শুরুটা অন্যরকম পর্ব ৯

0
344

#শুরুটা_অন্যরকম
#পর্ব_০৯
#অধির_রায়

নিয়তি ভয়ে ভয়ে অফিসের ভিতরে প্রবেশ করল। প্রায় চারিদিকে অন্ধকার। শুধু নির্বণের কেবিনে লাইট অন করা৷ তাছাড়া অন্যান্য কেবিনে ড্রিম (আবছা আলোয় লাইট) লাইট অন করা৷ নিয়তি নির্বণের কেবিনের দরজা খুলে চমকে ওঠে৷ নিয়তি ভাবতেও পারেনি নির্বণ এমন ভাবে ভেঙে পড়বে৷

নির্বণ তার চেয়ারে বসে কয়েকটা চিরকুট সামনে রেখে ভীষণভাবে কেঁদে যাচ্ছে। নির্বণের কোন খেয়াল নেই, তার আশে পাশে কি হচ্ছে? নিয়তি নির্বণের কাঁদে হাত রাখতেই নির্বণ চমকে উঠে। নিয়তি দেখে চিরকুটগুলো লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে। কিন্তু তার আগেই নিয়তি একটা চিরকুট ছোঁ মেরে নিয়ে যায়৷

— নির্বণ কাঁদো কাঁদো স্বরে ভাঙা গলায় বলে উঠে, ” প্লিজ নিয়তি আমার চিরকুট টা দিয়ে দাও৷ আমি তোমার কাছে হাতজোড় করছি৷”

নির্বণ কারো সামনে এভাবে হাতজোড় করতে পারে নিয়তির চিন্তার বাহিরে৷ নিয়তি নির্বণের অসহাত্ব দেখে খুব দয়া হয়৷ নিয়তি কিছু না বলে চিরকুটটা দিয়ে দেয়৷

— নির্বণ হাতে চিরকুট পাওয়া মনে হাতে চাঁদ ফিরে পাওয়া৷ নির্বণ মুচকি হাসার চেষ্টা করে বলে উঠে, ” মিস নিয়তি৷ তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ জানাব, সেই ভাষা আমার জানা নেই৷ ”

— নিয়তি অবাক চোখে হন্তদন্ত হয়ে বলে উঠে, ” স্যার এখন কয়টা বাজে জানেন। ”

— নির্বণ চিরকুটগুলো ওয়ালেটে রাখতে রাখতে বলে উঠে, ” মেবি দশটা বাজে৷ তুমি এত রাতে অফিসে কেন?”

— চোখ ছোট করে হতাশ হয়ে বলে উঠে, ” আপনার মাথা ঠিক আছে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন কয়টা বাজে? ”

— নির্বণ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, ” এখন তো রাত ২ঃ৫৬ মিনিট। প্রায় রাত ৩ টা বাজে!”

— হ্যা স্যার এখন রাত তিনটা বাজে৷ আপনি আজ আমাকে একটা কথার জবার দিবেন!

— কি কথা? মা নিশ্চয় এখনো জেগে আছেন৷ লেট করলে চলবে না৷ আমাদের তারাতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে৷

নির্বণ দ্রুত গতিতে চলে যেতে নিলেই নিয়তি নির্বণের হাত ধরে ফেলে। নিয়তি নির্বণের সামনে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে বলে উঠে, ” স্যার মাকে নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না৷ আমি মাকে ঘুম কথা বলে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি৷ ”

— ” তুমি এভাবে আমার পথ আটকানো চেষ্টা করছো কেন? বাড়ি ফিরতে হবে।” কর্কট কন্ঠ বলে উঠে

— হ্যাঁ আমরা বাড়ি ফিরব৷ তবে আজ আপনাকে একটা কথার জবাব দিতে হবে।

— কি কথা? আর আমি তোমার কাছে জবাব দিতে যাব কেন? কে হও তুমি?

— ধরে নেন আমি আপনার কাছের কেউ। বা আমি আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড। বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে তো আপনি সব শেয়ার করতে পারেন৷

— নির্বণ দেয়ালে ঘুশি মেরে, ” আমার জীবনে বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে কিছু নেই৷ সব মেয়েরাই বেইমানি করে। কোন মেয়ে কারো আপন হতে পারে না৷ ”

— যদি একই প্রশ্ন আপনার দিকে আমি ছুঁড়ে দেয়৷ তাহলে কি জবাব দিবেন?

— কিসের প্রশ্ন? তোমাকে আমার জীবন নিয়ে ভাবতে হবে না৷ সামনে তোমার জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। তুমি বরং সেখানেই মন দাও।

— আমি কোন স্বার্থপর মেয়ে নয়৷ আমার চোখের সামনে একজন মানুষ নিবরে দগ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। আমি তাকে ফেলে সামনে এগিয়ে যাব৷ আর হ্যাঁ সব মেয়েরা এক নয়৷ যেমনঃ ছেলেরা ধর্ষক হয়৷ আবার সেই ছেলেরাই কারো ভাই, কারোর আদর্শ স্বামী, কোন কাঙালি মায়ের আদর্শ ছেলে। তেমনি সব মেয়ে এক না৷

— নির্বণ রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, ” হোয়াট ডু ইউ মিন? তুমি বলতে চাইছো তোমরা বেইমানি কর না৷ তুমি আজ আমার সাথে বউ হিসেবে আছো। কাল আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার পর তুমি কি বসে থাকবে? তুমি তো টাকার জন্য নিশ্চয়ই একটা কাজ করবে৷ ”

— অবশ্যই আমি কাজ করব৷ কাজ না করলে খাব কি? আমার জীবন নিয়ে আমাকেই ভাবতে হবে৷ আমি ছাড়া আমার জীবন নিয়ে ভাবার মতোন কেউ নেই।

— ঠিক তেমনই৷ আমি আমার জীবন নিয়ে ভালোই আছি৷ আমার জীবনে কি হবে, সেই নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না?

নিয়তি কিছু বলতে নিবে তার আগেই নির্বণ নিয়তির মুখের উপর আঙুল দিয়ে কথা বলতে মানা করে দেয়। নিয়তি বুঝতে পারে এখন নির্বণকে এভাবে ফোর্স করা যাবে না৷ এই নিয়ে পরে কথা বললে ভালো হবে। নির্বণ এমনিতেই অনেক আপসেট।
______________

নির্বণ ঘুম থেকে উঠে অবাক। আজ নিয়তি নির্বণকে কোন বিরক্ত না করে নির্বণের পোশাক। খাবার রুমে রেখে দিয়েছে। অফিসের ফাইল, নতুন প্রজেক্টের অনেক কাজ করে এগিয়ে রেখেছে৷

আসলে নিয়তি রাতে আর ঘুমাতে পারেনি৷ মাথায় হাজারটা চিন্তা চেপে বসেছে। চিন্তাগুলো দূরে করতেই নিয়তি এসব কাজ করেছে।

নির্বণ ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নিচে চলে আসে। নিচে এসে দেখে পাই নির্বণের মা সকলের সাথে হুইলচেয়ার বসে গল্প করে যাচ্ছে। নির্বণ তার মাকে দেখে খুব খুশি। সকল সার্ভেন্ট মাকে ঘিরে বসে আছে। মার কাছ থেকে রুপকথার গল্প শুনে যাচ্ছে। নির্বণ তার মাকে এভাবে দেখে ফাইলগুলো ট্রি টেবিলে রেখে এক প্রকার দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে।

— নির্বণ টলমল চোখে বলে উঠে, ” মা আমি কতটা হ্যাপি তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না৷ তোমাকে ডাইনিং রুমে দেখে আমি খুব খুশি। আমার অনুভুতি তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।”

— মা ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে উঠে, ” আমিও খুব খুশি৷ এসব কিছু শুধু নিয়তির জন্য সম্ভব হয়েছে৷ নিয়তির মতো লক্ষী বউমা থাকলে আমার কি লাগে?”

— মায়ের দিকে সুরু চোখে তাকিয়ে মিহি কন্ঠে বলে উঠে, ” হুম মা তুমি একদম ঠিক বলেছো। নিয়তি আমাদের সবাইকে একটা নতুন জীবন দান করেছে। আমি তার ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারব না৷ ”

— সার্ভেন্টরা বলে উঠে, ” আমাদের ছোট ম্যামের হাতে জাদু আছে। আবার আমাদের এক করে দিয়েছে৷ আমাদের মুখের হাসি ফিরিয়ে দিয়েছে। ছোট ম্যামের কাছে আমরা সারাজীবন ঋণি থাকব৷ ”

— নিয়তি সবার উদ্দেশ্য বলে উঠে, ” মা তো আমার মা৷ আমি যা করেছি আমার মায়ের জন্য৷ আমিও চাই মা তারাতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক। তিনি যেন এই সংসারকে আবার আলোকিত করতে পারে৷”

— নির্বণের মা নিয়তির হাত ধরে বলে উঠে, ” এটা এখন থেকে তোমার সংসার৷ তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে এই সংসারকে আলোকিত করবে৷”

নিয়তি নির্বণের মায়ের কথা শুনে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না? সে তো আর এই বাড়িতে থাকতে আসেনি৷ সে এসেছে এই বাড়িতে চুক্তি হিসেবে৷ ধরতে গেলে একবার মাইনে করা কর্মচারী। নিয়তি অসহায় দৃষ্টিতে নির্বণের দিকে তাকায়৷ নির্বণ নিয়তিকে ইশারা করতে হ্যাঁ বলতে বলে।

— কি হলো আমার সোনা মায়ের? আমি যতদূর জানি আমার সোনা মা কিছুতেই ভয় পায় না৷ আজ সেই সোনা মায়ের মুখে ভয়ের ছাপ ছড়িয়ে পড়েছে৷

— আসলে মা.. আপনারা আমাকে এত ভালোবাসা দিবেন৷ আমি জীবনে কখনো ভাবতে পারিনি৷ আমি কি এই ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য?

— নির্বণের কথা ঘুরানোর জন্য বলে উঠে, ” নিয়তি তুমি সব সময় মায়ের সাথে সাথে থাকবে৷ তোমাকে কোন কাজ করতে হবে না৷”

— হ্যাঁ ছোট ম্যাম। আপনাকে আজ থেকে কিছুই করতে হবে না৷ আমরা সব কাজ করে দিব৷ কখন কি করতে হবে শুধু আমাদের বলবেন? আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করব৷

— নির্বণ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, ” আমার লেট হয়ে যাচ্ছে৷ তোমরা সকলে মিলে আড্ডা দাও৷ সকলের মুখে যেন হাসি থাকে৷”
_________

নিয়তি নির্বণকে ফলো করতে করতে সেও অফিসে চলে আসে ছদ্মবেশ নিয়ে৷ নিয়তি সবাইকে বলে এসেছে তার বাহিরে দরকার আছে। নির্বণের গাড়ি গেইট দিয়ে ঢুকার সময়ই নির্বণ খেয়াল করে গেইটের দারোয়ানের চোখে জল। নির্বন গাড়ি সেখানেই থামিয়ে দারোয়ানের কাছে যায়৷

— দারোয়ান চেখের জল মুছে, “নমস্কার স্যার৷ প্লিজ স্যার আমাকে ক্ষমা করে দিবেন৷ গতকাল রাতে আমার ছেলে আসতে পারেনি৷ প্লিজ তাকে চাকরি থেকে বের করে দিবেন না৷” হাত জোর করে।

— নির্বণ দারেয়ানের হাত ধরে, ” কাকা আমি সেজন্য নামিনি৷ মানুষের জীবনে সমস্যা থাকতেই পারে। আর একদিন গেইটে না থাকলে কোন সমস্যা হবে না৷ কারণ ভিতরে লোক আছে। ”

— স্যার আপনার মনটা অনেক বড়৷ আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দিব আমার জানা নেই?

— আচ্ছা কাকা আপনি বসে চোখে জল মুছছিলেন কেন? কি হয়েছে আপনার?

— না স্যার৷ আপনি ভুল ভাবছেন৷ চোখে কোন একটা পড়েছিল৷ সেজন্য এমন হয়েছে৷ আমি একদম ঠিক আছি৷

— কাকা আমার কাছ থেকে কি লুকাতে চান? আমার কাছ থেকে কিছু লুকাবেন না৷ আমি কিন্তু খুব রেগে যাব৷

— দারোয়ান কাকা কেঁদে বলে উঠে, ” স্যার আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে কোন টাকা নেই৷ এত টাকা পাবো কোথায়? ”

— চোখের জল মুছে দিয়ে, ” কাকা চিন্তা করতে হবে না৷ জাস্ট অ্যা মিনিট। ”

নির্বণ গাড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা এনে দারোয়ান কাকার হাতে খুব যত্নসহকারে তুলে দেয়৷

— কাকা আজ আমাকে আর কাজ করতে হবে না৷ এই টাকা নিয়ে কিছু কিনা কাটা করে ফেলেন৷ কাল আমার মিটিং আছে আমি বিজি থাকব৷ আগামী পরশু আমার সাথে দেখা করবেন৷ আমি টাকা দিয়ে দিব৷

নির্বণ আর কিছু না বলে গাড়ি পার্কিং করে কেবিনে চলে যায়৷ নিয়তি বুঝতে পারে নির্বণ শুধু মেয়েদের ইনগোর করে। মেয়েদের সহ্য করতে পারে না৷ দারোয়ান কাকাকে কত সুন্দর ভাবে টাকা হাতে বুঝিয়ে দিল। আর আামকে টাকা ছুঁড়ে মেরে দিয়েছেন৷ নিশ্চয় কোন রহস্য লুকিয়ে আছে৷ কি রহস্য লুকিয়ে আছে, আমি বের করেই ছাড়ব?

______________

— “নিয়তি তুমি আমার আলমারির সামনে কি করছো?” পিছন থেকে চিৎকার করে বলে উঠে নির্বণ।

নিয়তি নির্বণের কন্ঠ শুনে ভয় পেয়ে যায়। নিয়তি কিছু জানার জন্য আলমারি খোলার চেষ্টা করছিল।

— নিয়তি ভয়ে ভয়ে বলে উঠে, ” কই কিছু না তো। এমনি রুম পরিষ্কার করছিলাম।”

— নির্বণ নিয়তির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে, ” রুম পরিষ্কার করছিলে তাহলে তোমার হাতে কোন টিস্যু বা নেকরা নেই। হাউ ফানি!”

— নিয়তি শাড়ির আঁচল হাতে নিয়ে, ” এইতো আমি শাড়ির আঁচল দিয়ে পরিষ্কার করছিলাম৷”

নির্বণ ধীরে ধীরে নিয়তির একদম কাছে চলে আসে। নিয়তি নির্বণকে এত কাছে দেখে আলমারির সাথে আরও লেগে যায়৷

— নির্বণ নিয়তির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠে, ” মিস নিয়তি.. তোমাকে বলা হয়েছিল তুমি আমার এই আলমারিতে হাত দিবে না৷ ”

নির্বণের গরম নিঃশ্বাস নিয়তির ঘাড়ে পড়ছে৷ নিয়তি একটা নেশায় চলে যাচ্ছে৷ খিঁচে চোখ বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। চোখ মেলাতে ভয় লাগছে। তবুও অনেক চেষ্টায় আধো চোখে তাকায়৷

— নিয়তি আমতা আমতা করে বলে উঠে, প্লিজ স্যার দূরে সরে দাঁড়ান৷ আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে৷”

— আচ্চা নিয়তি সত্যি করে বল কি করছিলে?

— আসলে.. স্যার আপনার বিষয়ে কিছু জানার চেষ্টা করছিলাম। আপনি কি এমন লুকিয়ে রেখেছেন এখানে, যা কাউকে হাত লাগাতে দেন না?

— নির্বণ নিয়তির দুই বাহু চেপে ধরে, ” নিয়তি তুমি কেন বার বার আমার বিষয় জানার চেষ্টা করছো? জেনে কি করবে তুমি? ফিরিয়ে দিতে পারবে কি সেই আগের স্বাভাবিক জীবন?”

নির্বণ চোখ বন্ধু করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। নির্বণ রুম থেকে চলে যেতে নিলে নিয়তি নির্বণের সামনে দাঁড়ায়৷

নিয়তি নির্বণকে যা বলে উঠে তা শুনে নির্বণ নিয়তির উপর কিছু একটা ভরসা হয়৷ তবুও নিয়তিকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here