শুভ্র_বর্ষণ #পর্ব_৪

0
398

#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_৪

বিকেলের সময়টা বাহিরে হেটে বেরিয়ে কাটাতে ভালো লাগে শোভার। এইসময় সে রাস্তা ধরে হেটে বেড়ায়। মাঝে মাঝে রাস্তার বিড়াল কিংবা কুকুরকে উত্ত্যক্ত করে। এদের প্রত্যককে শোভা গায়ের রঙ অনুযায়ী নামে ডাকে। যেমন, কালো কুকুরকে ডাকে কালু, লালকে লালু। বিড়ালদের ডাকে নিজের অপছন্দের কিংবা অসহ্য মানুষের নামে। এর মধ্যে একটার নাম ইংলিশ আন্টিও বটে। শোভা মাঝে মাঝে বাচ্চাদের খেলার মাঝে ঢুকে সব কেচে গন্ডুষ করে দেয়। কখনো বা ছোটদের ভুলিয়ে ভালিয়ে তাদের সাইকেল চালাতে চায়।

শোভার সবথেকে পছন্দের কাজ হলো ইংলিশ আন্টির শিয়ালের মতো দেখতে কুকুরটাকে বিরক্ত করা। অন্য কুকুরকে সে পছন্দের নামে ডাকলেও এটাকে সরাসরি কুত্তা ডাকে। কুকুরটার নাম টফি। যেই নামে ডাকতে শোভার ঘোর আপত্তি। ওর নাম তো শিয়াল পন্ডিত হওয়া দরকার ছিলো। শোভাকে দেখলেই যেন ক্ষেপে ওঠে। ওই শেয়াল পন্ডিতের মতো কুকুর যতদিন ওই বাড়ি আছে, ততদিন চোর বাড়ির ভেতর ঢুকতে পারবে না।

শোভা ইংলিশ আন্টির বাড়ির সামনে উঁকি দিলো। সব ফাকা। গেলো কোথায় শিয়াল টা? হঠাৎ পিছন থেকে চিকন স্বরের কুকুরের ডাক ভেসে এলো। শোভা ভয়ে লাফ দিয়ে দূরে সরে গেলো। তাকিয়ে দেখলো পেছনে টফি ওর দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়াচ্ছে জিভ বের করে। শোভার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারলো না। তার আগেই কেউ একজন প্রশ্ন ছুড়লো,

“তুমি আমাদের বাড়িতে উঁকি ঝুকি মারছো কেনো?”

ভরাট পুরুষালি কন্ঠে শোভা হতচকিত হয়ে গেলো। পাশে তাকাতেই দেখলো ইংলিশ আন্টির ইংলিশ বয় রিয়াদ দাঁড়িয়ে আছে। ঘামে গলার কাছটায় ভিজে ওঠা জলপাই রঙের টিশার্ট গায়ে। চুলগুলো কিছুটা অবিন্যস্ত হয়ে কপালে পড়ে আছে। এক হাতে টফির গলায় বাধা বেল্ট আকড়ে আছে। শোভা কি বলবে ভেবে পেলো না। কিন্তু দমে গেলে চলবে না। চোরা ভাবটা চেহারা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে হালকা গলা পরিষ্কার করে বললো,

“আমিতো কুত্ত.. না মানে টফিকে খুজছিলাম আদর করতে। নাথিং এলস।”
বলে সাথে সাথেই নিচু হয়ে টফির গায়ে দুইবার হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর রিয়াদকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“আপনি ওকে নিয়ে হাটতে বের হয়েছিলেন?”

রিয়াদ তীক্ষ্ণ চোখে শোভাকে পর্যবেক্ষণ করলো। ছোট্ট করে ‘হুম’ বললো। তারপর পাশ কাটিয়ে টফিকে নিয়ে চলে গেলো। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় টফি দুইবার ডেকে গেলো। যেন বিদ্রুপ করে বলে গেলো আমাকে সকালের করা অপমানের বদলা আমার মালিক নিলো।
শোভার অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে গেলো। এটা কোনো আচরণ হলো? একজন মানুষ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ তাকে উপেক্ষা করে ভেতরে চলে গেলো? ইংলিশ আন্টি ঠিক যতটাই বোকা, তার ইংলিশ বয় ঠিক ততটাই বদমাইশ। নেহাত লোকটা দেখতে একটু আকর্ষণীয় বলে শোভা ভদ্র ব্যবহার করে। কিন্তু লোকটার আচরণ একদম অভদ্র। কাউকে পাত্তা পর্যন্ত দেয় না। ফালতু একটা। মনে মনে রিয়াদের গুষ্টি উদ্ধার করে শোভা স্থান ত্যাগ করলো।

___________

সন্ধ্যা নাগাদ নিশান্তের বাবা-মা এবং ভাবীর সাথে ভিডিও কলে কথা বললো মিহা এবং তার পরিবার। একদিনের অল্প একটু আলাপেই দুই পরিবার অনেকটা আপন হয়ে গেছে। মিহার মা এবং নিশান্তের মা ঘন্টা ধরে নানান বিষয় নিয়ে আলাপ করলো। এরপর মিহার সাথে নিশান্তের ভাবী ফাইজা একান্তে কিছুক্ষন কথা বললো,

“আমার দেবর টাকে তোমার পছন্দ হয়েছে তো মিহা?”

মিহা লাজুক হাসি দিলো। তা দেখে ফাইজা আবার বললো,
“একদিনেই তো পাগল করে ফেলেছো। ফোন দিলেই তোমার কথা বলছে। তোমার হাসি, তোমার কন্ঠ সব মুখস্ত করে ফেলেছে।”

মিহার মনে অজানা সুখে ছেয়ে গেলো। নিশান্ত ওকে মনে করছে। ওর কথা ভাবছে শুনতেই বুকের ভেতর শীতল স্পর্শে ছেয়ে গেলো। সে নিজেও কি কম পাগল হয়েছে? মানুষটা সারাদিন মিহার মনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মিহা মাথা নিচু করে নিলো।

“আমার সামনে এতো লজ্জা পেতে হবে না। যদি নিশান্ত কিংবা আমাদের সম্পর্কে কিছু জানার থাকে যা তুমি অন্যকে বলতে লজ্জা পাবে, সেটা আমাকে মন খুলে বলতে পারো। আমি সব বলবো তোমায়।”

মিহা জিজ্ঞেস করবেনা করবেনা করেও করে করে ফেললো,
“আপনাদের সবার প্রিয় খাবারের নামগুলো জানতে চাই ভাবী।”

“আমাদের নাকি নিশান্তের? হুম?”

মিহা চোখ নামিয়ে ফেললো। আসলে ও নিশান্তের প্রিয় খাবার সম্পর্কেই জানতে চাইছিলো কিন্তু সরাসরি বলতে সংকোচ হচ্ছিলো। ফাইজা হেসে বললো,

“আমাকে আপনি করে বলতে হবে না। বড় বোন মনে করে তুমি করে ডাকো। আর নিশান্তের চিকেন পছন্দ। ওকে চিকেন দিয়ে ঝাল ঝাল করে যেকোনো আইটেম করে দিলেই দেখবে সব সাবার করে ফেলবে। তবে আমার দেবরের রান্নার মতো করতে পারবে না গ্যারান্টি। ওর রান্নার হাত মাশা-আল্লাহ। আর রইলো কথা আমাদের? সেটা নাহয় ধীরে ধীরে জানবে। এতসব নিয়ে এখন ভাবতে হবে না। সংসারে ঢোকার আগে যে কয়দিন সময় পাও দুজনে মন প্রান উজার করে প্রেম করো।”

____________

আজ রাতের আবহাওয়াটা বেশ সুন্দর। ঝকঝকে আকাশে অর্ধপূর্ণ চাঁদের উপস্থিতি। মৃদুমন্দ বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে গাছের পাতাগুলো। রাত যত গভীর হচ্ছে মিহার অনুভূতি গুলোও তেমন প্রগাঢ় হয়ে উঠছে। আজ সকালের পর আর একবারও কথা হয়নি নিশান্তের সাথে। নিশান্ত নাম্বার নিয়ে যাওয়ার পর কতবার যে ও মোবাইল চেক করেছে তার ইয়ত্তা নেই। বার বার মনে হয়েছে এই বুঝি সে ফোন দিলো। সারাদিন এক অস্থিরতায় কেটেছে মিহার। অথচ সেই মানুষটার কোনো খোজ নেই। সে কি জানে তার জন্য একজন মানুষ কিভাবে ছটফট করছে? জানে নাতো। জানলে কি আর ফোন না দিয়ে থাকতে পারতো। আচ্ছা! লোকটার কি এমন অনুভূতি হয় না?
মিহা নিজের মনেই আবার যুক্তি সাজায়, হয়তো খুব ব্যস্ত ছিলো সারাদিন। ওনার নাকি কাজের প্রেশারে ইদানীং বাড়ি ফিরতে রাত হচ্ছে। মিহাকে বাড়ি নেওয়ার আগে আগেই নাকি সব প্রেশার কমাতে চায়। হয়তো তাই ব্যস্ত। তবুও মিহার মন মানতে চায় না। একবার কি কল দেওয়া যায় না? ওর কাছে মোবাইল নাম্বার থাকলে নিশ্চয়ই এতোক্ষণে কল দিয়ে দিতো।

মিহার ভাবনার মাঝেই নিস্তব্ধতা ঠেলে বেসুরো আওয়াজে মুঠোফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ফুটে উঠলো আননোন নাম্বার। মিহার মনে হলো ফোনের ওপাশে ওর কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিই থাকবে। সেই বোধহয় এতোক্ষনে স্মরণ করেছে। কাপাকাপা হাতে ফোন তুলে নিলো। রিসিভ করে কানে দিতেই মিহার ভাবনা সত্যি করে সেই আকাঙ্ক্ষিত গলাটা শ্রবন হলো। মিহার হৃদয় সিক্ত হলো। কিন্তু গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। এতোক্ষণ যার জন্য অভিযোগ সাজাচ্ছিলো এখন তার সাথে কথা বলার জন্য শব্দ ফুরিয়ে গেলো নিমিষে। নিশান্ত মিহার জবাব না পেয়ে বললো,

“তোমার আশেপাশে পানি থাকলে একটু গলা ভিজিয়ে নাও মাহযাবীন। না হলে আজ আর সেই কোমল রিনরিনে কন্ঠ আমার কর্ণগোচর হবে না।”

মিহা সত্যিই পানি পান করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো। ফোন কানে ধরেই ছূটে গেলো ডাইনিংয়ে। চেয়ারে বসে ঢকঢক করে আধা গ্লাস পানি শেষ করে আবার ব্যস্ত পায়ে রুমে ফিরলো। তারপর শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলো।
শোভা সোফায় বসে পা নাচিয়ে নাচিয়ে টিভিতে ইন্ডিয়ান রিয়েলিটি শো দেখছিলো। বোনের এমন অদ্ভুত কান্ডে ওর মনোযোগে বিগ্ন ঘটলো। কিছুক্ষন নীরবে সব পর্যবেক্ষণ করে ঠোঁট টিপে হাসলো শোভা। আপুটা এতো সরল কেনো?

মিহা বিছানায় গোল হয়ে বসলো।
নিশান্ত বললো,
“পানি খেয়েছো?”

“হু।”

“বাড়ি ফিরলাম মাত্র। সারাদিন খুব মন চাইছিলো তোমায় কল দেই। কিন্তু ইচ্ছে করেই দিলাম না।”

মিহার অভিমান হলো। ইচ্ছে করে দিলো না? এদিকে যে একজন ফোনের অপেক্ষায় ছিলো সেটুকু বুঝলো না? অভিমান মিশ্রিত গলায় উত্তর দিলো।

“ওহহ। তাহলে এখন দিলেন যে?”

নিশান্ত মৃদু হাসলো। বললো,
“কারন এখন ইচ্ছে হলো। কেনো জানি ফোন না দেওয়াটাও উপভোগ করছিলাম। তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো? তাহলে রেখে দেই?”

মিহার মন ভার হয়ে গেলো। এইটুকু কথা বলার আছে লোকটার? আবার বলছে রেখে দেবে? নিষ্ঠুর। একটুও মায়া নেই ওর জন্য।

নিশান্ত আবার বললো,
“আমায় মিস করেছো খুব তাইনা? আমি জানি খুব মিস করেছো। আমার থেকেও বেশি মিস করেছো। তাই এখন অভিমানে গাল ফুলিয়েছো।”

মিহা হকচকিয়ে গেলো। মনের কথা বুঝে গেলো কি করে? একদিনেই এতোখানি চিনে ফেললো?
নিশান্ত বললো,
“চুপ করে থাকলে কিন্তু আমি এবার সত্যি সত্যিই কল কেটে দেবো।”

মিহা তড়িঘড়ি করে বললো,
“না না।”
তারপর আবার চুপ হয়ে গেলো। ওর কন্ঠের উদ্বিগ্নতা অপরজন ঠিকই বুঝতে পারলো।

“তাহলে কথা বলো। ওই মায়াময় কন্ঠের আওয়াজ থেকে আমায় কেনো বঞ্চিত করছো শুনি?”

মিহা কি বলবে ভেবে পেলো না। আমতা আমতা করে বললো,
“আপনি রাতের খাবার খেয়েছেন?”

“খেয়েছি।”

“এখন কি ঘুমাবেন?”

“ঘুম কি আর এখন আমার কথা শোনে? সে তো এখন তোমার বশে চলে যাচ্ছে।”

মিহার কান গরম হয়ে যাচ্ছে। এভাবে কেউ বলে? খালি লজ্জা দেওয়ার পায়তারা করে। এখন কথা বলবে কি করে বা কি বলবে বুঝতে পারলো না মিহা। কোনোমতে বললো,

“আপনি বোধহয় ক্লান্ত। ঘুমান। আমি রাখছি এখন।”

সাথে সাথে ফোন কেটে দিলো মিহা। ফোনটা বালিশের ওপর রেখে দুইহাতে মুখ ঢাকলো। যাকে একদিন আগে চিনতো না এখনই তার প্রতি এতো প্রগাঢ় টান। এরই নাম কি ভালোবাসা?
পরমুহূর্তেই মনে পড়লো এভাবে ফোন কেটে দেওয়ায় নিশান্ত রাগ করলো নাতো? ফোনটা হাতে নিলো আবার কল দেবে বলে। কিন্তু তার আগে একটা ম্যাসেজ এসে মিহার সংশয় দূর করে আবারো লজ্জায় ডুবিয়ে দিলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো কয়েকটা শব্দ।

“তুমি এতো মিষ্টি কেনো মাহযাবীন? ইচ্ছে করে টুপ করে খেয়ে ফেলি।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here