়ে হঠাৎ বিস্মিত হলো সে। আঁতকে উঠে বলল,
‘সাদরাজ কি বাবা হতে চলেছে নাকি?’
মেহুল খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
‘হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে হয়।’
রাবীরের বিস্ময়ভাব উবে গেল। বলল,
‘আপনার মনে হয়? এটা সিউর না?’
‘না, সিউর ও। আসলে এখনো টেস্ট করা হয়নি। কালই টেস্ট করে একেবারে সিউর হওয়া যাবে।’
রাবীর এবার থমথমে সুরে বলে,
‘যদি এমন না হয়?’
‘আলবত হবে, আমি একদম সিউর। আর ওর টেস্ট একবার পজিটিভ আসলেই, আমি আর দেরি করব না।’
মেহুলের কথাবার্তা শুনে এখনো কিছু বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। তাই সে এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। উঠে দাঁড়ায়। হাত থেকে ঘড়িটা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে,
‘খেয়েছেন?’
মেহুলের কাছে এই প্রশ্নটা এই মুহুর্তে মাত্রাতিরিক্ত অপ্রাসঙ্গিক মনে হলো। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘আমি কী বলেছি, আর আপনি কী বলছেন?’
রাবীর ভীষণ স্বাভাবিক গলায় বলল,
‘আপনি যা বলেছেন, আমি তা শুনেছি। সময় হলে সবকিছুই হবে। আপাতত পড়াশোনাটা আগে শেষ করুন।’
মেহুল রেগে যায়। রাগটা মনের মাঝেই চেপে রাখে। রাবীর ওয়াশরুমে চলে যায়, ফ্রেশ হতে। এসে দেখে, মেহুল চোখ বুজে শুয়ে আছে। সে এসে পাশে বসে। মেহুলের গাল স্পর্শ করে মিহি সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘ঘুমিয়ে পড়েছেন?’
‘জি।’
মেহুলের রাগে ভরা স্বর। রাবীর ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। বলে,
‘তাহলে জবাব দিলেন কী করে?’
মেহুল সেই রাগ জারি রেখেই বলে,
‘জানি না।’
‘খেয়েছিলেন রাতে?’
‘জি।’
রাবীর চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করল,
‘সত্যি তো?’
ফট করে মেহুল চোখ মেলে তাকায়। বিরক্তির সুরে বলে,
‘আপনাকে মিথ্যে বলে আমার কী লাভ? আমি খিদে নিয়ে ঘুমাতে পারি না। যান, আপনিও গিয়ে খেয়ে আসুন।’
কথা শেষ করেই আবার চোখ বুজল সে। রাবীর তার কর্মকান্ড দেখে মুচকি হাসে। যতই ম্যাচিউর হয়ে যাক না কেন, মেয়েরা তার স্বামীর কাছে সবসময়ই আহ্লাদী।
______
চোখ বুজে শুয়ে থাকলেও মেহুলের চোখে ঘুম আসে না। পাশে কিছুক্ষণ আগে রাবীর এসে শুয়েছে। রাবীরের উপস্থিতি টের পেয়েই আরো গভীর ভাবে ঘুমের ভান করছে সে। কিন্তু, তাও ঘুমকে কাবু করতে পারছে না। এর মাঝেই তার উদরে অল্প উষ্ণতা পেতেই সেদিকে তাকায়। চেয়ে দেখে রাবীর তার হস্তের বাঁধনে তাকে জড়িয়ে নিয়েছে। এটা দেখে মেহুল একটু নড়ে চড়ে উঠে। রাবীর আরো কিছুটা অগ্রসর হয়। হাতের স্পর্শ দৃঢ় হয়। ঘাড়েও তখন উগ্র শ্বাসের অনুভূতি হচ্ছে। রাবীরের হাতের স্পর্শ আরেকটু উপরে উঠতেই মেহুল চট করে তার হাত সরিয়ে দেয়। রাবীর মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকায়। মেহুল তখনো চোখ বুজা। সে নিমিষ চেয়ে থাকে। মেহুলের ভাবসাব বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, ঘুমের অভিনয় করছেন কেন?’
মেহুল তাতে জবাব দেয় না। তাতে অবশ্য রাবীরের কিছু যায় আসে না। সে জানে জবাব কীভাবে আদায় করতে হয়। সে তাই ইচ্ছে করে তখন তার হাতটা মেহুলের অনাবৃত উদরে ছোঁয়ায়। স্পর্শ যত গভীর হয়, মেহুলের মধ্যে অস্থিরতা তত বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সে আর থাকতে না পেরে চোখ মেলে তাকায়। তেতিয়ে উঠে বলে,
‘কী সমস্যা আপনার? ঘুমাচ্ছেন না কেন?’
রাবীর থেমে তাকায়। বাঁকা হেসে বলে,
‘আপনিও তো ঘুমাচ্ছেন না।’
‘আপনি আমাকে ঘুমাতে না দিলে, কীভাবে ঘুমাব?’
‘কেন, আমি আবার কী করলাম?’
রাবীরের এমন ভোলাভালা ভাবে মেহুল আরো চেতে যায়। গরম দেখিয়ে বলে,
‘অনেক কিছু করেছেন। এখন দয়া করে সরে গিয়ে, নিজের বালিশে মাথা রাখুন। নিজে ঘুমান, আর আমাকেও ঘুমাতে দিন।’
মেহুল শুয়ে পড়তেই রাবীর হাসে। তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘বিয়ে করেছি কি, বউ রেখে অন্য বালিশে শোয়ার জন্য? উঁহু, একদমই না।’
বলেই মেহুলের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় সে। রাবীরের স্পর্শে মেহুলের সেই কিঞ্চিত রাগ বেশিক্ষণ ঠাই পায় না। একসময় সব হাওয়ায় মিশে যায়…
___________
বাইরে সূর্য উঠেছে আরো এক ঘন্টা আগে। চারদিকে পাখিদের ব্যস্ততা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। আরেকটা নতুন দিন, নতুন সকাল। একটু পরেই হয়তো মানুষ প্রজাতির ও ব্যস্ততা শুরু হবে। নিরব, নিস্তব্ধ শহর হয়ে উঠবে কোলাহলে পূর্ণ। ব্যস্ত নগরীতে ছুটে চলবে রোজকার দিনের সমস্ত কার্যক্রম।
তবে আজ অন্যদিনের মতো সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে হলেও রিতার আজ কেন যেন সবকিছু নতুন লাগছে। আশ্চর্য, এমন কেন হবে! এইতো সেই পুরোনো সকাল। একই রূপ, একই রং। এর মধ্যে নতুনত্বের কী আছে? সবকিছুই তো পুরোনো। প্রতিদিনকার একই জীবনচক্র। অথচ, আজ যেন নিমিষেই সবকিছু নতুন হয়ে উঠেছে। নতুনের মতো ফকফকা চারিদিক। এত আনন্দ কেন আজ বাতাসে? এত সুখ কেন? এই এত এত সুখ, আনন্দ সে রাখবে কোথায়? চোখ ছলছল করছে তার। মুখ চেপে ধরে বসে আছে। কীভাবে শুরু করবে, কীভাবে বলবে? কাকে আগে বলবে, মেহুলকে নাকি মা’কে আর নাকি সাদরাজকে? কম্পিত মনে উত্তর মেলাতে পারছে না। হাতের ছোট্ট কিটটাকে এখনো অবিশ্বাস্য চোখে দেখে যাচ্ছে। এটা কি আদৌ সত্যি? কোনো স্বপ্ন নয়তো?
সাদরাজের ঘুমন্ত মুখের দিকে চোখ পড়তেই বুঝে, না, এটাই সত্যি। আর এর থেকে ভয়ংকর সুন্দর কোনো সত্যি হতেই পারে না।
কাঁপা কাঁপা হাতে রিতা মেহুলকে কল দেয়। রিংটোনের শব্দ পেতেই মেহুল ঘুমের মাঝেই ফোনটা মাথার পাশ থেকে হাতড়ে বের করে। না দেখেই কোনোরকম রিসিভ করে কানে লাগায়। ওপাশ থেকে রিতার কম্পিত সুর। বলে,
‘দদোস্ত, প-পপজিটিভ এসেছে।’
ঘুমের ঘোরে কিছুই বুঝে না মেহুল। কিঞ্চিত চোখ মেলে চেয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,
‘কী পজিটিভ এসেছে?’
রিতা আগের মতোই কাঁপা স্বরে বলে,
‘প্রেগন্যান্সি টেস্ট।’
‘ওহ।’
“ওহ” টা মুখ থেকে বের করে চোখ বুঝতেই হঠাৎ মস্তিষ্ক সজাগ হলো তার। রিতার বলা কথাগুলো নিউরনে নিউরনে ছড়িয়ে পড়ল। চট করে উঠে বসল মেহুল। প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল,
‘কী, আসলেই?’
‘হ্যাঁ।’
রিতার ছোট্ট করে বলা এই “হ্যাঁ” শব্দটাই মেহুলকে পুরো পাগল বানানোর জন্য যথেষ্ট। সে প্রচন্ড জোরে চেঁচিয়ে উঠে। রাবীর তার গলা পেয়ে ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠে। ভীত হয়। মেহুলের দিকে চেয়ে বিচলিত সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, মেহুল?’
চলবে….