শূন্যতায় পূর্ণতা পর্ব ১১

0
474

#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-১১||

★ভোরের সরু, মিষ্টি সূর্যের কিরণ জানলার পর্দা ভেদ করে রুমে প্রবেশ করতেই সর্বপ্রথম ফারহিনের চোখ মুখে পড়লো। ভ্রু কুঁচকে ফারহিন এপাশ থেকে ওপাশে ফিরে। ফারহিন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সকাল গড়িয়ে বেশ বেলা হলো, অথচ ফারহিন এখনো ঘুম। হঠাৎ দরজায় নক পড়তেই ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো ফারহিন। দরজার দিকে তাকিয়ে গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিলো। ভেতরে আসার জন্য অনুমতি দিতেই কাদের শিকদার রুমে প্রবেশ করলো। কাদের শিকদার এর হাতে নাস্তার ট্রে দেখে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো ফারহিন,
“-একি বাবা আপনি? আপনি কেন আনতে গেলেন?
“-অস্থির হবে না, একদম না। আমি এসেছি তাতে কি হয়েছে? বসো তুমি।
ফারহিন প্রচন্ড লজ্জা পেল। একরাশ অস্বস্তি নিয়ে বসে পড়ল সে।
কাদের শিকদার বলল-
“-মাত্র ঘুম ভাঙলো বুঝি?
“-হ্যাঁ! আসলে…
“-কোনো এক্সপ্লেনেশন দিতে হবে না। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি দেখো আমার জন্যও চা এনেছি। দুজনে খেতে খেতে গল্প করবো।
“-আচ্ছা।
মৃদু হেসে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো ফারহিন। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো। রুমে এসে দেখলো কাদের শিকদার সোফায় বসে আছেন। ফারহিন এসে পাশে বসলো। কাদের শিকদার কাপে লিকার ঢালতে ঢালতে প্রশ্ন করলো-
“-চিনি কয় চামচ খাও?
“-২চামচ।
“-আচ্ছা।
চা বানিয়ে ফারহিনের দিকে এগিয়ে দিলো। ফারহিন লজ্জা পেল। এটা তো ফারহিনের করার কথা ছিলো। ফারহিন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাথা নিচু করলো। কাদের শিকদার চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন-
“-আমাকে সংকোচ করো না। তুমি আমাকে নিজের বাবার মতই দেখো! কিছু লাগলে আমায় জানাতে একদম আপত্তি করবেনা।
“-আচ্ছা।
“-তুমি এটা ভেবো না যে আরশ তোমাকে দয়া করে বিয়ে করেছে। আরশ কিন্তু তোমাকে পছন্দ করতো।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেল ফারহিন। মুখ তুলে কাদের শিকদার এর দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো-
“-আগে থেকে?
“-হুম! আমার ছেলে তোমাকে পছন্দ করতো এটা আমিও জানতাম। তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর অনেক কিছুই হয়েছে, ও তো সব ছেড়ে কোথায় যেন গায়েব হয়ে গিয়েছিল। পরে নিজে নিজেই ফিরে এলো তোমার বিয়ের কয়েকদিন আগে। তুমি জানো আমার ছেলে প্রচন্ড অসামাজিক, হ্যাঁ আমিই বলছি ও অসামাজিক। কারণ, ও কারো সাথে মেশেনা, কারো সামনে যায় না। আজ পর্যন্ত কোনো দাওয়াত, কারো বাড়ি, বা আমার কোনো রিলেটিভ ওকে দেখেনি। ও খুবই একঘেয়ে, একরোখা, বদমেজাজি। আর রাগ? তা তো আসমান সমান। রাগ উঠলে ওর হুশই থাকেনা, ও নিজেকেই আঘাত করে বসে। ওর এমন হওয়ার পেছনে আমারই হাত। ওর মা জন্মের সময়ই মারা যায়। আমি ওকে ছোট থেকেই কাজের লোকের হাতেই মানুষ করিয়েছি। আমি সারাক্ষণ ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতাম যে ওর দিকে তাকানোর সময় ছিলোই না। আমি কখনো ওর খোঁজও নেওয়ার সময় পাইনি। টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে আমার একমাত্র ছেলেকে আমি একা করে দিলাম। আমি টাকার সাম্রাজ্য তো বানিয়ে নিলাম কিন্তু আমার ছেলেটাকে হারালাম। তুমি জানো, ও আমার সাথেও কথা বলে না প্রয়োজন ছাড়া। তুমি ওকে সময় দিও, ওর একাকিত্ব দূর করো, ওকে ভালোবেসো। আমি চাইনা ও তোমার কাছ থেকেও অবহেলা পাক। তোমাকে এসব জানিয়ে রাখাটা দরকার ছিলো তাই জানিয়ে রাখলাম।

নির্লিপ্ত চাহনি ফারহিনের। আরশ ওকে পছন্দ করতো? ফারহানার বলা কথাটা মনে পড়ে গেল ফারহিনের। তারমানে ফারহানা সত্যি বলেছিলো। কাদের শিকদার উঠে দাঁড়ালো। বলল-
“-চা শেষ করে নিচে এসো।
“-বাবা!
মৃদুস্বরে ডাকলো ফারহিন।
“-বলো?
“-আপনার ছেলে কোথায়?
“-তোমার আর ওর বিয়েতে তো তেমন জমকালো আয়োজন করা হয়নি তাই আজকে একটা ছোট্ট রিসেপশন পার্টি রেখেছি, ডেকোরেশনের লোক এসেছে ওখানেই হয়তো আছে।
“-আচ্ছা।

পুরো বাড়ি সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। বাড়ির ভেতরটা আলোয় পরিপূর্ণ! পুরো কাজে আরশ সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবটা করিয়েছে সে। কোনো প্রকার ক্রুটি সে রাখেনি। কাজের ফাকে হঠাৎ বেখেয়ালিভাবে উপরে তাকাতেই আরশের চোখ আটকে গেল। স্থির হলো চাহনি। ব্যস্ত দৃষ্টিজোড়া উপরে দাঁড়িয়ে থাকা নববিবাহিতা মেয়েটির দিকে স্থির হলো। আরশ কাজ ছেড়ে উপরে উঠে এলো। ফারহিনের পাশে এসে দাঁড়ালো। অ্যাশ রঙের একটি শাড়ি পরেছে সে। ফারহিন ঘুরে দাঁড়ালো। ফারহিনের দিকে তাকিয়ে রইল আরশ, মৃদুহেসে বলল-
“-গুড মর্নিং!
“-অনেক আগেই মর্নিং হয়েছে। আর এখন বলছেন?
“-কাজের চাপে খেয়াল ছিলো না।
“-স্বাভাবিক! বিয়েটা যেভাবে তাড়াহুড়োতে হয়েছে আমাকে ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আস্তে ধীরে অভ্যাস হবে, মন স্থির হবে কোনো ব্যাপার না।
ফারহিন ঘুরে দাঁড়ালো। কথা শেষ হতেই ফারহিনের বাহু চেপে ধরে নিজের দিকে ঘুরে দাঁড় করালো আরশ। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল-
“-আমি সব ভুলতে পারি কিন্তু তোমাকে না! তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলেই আমি বিরক্ত করিনি।
“-বুঝেছি। একটা প্রশ্নের উত্তর দিন..?
“-বলো?
“-আমায় কখন থেকে চেনেন?
“-মানে?
থতমত খেল আরশ।
“-মানে এই যে আমাকে কখন থেকে চেনেন আপনি?
“-হাসপাতালে মিট হওয়ার দিন থেকে..
ফারহিন হাসল। বলল-
“- মিথ্যেটাও ঠিকঠাক বলতে পারেন না? আচ্ছা এটা বলুন এক দেখায় ভালোবাসা হয়?
আরশ তাকিয়ে রইলো। ফারহিন কে কি বলবে তা বুঝতে পারছেনা সে। ফারহিন হাত উঁচু করে একটি রুমাল মেলে ধরলো আরশের চোখের সামনে। রুমালটা ফারহিনের যেটা প্রথম দেখায় বেধে দিয়েছিলো ফারহিন আরশের হাতে। আরশ রুমালের দিকে তাকিয়ে ফারহিনের দিকে তাকালো। ফারহিন মৃদুহেসে বলে উঠল-
“-এই রুমালটা আপনার ঘরে কি করছে?
আরশ মাথা নত করলো! ফারহিন বলল-
“-আমার পছন্দের ফুল কি?
“-গোলাপ! তাইতো সব ডেকোরেশন আমি গোলাপ দিয়ে করেছি।
দ্রুত উত্তর দিলো আরশ। ফারহিন তাকিয়ে রইল। বলল-
“-গোলাপের ফুলের তোড়া, গোলাপের পাপড়ি দিয়ে উইশ ওসবও করেছিলেন তাই না?
আরশ অবাক হলো। কি করে জানলো ফারহিন? আরশ তো এসব কাউকে বলেনি। ফারহিন বলল-
“-যান কাজ করুন। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।
“-ফারহিন!!
“-প্লিজ! যান..
“-আমায় ভুল বুঝলে তুমি?
“-উহু! ভুল বুঝিনি। আপনি জানেন আমি বার বার ঠকেছি। যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো হয়নি সে কিন্তু আমার পছন্দের মানুষ ছিল। এখন আর নেই। সে আমাকে বার বার ধোকা দিয়েছে, বার বার আঘাত করেছে। আমার পছন্দ, ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে আমাকে তুচ্ছ করেছে। এই ভয়ে আমি কারো উপর বিশ্বাস করতে পারিনা। হয়তো হবেও না।

ফারহিন রুমে চলে গেল। আরশ বুঝতে পারলো ফারহিন কার কথা বলছে। আরশ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেওয়ালে আঘাত করলো। চোখ দুটো লাল হয়ে এসেছে। থরথর করে কাঁপছে অধরজোড়া। কপালের দু পাশের রগ ফুলে উঠেছে। চোখের কোণে পানি এসে ফেরত গেল। থমথমে গলায় বলল-
“-আমাকে ছাড়া তুমি কাউকে ভালোবাসতে পারো না। তুমি শুধু আমার! আমাকে ছাড়া কারো উপর ভরসা তুমি করতে পারবেনা। আমি করতেই দেব না। তুমি শুধু আমার! সম্পূর্ণরুপে চাই আমি তোমাকে। একটুও অন্যের ছায়া বরদাস্ত করবো না।

★বউ সাজে সেজেছে ফারহিন। গাড় কালো একটি শাড়ি পরেছে। রিসেপশনে কেউ কালো রঙ পরেনা, তবে ফারহিন নিরুপায়। আরশের কালো রঙই সবচেয়ে বেশি পছন্দ। তাই কালো রঙের শাড়িতেই নিজেকে সাজাতে হয়েছে। জমকালো রিসেপশনের আয়োজন দেখে সবার চোখ কপালে। একদিনের মধ্যেই এত সুন্দর ডেকোরেশন অবিশ্বাস্য! ফারহিন আর আরশ দুজন একসাথে নিচে নামতেই সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আরশের পাশে ফারহিনকে বেশ মানিয়েছে। ফারহিন যেন আরশের জন্যই তৈরী হয়েছে, এমনটাই সবাই বলাবলি করছে। সবার এমন উল্লাসী দৃষ্টিতে ফারহিন অস্বস্তিবোধ করছে। দিদার হাসান, সালমা হাসান এসেছে। মা বাবা কে দেখে একটু স্বস্তি পেল ফারহিন। অধরকোণে হাসির রেখে ফুটে উঠলো। সালমা এগিয়ে আসতেই জাপটে জড়িয়ে ধরলো ফারহিন,
“-মা, আই মিস ইউ।
“-আই মিস ইউ টু প্রিন্সেস! তুমি কেমন আছো?
“-ভালো আছি।
“-মাকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেলে?
দিদার হাসানের কথায় ফারহিন সালমা কে ছেড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। বাবাকে পেয়ে যেন শোক উথলে উঠলো ফারহিনের। ফারহিন ভুলেই গিয়েছিলো পাশে আরশ দাঁড়িয়ে। মা বাবাকে পেয়ে আরশের কথা ভুলেই গিয়েছিলো। দিদার মেয়েকে ছেড়ে আরশের দিকে তাকালো-
“-কেমন আছো?
আরশ সালাম করলো দুজনকেই। হালকা হেসে বলল-
“-ভালো। আপনারা কেমন আছেন?
“-এইতো ভালো।
আরশ ফারহিন কে লক্ষ্য করছিলো। ফারহিন একবারও আরশের দিকে তাকাচ্ছেনা। আরশের মুখ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। তিক্ততায় তেতো হয়ে উঠলো ভেতরটা। কাউকে পেয়ে এভাবেই ফারহিন ওকে ভুলে গেল? অথচ! আজকের দিনটা দুজনের একসাথে থাকার কথা। কোথায় ফারহিন? আরশ তো একা দাঁড়িয়ে। সহ্য হলো না আরশের। ভীড়ের মাঝেও নিজেকে একা পেল সে। হঠাৎ পাওয়ার কাট হয়ে গেল। চারপাশে নিরবতা বিরাজমান করছে। আরশ দ্রুত লোক পাঠালো কি হয়েছে তা চেক করার জন্য। নিজেও গেল তাদের সাথে। মেইনসুইচ অফ দেখে আরশের সন্দেহ হলো। সন্দিহান ভাব নিয়ে ফিরে আসতেই আরশের চোখ পড়লো ফ্লোরে। ফ্লোরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ফারহিন। পেটের একপাশ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সাদা টাইলস রক্তে লাল হয়ে আছে। সবাই নিজেদের মত ব্যস্ত। পেটের বা পাশেই একটা ছুরি গেথে আছে। আরশের বুক ধক করে উঠলো। আরশ এক দৌড়ে ফারহিনের কাছে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে। উপস্থিত সবাই তাকাতেই দেখলো ফারহিন বিধ্বস্ত! সবাই আঁতকে উঠলো। আরশ ফারহিনের মাথা নিজের কোলে নিয়ে অনবরত ডেকে যাচ্ছে..
“-ফারহিন উঠো! ফারহিন কি হলো তোমার? এত রক্ত! এসব কীভাবে হলো..
চিৎকার করে ওঠে আরশ।
নিজের মেয়ের এমন অবস্থা দেখে কলিজা মোচড় দিলো দিদার হাসানের। আরশের পাশেই বাকরুদ্ধ হয়ে বসে পড়ে তিনি। কাদের শিকদার দ্রুত গাড়ি বের করতে বলে। আরশ রক্তাক্ত ফারহিনকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত পায়ে ফারহিনকে গাড়ির পেছনের সিটে বসালো। সালমা নিজেও বসলো। মেয়ের মাথা কোলে নিয়ে কাঁদছে আর ডাকছে। কিন্তু ফারহিন নিস্তব্ধ! নিথর হয়ে পড়ে আছে। আরশ প্রচন্ড স্পীডে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি চালাতে চালাতে পেছন ফিরে বার বার অস্থির কন্ঠে বলছিলো-
“-কিছু হবেনা ফারহিন আমি আছি, আমি হতে দেব না কিছু।

চলমান…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here