#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৫।
কাল থেকে রোযা শুরু। আর রোযার মাঝখানেই রাবীরের নির্বাচন। রাবীরের তাই দিনগুলো ব্যস্ত কাটছে। মেহুলেরও তাই। শাশুড়ির সাথে রোযার সব প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজকাল মেহুল বেশ খুশি খুশি থাকে। রিতা আবার ভার্সিটিতে যাওয়া আরম্ভ করেছে। দুই বান্ধবী একসাথে সময় কাটাতে পারে। আনন্দ করতে পারে। রিতার জীবন ও আস্তে আস্তে এগুচ্ছে। সাদরাজ আগের তুলনায় ভীষণ যত্নশীল হয়েছে। রিতার প্রতি অগাধ মায়া জন্মেছে তার। একটা ছোট্ট ব্যবসা দিয়েছে। রিতা এতে ভীষণ খুশি। আর পাঁচটা মেয়ের মতো সেও ছোট্ট সংসার শুরু করেছে। সাদরাজের ব্যবহারে এখন সে মুগ্ধ হয়। ভাবে, সত্যিই মানুষ চাইলে খুব সহজেই অন্য একটা মানুষকে বদলে দিতে পারে।
আজ আকাশটা নরম। মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। রোযার আগের দিনটা এমনিতেই মন ফুরফুরে থাকে। তার উপর এমন আকাশ আর আবহাওয়া দেখলে, মন তো আরো খুশি হয়ে যায়।
ক্লাস শেষে দুই বান্ধবী গেল ফুচকা খেতে। অনেকদিন পর ফুচকা খাবে তারা। ঝাল দিয়ে দু প্লেট ফুচকা অর্ডার করে দুজন চেয়ারে বসল। মেহুল বলল,
‘আজকের আকাশটা দেখ, কত সুন্দর!’
রিতা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, আসলেই। কেমন আরাম আরাম লাগছে।’
মেহুল জিজ্ঞেস করল,
‘সাদরাজ ভাইয়া এখন নিশ্চয়ই তোকে খুব ভালোবাসেন?’
রিতা নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘ভালোবাসা তো আর হুট করেই হয় না। ধীরে ধীরে হয়। তবে উনি এখন আমার ভীষণ যত্ন নেন। আমার কথা ভাবেন সবসময়। উনি ধীরে ধীরে নিজেকে পাল্টাচ্ছেন। আমারও কোনো তাড়া নেই। আস্তে আস্তেই সব হোক।’
‘আন্টি আংকেলের সাথে দেখা করবি না?’
‘হ্যাঁ, সাদরাজকে বলেছিলাম। উনি বলছেন, শুক্রবারে নিয়ে যাবেন।’
তাদের কথার মাঝেই ফুচকাওয়ালা মামা দু প্লেট ফুচকা নিয়ে হাজির হলো। মেহুল রিতা প্লেট দুটো হাতে নেয়। মেহুল খুশিতে খেতেও আরম্ভ করে। তবে রিতা থেমে থাকে। তার নাকে একটা গন্ধ ঠেকছে। গন্ধটা তার ভালো লাগছে না। তাকে খেতে না দেখে মেহুল জিজ্ঞেস করে,
‘কিরে, খাচ্ছিস না কেন?’
রিতা ফুচকা একটা তুলে মুখে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো, তার বমি চলে আসবে। ফুচকাটা জলদি মুখ থেকে বের করে ফেলে দেয়। রিতার এমন কাজে মেহুল খাওয়া ভুলে তার দিকে হা করে চেয়ে থাকে। রিতা চেয়ে বলে,
‘মামা আজ কী দিয়ে ফুচকা বানিয়েছে, এমন গন্ধ লাগছে কেন?’
মেহুল অবাক হয়। তার ফুচকাটা নাকের কাছে ধরে বলে,
‘কই, কোনো গন্ধ নেই তো।’
‘আমার কাছে তো লাগছে। খেতে পারছি না, বমি আসছে।’
মেহুল বলে,
‘আচ্ছা, তুই আমার প্লেট থেকে খা।’
মেহুলের প্লেট থেকে একটা ফুচকা নিয়ে মুখে পুরল। এটাও একই মনে হলো তার। জোর করে দুইবার চিবিয়ে মুখ থেকে বের করে ফেলে দেয়। মেহুল হতভম্ব। হলো কী মেয়ের?
মেহুল চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে তোর? শরীর খারাপ করছে নাকি?’
রিতা দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘না, শুধু খেতে পারছি না। গন্ধ লাগছে। বমি পাচ্ছে।’
মেহুল অতি মনোযোগের সহিত রিতাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞেস করল,
‘তোর পিরিয়ড কি রেগুলার?’
রিতা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
‘না, আগের মাসে ডেইট মিস গিয়েছিল, এখনো হয়নি।’
মেহুল ততক্ষণে অস্থির হয়ে উঠেছে। জিজ্ঞেস করে,
‘মাথা ঘুরায়, শরীর দুর্বল লাগে?’
রিতা ভেবে বলে,
‘মাথা ঘুরায় না। তবে শরীর মাঝে মাঝে একটু দুর্বল লাগে।’
মেহুল অস্থিরতায় উঠে দাঁড়ায়। চোখ মুখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। কী বলবে সে? কী করবে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। রিতা বুঝতে পারছে না কিছু। মেহুল এমন কেন করছে? রিতা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, এমন করছিস কেন?’
মেহুল নিজের অস্থিরতা আর ধরে রাখতে না পেরে বলে,
‘প্রেগন্যান্সি টেস্ট কর।’
রিতার হঠাৎ টনক নড়ল। সে সবকিছু মনে মনে মেলাল। আঁতকে উঠল। সত্যিই এমন কিছু হতে চলছে নাকি? আবেগে সে চোখ পিটপিট করে মেহুলের দিকে তাকায়। মেহুলের চোখে মুখে উত্তেজনা উপচে পড়ছে। রিতা নিমিষ চেয়ে আছে তার দিকে। মেহুল খুশি খুশি গলায় বলে,
‘চল, ফার্মেসিতে যাই।’
_________________
রাতে সাদরাজের সাথে খাবার টেবিলে বসতেই রিতার আবারও গা গুলাতে আরম্ভ করল। তবে সে সেটা সাদরাজকে বুঝতে দিল না। খালা তার আর সাদরাজের প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়। খাবার দেখে রিতার যেন বমি আসছে। সাদরাজ সামনে। ভয়ে ভয়ে এক লোকমা মুখে তুলে সে। অনেকক্ষণ মুখে নিয়ে বসে থাকে। গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছে না। উগলে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে। খালা ব্যাপারটা দেখে। জিজ্ঞেস করে,
‘কী হলো, খালা? আপনি দেহি খাইতেছেন না।’
খালার কথা শুনে সাদরাজ রিতার দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, রিতা? কোনো অসুবিধা?’
রিতা ফট করে মুখের খাবারটা গিলে ফেলে। হেসে বলে,
‘না না, কিছু না। আপনি খান।’
সাদরাজ আবার খাবারে মনোযোগ দেয়। রিতা খুব কষ্টে দু থেকে তিন লোকমা গলাধঃকরণ করে। পরে আর খেতে পারে না সে। চেয়ার ছেড়ে উঠতেই সাদরাজ জিজ্ঞেস করে,
‘উমা, তোমার খাওয়া শেষ! প্লেটের ভাতও তো শেষ করোনি।’
রিতা হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘আমার খিদে নেই। সন্ধ্যায় অনেক নাস্তা করেছি তো, তাই এখন খেতে পারছি না। আপনি খান, আমি রুমে যাচ্ছি।’
রিতা এই বলে রুমের দিকে পা বাড়ায়। সাদরাজ কিছু না বুঝলেও খালা অনেক কিছু বুঝতে পারেন। আর সব বুঝতে পেরে মুচকি হাসেন তিনি।
.
রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায় রিতা। আপনা আপনি ডান হাতটা পেটে যায়। বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। যেন কিসের জন্য মনে প্রচন্ড অস্থিরতা হচ্ছে। সে যা ভাবছে, সত্যিই কি তেমনটা হতে চলেছে? যদি এমন হয়, তবে ব্যাপারটাই সাদরাজ কীভাবে রিয়েক্ট করবে? রিতার ভয় হচ্ছে, ভালো লাগছে। সবকিছু মিলিয়ে যেন এ এক অন্যরকম অনূভূতি। কাল সকালেই টেস্ট করে সবকিছু সিউর হবে। আর কাল সকালের কথা ভেবে এখনই খুশিতে গা শিউরে উঠছে তার।
______________
অন্যদিনের মতো রাবীর আজও লেইট করে বাড়ি ফিরে। যার দরুন, মেহুলকে একাই রাতের খাবার খেতে হয়। এটা আজকাল রাবীরের নিত্যদিনের অভ্যাস। সেই সকালে বের হয়, মাঝখানে দুপুরে এসে কিছু খায়। তারপর আবার বের হয়, ফিরে রাত একটার পর। মেহুল ততক্ষণে শাশুড়ির সঙ্গে খেয়ে দেয়ে ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়ে। প্রায়ই মেহুলকে এসে রাবীর ঘুমে পায়। জাগায় না সে। খেয়ে দেয়ে এসে তার পাশে শুয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে খুব একা লাগলে ঘুমন্ত মেহুলকেই টেনে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়। কখনো কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। কখনো তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, শরীরে ঘ্রাণ নেয়। এভাবেই তার জীবন যাচ্ছে। ব্যস্ততায় বউকে সময় দিতে না পারার ভীষণ আক্ষেপ তার মনে। ব্যাপারটা মেহুলও বুঝতে পারে। তাই তো, সে অভিমান করে না। নিজেকে এসবের মাঝেই অভ্যস্ত করে নিয়েছে।
অন্ধকার রুমের লাইট জ্বালতেই রাবীর মেহুলকে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে। কিছুটা অবাক হয়ে ঘড়িতে তাকায়। দেড়টা বাজছে। মেয়েটা এখনো ঘুমায়নি? রাবীর পাঞ্জাবীর বোতাম খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে,
‘এখনো ঘুমাওনি যে?’
‘ঘুম আসছে না।’
মেহুলের স্পষ্ট আওয়াজে রাবীর পেছন ফিরে তাকায়। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, শরীর খারাপ?’
মাথা দুই দিকে ঝাঁকিয়ে বলে,
‘উঁহু।’
‘তাহলে?’
রাবীর প্রশ্ন করে। মেহুল জবাবে বলে,
‘মন খারাপ।’
রাবীর উত্তর পেয়ে হাত থেকে ঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখে। ধীর পায়ে এগিয়ে মেহুলের পাশে গিয়ে বসে। মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন, মনের আজ হঠাৎ কী হলো?’
মেহুল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে রাবীরের মুখ পানে। কত ক্লান্তি ঐ চোখে মুখে। দেখে মায়া হয়। তাই তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে,
‘না, কিছু না।’
রাবীর সন্দিহান চোখে তাকায়। ছোট ছোট চোখ করে মিনমিনিয়ে বলে,
‘কিছু তো একটা হয়েছে। না বলতে চাইলে জোর করব না। তবে বলে ফেলা ভালো।’
মেহুল খানিক ভাবে, বলবে কী বলবে না। পরে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়, বলবে। তার বলা উচিত। তবে বলতে গিয়েও জড়তা কাজ করছে। রাবীর চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। মেহুল ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘অমন ভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি কথা গুলিয়ে ফেলছি তো।’
রাবীর মৃদু হাসে। বলে,
‘আচ্ছা, চোখ বন্ধ করলাম। এবার বলে ফেলো।’
মেহুল সব জড়তা কাটিয়ে মনে সাহস জুগাল। কম্পিত সুরে বলল,
‘আমার বাচ্চা চাই, রাবীর।’
চলবে….