#শুধু_তুই
#পর্বঃ১৮
#Rifat_Amin
প্রেম বাসা থেকে বের হয়ে পার্কের দিকে হাঁটছিলো , এমন সময় সারাকে দেখতে পেলো সে। সারাকে এই সকাল বেলা পার্কে হাটতে দেখে মোটেও বিচলিত হয়নি। অবাক হয়েছে সামান্যই। সারা ব্লাক হুডি আর শাল জড়িয়ে রেখেছে পুরো শরীরে। প্রেম হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল ৭ টা ১৫। সূর্য উঠেনি এখনো। চারদিকটা হালকা কুয়াশায় আচ্ছন্ন। ফাল্গুন এসে গেলেও ঠান্ডার রেশ বিন্দুমাত্র কমেনি। যদিও দশটার পর আবহাওয়া অনেকটা পরিবর্তন হয়। সারা প্রেমকে দেখামাত্র ছুটে এসে বললো,
– সারপ্রাইজ!! তুমি এমন খালি পা’য় হাটছো কেনো? ঠান্ডা লাগে না? (সারা)
প্রেম কালো শালটা খুলতে খুলতে বললো,
– অসহ্য লাগছিলো তাই খুলে রেখেছি। এত সকালে যে! (প্রেম)
সারা অবাক হয়ে বললো,
– তুমি সারপ্রাইজ হওনি? আমি তো জানতাম তুমি আর ঘুমাতে পারবা না। নিশ্চই বের হবা হাঁটতে। বোহেমিয়ান বলে কথা। তাই আমিও সারপ্রাইজ দিতে এসে গেলাম দেখা করতে এলাম।
বলেই মুচকি হাসলো সারা। প্রেম স্বহাস্য কন্ঠে বললো,
– এই সকাল সকাল তোমাকে দেখে ভালো লাগছে। যাই হোক, চলো চা খাই। টঙ দোকানের চা কিন্তু। (প্রেম)
সারা যেনো বিশ্বাস করতে পারলো না প্রেম ওকে চা খাওয়ার অফার করছে। সে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
– সত্যি খাওয়াবা? তোমার সাথে বসে সব খাওয়া যায়। আর টঙ দোকান বলে, কি খাবো না নাকি? (সারা)
প্রেম ঠোঁট চেপে হেসে বললো,
– সব খাওয়া গেলে আমাকেই না’হয় খাও। হা-হা-হা।
কথাটা বলেই প্রেম তার ভুবন মাতানো হাসিটা দিলো। সারা এই প্রথম প্রেমকে এত সুন্দর করে হাসতে দেখছে। শ্যামসুন্দর মানুষটাকে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর পুরুষ মনে হলো সারার। যদিও এর আগেও প্রেম হেসেছিলো। কিম্তু সেই হাসিতেও যেনো কঠরতা বিরাজ করে। সারা ভয় পায় সেই হাসি। সারা বললো,
-তুমি হাসলে অনেক সুন্দর লাগে প্রেম। নিয়মিত হাসতে থাকবা। বুঝছো? তাহলে মন ভালো থাকে (সারা)
– মানুষ সবসময়’ই হাসার চেষ্টা করে। কিন্তু সব হাসিতে কী সুখ থাকে! কিছু হাসিতে থাকে ব্যার্থতা, অপূুর্ণতা, কষ্ট (প্রেম)
সারা বারবার প্রেমের দিকে তাকাচ্ছে আর মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। সারার সন্দেহ হয় প্রেমের সৌন্দর্য নিয়ে। যার ভাই এত ফর্সা, সে কিনা শ্যামলা! বিষয়টা সন্দেহের বটে। কিন্তু কেউ কি নিজের সৌন্দর্য ঢাকতে চাইবে নাকি? সারা প্রেমের জবাবে বললো,
– তোমার মাঝে এত কিছু দেখে অবাক হই আমি। এত প্রতিভা কই রাখো? আমারেও কিছু ধার দিও। হিহি। (সারা)
যখন তারা রাস্তার পাশের টঙ দোকানে থামলো চা খাওয়ার জন্য। চারদিকে তখন আলো ফুটেছে অনেকটা। মেইনরোডে গাড়ি চলছে সামন্যই। এটাই সেই দোকান যেখানে প্রহরভাই সোনিয়ার সামনে রশ্নি আপুকে থাপ্পড় মেরে ছিলো৷ ভাগ্যিস ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম। দোকানে বসতে বসতে প্রেম বললো,
– বন্ধু হও, ধার তো দিতেই পারি। হিহিহি। যাই হোক, চা খাওয়ার পর বাসা ফিরবে নাকি আমাদের যাবে? (প্রেম)
সারার ইচ্ছে হলো আরো কিছুক্ষণ প্রেমের সাথে থাকতে। আরেকটু কথা বলতে, আরেকটু প্রেমের চোখের দিকে তাকানোর সাহস করতে। কিন্তু এখন যাওয়া যাবে না প্রেমের সাথে। নাহলে আজ সারাদিনে একবারো প্রেমের দেখা পাবো না। সারা বললো,
– এখন চলে যাবো বাসা। বিকালে এখন ভাইয়া আর আপুর সাথে দেখা করতো আসবো। ঠিক আছে? (সারা)
প্রেম মুচকি হাসলো। সদ্য গজে উঠা দাড়িগুলোও যেনো ঝলমল করলো। সারা আরো একবার সেই হাসিটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। চা শেষ করে সারাকে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে বিদায় দিলো প্রেম। অতঃপর প্রেম ফোন করলো সোনিয়াকে। আবীর মেসেজটার সাথে সোনিয়ার নাম্বারো এ্যারেন্জ করে দিয়েছিলো গতকাল। এই টঙ দোকানে একবার মিট করলে ক্ষতি কি। দেখি সোনিয়া আসে কি না। প্রেম রিং করার সাথে সাথে’ই রিসিভ করলো সোনিয়া। প্রেম হ্যালো বলার বলার আগেই ওপাশ থেকে সোনিয়া বললো,
-শুভ সকাল প্রেম বাবু। তা এত সকাল সকাল আমাকে মনে করলেন যে! (সোনিয়া)
সোনিয়ার কথায় প্রেম খানিকটা অবাক হলো৷ প্রেমের নাম্বার তো সোনিয়ার কাছে থাকার কথা না। কিভাবে পেলো সে? প্রেম স্বাভাবিক সুরে বললো,
– শুভ সকাল মিস। ভাবলাম আপনার সাথে একবার মিট করি। একটা ঋণ পরিশোধ করা বাকি। তা আসবেন নাকি? লোকেশনটা সেন্ড করি তাহলে? (প্রেম)
সোনিয়া ফোনের ওপাশ থেকে একটা ভ্যাবলামার্কা হাসি দিয়ে বললো,
– আপনার লোকেশন অলওয়েজ আমার কাছে থাকে মিষ্টার প্রেম। ওয়েট করেন। ৫ মিনিটের মধ্যে আসছি। (সোনিয়া)
প্রেম ফোন কাটার ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় বাইকে করে সেখানে উপস্থিত হলো সোনিয়া। মনে হয় কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভেঙ্গেছে। প্রেম বাইকটার সামনে গিয়ে শরীর থেকে শালটা বের করে গলায় পেঁচিয়ে নিলো। অতঃপর কোনো কথা বার্তা ছাড়াই সজোড়ে থাপ্পড় মারলো সোনিয়াকে। মহুর্তেই নিশ্চুপ হয়ে গেলো চারপাশটা। ছাদের উপরে থাকা দুটো দাঁড়কাক উড়ে গেলো। সাথে সাথেই তিনটা বাইকে উপস্থি হলো তিন মানব। রাফি, সাব্বির আর আবীর। চায়ের দোকানি ভাবতেই পারেনি এই শান্তশিষ্ট ছেলেটা মারপিট করতে পারে। একটু আগেই কতটা ভদ্র আচরণ করলো উনার সাথে। প্রেমের হাতের থাপ্পড় খেয়ে বাইক থেকে পরে গেলো সোনিয়া। সাথে সাথেই সেখানে উপস্থিত হলো সোনিয়ার দুই বডিগার্ড। প্রেম গলার শালটা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে চায়ের দোকানে ছুটে গেলো। সামনে থাকা লাঠিটা তুলে নিলো সে। সোনিয়ার বডিগার্ডদুটি অলরেডি সোনিয়াকে তুলতে ব্যস্ত। আর এদিকে তিন মানব তাদের সেম কালারের ড্রেসআপ সো অফ করতে ব্যস্ত। প্রেম লাঠিটা নিয়ে আসতে আসতেই সোনিয়াকে রাস্তা থেকে উঠানো হয়ে গেছে। প্রেম আবারো কথা বার্তা ছাড়াই সোনিয়ার লোকের উপর চড়াও হলো। ছোট ছেলেটার মারপিটের কৌশল দেখে তাদের চোখ ছানাবড়া। সাথে যুক্ত হলো সাব্বির, রাফি, আবীর। সকাল সকাল শরীরের ব্যায়াম হওয়ায় প্রচন্ড খুশি সবাই। বডিগার্ড দুটির অবস্থা নাজেহাল করে ঘামতে থাকা প্রেম সোনিয়ার সামনে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– তোর জন্য সেদিন এইখানে রশ্নি আপু ভাইয়ার হাতে থাপ্পড় খেয়েছে। ইচ্ছে ছিলো আপুর হাতে তোকে থাপ্পড় খাওয়ানোর। কিন্তু আপসোস। তারা দুজন বাসর করতে ব্যস্ত। তাই আমি’ই সেই কাজটা পূরণ করলাম। যাই হোক, সরি এভাবে মাঝ রাস্তায় থাপ্পড় মারার জন্য। এই কাজের জন্য আমার বাপের চাকরি যদি চলে যায়। তাহলে তোর সুন্দর শরীরটায় আর প্রাণ থাকবে না সুইটি। আল্লাহ হাফেজ। (প্রেম)
কথাটা বলেই হাতের লাঠিটা নিয়ে চায়ের দোকানে ফেরত দিতে গেলো প্রেম। সোনিয়ার এখনো ঘোর কাটেনি। এক থাপ্পড়ে কানে তালা লেগে গেছে। মাথাটা এখনো ভনভন করছে। এদিকে সামান্য আগের ঘটনায় দোকানি ভয়ে চুপসে গেছে। প্রেম গিয়ে যখন বললো, কত বিল হয়েছে আঙ্কেল। তখন দোকানি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, টটাকা ললাগবে নে ভাইজান। প্রেম মুচকি হেসে বললো,
-আমাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই আঙ্কেল। আপনার মতো সাধারণ মানুষ আমি। কোনো পাতি নেতা না। আপনার যতটুকু যোগ্যতা আছে। আমার সেটাও নেই। (প্রেম)
কথাটা বলেই একশো টাকার একটা নোট হাতে গুজিয়ে দিলো প্রেম। দোকানি এখনো বিষ্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কে এই ছেলে? মেয়েটার সাথে যখন কথা বলছিলো তখন মনে হয়েছে, পৃথিবীর সব থেকে ভদ্র ছেলেটা বোধহয় এই ছেলে ছাড়া কেউনা। আর মহুর্তেই এত এত পরিবর্তন!
———-?
পরদিন সকাল আটটায় ঘুম ভাঙলো আমার। প্রহরভাইয়ের বিছানায় এত সুন্দর ঘুম হয় আগে জানা ছিলো না তো৷ জানলে বিয়ের আগে প্রহরভাইকে আমার রুমে ট্রান্সফার করে আমি এখানে থাকতাম৷ অতঃপর ঘুমু ঘুমু চোখে চারপাশে একবার তাকালাম। প্রহরভাই কোথায় গেলো? কম্বলটা বিছানার একপাশে রেখে বিছানা থেকে নামতে যাবো এমন সময় মেঝেতে চোখ আটকে গেলো আমার। প্রহরভাই কিনা মেঝেতে শুয়ে আছে! আর আমি উনার স্ত্রী হয়ে উপরে শুয়ে আছি! শুধু একটা কম্বল গায়ে দিয়ে থাকছে কিভাবে মেঝেতে? ভীষণ অপরাধবোধে চোখমুখ কুঁচকে গেলো আমার। আমি ঝটপট বিছানা থেকে নামলাম। উনার সামনে গিয়ে বললাম,
– এখানে ঘুমাইছেন কেনো প্রহরভাই? এইযে হ্যালো। উঠেন প্লিজ৷ আপনি মানুষ নাকি অন্য কিছু। এভাবে কেউ মেঝেতে ঘুমায়।
প্রহরভাই আমার কথায় চোখ খুললেন না। জেগে উঠেছেন বোধহয়। উনি চোখ বন্ধ করেই বললেন,
– আহ!! ডিস্টার্ব করিস না তো। কাল রাতে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে একটা শিপ ডিজাইন করছিলাম। হঠাৎ করে ঘুম পেয়ে যাওয়ায় এখানেই দুমিনিটের জন্য মাথা রেখেছিলাম। সেখানে দুমিনিটের যায়গায় সকাল হলো কিভাবে কে জানে? এত তারাতারি দুই মিনিট হয়? (প্রহর)
আমি উনার কান্ডে হতবাক হয়ে গেলাম। উনি তো একটা বালিশও নেয়নি দেখি। কি পাগল মানুষের পাল্লায় পরলাম ধুর। কপালে হাত দিয়ে জ্বর চেক করার ইচ্ছে হলো আমার৷ কিন্তু প্রহরভাইকে এভাবে এর আগে কখনো স্পর্শ না করায় দ্বিধায় পরে গেলাম আমি৷ তবুও কাঁপা কাঁপা হাতে উনার কপালে হাত রাখলাম৷ মহুর্তেই কেঁপে উঠলেন উনি৷ নাহ! জ্বর নেই। তবে হালকা শরীর গরম। উনি চোখ খুলে আমার দিকে তাকালেন। আমি অনুভূতি শুন্য স্বরে বললাম,
-প্রতিটা মানুষের কাছেই বাসররাত হয় জীবনের সেরা রাত। কিন্তু আপনি কি পাগল? এভাবে শুয়ে আছেন যে। (আমি)
উনি চুপ করে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
– বিছানায় শুয়ে থাকলে, আমার আজন্ম প্রেয়সী কপালে হাত রেখে কখনই দেখতো না আমার জ্বর আছে কি না।
এটা কি তোর পাগলামো মনে হয়?
তাহলে আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য এমন পাগলামো করবো। পাগলামো করবো তাঁর রাগে ভরা ঐ দৃষ্টি দেখার জন্য। পাগলামো করবো আমার প্রতি তার ভালোবাসায় ভরা মনটা উপলব্ধি করার জন্য। আমি সম্ভবত এই ছোট্ট কারণগুলোর জন্যই পাগলামো করবো৷ হয়তো পাগলামো করবো আমার জন্য তার ভয় হওয়া ঐ চোখ দুটোর জন্য। (প্রহর)
কথাটা বলেই উনি মুচকি হাসলেন। আমি উনার ঘুমুঘুমু কন্ঠে আবারো প্রেমে পরে গেলাম৷ এই প্রেম যে কি ভয়ানক৷ সেটা প্রেমিক মানুষগুলোই জানে। আমি ঠোঁট বাকিয়ে বললাম,
-হইছে, আর হুমায়ুন আহমেদ স্যারকে কপি করতে হবে না। এখন উঠে বিছানায় ঘুমিয়ে পরেন৷ আম্মি যদি জানতে পারে বাসর রাতে তাঁর আদরের ছেলেকে মেঝেতে ঘুমাতে বলেছি৷ তাহলে বিয়ের পরদিনই এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন আমায়। উঠেন প্লিজ। (আমি)
উনি আমার কথা শুনলেন না। শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা কম্বলটা বাম হাত দিয়ে সড়িয়ে দিলেন৷ তার সাথে সাথেই হেচকা টানে উনার শরীরের সাথে মিশিয়ে নিলেন আমায়। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি স্তব্ধ, হতবাক হয়ে গেলাম। উনার উত্তপ্ত শরীরে আমাকে মিশিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেন বোধহয়। উনি ভিলেনমার্কা হাসি দিয়ে বললেন,
– সবাই তো বাসররাত পালন করে। আমরা নাহয় বাসর সকাল পালন করি। কি বলিস? (প্রহর)
আমি উনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে বললাম,
– আপনার সোনিয়াকে নিয়ে বাসর সকাল পালন করুন। এখন ছাড়ুন আমায়। অসভ্য!
চলবে?
(ভুলত্রুটি মাফ করবেন)