শুভ্র_স্পর্শ পর্ব ২

0
1645

#শুভ্র_স্পর্শ
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
# পর্বঃ২

মায়ের সাথে কথা শেষ করে মায়ের রুমের দিকে পা বাড়ায় সরব। অন্ধকার রুমে বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে আরহা৷ বিয়ের তিনটে বছরে কখনো আরহা কে কাঁদতে দেয়নি শুধু মাত্র একদিন ব্যতীত। সেদিন যেদিন সরবের বাবা ইন্তেকাল করেন। সেদিন আরহা যেমন কান্না করেছিল ঠিক তেমন ভাবেই আগলে নিয়েছিল বাড়ির প্রত্যেক মানুষকে। আরহা শুধু একটা নাম বা মানুষ না সরবের লাইফে, আরহা নিজেই সরবের সব।

সবেমাত্র রাত আট টা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট অথচ পুরো বাসায় পিন পতন নীরবতা। বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা আরহা কে ঠিক করে দিচ্ছিলো, কিন্তু ঘুমন্ত আরহা সরবের বাম হাতে মাথা রেখে দিব্যি আরাম করে ঘুমাচ্ছে৷ সরব উঠতে পারলো না। আজ মেয়েটা চুল বেনুনি করেনি, চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাস্রোতের শুকনো ছাপ, কিছুক্ষণ পর পর ফুপিয়ে কেঁদে উঠা এসব একরাশ কষ্ট হয়ে বুকের মাঝখানে কেমন ভার ভার লাগছে সরবের।

আরহার কপালে ছোট্ট একটা আবেগী স্পর্শ দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সরব।
ডান হাতে চিবুকে স্পর্শ করতেই দৃষ্টি স্থির হলো আরহার চিবুকের নিচের কাটা দাগ টাতে।

আচ্ছা? কেউ কি কারো ক্ষতস্থানের প্রেমে পড়তে পারে? কাটাছেঁড়ার দাগের উপর কি কেউ ভীমড়ি খেয়ে পা পিছলে প্রেমে পড়তে পারে?
পারে তো! যেমন সরব পড়েছে আরহার থুতনির নিচে কাটা দাগে……..৷

বছর তিনেক আগের কথা। পুরো পরিবার ব্যস্ত সরবের জন্য পাত্রী দেখতে। এক মেয়েকে মোটামুটি বেশ পছন্দ হয়েছিলো সবার। বিয়ের পাকা কথা দেওয়ার আগে বৃন্ত যখন মেয়ের ছবি দেখলো তখন সাফ মানা করে দিল। কারণ জানতে চাইলে বৃন্ত বলল,

” এই মেয়েকে আর যাই হোক বাড়ির বউ করে আনা যায় না। এই মেয়ে শুধু নামে শিক্ষিত। আর তাছাড়া একটু ভালো ফ্যামিলি হলেই হয় না৷ এই মেয়ের মুখের ভাষা জঘন্য। এত নিকৃষ্ট ভাষা মেয়ে মানুষের মুখের হতে পারে না৷ শুধু এই মেয়ে নয়, এই মেয়ের বড় বোনের মুখের ভাষা ভালো না।এরা কথায় কথায় বাবা মা তুলে গালিগালাজ করে। মান-সম্মানের ভয়ে কেউ এদের মুখ লাগতে যায় না। কারণ এরা বস্তির মেয়ের মতো আচরণ করে আর ভাষা? মুখের ভাষা তো ব্রোথেলের মেয়েদের থেকেও জঘন্যতম ভাষা।শোন মা! মেয়ে মায়ের জাত, এদের নরম হতে হয়। আমরা মেয়ে না? আমাদের কেউ কিছু বললে আমরা কি যাই পুরুষ মানুষের মতো গলাবাজি করে এগিয়ে? না কি চুপ থেকে ঝামেলা যেনো বড় না হয় সেদিকে খেয়াল রাখি? আসলে দেশের বাহিরে থাকলে কিংবা একটু মর্ডান ড্রেস-আপ ফলো করলেই সভ্য মানুষ হওয়া যায় না। এই মেয়ের ফ্যামিলিগত যোগ্যতার দিক দিয়ে ভালো কিন্তু ভাইয়া তো মেয়েকে বিয়ে করবে, মেয়ের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস কে না। আশা করে বুঝেছো! ”

বৃন্তর কথা সত্যি ছিল।মেয়ের উগ্র ব্যবহার, অসংযত মুখের ভাষা সম্পর্কে খবর পেয়েছিলো সরব৷ আর তাছাড়া সৌভাগ্য বশত বৃন্তর জুনিয়র ছিল মেয়েটা । তাই এ যাত্রায় বেঁচে যায় সরব। কারণ আর যাই হোক, ঘরের বউ হিসেবে উগ্র আচরণের মেয়েকে কোন মানুষ পছন্দ করবে না।

এসব আলোচনা চলছিল সরবদের বাসায়। ওসমান সাহেব তখন নামাজে গিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো ফিরেনি। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠে। বৃন্ত এগিয়ে সদর দরজা খুলতেই দেখে কালো রঙের বোরখা, হিজাব পড়া একজন মেয়ে ওসমান সাহেব কে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। অল্পবয়স্ক মেয়ে বুঝতে অসুবিধে হয় না বৃন্তর কারণ চোখ স্পষ্ট বলছিলো এ মেয়ে দেখতে মা-শাহ্-আল্লাহ্ সুন্দরী হবে। মেয়ের কন্ঠস্বরে ধ্যান ফিরে বৃন্তর।

“আসলে! উনি রাস্তায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাই…. ”

মেয়েটার কথা শেষ হতে না হতেই বৃন্ত ওর বাবার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে আসে সাথে মেয়েটাকে আসতে বলে।
ওসমান সাহেবের তখন সবে মাত্র রোগ ধরা পড়েছে। উনি ঠিকমতো চলতে পারে কিন্তু হঠাৎ হাত পা কাপতে থাকে৷ বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো তখন। ওসমান সাহেব কে বৃন্ত ভিতরে দিয়ে এসে দেখে মেয়েটা দাঁড়িয়েই আছে। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলো মেয়ের পড়নে বোরখা না,লংড্রেস কিন্তু মুখ আবৃত।
বৃন্তর থেকে বিদেয় নিয়ে মেয়েটা চলে যাচ্ছিলো।
মনোয়ারা বেগম ধন্যবাদ জানাতে এগিয়ে আসছিলো কিন্তু মেয়েকে চলে যেতে দেখে আর পিছন থেকে ডাকলো না।

এবার মেয়েটা হঠাৎ পিছন ফিরে চাইলো। স্থির দৃষ্টি মনোয়ারা বেগমের দিকে। কয়েক কদম এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

“কেমন আছো আন্টি? ”

বৃন্ত এবং মনোয়ারা বেগমের কৌতুহলময় দৃষ্টি। প্রথম পরিচয়ে কেউ কাউকে হুটহাট আন্টি বললেও তুমি করে বলে না। তবে মেয়েটা কে?

মেয়েটা হালকা হাসলো। চোখ হাসির প্রতিচ্ছবি প্রকাশ করছে। মুখ অনাবৃত করতে করতে মেয়েটি বলল,

“আমায় চিনতে পারোনি তো? আমি আরহা! ”

আরহা নাম শোনার সাথে সাথে মনোয়ারা বেগমের চোখেমুখে খুশি যেনো উপচে পড়ছে। এত বছর পর প্রিয় প্রতিবেশীর পিচ্চি মেয়েটাকে এভাবে নিজের বাসায় দেখবে কখনো আশা করেন নি উনি।

“তুমি আরহা? আমাদের আরহামণি? আরাফ ভাইয়ের মেয়ে? ”

একরাশ বিস্ময় সাথে উত্তেজিত কন্ঠ নিয়ে জিজ্ঞেস করেন মনোয়ারা বেগম।
মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে আরহা সায় দিতেই মনোয়ারা বেগম আরহার গলা জড়িয়ে ধরে।
প্রায় আট বছর পর আরহাকে দেখছে।বৃন্ত যেনো একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে৷ ঘোর কাটতেই সে আরহা পাশে গিয়ে বসলো। মনোয়ারা বেগম ধীরেধীরে সব কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন এবং আরহা সব বলছিল।হঠাৎ করে চলে যাওয়ার কারণ বলল আরহা। ওসমান সাহেবের কথা শুনে বেশ মন খারাপ করলো কিন্তু এটাও বলল,

“আমি সত্যি আংকেল কে চিনতে পারিনি। ”

“দাড়ি রেখেছে তো তাই হয়তো চিনতে পারোনি। আচ্ছা বলো কি খাবে? তুমি তো আম পছন্দ করো তাই না? একটু অপেক্ষা করো সরব সকালেই বাজার থেকে আশ্বিনা আম এনেছে৷ আমি নিয়ে আসছি। ”

আরহার উত্তরের অপেক্ষা না করেই মনোয়ারা বেগম পা বাড়ায় রান্নাঘরের দিকে। এদিকে আরহা আড্ডা জমিয়েছে বৃন্তর সাথে। দুজনে একসাথে কত খেলেছে, আচার চুরি করে খেয়েছে, ধলাবুড়ির গাছের লেবু চুরি করেছিল এতওতশত কত কথা!

ড্রয়িংরুম থেকে কারো হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। হাসির শব্দ যেনো কাচের চুড়ির শব্দের মতো সরাসরি মস্তিষ্কে আঘাত করছে। উঁহু! বুকে আঘাত করছে যার ফলে ব্লাড পাম্প দ্রুত হচ্ছে৷ অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়ায় সরব। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছিলো তাই সে ভিজে গিয়েছিলো।

ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই সরব দেখে বৃন্ত কারো সাথে খোশগল্পে ব্যস্ত। সরব কে দেখতেই দ্রুত জিজ্ঞেস করে

“দেখতো ভাইয়া চিনতে পারিস কি না?”

শ্বেত-ধূম্রের ন্যায় পা দুটো। পায়ের নখে মেহেদীর রঙ অবশ্য ইদানীং মেহেদী থাকে না কি? মেহেদীর নাম করে যা বিক্রি করে ওসব তো ক্যামিকেল প্রডাক্ট। হাতদুটোর শুধু কবজি দেখা যাচ্ছিলো।
মেয়েটার চুলগুলোর একপাশে ভেজা, মনে হয় আসার সময় বৃষ্টিতে ভিজেছে।
হঠাৎ চোখ পড়লো থুতনির নিচে। সবিস্ময়ে সরব বলল,

“আরহা!!”

“চিনেছিস তাহলে? তোর বাবা মসজিদ থেকে আসার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ও বাসায় নিয়ে এলো। আমরা তো চিনতেই পারিনি। নেকাবে মুখ আবৃত ছিলো। কিন্তু দেখ! মেয়ে আমার আমাকে ঠিক চিনেছে। ”

মনোয়ারা বেগমের কথা সরব কতটা শুনতে পেলো কে জানে? দৃষ্টি তো আরহা তে সীমাবদ্ধ ছিল। বেশ সময় আরহা ওদের বাসায় রইলো। আরহার মায়ের সাথে মনোয়ারা বেগম ফোনে কথা বললেন।
আরহার যাওয়ার সময় হয়ে এলো। কিন্তু বৃষ্টিবেগ যেনো পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মনোয়ারা বেগম এই ভর সন্ধ্যেবেলা আরহাকে একা ছাড়তে চাইছিলেন না কিন্তু আরহা বলছিলো সে পারবে তার কাছে ছাতা আছে। তবুও মনোয়ারা বেগমের পিড়াপীড়িতে সরব কে সাথে নিয়েই বের হতে হলো আরহার।

বাহিরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তাই রাত করে হিজাব না বেধে মাথায় ওড়না দিয়ে রেখেছে আরহা। কাধে ব্যাগ ঝুলানো, ডান হাতে লংড্রেসের নিচের অংশ গুটিয়ে উচু করে হাটছে। সরব মাথায় ছাতা ধরে আছে।

ভাগ্য ভালো তাই একটা রিক্সা পাওয়া গেলো। রিক্সায় উঠার পর রিক্সাওয়ালা কাগজ দিয়ে ওদের ঢেকে দিলে আরহা রিক্সাওয়ালার মাথায় ছাতা ধরে। এমন ব্যবহারে মোটেও অবাক হয় না সরব কারণ ওর এমন কাজের সাথে সে পূর্ব পরিচিত কি না! তাই।

রিক্সা একটু ঝাকুনি দিতেই আরহা খুব শক্ত করে রিক্সার হুড ধরে ফেলে। কারণ তার রিক্সার এক্সিপিরিয়েন্স যে মোটেও ভালো নয়।

“এখনো রিক্সায় উঠতে ভয়?”
“আসলে আমি উঠি না। আম্মোর সাথে উঠলে আম্মো ধরে রাখে, না হলে পড়ে যাই।”

সরব মুচকি হাসে। বাম হাত বাড়িয়ে আরহার পাশের হুড শক্ত করে ধরে রাখে, যেনো এটা একটা সুরক্ষা চক্র। রাস্তায় একথা ওকথা শুধু আরহা বলছিলো সরব চুপচাপ শুনছিল কারণ এখন তো শ্বাস নেওয়াই দুস্কর সেখানে আবার কথার উত্তর দিবে কি?

বাসার কাছে চলে আসতেই আরহা থামাতে বলে, খুব জোড়াজুড়ি করলেও সরবের এক কথায় যেতে দিতে বাধ্য হয় কারণ এই সময় হয়তো আর রিক্সা নাও পেতে পারে।

স্বাভাবিক বিদায় নিয়ে সরব চলে আসে। কিন্তু মনে কোথাও একটা অপূর্ণতা আজ যেনো তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছিলো।

সারারাত বিছানায় এপাশওপাশ করছে আরহা। এতদিন পর সবাইকে পেয়ে কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না। তবে সরবের স্পর্শ একটুও বদলায় নি।

শেষ যেদিন সরবের সাথে আরহার একটু মনোমালিন্য হয়েছিলো সেদিন ছিলো এরকম বৃষ্টির দিন। আরহা সেবছর ক্লাস সেভেনে পড়ে আর সরব এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
আরহাদের বাসায় কিছু রান্না করলে আরহার মা ওদের জন্য পাঠিয়ে দিতো ঠিক তেমনি করতো মনোয়ারা বেগম। সেদিন আরহার বাবা গ্রাম থেকে কাঁঠাল নিয়ে এসেছিলো।আরহার মা প্লেটে কাঁঠালের রোয়া দিয়ে পাঠিয়ে দেয় আরহাকে। কিন্তু ফিরে আসার সময় আরহা পড়ে গিয়ে থুতনির নিচে বেশ খানিকটা কেটে যায়। সরব কিছু দূরে দাঁড়ানো ছিল, এসব দেখে দ্রুত এসে আরহাকে ধরতেই আরহা আরো জোরে কান্না করতে লাগলো।

রক্তে একাকার অবস্থা। ওড়না দিয়ে চেপে ধরে বাসায় এসে যখন এন্টিসেপ্টিক এ তুলো ভিজিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছিলো আরহা সে কি কান্না! জ্বলছে,জ্বলছে বলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছিল। বাসায় ছেলে মানুষ বলতে শুধুমাত্র সরব । কারণ তখন অফিস টাইম ছিল। রক্তে একাকার অবস্থা দেখে সবাই ভিষণ ভয় পেয়ে যায়। বাধ্য হয়েই সরবের বের হতে হয় আরহা কে নিয়ে।
ফার্মেসী থেকে যখন ব্যান্ডেজ করিয়ে নিয়ে আসছিলো রিক্সায় বসে আরহার হাত ধরে
নির্লিপ্ত কন্ঠে সরব বলল,

“আমি যদি ডক্টর হতে পারি তাহলে তোর স্কাল কেটে মগজ বের করে নিবো তারপর একটু চেখে দেখবো। আচ্ছা? তোকে কোন মাটি দিয়ে বানিয়েছে একটু বলবি?

(অতীতের স্মৃতি রোমন্থন হচ্ছে)

চলবে
#ছবিয়ালঃবাহার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here