#শুধু_তুই
#পর্বঃ২০
#Rifat_Amin
– আমার কথাটা একবার অন্তত শোন। পাগলামী করলে কি সমাধান আসবে? (প্রহর)
প্রহরভাই বিছানায় বসতে বসতে কথাটা বললেন আমায়৷ আমি বালিশে মুখ গুজে কেঁদেই চলেছি। উনি আরেকবার ধমক দিতেই আমি ফিরে তাকালাম। উনি বলতে শুরু করলেন,
– নাউমি তোকে কি বলেছে স্পষ্ট বল। নাহলে থাপ্পড় খাবি। (প্রহর)
আমি কাঁপা কাঁপা স্বরে জবাব দিলাম,
-কিছুই বলেনি। আপনাকে ভাবতে হবে না প্লিজ। আপনি আপনার কাজ করুন গিয়ে (আমি)
কথাটা শোনামাত্র উনি রাগী কন্ঠে বললেন,
– আমার এখন একমাত্র কাজ হলো তোর রাগ ভাঙ্গানো। আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে। (প্রহর)
-কিছু হয়নি (আমি)
আমার কথা শোনা মাত্র উনি খিলখিলিয়ে হাসলেন। উনার কান্ডে আমি ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলাম। এই সিরিয়াস মহুর্তে কেউ হাসতে পারে আমার জানা ছিলো না। কিন্তু এই ভয়ংকর হাসির সামনে আমার রাগ তো মহুর্তেই হাওয়া হয়ে যাবে! উনি হাসি দমাতে না পেরে বললেন,
– দুদিন আগে ফেসবুক স্ক্রল করছিলাম বুঝলি। তো হঠাৎ একটা পোষ্ট দেখে আমার চোখ আটকে গেলো৷ পোষ্টটি ছিলো ‘ বউ যদি রাগ করে থাকে তাহলে আপনি সাধারণত জিজ্ঞেস করবেন, কি হয়েছে? এখানে বউ যদি উত্তর দেয় ‘কিছু হয়নি’ তাহলে বুঝবেন ডালমে কুচ কালা হে। কিন্তু সাবধান! ভুলেও বলবেন না ‘আচ্ছা ঠিক আছে’। তাহলে কিন্তু বউয়ের হাতের মার নিশ্চিত। যারা নতুন বিয়ে করতে যাচ্ছেন, তাদের জন্য বড়ভাইয়ের পক্ষ থেকে ফ্রি টিপস্। ”
কথাটা শেষ করে উনি হাসতেই থাকলেন। হাসি ছাড়া এই মহুর্তে বোধহয় উনার কোনো কাজ নেই। আমি হাসবো নাকি কাঁদবো ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এটা বুঝতে পারলাম আমার রাগ আর নেই। শত চেষ্টা করেও আর রাগ তৈরী করা সম্ভব নয়। অন্তত এই অসভ্য মানুষটার সামনে নয়। আমি তাকিয়ে থাকতেই উনি বললেন,
– বড় ভাইকে একটা থ্যাংস দেয়াই যায়। কি বলিস? ভাগ্যিস টিপসটা পেয়েছিলাম। কত উপকার হলো আমার বল! (প্রহর)
আমি চোখ নামিয়ে নিয়ে নতজানু হয়ে বসলাম। উনার দিকে লুকিয়ে তাকাতে ভালো লাগে। কিন্তু সামনে থাকলে তাকানোর সাধ্য থাকে না। আমি বললাম,
– আজ থেকে আপনার সাথে থাকছি না আমি। আমাদের বিয়ের সময় শুধু পরিবারের কয়েকজন সাথে ছিলো, যতক্ষণ না ঐশীর বিয়ে হচ্ছে। ততদিন আমি এ বাসায় আমি ফিরবো না। তখন অবশ্য ভালোই হবে৷ আপনার পড়াশোনা করা, বিশেষ করে নাউমি আর সোনিয়ার সাথে কথা বলার একটা ভালো স্পেস পাওয়া যাবে৷ আমার মনে হয় আমার পরিবার আর আঙ্কেল আন্টির একই মত থাকবে। (আমি)
আমার কথায় উনি কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো৷ একদম কঠর শব্দে জবাব দিলো,
– কথাটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল দেখি, কত সাহস তোর। তুই কার না কার কথায় এমন পাগলামো করছিস।তোর এসব বাচ্চাদের মতো পাগলামো দেখলেই মাথা ঘুরিয়ে যায়। আচ্ছা দাঁড়া আমি নাউমিকে ফোন দিচ্ছি। ওহহ! সরি। নাউমির পরিচয় তো দি….
উনাকে কথাটা শেষ করতে দিলাম না৷ আমি স্বাভাবিক স্বরে বললাম,
– পরিচয় দিয়ে আর কি হবে? নাউমি আপু, সরি! হবু ভাবি নিজেই বলছে আপনার জিএফ উনি। (আমি)
– ওরে পাগলীরে! আমার রাগ কিন্তু হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। আমার রাগ সম্পর্কে নিশ্চই তোর ধারণা আছে। ঐ নাউমি হলো আমার ক্লাস ৮ এর ফ্রেন্ড। ছোটবেলায় ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছিলাম তুই তো সেটা জানিস। তোকে সেখানে কত নিয়ে গিয়েছিলাম! তখন নাউমি আমার একটা ভালো ফ্রেন্ড ছিলো। ওর বাবা বোধহয় এখন সোনিয়ার বাবার বিজনেস পার্টনার। যাইহোক, ঐ মেয়েটা ক্লাস ৭ এ হুট করে বদলে গেলো। সে নাকি আমায় পছন্দ করে। পছন্দ করে মানে ভালোবাসে। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম ওর কান্ডে। আমি কখনো ওর ভালোবাসায় ফাঁদে পা দেইনি। কারণ আমার বাবা-মা ছোটবেলা থেকেই শিখিয়েছিলো কিভাবে জীবনে চলতে হবে, কার কার সাথে মিশতে হবে, সব শিখিয়েছে। প্রথম প্রথম ভাবলাম হয়তো মজা করছে, যেহেতু আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড। তখন সে জানতো না আমি তোকে ভালোবা….। মানে ঠিক ওটা না। আমি তো তোকে ভালোবাসি না। তুই সেটা ভালো করেই জানিস। তারপর ও গোটা স্কুলে বলে বেড়ালো প্রহর আমার বয়ফ্রেন্ড। তখনকার দিনে বয়ফ্রেন্ড শব্দটা তেমন কেউ বুঝতো না। আমি তো ভীষণ রেগে গেলাম। ওকে এসব বন্ধ করতে বললেও করেনি। বরং দিনের পর দিন আমার নামে বিভিন্ন কথা বের করছিলো। তারপর এইট পাশ করে বাধ্য হয়ে ঐ স্কুল ছাড়লাম। তখন থেকেই এই বড়লোকদের এড়িয়ে চলি আমি। এদের আসলে টাকার পাওয়ার ভীষণরকম৷ তবে সব উচ্চবিত্তদের ছেলে মেয়েরা কিন্তু এমন হয় না। যে ফ্যামিলি অবৈধ টাকায় চলে, তাদের ছেলে-মেয়েরা এই টাইপের হয়। স্কুল ছাড়লেও ও আমায় ছাড়েনি, আমার খোঁজ সবসময় নিয়ে বেড়িয়েছে৷ রাস্তাঘাটে বিভিন্নভাবে হেও করেছে। আজকের প্রহর কিন্তু একদিনে হয়নি। ছোটবেলা থেকে মেধাবী হওয়ার খেতাব থাকলেও আমার পড়াশোনায় কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না। আমি ছিলাম মারাত্মক লেভেলের দুষ্টু। কিন্তু কিছু কিছু ধাক্কা খাওয়ার পর জীবনের মানে বুঝেছি। তখন থেকেই বুয়েট হলো আমার স্বপ্ন। এখন সেটা বাস্তবেও রুপ নিয়েছি। এখন আমি পৃথিবীর সব থেকে সুখি মানুষ কেনো জানিস? কারণ আমার সাথে আমার একটা হ্যাপি ফ্যামিলি আছে, আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। যাকে চেয়েছি, তাকেও পেয়েছি। আমার এখন পাওয়ার কিছুই নাই। শুধু যা পেয়েছি তা ধরে রাখতে চাই। বাধা আসবেই, তবে সেসবকে প্রহরকে কখনো পাত্তা দিবেনা। নেভার এভার। আর সোনিয়ার ব্যাপারটা আমি আগেও ক্লিয়ার করেছি। এর বাইরে আমার কোনো লুকানো ইতিহাস নাই। ইভেন তুইও এসব শুনেছিস। কিন্তু মনে করতে পারছিস না। কারণ আমি যখন ক্লাস ৭ এ ছিলাম, তোর বয়স তখন সবে ৫ বছর। (প্রহর)
প্রহরভাইয়ের দীর্ঘ লেকচারটা আমি বাধ্য মেয়ের শুনছিলাম। শেষ কথাটায় ভীষণরকম আশ্চর্য হয়ে গিয়ে বললাম,
– তখন আমার বয়স মাত্র ৫ ছিলো! আপনার এখন বয়স কত ভাইয়া?
প্রহরভাই মুচকি হেসে বললেন,
– টুয়েন্টি সেভেন, মানে ২৭। আর তোর এখন ১৮। সাধে কি পিচ্চি বলি। হা-হা-হা। (প্রহর)
আমি বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলাম,
-কিহহহহহ! আপনি আমার এত বড়? ভেবেছিলাম ২৪/২৫ হবে হয়তো৷ আপনি তো দেখি বুইড়া ব্যাটা। যদিও চেহারা দেখে বোঝা যায় না। (আমি)
উনি মুচকি হেসে বললেন,
-রাগ কাটলো তাহলে! বাঁচা গেলো। (প্রহর)
উনার কথা শোনামাত্র আমি থ হয়ে গেলাম৷ উফফফ! রাগটা থাকে না কেন? ঠিক তখনি ঐশী আর প্রেয়সী সেজেগুজে রুমের ভীতর প্রবেশ করলো। প্রেয়সী রুমে এসেই সোজা ওর দাভাইয়ের কাছে চলে গেলো। পায়ের কাছে গিয়ে টাওয়ার দেখার মতো উপরের দিকে হা করে তাকিয়ে বললো,
– উফ! তুমি খাতো হবা। আমার তাকাতে পবলেম হয়। আমার চকলেট কই? (প্রেয়সী)
প্রহরভাই হাঁটুগেড়ে বসে বললেন,
– এটা পবলেম না, প্রবলেম হবে পিচ্চু৷ ড্রয়ারে আছে চকলেট। প্রতিদিন আসবি আর নিয়ে যাবি। মনে থাকবে? (প্রহরভাই)
প্রেয়সী কথা না বাড়িয়ে আগে ড্রয়ারে তল্লাসি চালাতে গেলো। উফফফ! আমি জানলে আগেই সাবার করে দিতাম৷ ঐশী বললো,
– তোমাকে আম্মি আমাদের বাসায় ডাকছে ভাইয়া। আবার বোধহয় সবাই আলোচনায় বসবে, বিয়ের অনুষ্ঠান করার বিষয়ে মেবি। (ঐশী)
প্রহরভাইয়া গম্ভীরস্বরে বললেন,
– কয়টার দিকে রে?
– রাতে যেকোনো একটা সময় আঙ্কেল – আন্টিকে নিয়ে যেতে বলছে।
প্রহরভাই বললেন,
– আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোর কি হই জানিস? (প্রহর)
ঐশী থতমত খেয়ে গিয়ে বললো,
-কি ভাইয়া? (ঐশী)
– কি ভাইয়া ভাইয়া করছিস? দুলাভাই বলবি! ঠিক আছে? কি বলবি বল দেখি। (প্রহর)
ঐশী কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
– দদুলাভাই ভাইয়া। (ঐশী)
প্রহরভাই শব্দকরে হেসে বললেন,
– তাহলে তুই তো আমার শালি। সামনে একটা চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বুঝলি। তো তুই যেহেতু আমার শালি। তাই তোর আর প্রেয়সীর একটা শখ আমি আজ পূরণ করবো। হয়তো দেখলি চাকরি পেয়ে আর তোদের খোঁজ নিলাম না। তাই বলছি এক্ষুনি ঝটপট আবদার করে ফেল।(প্রহর)
ঐশী আবারো বিভ্রান্তিতে পরে গেলো। বিয়ের পর মাথাটা গেলো নাকি। যে প্রহরভাইয়ের গম্ভীর কন্ঠ ছাড়া কিছু শোনা যেতো না। সেই প্রহরভাই কি না এত হেসে হেসে ফ্রিলি কথা বলছে। ঐশী নিজে খানিকক্ষণ ভেবে বললো,
– সাজেক যাবো ভাইয়া। আমার বহুদিনের শখ। (ঐশী)
প্রেয়সী চকলেট খেতে খেতে বললো,
– আমাকে প্রতিদিন চকলেট এনে দিলেই হবে দাভাই (প্রেয়সী)
প্রহরভাই ওর কথা শোনামাত্র গালটা টেনে দিয়ে বললো,
– টাকা দিবি এনে দেবো। (প্রহর)
প্রেয়সী মুখকালো করে বললো,
-তুমি কবে থেকে কিপ্টা হলে দাভাই? তোমার তো এত্তো টাকা। সেগুলা আবার বড় বড়। (প্রেয়সী)
ওদের কথার মাঝে আমি শুধু চাওয়া-চাওয়ি করছি। কথা বলার সুযোগটুকু পাচ্ছিনা। শেষে প্রহরভাই বললেন,
– আচ্ছা দুজনের কথাই আমি রাখলাম৷ আর আমারো একটা অবুঝ মেয়েকে নিয়ে পাহাড় দেখার শখ। ঐটারে নিয়ে গিয়ে পাহাড় থেকে ফালায় দেবো। যত্তসব ঝামেলা। কি বলিস ঐশী? (প্রহর)
ঐশী জীবনে প্রথম প্রহরভাইয়ের সাথে এত কথা বলার সুযোগ পেলো বোধহয়। আমরা দুবোনেই ছোটবেলা থেকে প্রহরভাইকে যমের মতো ভয় পাই। সেখানে প্রহরেভাইয়ের চেন্জনেস সত্যি চোখে পড়ার মতো। এদিকে সাজেক যাওয়ার আনন্দে ঐশী পাগলপ্রায়।
চলবে?